বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০২২

ছিলিমপুরের ইতিহাস

 ছিলিমপুরের ইতিহাস

মোঃ নূরুল ইসলাম মাস্টার 

( রূপসীযাত্রা গ্রামের প্রবীন ব্যাক্তি এলিহি বকস্, আদম বেপারী/কুরপান সরকার এদের কাছে শোনা)

ছিলিমপুরের আদি নাম ছিল শ্রীরাম পুর। লোক মুখে উচ্চারনের বিভ্রাটে ছিরামপুর ছিলিমপুরে রূপ নিয়েছে। জনৈক প্রবীন ব্যাক্তির মতে প্রথমে শ্রীরামপুর তারপর ছিরামপুর এবং শেষে হয়েছে ছিলিমপুর। 
আদতে ছিলিমপুর এখন যেমন বাজার বা হাটখোলা আগে তা ছিল না। তখন ছিল বন্দর বা কোল- ছিলিমপুর কোল। এখানে সুদূর ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়নগজ্ঞ, আসাম, খুলনা, রাজশাহী প্রভৃতি স্থান হতে জাহাজ, ইষ্টিমার, লঞ্চ, বড় বড় ব্যাবসায়ী নৌকা আসতো। মাল বিকি কিনি করতো যাত্রী সাধারণ নামত আবার বোঝাই হলে চলে যেত। ছিল মস্ত বড় ব্যবসায়ের কেন্দ্র। ইউরোপ মহাদেশের পাট ব্যবসায়ীরা  এখানে পাটের গুদাম খুলেছিলেন। তার একটি আর. সিম কোম্পানীর অফিস ছিল এখানে। আরও একটি অফিসের নাম ও জায়গার কথা শুনা যায়। তা ছিল হাটখোলারই দক্ষিন দিকে খোলা জায়গায়। স্থানীয় লোকেরা আজও এ স্থানটিকে ‘কাইয়্যা’র অফিস বলে। এ অফিসের মালিক ইউরোপের কোন এক পাট কোম্পানীর সাহেব ছিল। 
ছিলিমপুরের যৌবন সময়ে টাংগাইলের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এখানে দোকান/গুদাম খুলে কায় কারবার করতেন। এদের মধ্যে আমি নিজেই দেখেছি কাগমারী, সহবতপুর, দেলদুয়ার, পোড়াবাড়ি, চাড়া বাড়ি, সয়া, এলেঙ্গা ও টাংগাইলের কয়েকটি বড়বড় দোকান। এরা কাপড় চোপড়, লোহা লক্কর, চিনি, ধান, পাট, মিষ্টি, তাঁতের কাপড়, কাঁসা পিতল সহ নানা প্রকার সামগ্রীর ব্যবসা করতেন। আজও যেমন বাজারটি উত্তর দক্ষিনে লম্বা প্রাথমিক অবস্থায় তেমনি উত্তর দক্ষিনেই ছিল। স্থায়ী বড় দোকানগুলি বাজারের পূর্বে এবং পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। সপ্তাহে একদিন হাট বসত এখনকার তম শুক্রবারেই। ছোট খাট অস্থায়ী দোকান গুলি হাটে ঘুন্টিঘর তৈরি করে ব্যবসা করতো। এদেরকে কাছারি ঘর বলা হত। এ সময়ে ছিলিমপুরে সবচেয়ে জৌলুসপূর্ন জমিদারের অফিস ছিল। তারমধ্যে করটিয়ার ছোট তরফ ও বড় তরফের অফিসই প্রধান। তারা দেলদুয়ার, সাওয়ালী মহেরা, ভাটরার জমিদার, ঢাকার নবাব প্রধান। কিন্তু করটিয়াদের অংশ এ হাটে বেশি ছিল এ থেকে প্রচুর আয়ও তাঁরা পেতেন। 
বড় তরফ করটিয়াদের কাছারী অফিস ছিল বাজারের পূর্ব দক্ষিন পাশে। বর্তমান দুই পাকা রাস্তার রাস্তার পশ্চিম পাশে। আমরা ছোট কালে কাছারী অফিসগুলির ঠাট পাট কিছু দেখেছি। প্রতি বছর শুভ ‘পুন্যাহ’ উৎসবের সময় অর্থাৎ নতুন খাজনা কর আদায়ের সময় বিরাট রকমের ধুম ধাম হত। মিষ্টি, দই, চিড়া, পোলাও, মাংস প্রজারা যারা খাজনা দিতে আসত ও নিমন্ত্রিত ব্যাক্তিদেরও খাওয়ান হত। তারপর নাচ- গানও হত। তখনকার আরও একটি উৎসবের কথা শুনা যায়। ওটা ছিল ‘ছিলিমপুরের মেলা’। এ মেলা প্রায় ছয় মাসাধিক কাল স্থায়ী হত। এখানে একটি কালী মন্দিরও ছিল। দূর দূরান্ত থেকে মেলায় লোক আসত। ব্যবসায়ীরা দোকান খুলত, হরেক রকমের যাত্রাগান, পুতুল নাচ, সারকাস, ম্যাজিক শো, নানা প্রকার খেলা ধূলা হত। মেলায় দোকানগুলি সুন্দর করে সাজান হত। এর পরিচালনায় হিন্দু মহাজনেরাই বেশি থাকতো। এ মেলা ছিল টাংগাইলের মধ্যে বিখ্যাত মেলা। নানা স্থান হতে পূন্যার্থীরা মেলা দর্শন ও সদাই করতে আসতেন। একবার এই মেলায় এমনি অগ্নিকান্ড ঘটে যে তা থেকে সামান্য দোকানদার পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। সম্পূর্ন মেলা স্থান আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই থেকে মেলা যে বন্ধ হয়ে গেল আর কখনও মেলা জমত না। আমাদের প্রামের লোকেরা এখনও কালী বাড়ীর চক বা মেলার চক বলে উল্লেখ করে থাকেন। ৪০/৫০ বছর আগেও এখানে কৃষকেরা হাল বাইতে আসলে লাঙ্গলের ফলায় পোড়া কাঠ কয়লা মাটি, চিনা মাটির পুতুল, ভাঙ্গা চোড়া খাপড়া, মারবেল, তামার পয়সা, রূপার টাকা কড়ি, পুতির মালা পাওয়া যেত। বন্যায় মাটি পড়ে স্থানটি অনেক উচু হয়ে গেছে তাই এখন আর চিহ্ন মাত্র অবশিষ্ট নেই।  

(১ম অংশ)



ছিলিমপূরের ইতিহাস (2)

 ছিলিমপূরের ইতিহাস (মোঃ নূরুল ইসলাম মাষ্টারের পান্ডুলিপি থেকে নেওয়া) (২য় অংশ) ছিলিমপুরের ছোট তরফের কাছারি বাড়ি ছোট হলেও এর নায়েব গোমস্তারা...