সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৩

BONGO ROTNO SUMSUL HAQUE

বঙ্গরত্ন শামছুল হক
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও মহান ভাষা আন্দোলনের রূপকার
সম্পাদক মোঃ নূরুল ইসলাম মাষ্টার

রূপসী প্রকাশনী, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, টাঙ্গাইল৷
প্রথম সংস্করণ ২০০৮
প্রচ্ছদ
, অলংকরণকম্পোজ
মোঃ নূর কুতুবুল আলম (পলাশ)
যোগাযোগের ঠিকানাঃ
মোঃ নূরুল ইসলাম মাস্টার
সাং- রূপসীযাত্রা, পোঃ হিঙ্গানগর
থানা ও জেলাঃ টাঙ্গাইল৷
ফোনঃ ০৯২১-৬২৭২৫, মোবাইলঃ ০১৯১২-০৯৮৮৫৫ ৷

উত্‍সর্গ
আমার শিক্ষকতা জীবনের প্রিয় ছাত্র/ছাত্রীদেরকে

লেখকের আরও কিছু গ্রন্থঃ
* টুকটাক  * রূপসী ললনা
প্রকাশের পথেঃ
* আটিয়ার ইতিহাস  * ছোটদের ভাসানী  * হাজী বাড়ির ইতিহাস
* বঙ্গরস  * বরনীয় লোকের স্বরনীয় কথা

প্রকাশকঃ
মোঃ নূর কুতুবল আলম (পলাশ)
রুপসী কম্পিউটার
৬৬ নং পৌর সুপার মার্কেট
পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, টাঙ্গাইল ৷
বাসা নং-২৩, ব্লক- ই,
রোড নং- ১, আকুর টাকুর, মুসলিম পাড়া, টাঙ্গাইল ৷


কিছু বলা প্রয়োজন আমার রাজনৈতিক জীবনের প্রাণ পুরুষ "বঙ্গরত্ন শামসুল হকের৷ জীবিত অবস্থায় আমি তাঁকে বহুবার দেখেছি এবং বহু বক্তৃতা তাঁর শুনেছি৷ যতই দেখেছি এবং বক্তৃতা শুনেছি ততই মহাবিষ্টের মত চমত্‍কৃত হয়েছি এবং মন মন্দিরে আশা পোষণ করেছি পরিণত বয়সে তাঁর সুকমল পদাঙ্ক অনুসরণ করে জীবন ধন্য করব৷ কিন্তু তা আর পারলাম কই ? ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন পুরাতন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্ম তাঁর হাতে৷ তখন এর নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ৷ পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ রাখা হয়৷ মওলানা ভাসানী এর সভাপতি ও শামসুল হক হন তার মহাসচিব ৷

প্রতিবত্‍সর এ দলের জন্ম বার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিপালিত হলেও যিনি দলের জন্মদাতা তার ক্ষেত্রে তেমন কিছুই হয় না৷ আমি দলীয় নেতা কর্মীদের সবিনয়ে অনুরোধ করব এদিনে বেচারা শামসুল হকের জন্য একটা কিছু করা হোক৷ সেই সাথে তার ধুলি মলিন ছবি দলীয় অফিসের একপ্রান্তে টাঙ্গিয়ে রাখা হোক৷ এতে দল এবং নেতৃবর্গের ইজ্জত অনেকাংশে বেড়ে যাবে৷ নিদেন পক্ষে বাংলাদেশে তো বটেই বিদেশেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ বঙ্গরত্ন শামসুল হকের জীবনী পুস্তাকারে প্রকাশ করার ইচ্ছা প্রথমে আমার ছিল না৷ শুধু মূল্যবান জীবনকে জানার একটা খেয়াল ছিল৷ পরে জানতে জানতে বেশ কিছু তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ হয়ে গেল৷ তাই বই প্রকাশের ঝোঁক চাপল৷ শেষে ওগুলো একত্র করে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হই৷

বঙ্গ রত্ন শামসুল হকের জীবনী গ্রন্থটি লিখতে আমাকে অনেক পরিশ্রম ও সময়ের অপচয় করতে হয়েছে৷ কি জানি ঐতিহাসিক চরিত্র বলেই হয়ত এরূপ হয়েছে৷ এটা সর্বজন স্বীকৃত কথা যে - ঐতিহাসিক চরিত্র চিত্রন করতে কাব্য করা যায় না৷ নইলে সেটা ইতিহাস থাকে না, তা হয়ে যায় ইতিহাসের আলোকে ঐতিহাসিক কাব্য গাঁথা৷ বঙ্গঁ রত্ন শামসুল হক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব৷ তিনি রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রামের ভাষা সৈনিক ও রুপকার৷ বাংলা যত দিন আছে বাংলার মানুষ যত দিন থাকবে তার নাম ইতিহাসের পাতায় তত দিন স্বর্নক্ষরে লেখা থাকবে৷ এ মণীষী লাহোর প্রস্তাবের সর্ব কনিষ্ট নেতা, পাকিস্তান বাস্তবায়ন আন্দোলনের অবিস্মরণীয় বীর পুরুষ, আজকের বৃহত্‍ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক, দক্ষিণ টাঙ্গাইল উপ নির্বাচনের বিজয়ী সিপাহশালা, বঙ্গঁ রত্ন শামসুল হক৷ সুতরাং ইতিহাস যেখানে দেদীপ্য মান সেখানে কাব্য করা যায় না৷ তাই এ মহান চরিত্র চিত্রনে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও শঙ্কা নিয়ে আমাকে এগিয়ে যেতে হয়েছে বইটি রচনায়৷ পান্ডু লিপি আমাকে অনেক আগেই লিখতে হয়েছিল৷ আর্থিক টানা পোড়নে ও নানা প্রতিকূলতা হেতু অনেক সময়ের ব্যবধানে অবশেষে বইটি পৃথিবীর আলো বাতাসের মুখ দেখতে সক্ষম হল৷ যুগ স্রষ্টা শামসুল হক গ্রন্থখানি রচনা ও গুরুত্ব দেয়ার পিছনে একটি ছোট ঘটনা আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল বেশি আমি তখন কলেজের ছাত্র৷ শামসুর হকের চাচাত ভাই প্রখ্যাত আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমান বিক্ষুব্দ ধলেশ্বরী নদী হতে নিজের জীবনকে বাজী রেখে গাছ নিয়ে জনৈক পুলিশ কমিশনারকে নৌকা ডুবি অবস্থায় উদ্ধার করে ছিলেন৷ তাঁর এই বিরল বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য পুরস্কৃত করতে ঢাকা ডিভিশনের, ডি, জি, আই, জি ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ও পাঁচ শতাধিক পুলিশ বাহিনী আমাদের ছিলিমপুর বাজারে (টাঙ্গাইল) আগমন করেন৷ সাতদিন আগে সভার আয়োজক জেলা এস, পি স্থানীয় একজন বক্তা খুঁজছিলেন স্বাগত ভাষণের জন্য৷ দূভর্াগ্য ঐ বক্তা খুঁজে না পেয়ে দুঃখ করে বলে ছিলেন যে অনল বষর্ী শামসুল হকের মাটিতে একটি লোকও পেলাম না যাকে দিয়ে অনুষ্ঠিতব্য সভায় দু'কথা বলতে পারি৷ আমি পিছনে এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ বললাম যে আমাকে অনুমুতি দিলে উক্ত সভায় আমি দু'কথা বলতে পারব৷ তখন তিনি আমাকে কাছে ডেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নামধাম লিখে নিয়ে গেলেন৷ তিন দিন পর টাঙ্গাইল থানার পুলিশ আমাকে এস, পি, সাহেবের অনুমতি পত্র দিয়ে গেল৷ নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠানে প্রাণবন্ত ভাষণ দিলাম৷ তাতে মঞ্চে উপস্থিত অতিথি বর্গ আমাকে এক পাশে চেয়ারে বসতে অনুরোধ করলেন৷ আমি শুনতে পেলাম ডি, আই, জি বলছেন নিশ্চয়ই শামসুল হকের নিকট কেউ হবে হয়তো বেশ বলেছেন৷ সে যাই হোক কমান্ডার আব্দুর রহমানকে অসম সহসীকতার পুরস্কার স্বরুপ স্বর্ণ পদ দেয়া হল এবং আমার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে একটা মোটা ভাতা পরিবারস্থ সকলের জন্য ব্যবস্থ করে গেলেন৷ আব্দুর রহমান যত দিন বেঁেচ ছিলেন দেখা হলেই আগে সালাম দিতেন এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেন৷

বাংলার সূর্য সন্তান শামসুল হকের জীবনী জানার জন্য তাদের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছি৷ তার ছোটভাই আলহাজ নূরুল হক (তখন জীবিত), আলহাজ আজমল হক (তখন জিবিত), আলহাজ আনোয়ারুল হক ও তাঁদের বেটা ভাতিজা ও চাচাত জেঠাত ভাই ভাতিজা তারাও আমাকে পরম আদরে অভ্যর্থনা জানাতেন৷ ধৈর্য সহকারে তাদের পূর্বপুরুষ ও বর্তমান প্রজন্মের অনেক অজানা কাহিনী আমাকে শুনাতেন৷ বিশেষকরে তাদের প্রিয় হক সাহেবের কথা শুনিয়ে দারুণভাবে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন৷

হক সাহেবের চাচাতোভাই আবু বকর সিদ্দিকী একজন জ্ঞানী ব্যক্তি৷ ভাল বক্তাও বটে৷ তিনি শামসুল হককে টাঙ্গাইলে স্মরণীয় করে রাখার জন্য অনেক সভা সমিতিতে বক্তব্য রাখতেন৷ আমি তত্ব ও তথ্য প্রাপ্তির জন্য তাঁর কাছে সবিশেষ কৃতজ্ঞ৷ শামসুল হককে জাগরিত রাখার জন্য তিনি তার নতুন বংশধরদের হাতে ঝান্ডা তুলে দিয়েছেন৷ তাঁর নিজের প্রত্যেকটা পুত্র সন্তান তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চাচার আদর্শ জীবিত রাখতে বদ্ধ পরিকর৷ তার চার ছেলে৷ শহীদুল ইসলাম, ডাঃ সাইফুল ইসলাম, রুহুল আমীন ও হুমায়ন কবীর৷ চাচা শামসুল হককে স্বরণীয় করে রাখার জন্য প্রত্যকেই সচেষ্ট৷ কমবেশি লেখা ও র্কীর্তির মাধ্যমে তাঁরা সতর্কপথ বেছে নিয়েছেন৷ এদের মধ্যে হুমায়ন কবীর উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারী এবং আমার হাই স্কুলে শিক্ষাকতা জীবনের গর্বের ছাত্র৷ সে "বাংলার স্বাধীকার আন্দোলন এবং শামসুল হক" নামে একটি প্রামাণ্য বই লিখেছে৷ এ বইয়ের গুরুত্বপর্ণ অনেক তত্ত্ব ও তথ্য আমার বইয়ে স্থান বিশেষে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছি৷ হক সাহেবের আপনজন হিসেবে তার উল্লেখিত বিষয় গুলি আমার নিকট নির্ভর যোগ্য মনে হয়েছে৷ সিদ্দিক সাহেবের আরেক পুত্র রত্ন ডাঃ সাইফুল ইসলাম চিকিত্‍সা জগতে টাঙ্গাইলে অন্যতম প্রধান চিকিত্‍সক৷ চিকিত্‍সা শাস্ত্রে ইতি মধ্যেই উপরের স্তারে পেঁৗছে গেছে৷ স্বীকৃিত হিসেবে স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছে৷ শামসুল হক স্মৃতি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল নামে থানাপাড়া বিসিক রোডে একটা নিজস্ব সুদৃশ্য হাসপাতাল গড়ে দুস্থের সেবায় নিয়োজিত আছে৷ এটা আমার সাবেক স্নেহ ধন্য ছাত্র৷ সে চাচা শামসুল হকের দামী তথ্য চিত্র ও জীবনের নির্ঘন্ট রচনা করে দিয়ে আমাকে গভীর ভাবে ধন্য করেছে৷ লেখাটি বইয়ের শেষাংশে সংযোজন করে দিয়েছি৷ তার আর্থিক আনুকূল্য ও সক্রিয় সাহায্য আমাকে কৃতজ্ঞ করেছে৷ আমার আরেক সাবেক ছাত্র ইউসুফ (সমবায় মার্কেটে ওড়না ঘরের স্বত্বধীকারী) ব্যবসায়ীক ব্যস্ততা থাকা সত্বেও আমাকে সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে৷ তার পিতার নাম ডাক্তার ও ওসমান গনি শামসুল হকের জ্ঞাতি ভাই এবং ইউসুফের বাবা৷ শামসুল হক পরিবারের প্রতিটি মানুষ আমাকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন অকুন্ঠচিত্তে৷ নাম উল্ল্লেখ করতে হয় সিরাজুল হক, সরোয়ার, সামিরুল হক, আলমগীর হোসেন, আমিনুর রহমান, আব্দুল হামিদ, মৌলভী সাইফুল ইসলাম, আব্দুল আওয়াল, কামরুল হক, তাহেরুল হক৷ এদের সহযোগিতা মনে রাখার মত৷ এদের জন্য শ্রেণী মোতাবেক আদর সোহাগ ও প্রশংসা সহ কর্মময় সুদীর্ঘ জীবন কামনা করি৷ 


আমার রাজনৈতিক জীবনের আরেক দীকপাল, রাজনৈতিক পথিকৃত্‍ ও প্রখ্যাত বাম লেখক বদর উদ্দিন উমর৷ তার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি শ্রদ্ধানত চিত্তে ৷ তার লেখা "ভাষা আন্দোলন ও তত্‍কালীন রাজনৈতিক" গ্রন্থ থেকে বিশেষত্ব শামসুল হকের ভাষা আন্দোলন পর্বটি রবি রশি্নর মত পথ দেখিয়েছে আমাকে৷ এ বইয়ের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করে দিয়েছি সহৃদয় পাঠক বর্গের সুবিধার জন্য৷ আরও যাদের লেখা থেকে মাল মসলা সংগ্রহ করেছি তারা হলেন ভাষা সৈনিক শামসুল আলম ঘাটাইল, টাঙ্গাইল ও ২১ ফেব্রয়ারি ঐতিহাসিক ভার্সিটির আমতলার সকালের সমাবেশের সভাপতি৷ যিনি সমাবেশের প্রথম বক্তা হিসেবে শামসুল হকের নাম ঘোষণা করেন, অধ্যাপক আব্দুল গফুর (বিদেশ বিষয়ক সম্পাদক, ইনকিলাব) গাজীউল হক (২১ ফেব্রয়ারি আমতলা, ঢাকা ভার্সিটি, শামসুল হকের বিরোধী বক্তা ছিলেন)৷ স্মৃতিকথা, মোস্তফা কামাল (সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন), বশির আল হেলাল (ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস), মোকছেদ আলী (মওলানা ভাসানী), মাহ্মুদ কামাল (সম্পাদক, টাঙ্গাইল সাধারন পাঠাগার, মুফাখ্খরুল ইসলাম (জালালী কবুতর), মাহ্মুদ হাসান (লন্ডন, আওয়ামী লীগের ভুলে যাওয়া নেতা শামসুল হক), মোহাম্মদ হজরত আলী সিকদার (একটি বিম্ময়কর প্রতিভা শামসুল হক), আবু তাহা (বাংলার বীর সন্তান), শামসুল হক), শহীদুল ইসলাম (ভাষা আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি শামসুল হক), শফিক ইমতিয়াজ (সংগ্রামী শামসুল হক, রাজনীতি ও চিন্তা চেতনা) ডাঃ সাইফুল ইসলাম (যুগ স্রষ্টা শামসুল হক ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক), তপন কুমার দে (কোথায় আছেন টাঙ্গাইলের শামসুল হক) শামসুল হক (বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম), আশরাফ সিদ্দিকী (উপেক্ষিত নায়ক জননেতা শামসুল হক) প্রমুখ৷ এদের মূল্যবান লেখা পড়েছি এবং প্রয়োজনে অংশ বিশেষের সাহায্য নিয়েছি৷ অধ্যাপক আব্দুর রহিমের "টাঙ্গাইলের ইতিহাস" আমার দারুণ উপকারে এসেছে৷ তাঁর কাছেও আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই৷

আরও দু'ব্যাক্তির কথা উল্ল্লেখ করতে হয়৷ তারা হলেন চকতৈল নিবাসী (দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল) তোজাম্মেল হোসেন ফকির৷ তিনি শামসুল হকের আবাল্য বন্ধু এবং রাজনৈতিক সহচর৷ শামসুল হকের আপ্ত-গুপ্ত অনেক কথাই বলতে পারেন৷ অন্যজন বাবুপুরের (দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল) আব্দুল গফুর বেপারী৷ তিনি আওয়ামীলীগের কিছু দলিল দিয়ে সাহায্য করেছেন যা আমার উপকারে এসেছে৷ তিনি শামসুল হকের আর্শিবাদ পুষ্ট এক জন ভক্ত৷ ভিন্ন আঙ্গিকে আমার একটা জবাবদিহিতা আছে৷ তাহলো এই বই খানি "বঙ্গঁ রত্ন" শামসুল হকের জীবনের ধারাবাহিকতাপূর্ণ পূণর্াঙ্গ জীবন চিত্র নয়৷ বলা যেতে পারে ধারাবাহিক খন্ড ছবি মাত্র৷ আপ্রাণ চেষ্টা করেছি শৈশব থেকে জীবনের শেষ পরিনতি পর্যন্ত নিরিবিচ্ছিন্ন যোগ সূত্র সমন্বিত করতে৷ কিন্তু সে রকম কোন নির্ভর যোগ্য চাল চিত্র খুঁজে পাইনি৷ যা পেয়েছি তা তার পারিবারিক সুত্রে ও সম সাময়িক লেখা ও তার সঙ্গী বন্ধুদের কাছ থেকে৷ অতি যত্নে সুসনি্নবেশিত করেছি মাত্র৷ এই জন্য তার জীবনের অনেক মূল্যবান ঘটনা ইতিহাসের অন্তরালে রয়ে গেছে৷ এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য করজোরে ক্ষমা চাচ্ছি এছাড়া আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ঐরূপ প্রার্থনা ছাড়া গত্যন্তর নেই আমার পাঠক বর্গের কাছে৷

"বঙ্গরত্ন" শামসুল হক কত বড় মাপের শক্তিধর নেতা ছিলেন তা তাঁর স্বল্প্ল কালীন রহস্য ও বিস্ময় ভরা রাজনৈতিক জীবনের ঘটনারাজি পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমান করা যায়৷ বিস্মৃতি কল্প মুসলিম লীগকে সাবলীলতায় সঞ্চীবনী সূধা পান করিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া, লাহোর প্রস্তাবের সম্লিলিত অভিযাত্রী দলের যুব নেতা, ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বীরবাহু ও রূপকার আজকের আওয়ামীলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসব কিছুরই চুলচেরা বিশ্লেষন করলে বিস্ময়ে অভিভূত হয়৷ তাঁর রাজনৈতিক দর্শন সর্বব্যাপী কর্মকান্ড দলের অভ্যন্তরে তাঁকে পাশ কাটিয়ে নিরঙ্কুশ স্থান করে নেওয়া বরই দূরুহ ব্যাপার ছিল৷ মোদ্দাকথা সম্ভব ছিল না মোটেই৷ অন্ততঃ সামনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে তাঁকে চেলেন্জ ছুড়ে মারা দুঃসাধ্য ছিল৷ সেজন্যই কুচক্রী মহল পিছন দরজাদিয়ে প্রবেশ করে বন্ধুর ছদ্যাবরনে পৃষ্ঠদেশে ঘাতকের মত ছুরিকাঘাত করেন৷ রাজনৈতিক আকাশ থেকে তো বটে ধরাধাম থেকে করুনভাবে বিদায় করে দিয়েছে৷ দলীয় চক্রান্ত, স্ত্রী আফিয়া খাতুনের উচ্চাভিলাস এবং ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সরকার এজন্য সর্বাংশে দায়ী৷ এই বঙ্গ শার্দুলকে কৌশলে খাঁচায় আটক করে নির্মম নিষ্ঠুরের মত অগি্নদগ্ধ লৌহ শলাকা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তিলে তিলে হত্য করেছে পাষন্ডরা৷ তাঁর জীবন সায়াহ্নের বিয়োগান্ত পরিনতির কথা স্মরণ করলে বুক ফেঁটে কান্না বেরিয়ে আসে৷ চোখে অশ্রু সন্বরন করতে পারি না৷ যে মৃত প্রায় মুসলিম লীগকে অজানা অচেনা আস্তাকুঁড় থেকে টেনে এনে বাংলার ঘরে ঘরে পরিচয় করিয়ে দিলেন পরে স্বাধীনতা আনতে সক্ষম হল৷ ক্ষমতার উচ্চ শিখরে আরোহন করেই তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে মুসলিম লীগ থেকে নির্মম ভাবে বহিস্কার করা হল৷ নিজ হাতে গড়া দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ হতে কারা প্রকোষ্ঠের সুযোগে খোঁড়া যুক্তির অজুহাতে মুষ্ঠাঘাতে সরিয়ে দেওয়া হল৷ এর পরও কি একটা মানুষ স্থির থাকতে পারে ? পরিনতি যা হবার তাই হল৷ কারা অন্তরালে নিঃসহায় অবস্থায় শোকে দুঃখে অভিমানে মস্তিঙ্ক বিকৃতি দেখা দিল৷ তাঁর স্বাস্থ্য গেল দারুণ ভেঙ্গে৷ তদুপরি শোনা যায় শারীরিক অত্যাচার বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগে মস্তিঙ্কের ভিতরে আরও দাবানল দেখা দিল৷ সরকার অবস্থা বেগতিক দেখে বাংলার বাঘ্র সাবককে মষিক শাবকে পরিনত করে মুক্তি দিল৷ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জীবনী শক্তিহীন মানুষটি উল্কার মত বাংলার শহর-বন্দর-নগরে-জনপদে পাগল বেশে ছুটে বেড়াতে লাগলেন৷ মুখে জল্পনা নতুন দল গঠন করে বাংলার ভাগ্যাকাশ থেকে শকুনি গৃধিনীদের বিতাড়িত করবেন৷ কিন্তু সে সুযোগ কি পেয়েছিল ভাগ্যাহত "বঙ্গ রত্ন" শামসুল হক ?

জোগারচরে জীবনের শেষ একটি বছর প্রবাহমান যমুনাতীরে বসে ত্রিকালত্ত ঋষীর মত ধ্যানস্থ থাকতেন আর ভাটি উজানী নৌকা দেখলেই চিত্‍কার করে বলতেনঃ এই মাঝি নৌকা ভিড়াও, আমি শামসুল হক বলছি৷ কিন্তু কে শোনে তাঁর কথা ? তাঁর জীবন তরী ভাটির টানে ডুবন্ত প্রায়৷ শেষে রোগে ভুগে অনাহারে ক্লিষ্ট হয়ে বিনা চিকিত্‍সায় মৃতু্যর হীম শিতল কোলে ঢলে পড়েন "বঙ্গ রত্ন" শামসুল হক, কিন্তু কেন???

কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার জন্য আমার আরও একজন ছোট ভাইয়ের কথা উল্লেখ করতে হয়৷ সে টাঙ্গাইল পৌর সভার সুপ্রিয় সচিব ঈসমাইল হোসেন সেলিম৷ তার কাছ থেকে বাংলার অগি্ন পুরুষ শামসুল হকের স্বহস্তে লেখা দুটি চিঠি নিজ ব্যবহারের লোহার সিন্দুকের ফটোর জন্য৷ দুটো চিঠি ও সিন্দুকটি তার কাছে স্বযত্নে রক্ষিত আছে ৷


পূর্বাভাষ
বঙ্গ রত্ন শামসুল হক একটা নাম একটি ইতিহাস৷ রূপকথার গল্লের মতই সামান্য কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহন করে স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অপতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে আবিভর্ূত হন৷ শৈশবে যেমনি ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন সুদর্শন চেহারার বালক৷ তাঁর প্রতিভাদীপ্ত মুখ দেখলে প্রাণ খুলে আদর ও দোয়া করতে ইচ্ছে করত৷ খরশ্রোতা নদীর মত তর্ তর্ করে একর পর এক ক্লাশ ডিঙ্গিয়ে যেতেন আর উদীয়মান সূর্যের মত দিগন্ত বিস্তারি রাজনীতির নতুন কথা শুনাতেন ছাত্র সমাজের মধ্যে৷ নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীণ সময়েই শামসুল হক রাজনৈতিক দৃশ্যপটে প্রথম পদার্পন করেন এবং কলেজের প্রথম বর্ষেই এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ সে সময়ের বহুল প্রচারিত দৈনিক আজাদ, সৈনিক, নও বেলাল সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকা পাঠ করে চলমান রাজনীতির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে সাম্যক উপলব্ধি করতে পেরে ছিলেন৷ তাইত তত্‍কালীনল যুব সমাজ ও ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে তাঁর প্রভাব অপ্রতিরোধ্য ছিল৷ এ প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে যুব মুসলিম লীগ গঠন করে নিজেই হন এর একছত্র নেতা৷ পরে পরিণত বয়সে মুসলিমলীগের পাল্টা রাজনৈতিক আওয়ামী লীগ সংগঠন দাঁড় করান এবং সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন৷ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সভাপতি ও ১ নং এবং ২ নং সহ-সম্পাদক যথাক্রমে শেখ মুজিবর রহমান ও মোস্তাক আহাম্মেদ ভূষিত হন৷ সা'দত বিশ্ব বিদ্যালয় কলেজে যখন তিনি অধ্যয়ন করেন তখন এ কলেজে ছাত্রদের দাবী দাওয়া আদায়ের জন্য কোন ছাত্র সংসদ ছিল না৷ কতর্ৃপক্ষের নিকট দাবী পেশ এবং সমান্তরাল ভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ আদায় করেন৷ সাধারণ ছাত্র তাঁকে পুরষ্কার স্বরূপ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভি, পি, নিযুক্ত করেন৷ এজন্য কলেজ প্রতিষ্ঠাতার উত্তরসূরী প্রভাবশালী জমিদার খুররম খান পন্নী তাঁকে কলেজ থেকে বহিস্কারের উদ্যোগ নেন এবং সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে এ অশুভ পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকেন৷ এর চরম পরিণতিতে ১৯৪৯ সালের দক্ষিণ টাংগাইলের উপনির্বাচনে খুররম খান পন্নীকে বিপুল ভোটের ব্যাবধানে পরাজিত করে প্রাদেশিক পরিষদের সংসদ সদস্য নিযুক্ত হন৷ এতে দেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসাবে তার নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে৷ পাকিস্তান সরকার এতে শামসুল হকের কাল হয়ে দাঁড়ায়৷ যেহেতু মুসলিম লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হয়েছেন তাই তাঁকে কোনমতেই বরদাস্ত করা যায় না৷ এজন্য খোঁড়া ওজুহাত খুঁজতে শুরু করে৷ এ আসনের নির্বাচিত প্রদেশিক সদস্য ছিলেন মওলানা ভাসানী৷ তাঁকেও মিথ্যা ওজুহাতে তাঁর সদস্য পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল৷ কৌশলে সামসুল হকের সদস্য পদও কেড়ে নেওয়া হল৷ তাঁর অপরাধ নির্বাচনী হাতির খোরাক অর্থ কোথায় পেলেন৷ সেই পুরানো কৌশলে শামসুল হকের সদস্য পদও বাতিল ঘোষিত হল৷ তাঁর অপরাধ নির্বাচনী হাতির খোরক অর্থ পেল কোথায়৷ দ্বিতীয়তঃ শামসুল হকের পক্ষে মওলানা ভাসানীর প্রচারপত্র মিথ্যা সুতরাং মুসলিম লীগ সরকার তাঁকেও অপরাধী করে৷ পরে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে জেলে নিক্ষেপ করল৷ এ মহূর্তে শামসুল হক দ্বিমূখী ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন৷ সরকার জেলে তাঁর উপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালাল৷ এ নির্মমতা এমন পর্যায়ে এসে গেল যে তাঁর মস্তিস্ক বিকৃতি দেখা দিল৷ এক পর্যায়ে বিকৃতি নিয়ে জেল হাজত হতে মুক্তি পেলেন৷ জেল হাজতের বাইরে এসে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ভয়ংকর মূর্তি দেখলেন৷ এক দিকে পরিবারের বিধ্বস্ত সংহার মূর্তি, অপরদিকে দলীয় ষড়যন্ত্র৷ এহেন প্রলয়ংকরী মূর্তি পর্যবেক্ষন করে মস্তিস্ক বিকৃতিতে ঘৃতাহুতি হল৷ পূর্ণ উন্মাদ হয়ে পড়লেন৷ তাঁকে শান্ত্বনা দেবার কেউ নেই৷ চিকিত্‍সার জন্য কেউ এগিয়ে এলেন না৷ উম্মাদের আচরণ করে মিটিং এর নামে চাঁদা উঠাতে লাগলেন আর ঝড়ের মত সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন৷ স্ত্রী আফিয়া হক সাহেবকে ডিভোর্স করল৷ মেয়ে দুটিকে তাঁর দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে গেল৷ সেই সঙ্গে মরার উপর খাড়ার ঘা নেমে এল৷ কাউন্সিল অধিবেশনে তাঁকে সরিয়ে শেখ মুজিবকে সম্পাদক নিযুক্ত করা হল৷ মওলানা ভাসানী সভাপতি রয়েই গেলেন৷ বড়ই পরিতাপের বিষয় এত বড় মাপের নিঃস্বার্থ নেতার শেষ জীবন কোথায় কিভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল কেউ তার খোঁজ নিল না৷
বাল্য ও শিক্ষা জীবনঃ শামসুল হক সোনার চামিচ মুখে নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেননি৷ বাংলার সামান্য কৃষক পরিবারে তাঁর জম্ম৷ টাংগাইল সদর হতে দশ মাইল দক্ষিণে পাছ এলাসিনের শাকইজোড়া একটি গ্রাম৷ এলাসিন ভাষানী কলেজের পশ্চিম পাশেই গ্রামটি অবস্থিত৷ উল্লেখ্য টাঙ্গাইল জেলাধীন দেলদুয়ার উপজেলার অন্তর্গত শাকইজোড়া৷ এখানে ভোরের সি্নগ্ধ আলো বাতাসে সোমবার সুবেহ্ সাদেকের হাসি ফোঁটার সময় মা শরিফুন্নেছার কোল আলোকিত করে শামসুল হক জন্ম গ্রহণ করেন৷ নানাভাই খন্দকার নছর উদ্দিন চৌধুরী মনের আনন্দে আযান ফুঁকে বসলেন৷ সে যুগে মুসলমানদের ঘরে ছেলে সন্তান জন্ম নিলে আযান দিতে হত৷ তাই নানাভাই তাঁর নাতি ভাইয়ের শুভাগমন বার্তা ঘোষণা করে দিলেন৷ তিনি আরবি, ফার্সি ভাল জানতেন৷ তাবত্‍ গ্রামের মানুষ নবজাতক শিশুদের নাম রাখার জন্য তাকে অনুরোধ করতেন৷ তিনি আরবি, ফার্সি কিতাব ঘেটে তাদের শিশুদের নামের অর্থ ভাল দেখে নাম রেখে দিতেন৷ তাতেই খুশি হয়ে চলে যেতেন তারা৷ কিন্তু নিজের স্নেহধন্য কন্যা শরিফুন্নেছার ছেলে অর্থাত্‍ তার নাতি ভাইয়ের কি নাম রাখা যায় তা নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন৷ ভোরের বেলা জন্ম নিল নাতি৷ নব সূর্য দিগন্ত উদ্ভাসিত করে ফুটে উঠেছে আকাশে৷ তাই নাম পেয়ে গেলেন৷ ব্যস ! নাম রাখলেন শামসুল হক-আর্থাত্‍ আল্লাহর সূর্য৷ শামস্ অর্থ সূর্য আর হক আল্লাহ নিজেই৷ তাই স্নেহধন্য নাতির নাম হল শামসুল হক আল্লাহর সূর্য৷ ভোর বেলায় সূর্যের বাস্তবতা আর শামসুল হক নামের স্বার্থকতা তিনি তাঁর অর্ধ সমাপ্ত রাজনৈতিক জীবনে স্বার্থক প্রমাণ করে গেছেন৷

জনাব শামসুল হকের পিতার নাম দবির উদ্দিন সরকার৷ নিজ গ্রাম সহ এলাকায় তাঁকে দয়ের উদ্দিন পঞ্চায়েত নামে বেশি চিনতেন৷ মাইঠাইন-টেউরিয়া দেলদুয়ার উপজেলার সানমধন্য একটি গ্রাম৷ এ গ্রামটি পাশের আর দশ-বিশটি গ্রামের মধ্যে বেশ উন্নত ছিল৷ ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা শান্ত শিষ্ট আদর্শ গ্রামের প্রতীক ছিল এটা৷ শিক্ষিত, অশিক্ষিত, হিন্দু, মুসলমান স্ব স্ব ধর্ম ও পেশায় বেশ সুখে শান্তিতেই বসবাস করতেন৷ হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, অধিকারী, কর, মুচি, চাড়াল, ঢুলি, জেলে, কৈবর্ত ইত্যাদি৷ মুসলমানদের মধ্যে বর্ণভেদ ছিলনা৷ তবে পীর, ফকির, দেওয়ান, দরবেশ, মুন্সি, মওলানা, বাস করতেন এখানে৷ পীর-ফকিরদের মধ্যে মরহুম সাদেক বা সাধু ফকিরের নাম উল্লেখযোগ্য৷ তার বংশধরেরা আজও বার্ষিক ওরস বা মেলা অনুষ্ঠান করে থাকেন৷ মুন্সি মওলানারা ওয়াজ মাহ্ফিলের আয়োজন করতেন৷ তবে এদের মধ্যে তেমন কোন ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না৷ অনুষ্ঠানাদিতে সবাই সবাইকে দাওয়াত ও আদর আপ্যায়ণ করতেন৷ মাঝে মধ্যে হিন্দু ভদ্রলোকদের বাড়িতে পুজা পার্বণ উপলক্ষ্যে মেলা বসত৷ অবস্থা সম্পন্ন হিন্দুরা সাধু সন্যাসীদের ভোজের ব্যবস্থা করে সবাইকে খাওয়াতেন৷ মুসলমানরাও বাদ পড়তেন না এতে৷ এখন হিন্দু এলাকা বিরানভূমি৷ ধনীরা ভারতে পাড়ি জমিয়েছে৷ গরিব কিছু নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা বাপ দাদার ভিটে মাটি কামড়ে পড়ে আছে আজও৷

পারিবারিক ঐতিহ্য ঃ শামসুল হকের পরিবার ছিল কৃষকদের আদর্শ৷ দেশীয় ও উন্নত পদ্ধতিতে কৃষি শষ্যের এমন কোন চাষ নেই যে তারা জানতেন না৷ শুধু তাই নয় তারা তা আবাদ করে আদর্শ স্থাপন করেছেন৷ তারা সারা বছর নানাবিধ কৃষি পণ্য আবাদ করতেন৷ বুনার আগে পঁচা গোবর, পঁচা সবুজ সার, খৈল, ছাই এমনকি গোয়াল ঘরের আশে পাশের মাটি পর্যন্ত ক্ষেতে ব্যবহার করতেন৷ চাষ করতেন উত্তম করে৷ পরিচর্যা করতেন নিয়ম মাফিক৷ কাজেই অন্যের চেয়ে অনেক বেশি ফসল উত্‍পাদন করতেন৷ সামসুল হকের পিতা দবির উদ্দিন ছিলেন মস্ত বড় কৃষিবিদ৷ কোন চকে কি শষ্য বুনবেন তা গাঁয়ের আর পাঁচজন জানতে আসত তাঁর কাছে এবং তিনি যথাযথ বুঝিয়ে দিতেন তাদের৷ তাতে তারা শষ্য পেতেন বেশি৷ দবির উদ্দিন সাব বাড়ির আশে পাশের পালান ক্ষেতে রীতিমত শাক সবজির আবাদ করতেন৷ বাড়ির ঘরের মরসুমি শাক সবজি যেমনঃ লাউ, জিঙ্গে, পটল, শসা, বাঙ্গি, বরবটি, চিচিঙ্গা, উচ্ছে, কচু, শশা, আলু, কুমড়া, মুলা, গাঁজর, কলা, পান, সুপারি, বেগুন, পেঁপে, আম, কাঁঠাল, পেঁয়ারা, লিচু, জাম, জামবুরা, ডালিম, জোয়াইর সহ যাবতীয় শাক সবজি, ফল-মূল উত্‍পাদন করতেন৷ ধান-পাট, মুগ-মুসুর, ছোলা, মটর, খেশারী, মাশকলাই, তিল, তিশি, ধনে, মিঠা সজ, কালি জিরা, কাউন, বুরা আবাদ করতেন দবির উদ্দিন সাব৷ আমার ছোট চাচা বলতেনঃ দবির উদ্দিন সাব এক লবণ এবং কেরোসিন তেল ছাড়া আর সবই উত্‍পাদন করতেন৷ বছরের বারো মাসই পাগার পুকুরে মাছ আবাদ করতেন৷ বর্ষার দিনে ধলেশ্বরীতে ইলিশ মাছ ধরার ধুম পড়ে যেত৷ কামলা মুজুর নিয়ে ঘটা করে নদীতে মাছ ধরতে যেতেন বিকালে৷ সকালে বিশ-পঞ্চাশটা ইয়া বড় ইলিশ মাছ ধরে আনতেন৷ নিজেরাও খেতেন-পাড়া পড়শিদেরও বিলাতেন৷ দোয়াইর, জাল, জালি, ধর্মজাল, ঝাঁকিজাল, বড়শি, জুতি, কোজ, পলো, টেটা, চিতল মাছ ধরার ফাটক প্রভৃতির অন্ত ছিল না৷ তাঁর বাড়ির গরু বাছুরগুলো ছবির মত তরতাজা ছিল৷ যত্ন আত্তির কোন অভাব ছিল না৷ শামসুল হকের বাবা এগুলো করতেন এবং অন্যকে এগুলো করতে উদ্ভুদ্ধ করতেন৷ শামসুল হক তার বাপ দাদার পেশাকে কখনও হেয় মনে করতেন না বরং শ্রদ্ধা জানিয়ে সময় পেলেই বাবাকে সাহায্য করতেন৷ এসব করতে করতে তিনিও এক সময় কৃষি বিশেষজ্ঞ বনে গিয়েছিলেন৷ তিনি নিজে একজন কৃষকের সন্তান হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন৷ হাটে বাজারে কৃষি পণ্য বিক্রি করার জন্য সময় পেলেই এগিয়ে আসতেন৷ তার বাবার আরও একটি গুন ছিল, মুখে মুখে ছড়া ও নীতি বাক্য রচনা করে অন্যকে শোনাতেন৷ আমার ছোট চাচা দবির উদ্দিনের বন্ধু ছিলেন৷ প্রায়ই দেখতাম চাচার সঙ্গে গল্প করতেন আমাদের বাড়িতে৷ শেষে অনুরোধ করলে স্বরচিত মারফতি গান, ছড়া ও নীতিবাক্য শোনাতেন৷ তিনি নাকি বেশ কতকগুলি পান্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন৷ তাঁর আশা ছিল এসব ছাপিয়ে বিনামূল্যে বিতরণ করবেন৷ তাঁর সে আশা কোনদিন পূরণ হয়নি আর খোঁজাখুজি করেও পরে হদিস মেলেনি৷ এভাবে হারিয়ে যায় সব৷ দবির উদ্দিন ন্যায় নীতির মানুষ ছিলেন৷ যেটা অন্যায় বলে জানতেন তাতে তাঁকে কেউ হাঁ বলাতে পারেনি৷ শেষে আন্দোলন করে প্রতিষ্ঠিত করে ছেড়েছেন৷ পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্ট ধনীর পক্ষে গরীবের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে দিলেন৷ তিনি এই মামলাকে আদালতে পেশ করে গরীবকে জিতিয়ে এনে ছিলেন৷ এমন কথাও শোনা যায় মাইঠাইনের বাইরের গাঁয়ের লোকেরাও মাতাব্বরিতে ডাকতেন তাঁকে৷

শামসুল হকের মা ছিলেন আর এক দয়ালু মায়ার প্রতিমূর্তিরূপে গুণে গাঁয়ের সেরা মহিলা৷ এমন গুণবর্তী লাখে একটা মিলে৷ ছেলের বন্ধু-বান্ধদেরকে তিনি আপন ছেলের মত মনে করতেন৷ একটা আদর্শ মা কি করে হতে হয় সে গুণ তাঁর পুরোপুরি ছিল৷ তিনি পিতৃগৃহে পিতার স্নেহে গৃহ শিক্ষকের নিকট বাংলা, অংক, ইতিহাস শিক্ষা করেন৷ মস্জিদের ইমাম সাহেবের তত্বাবধানে কোরআন হাদিস নীতিজ্ঞান ভালোই রপ্ত করেছিলেন৷ শামসুল হকের নানাবুজি মেয়েকে সংসারের সকল কাজকর্ম নিজ হাতে শিখিয়ে ছিলেন৷ তার হাতের রান্না জীবনে যে একবার খেয়েছে সে কোনদিন ভুলতে পারেনি৷ একজন রাজনীতিবিদের বাড়ীতে অহরহ লোকজন আত্মীয়স্বজন কি রকম আসতে পারে তা আমরা অবশ্যই জানি৷ এত লোকের খানাপিনা আদর আপ্যায়ণ কেউ কম পেয়েছেন বলে জানা নেই৷ আগেই বলেছি শামসুল হকের বন্ধুদের তিনি ছেলের মত মনে করতেন৷ স্কুলে কিংবা ভার্সিটিতে হোস্টেলে থাকাকালীন সময়ে মাঝে মধ্যে বাড়ী এলে তার মা হোস্টেলের ছেলেদের জন্যে মোয়ামুড়ি, পিঠা, পায়েস ও অন্যান্য উপাদেয় খাবার তৈরি করে ছেলের কাছে পাঠিয়ে দিতেন৷ যদি তারা তাঁর বাড়ি আসতেন তবে তো খানাপিনা আদর কদরের ধুম পড়ে যেত৷ বাড়ির গাছের ফল-মূল খেতের ধানের ভাত, পুকুরের মাছ, গাইয়ের খাঁটি দুধ তাদের খাইয়ে নেশা ধরিয়ে দিতেন৷ তারা মনে করতেন তাদের মাও এত কিছু পারবে না৷ নানাজান নিজের নাম অনুসারে মেয়ের নাম রেখেছিলেন শরিফুন্নেছা ভদ্র মেয়ে৷ মুছলমানদের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে বাপের নাম অনুসারে মেয়ের নাম, আর মায়ের নাম অনুসারে ছেলের নাম রাখেন৷ তাই নানা জান নিজের নামের মিলে মেয়ের নাম আর মেয়ের নামের আলোকে তার ছেলে অর্থাত্‍ শামসুল হকের নাম রেখেছিলেন৷ মেয়েরা যদি বাপের চেহারার মত হয় আর ছেলেরা যদি মায়ের মত হয় তবে তারা নাকি খুব ভাগ্যবতী বা ভাগ্যবান হয়৷ শরিফুন নেছা নিজ বাড়ির বৌ ঝিকে তো বটেই পাড়া প্রতিবেশীদের খোঁজ নিতেও ভুল করতেন না৷ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন৷ ফকির মিসকিনদের কত যে আদর কদর করে ভাল খাবার খাওয়াতেন তা তাদের দোয়া খায়েরে বুঝা যেত৷

এত সব সদ্গুণ যে সন্তানের বাপ মার সে সন্তান বিখ্যাত না হয়েই পারে না৷ শামসুল হক হয়েছিলেনও তাই৷ তিনি যাতে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেন সে জন্য তো মুন্সি মওলানা ছিল দবির উদ্দিনের বাড়িতে৷ নিজের জীবনের শিক্ষালব্ধ ধর্মীয় জ্ঞান যত্ন করে ছেলেকে শিখাতেন৷ শিশু শামসুল হক গ্রোগ্রাসে তাবত্‍ শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের অফুরন্ত দোয়া খায়ের লাভ করতেন৷ তাই তিনি ধর্মীয় জ্ঞানে এতটুকু বুত্‍পত্তি লাভ করেছিলেন যে তাঁর রচিত "বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম" তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ৷ তিনি গ্রন্থটি ষোল অধ্যায়ে বিভক্ত করে ইসলামের বিন্যাস বিন্যস্ত করেছেন৷ পাঠকের অজান্তে কঠিনতম প্রশ্ন উপস্থাপন করে উত্তর সরলীকরণ করেছেন৷ যা পড়ে পাঠক গভীর জ্ঞান লাভ করতে পারেন৷ তিনি তাঁর অমূল্য গ্রন্থখানিতে ইসলামকে বুঝার জন্য অন্য ধর্মেরও উপমা দিয়েছেন৷ ইসলামের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন সংস্কৃত শব্দ 'ধর্ম' বোধ প্রায় আরবি দ্বীন শব্দের সম অর্থবোধক৷ সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন চিত্তে দ্বীন পালন করার নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফে দ্বীনকে আল্লাহর ফিতর বা প্রকৃতি বলে বর্ণনা করেছেন৷ প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ ছিলেন শামসুল হকের কলেজ শিক্ষক৷ তিনিও 'ইসলামের মর্ম কথা' প্রবন্ধে অনুরূপ মতবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন ইসলাম হল ফিতরতের ধর্ম৷ গুরু শিষ্যের একই মত ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও অর্থ এক ও অভিন্ন৷ দুজনই ইসলামকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে পাঠককে দ্বন্দ্বমুক্ত করেছেন সাচ্ছন্দে৷
লেখক শামসুল হক ইসলামের উত্‍স অধ্যায়ে ইসলামকে একটি শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন৷ তিনি বলেনঃ ইসলাম দর্শন শাস্ত্র সম্বন্ধীয় গবেষণা বা ধ্যান ধারনা নয়, এ হচ্ছে মানব ও মানব জীবনের একটি পূর্ণ ও বাস্তব বিজ্ঞান৷ কুরআনে বর্ণিত দ্বীন বা ধর্ম সব বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান এবং সমগ্র বিশ্ব তা নিয়ন্ত্রণ করে৷ ইসলামের উত্‍সকে এত সরল ও সহজভাবে ব্যক্ত করে অতিবড় ধর্মজ্ঞানী লেখকও লিখতে পারেননি৷

ইসলামের শিক্ষা ও জ্ঞান সমদ্ধে শামসুল হক আরও সুন্দর কথা বলেছেন৷ তিনি এক্ষেত্রে বলেছেনঃ ইসলামের পাঠ ও ব্যাখ্যা পদ্ধতি এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি অন্ধ গলি থেকে টেনে বের করে আনতে হবে৷ মুসলিম জাতির অধপতন, অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস প্রসূত ব্যক্তিগত গতানুগতিকতা পরিবর্তন করতে হবে৷ এতে বুঝা যায় অন্ধ ধর্মীয় শিক্ষায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না৷ বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী যেভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটতে বদ্ধকর তাতে তিনি তাদেরকে পরিহার করতে বলেছেন৷ ইসলামকে তিনি চোরাগলিতে বিচার করতে নিষেধ করেছেন৷ তিনি বলেনঃ ইসলামকে যুক্তি, তর্ক, বিচার, বুদ্ধি প্রয়োগ, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে৷ তিনি কুরআনের পাঁচটি একার্থ বোধক বাক্যের অবতারনা করে ইসলামকে বুঝতে অনুরোধ করেছেন৷ আল্লাহ সম্পর্কে তার ধারণা বিজ্ঞান সম্মত৷ তিনি বলেনঃ ইসলামে আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা সম্পূর্ন বৈজ্ঞানিক ও যুক্তি ভিত্তিক৷ ইসলাম বৈজ্ঞানিক সত্যের সাথে কোনরূপ বিরোধ সৃষ্টি করে না৷ 'একে তিন বা তিনে এক' এরূপ অবাস্তব বা অসম্ভব উক্তি ইসলামে নেই৷ বিরোধিতা না করে সমগ্র সংঘাত-সংঘর্ষ, ঘাত প্রতিঘাত ও বিপরীতমুখী দ্বন্দ্বের ভিতর সমন্বয় সাধন করা ইসলামের বৈশিষ্ট৷ মার্কসবাদ, লেলিনবাদ, মাওবাদ সম্পর্কে তার ধারনা স্বচ্ছ৷ তিনি বলেনঃ জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক৷

উপরের কথাগুলে শামসুল হকের 'বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম'থেকে নেয়া৷ কুরআন, হাদিস, ফেকা, কেয়াস, ইজতেহাদ সহ ইসলামে সবগুলো জটিল বিষয়ে গভীর জ্ঞান না থাকলে ঐ মূল্যবান কথা তার বইয়ে লিখতে পারতেন না৷ ওগুলো ইসলামের গূঢ় কথা৷ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা সহ ধর্মীয় বিধানগুলো একজন খাঁটি ঈমানদার মুসলমানের মত নিষ্ঠার সাথে প্রতিপালন করতেন তিনি৷ যেহেতু ধর্মীয় মাহফিলে তাঁকে ওয়াজ নছিয়ত করতে হতো, তাই ধর্মকে পুরোপুরি ও সুন্দর ভাবে জানতে ও বুঝতে হবে এবং নিজ জীবনে তা প্রতিফলিত করতে হবে৷ সত্য বলতে কি এর ব্যতিক্রম হয়নি সবটাই বাস্তবায়িত হয়েছিল তাঁর জীবন সংগ্রামে৷

শামসুল হকের মাতৃবংশ এবং পিতৃবংশ রুচিশীল আধুনিক ও ইসলামের আলোকে পরিচালিত ছিল৷ ছেলে মেয়ে প্রত্যেককে অন্য শিক্ষার আগেই ইসলামি শিক্ষাবোধ জন্মাতে উত্‍সাহী করতেন৷ তাদের ধারনা ছিল যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা তাই এ শিক্ষা তাদের ছেলে মেয়েদের বাল্যেই দিয়ে দেয়া উচিত৷ বাস্তবে করতেনও তাই৷ কুরআন হাদিস শিক্ষার পাশাপাশি শিশু পাঠ সমাপ্ত করাতেন৷ পিতা দবির উদ্দিন শামসুল হকের প্রাথমিক শিক্ষার বুনিয়াদ এত শক্ত ভীতে রূপ দিয়েছিলেন যে, যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হন নাই৷ শুধু তাই নয় প্রতিটি প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি প্রাপ্ত হতেন৷

শামসুল হক স্থানীয় টেউরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন৷ তিনি প্রতিটি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করতেন৷ তার মেধা শক্তি এত প্রখর ছিল যে কোন পড়া একবার পড়লে বা শুনলে মনে রাখতে পারতেন৷ এ বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী হতে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন৷ তখন তৃতীয় শ্রেণী হতে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়া যেত এবং এতে শামসুল হক বৃত্তি পরিক্ষায় শুধু বৃত্তিই পেতেন না মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন৷ এতটুকু ছেলের চমত্‍কার ফলাফল দেখে শিক্ষা কর্মকর্তা তাঁকে কিছু মূল্যবান বই উপহার দিয়ে দোয়া করেছিলেন৷ শামসুল হক বর্তমান দেলদুয়ার থানার এলাসিন পুরান বাজারে অবস্থিত ডন মাষ্টারের মাইনর স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন৷ তখন এ মাইনর স্কুল হাই স্কুলের চেয়ে সবদিক দিয়ে উন্নত ছিল৷ ডন মাস্টার ডন কুস্তি মুগুর ভাজতেন এবং ছেলেদেরকে শিক্ষা দিতেন৷ তাই তার আসল নামের চেয়ে ঐ নামেই পরিচিত ছিলেন বেশি৷ শামছুলহক সাহেবের ছোট ভাই মরহুম নূরুল হক সাহেবের কাছে কিছু প্রামাণ্য কাগজ পাওয়া গিয়েছিল৷ তা থেকে যা জানা যায় তার ছক নিচে তুরে ধরা হল৷

শিক্ষক তালিকাঃ টেউরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাগরপুর, টাঙ্গাইল৷

কাজী আব্দুস ছালামঃ প্রধান শিক্ষক ছিলেন৷ সাকিনঃ চকতৈল৷ থানাঃ নাগরপুর, বর্তমান উপজেলাঃ দেলদুয়ার, জেলাঃ টাঙ্গাইল৷ তিনি বহুদিন গ্রাম্য পঞ্চায়েত প্রধান প্রেসিডেন্ট ছিলেন৷ তাঁর মুতু্যর পর ছেলেরা ও এলাকাবাসী তাঁর নামে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ কাজী আব্দুস ছালাম হাই স্কুল, চকতৈল, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল৷

লাল বিহারী অধিকারীঃ শামসুল হক সাহেবের গ্রামেরই ব্যক্তি ছিলেন তিনি৷ তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক জগতের একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব৷ গান, নাটক, যাত্রাগান ছিল তার নেশা৷ কলকাতার প্রখ্যাত নাট্যশিল্পী শিশির ভাদুরীর সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক৷ কলকাতায় বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি৷

কোরবান আলী মুন্সিঃ শোনা যায় তিনি ব্রাহ্মণখোলার অধিবাসী৷ তিনি ছিলেন খুব সত্‍ ও নিষ্ঠাবান ধর্ম পরায়ণ৷ শামসুল হককে ধর্মীয় শিক্ষায় অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি৷

আব্দুল মজিদঃ আদিবাস ছিল সিরাজগঞ্জের শনকলসির চরে৷ পরে নদী ভাঙ্গনে দেউলী এসে বসতি স্থাপন করেন৷ তিনি সুন্দর ছবি আঁকতে পারতেন৷ কলকাতার বিখ্যাত চিত্র শিল্পী শরত্‍ গোস্বামী তাঁর প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেন৷ শরত্‍ বাবুর বাড়ি দেউলী গোসাই বাড়ি ছিল৷

শামসুল হক চতুর্থ শ্রেণী হতে পর্যন্ত ডন মাষ্টারের স্বর্ণময়ী মাইনর স্কুলে লেখা-পড়া করেছেন৷ এক কালের এলাসিন বিখ্যাত পাট কোম্পানির মালিক নওজেশ আলী ছিলেন তার মামা৷ এ বাড়িতে থেকেই তিনি মাইনর স্কুলে পড়তেন৷ হিন্দু প্রভাবশালী জনৈক ব্যাক্তির ছেলের সাথে তাঁর লেখা পড়ার প্রতিযোগিতা ছিল৷ শামসুল হক প্রতিযোগিতায় প্রথম হতেন৷ ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে এসে এক দারুণ বিপর্যয় ঘটল৷ এ শ্রেণী হতে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়া যেত৷ যে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হত সেই এ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারত৷ এবার শামসুল হক প্রথম হবে এবং সেই-ই বৃত্তি পরীক্ষা দিবে৷ বিধি বাম৷ সে হল না৷ কিছু সংখ্যক শিক্ষকের ষড়যন্ত্রের শিকার ছিলেন তিনি৷ প্রধান শিক্ষকও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারলেন না৷ ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা গেল শামসুল হক প্রথম হতে পারেন নি৷ বরাবর যে ছেলেটি দ্বিতীয় হত সে হয়েছে প্রথম৷ সামান্য কিছু নন্বরের ব্যবধানে তাকে দ্বিতীয় করা হয়েছে৷ শামসুল হক চ্যালেন্জ করেন৷ রি-একজামিন হোক খাতা৷ কথাটা তাঁর অভিভাবক পর্যায়ে গড়াল৷ তারা প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় কতর্ৃপক্ষের স্মরণাপন্ন হলেও ফল ততৈবচ৷ প্রতিভার অমর্যাদা দেখে চলে এসে উপায় খুঁজতে থাকেন৷ অনতিবিলম্বে উপায় এসেও গেল৷ তার ভগি্নপতি বেলতা নিবাসী শিকিম বেপারী৷ তাঁর নিকট আত্মীয় মরহুম তয়েজ উদ্দিন দবির উদ্দিন সাহেবের বাড়ি এলে ছেলের দুঃখজনক ব্যপারটি সবিস্তারের ব্যক্ত করলেন৷ তিনি কাল বিলম্ব না করে শামসুল হককে তার এলাকার পোড়াবাড়ি কাবিলাপাড়া রাম বাবুর মাইনর স্কুলে ভর্তি করে দিলেন৷ তিনি রত্ন চিনতেন৷ তিনি অতি সত্ত্বর ছেলেকে নিয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিলেন৷ দেখা গেল শামসুল হক শুধু বৃত্তিই পান নাই মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন৷ এ স্কুলের তত্‍কালীন একমাত্র মুসলিম শিক্ষক বৈরাম উদ্দিন খান (বেরাম মাষ্টার) ছেলের অপূর্ব মেধা দেখে তার নিজ বাড়িতে কাবিলাপাড়া লজিং নিয়ে নিলেন৷ তিনি পুত্রবত্‍ শামসুল হককে লেখাপড়া করাতেন৷ এখানে দু'বছর লেখাপড়া করার পর কৃতিত্বের সাথে ১৯৩৬ সালে ৮ম শ্রেণী পাশ করে সন্তোষ জাহ্নবী হাইস্কুলেনবম শ্রেণীতে ভর্তি হলেন৷

তাজউদ্দিন সাহেব উচ্চ শিক্ষিত ও সরকারী চাকুরে ছিলেন৷ তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য র্কীর্তি টাঙ্গাইলের দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা৷ পাশেই মস্জিদ এবং দক্ষিনে লাগালাগি তাঁর গোরস্থান বিদ্যমান আছে৷

বৈরাম সাহেব প্রগতিমনা ও গঠনমূলক চিন্তার মানুষ ছিলেন৷ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলেন তিনি৷ সন্তোষ এবং কাগমারীতে যতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার পিছনে বৈরাম মাষ্টারের অবদান অনস্বীকার্য৷ তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল কাগমারী সরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠার সংশ্লিষ্টতা৷ তিনি দিন রাত কঠোর পরিশ্রম দিয়ে মওলানা ভাসানীকে সাহায্য করেছেন৷ তাই মওলানা ভাসানী তাকে আজীবন কলেজ গর্ভনিং বোড়ির সদস্য করে রেখে যান৷
শামসুল হকের জীবনে এলাসিন ডন মাষ্টারের মাইনর স্কুল এবং রাম বাবুর মাইনর স্কুলের দুটি ঘটনা প্রণিধান যোগ্য৷ প্রতি বত্‍সর স্কুলে সরস্বতী পূজা খুব ধুম-ধাম করে হিন্দু ছেলেরা করত৷ কিন্তু মুসলিম ছাত্রদের মিলাদ হত না বা হতে দিত না৷ এ বিষয়টি বালক সামসুল হকের কাছে ভাল লাগল না৷ তাই কিছু সংখ্যক মুসলিম ছাত্রদের সাথে নিয়ে সব শিক্ষকদের উপস্থিতে তিনি মিলাদ করার অনুমতি চাইলে সাথে সাথে তা নাকচ করে দেন প্রধান শিক্ষক৷ জেদী বালক দমবার পাত্র নন৷ তিনি সাধারণ ছাত্র শিক্ষকদের স্মরণাপন্ন হলেন৷ ছাত্রদের মধ্যে ভালোই সাড়া পাওয়া গেল এবং শিক্ষকদের মধ্যে কালী কুমার দত্তের বিশেষ সহানুভুতি দেখা গেল৷ এলাকাবাসী মুসলিম সমপ্রদায়ের আনুকুল্য পাওয়া গেল৷ শেষ পর্যন্ত জাঁক জমক সহকারে মিলাদ অনুষ্ঠিত হল৷ সে থেকে প্রতি বছর এ স্কুলে মিলাদ চালু হয়ে আসছে৷

বালক শামসুল হকের জীবনে যে গুণটি ধীরে ধীরে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছিল সন্তোষ জাহ্নাবী হাইস্কুলে তা পত্র-পুষ্প, ডাল-পালা নিয়ে নব যৌবনে দৃপ্ত পদক্ষেপে পথ চলতে লাগল, সাহসী ও বলিষ্ঠ হল৷ যার রক্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বীজ নিহিত তা যে কোন অন্যায় দেখলেই রক্ত টগবগিয়ে ফুটতে থাকে৷ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হিন্দু মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে ঘৃণ্য সামপ্রদায়িক বিষ বাষ্প ধুমায়িত হয়েছিল৷ মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গে বিমাতা সুলভ আচরণ করা হত৷ শ্রেণীতে বসা, ইন্দারা কূপের পানি পান, ভাতা বৃত্তি প্রদান এসব ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব ছিল৷ অল্পদিনের মধ্যে শামসুল হক তা বুঝতে পারলেন৷ মুসলমান ছাত্রদের হিন্দু ছাত্রদের পিছনে বসতে হত৷ সামনের বেঞ্চে বসার অধিকার ছিল না৷ অসপৃস্য অসূচি মনে করা হত৷ এর পৃষ্ঠপোষক ছিল স্থানীয় সন্তোষের জমিদার৷ প্রতি বছসর হিন্দু মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দেয়া হত৷ মুসলমান ছাত্রদের সে যত প্রতিভাবান ছাত্রই হোক না কেন তাকে কোন বৃত্তি দেয়া হত না৷ ইন্দারা কূপে পানি পান এটাও ছিল মুসলিম ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ৷ তাঁদের দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হত৷ হিন্দু ছাত্ররা পানি পান করার পর মুসলিম ছাত্রদেরকে পান করার সুযোগ দেয়া হত৷ তাও আবার হিন্দু দপ্তরি বা চাকর দ্বারা৷

কাবিলাপাড়া মাইনর স্কুলে জহুর ওয়াক্তে মাত্র আধা ঘন্টা নামায পড়ার বিরতি দেয়া হত৷ বালক শামসুল হক মুসলিম ছাত্রদের সহায়তায় একঘন্টা সময় নামাযের জন্য আদায় করেন৷ স্কুলের পাশেই একটি নামায গৃহ ছিল৷ অবহেলায় অযত্নে এর অবস্থা চরমে পেঁৗছেছিল৷ ভাঙ্গা বেড়া, মেঝে কাঁচা তাতে নামাজের জন্য মাদুর ছিল না৷ শামসুল হক মুসলিম ছাত্র ও এলাকার মুসলমানদের কাছে এর অবস্থা উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন৷ এতে দারুণ সারা পাওয়া গেল৷ নামাযের ঘরের বেড়া সংস্কার ও মেঝে পাকা করে মাদুরের ব্যবস্থা করা হল৷ এতে মুসলমান ছাএ ও স্থানীয় মুসলিম জন সাধারণ শামসুল হকের এ ধরনের কাজের অত্যন্ত প্রশংসা করল৷



বালক শামসুল হক সব ভেদ বৈষম্য বুঝতে পারলেন৷ তিনি সমাধানের পথ খুঁজতে থাকেন৷ মুসলিম ছাত্রদের আগে সংগঠিত করলেন৷ প্রতি বছর স্কুলের ক্যাপ্টেন নির্বাচন হোত৷ নিয়ম ছিল ৯ম শ্রেণীর সেরা ছাত্র স্কুল নির্বাচিত হতে হবে৷ শ্রেণী হিসেবে গুরুত্ব বহনকারী আর উপরের শ্রেণী৷ তদপুরি বড় ভাইয়ের মত ৯ম শ্রেণীর ছাত্র যারা৷ কিন্তু শামসুল হক এ নিয়মের ব্যতয় ঘটালেন৷ তিনি ৮ম শ্রেণী হতেই পুরো স্কুলের ছাত্র কতর্া হতে চাইলেন৷ তিনি তাতে প্রার্থী হয়ে দাঁড়ালেন৷ তাঁর বক্তৃতার কৌশল ও সাহসী মনোভাব দেখে সকলেই শামসুল হককেই তাদের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত করলেন৷ এতে হিন্দু ছাত্রদের একাংশ অন্য প্রার্থী দাঁড় করালেও শামসুল হকের কাছে হেরে গেল৷ ছাত্রদের নেতৃত্ব পেলেন৷ এরপর ছাত্রদের সব দাবী ও অভিযোগ আদায় করে ছাত্রদের প্রাণ প্রিয় নেতা সাজলেন৷ এবার সব ছাত্রদের মধ্যে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য৷ তিনি ছাত্রদের যা বলেন সত্য বলেন এবং তাই নির্বাক্য তারা মেনে নেয়৷ এবার তিনি প্রথমে শ্রেণী কক্ষে মুসলমানদের যে আগে আসবে সেই সামনে বসতে পারবে ঘোষণা দিয়ে বসলে, তাই হল৷ এতে প্রধান শিক্ষক প্রমাদ গুণলেন৷ তিনি সমস্ত ছাত্রকে একত্র ডেকে মিটিং করে সিদ্ধান্ত দিলেনঃ যে প্রথমে শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করবে সেই প্রথম বেঞ্চ বসতে পারবে, চাই সে হিন্দুই হোক বা মুসলমান হোক৷ এরপর ধরলেন পানি পান করার বৈষম্য৷ তিনি কিছু মুসলিম ছাত্রনেতাকে ডেকে ইন্দারা কুপে ভিড় করতে বললেন৷ তারা তাই করলে হিন্দু ছাত্রদের সাথে মুসলমান ছাত্রদের বচসা বাঁধলো৷ তারা প্রধান শিক্ষকের স্মরণাপন্ন হলে তিনি সমভাবে পানি পানের ব্যবস্থা করে দিলেন৷ এবার হাত দিলেন আসল জায়গায়৷ বৃত্তির ব্যাপারে৷ তিনি মুসলমান ছাত্র যদি প্রতিভা প্রদর্শন করতে পারে তবে তাঁকেও বৃত্তি দিতে হবে৷ হিন্দু মুসলিম সবাই একবাক্যে রায় দিলে তিনি ব্যপারটি লিখিত আকারে প্রধান শিক্ষকের নিকট পেশ করলেন৷ প্রধান শিক্ষক জমিদারের স্মরণাপন্ন হলেন৷ জমিদার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে তাকে স্কুল থেকে বহিস্কারের আদেশ দিলেন৷ কথাটি কার্যকরী করার আগেই সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে রাষ্ট্র হলে তারা হরতালের ঘোষনা দিল৷ শামসুল হক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগলেন৷ জমিদার ও প্রধান শিক্ষক যত কঠোর পদক্ষেপ নেন সাধারণ ছাত্ররা ততই বেশি উগ্র হতে থাকে৷ শামসুল হকের নেতৃত্বে ছাত্ররা অর্নর্িষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জনের হুমকি দিলে প্রধান শিক্ষক এবং জমিদার প্রবররা শামসুল হকের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিলেন এবং মুসলমান ছাত্ররাও বৃত্তি পাবে যদি তারা মেধাবী হয়ঃ বলে ঘোষণা করলেন৷ আন্দোলন থেমে গেল৷ শামসুল হক শান্তিপূর্ণভাবে সবাইকে শ্রেণী কক্ষে ফিরে যেতে বললে সবাই সুবোধ ছেলের মত শান্তিতে ক্লাশ করতে চলে গেল এবং লেখাপড়া করতে লাগল৷ আরও একটি ঘটনার কথা শুনেছি৷ এক ছাত্র স্কুলে আসার পথে জনৈক কৃষকের ক্ষেতের আঁখ ভেঙ্গে খেয়েছিল৷ কৃষক তাকে দারুন ভাবে পিটিয়েছিল৷ কথাটা স্কুলে ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ দেখা দিল৷ শামসুল হক পরামর্শ করে জানিয়ে দিলেন টিফিনের সময় ছাত্ররা সব আঁখ ভেঁেঙ্গ খাবে৷ কাজেও হল তাই৷ পরে কৃষক স্কুলে এসে নালিশ করল৷ সহকারী শিক্ষক নিয়োগী বাবু শামসুল হককে অভয় দিয়ে বলেন গোপসে, চুপ থাক৷ আমি সব দেখব৷ ক্ষেত ওয়ালাকে গোপসে ডেকে বললেনঃ ভাল চাস তো ভেগে যা৷ নইলে পিটিয়ে চাম তুলে নেবে জমিদার৷ তার স্কুলের ছাত্র মেরেছিস৷ একথা শুনে কৃষক পড়িমরি করে সেই যে স্কুর ছেড়ে চলে গেল আর কোনদিন স্কুল মুখো হয়নি৷

সন্তোষ জাহ্নবী হাই স্কুলে দারুণ ঘটা করে বার্ষিক সরস্বতী পূঁজো হয়৷ জমিদার সমপ্রদায় প্রকাশ্যে আর্থিক অনুদান ও মদদের মধ্যে দিয়ে পুঁজোর দিন স্কুল জুড়ে সাঁজ সাঁজ রব পড়ে যায়৷ মিঠাই, মন্ডা, দই, চিড়া, পায়েস পঁূজোর নৈবেদ্য দেদারছে বিরতরণ করা হয়৷ কিন্তু মুসলিম ছাত্রদের মিলাদ হয় না৷ এটার উদ্দ্যোগও কেউ নেয় না৷ সাহসও করত না৷ শামসুল হক এ ব্যপারে পাকা প্লেয়ার৷ এলাসিন মাইনর স্কুলের চাল এখানে চেলে শক্ত করে ধরলেন মওলানা শিক্ষককে৷ স্কুল চত্তরে সভা করে সাব্যস্থ হল যে, স্কুলের মুসলিম ছাত্ররাও এবার বার্ষিক মিলাদ মাহ্ফিল করবে৷ প্রস্তাব প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলে প্রথম মাথা চুলকালেন এবং জমিদারের আদেশ পাওয়ার জন্য আপেক্ষা করতে বলে আপাতত পরিত্রাণ পেলেন৷ কিন্তু জমিদারের পক্ষ থেকে সাড়া শব্দ নেই৷ শামসুল হক মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে চাঁদা আদায় করে যাবতীয় ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে ফেললেন৷ আদেশ পাওয়া গেল৷ কিন্তু সীমিত আকারের হতে হবে জমিদারের নির্দেশ৷ শামসুল হক হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিলেন৷ তিনি ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে, জমিদারের অনুমতি পাওয়া গেছে৷ কাজেই এক সপ্তাহের মধ্যে ঘটা করে মিলাদ হবে৷ হলও তা-ই৷ ঘটা করে পোড়াবাড়ীর চমচম, কাগমারীর দই, দাইন্যার চিড়া সহযোগে ভূড়ি ভোজের ব্যবস্থা হল মহা ধুমধাম৷ সব শেষ হলে সবাই শামসুল হকের বুদ্ধিমত্তা ও নেতৃত্ব দানের জন্য বাহবা দিলেন৷ সেই দিন হতে সন্তোষ জাহ্নবী হাই স্কুলে বার্ষিক মিলাদ চালু হল৷

এখন হতে শামসুল হককে এক বাক্যে সবাই চেনে এবং প্রয়োজনে তার স্মরণাপন্ন হন৷ ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাঁকে প্রতিনিধিত্ব করতে হয়৷ পূঁজা-পার্বণ, জমিদার বাড়ির উত্‍সবাদিতে তার ডাক পড়ে৷ জমিদাররা শামসূল হককে শনির পূঁজা দিত৷ নইলে কখন কি করে বসে বিধাতাই জানে৷ সে ক্ষুদে বিপ্লবী নেতা৷ তাই ওকে না ক্ষ্যাপানোই ভাল৷ শামসুল হক এসব কাজে নিজে অংশ নিতেন এবং অন্যকে সাথী করতেন৷ তিনি যে কোন কাজে ছাত্রদের ডাকলে প্রতিটি ছাত্র এসে সমবেত হত৷ এ সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গেঁ৷ হিন্দু মুসলিম সব ধরনের নেতারা টাঙ্গাইল এলেই সন্তোষের ছাত্রনেতা শামসুল হকের আহবান আসত৷ তিনি অভিজ্ঞ প্রবীণ নেতাদের মত বক্তৃতা করতেন৷ অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে৷ নির্দেশ এলো ঃ ব্রিটিশের তৈরি বস্ত্র পরিহার কর৷ চরকায় সুতা কাট৷ তিনি এ আন্দোলন বেগবান করার জন্য প্রতিদিন কোন না কোন এলাকায় ছুটে বেড়াতেন৷ পত্র পত্রিকায় তার নাম ছাপা হত৷ যে সমস্ত পত্রিকা প্রকাশিত হত তা যে করেই হোক তার পড়া চাই৷ আযাদ, সৈনিক, নওবেলাল, মাসিক মোহাম্মাদী, যুগান্তর, বসুমতি প্রভৃতি পত্রিকা নিয়মিত পড়তেন৷ এতে দেখা গেল তিনি একজন চলমান খুদে রাজনীতিবিদ বনে গেছেন৷ অনেকে তাঁকে ক্ষুদে গান্ধী বনে অতি কথনে অভিহিত করত৷ এতসব করেও কিন্তু পড়ালেখায় আবহেলা করতেন না৷ যেখানেই যেতেন ফিরে এসে বিদ্যালয়ের পড়া তৈরি করতেন, পরে অন্য কাজ৷ স্কুলের পড়া শেষ করে ইতিহাস, ধর্মীয় কিতাব অথবা গবেষণাধর্মী যে কোন বই পড়তেন৷ পড়তে পড়তে কখন যে ভোর হয়ে গেছে টেরও পাননি৷ টের পেয়েছেন ভোরের আযান আর মন্দিরের ঘন্টায়৷ নামাযকে তিনি কোন কামাই দেন নি৷ ধর্মজ্ঞান তার এত বেড়ে গিয়েছিল যে, ইসলামের জটিল বিষয়গুলো ফয়সালা করে ফেলতেন৷
১৯৩৮ সালে শামসুল হক অসাধারণ মেধা প্রদর্শন করে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন৷ এখন যেমন শতকরা ৮০ পেলে গোল্ডেন 'এ'+ ধরা হয়, ঐ রকম মেধা প্রদর্শণ করলেন৷ শামসুল হক প্রথম বর্ষে আই-এ ভর্তি হলেন করটিয়া সা'দত কলেজে৷ তখনও করটিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি৷ এ সময় কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ইব্রাহিম খান সাহেব৷ অনেকে তাঁকে মেধাবী ছাত্র বলে বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়ার জন্য বলেছিলেন৷ কিন্তু তিনি তা করলেন না৷ তাঁর ইচ্ছা ছিল জাতির খেদমত করা৷ বড় রাজনীতিবিদ হওয়া৷ জাতির সামান্যতম উপকার যাতে হয় তার জন্য তাকে সাধারণ বিভাগে পড়তে হবে৷ ইতিহাস জানতে হবে৷ পরাধীন জাতির উদ্ধারের পথ খুঁজতে হবে৷ তাই বিজ্ঞান বাদ দিয়ে ভবিষ্যতে ইতিহাস পড়ার মানসে আই, এ, ভর্তি হলেন৷ আগেই বলা হয়েছে এ কলেজের গুণধর প্রিন্সিপাল ছিলেন ইব্রাহিম খাঁন৷ তিনি প্রথম দর্শনেই ভবিষ্যত সম্ভাবনাময় তরুন ছাত্রকে চিনে ফেলেছেন৷ তিনি ছাত্র সমস্যার প্রতিটি কাজে প্রিয় ছাত্রটিকে ডাকেন৷ তাঁর বিজ্ঞেচিত পরামর্শই যেন বাস্তবে ফলও পান প্রচুর৷ লেখক হিসেবেও তিনি দক্ষ৷ তাঁর আদরের ছাত্রটির মধ্যে লেখার সপৃহা দেখতে পেলেন৷ তাই তার দেয়াল পত্রিকা বাতায়নে তার জ্ঞানগর্ভ লেখা স্থান দেন৷ তবে ছাত্রটি ইসলাম ও ইতিহাস বিষয়ক ছোট লেখা লিখে থাকেন বেশি৷ ছাত্র এবং শিক্ষক তার লেখা পড়ে চমত্‍কৃত হন৷ প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷

ষাটের দশকে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ একবার তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রিয় কলেজে করটিয়াতে বিশেষ এক অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে আগমন করেন৷ তিনি তাঁর কলেজ জীবনের অনেক স্মৃতিই সবিস্তারে বয়ান করেন৷ তারমধ্যে প্রাণপ্রিয় ছাত্রনেতা শামসুল হকের কথা গুরুত্ব ও বেদনাক্লিষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেন৷ বলেনঃ আমি কলেজের বিশেষ কাজে কলকাতা গিয়েছি৷ হ্যারিসন রোড দিয়ে রাইটার্স বিল্ডিং যাচ্ছি৷ সামনে বেশ দূরে এক বিরাট গণ মিছিল আসছে৷ রাস্তার যাবতীয় যানবাহন মানুষজন মূহূর্তে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে৷ আমি রাস্তার এক পাশে দাঁড়ালাম৷ মিছিল একদম কাছে এসে গেছে৷ হঠাত্‍ সামনের নেতাদের মাঝখান থেকে এক সুদর্শন নেতা ছুটে এসে আমার পায়ে ছালাম ঠুকল৷ দেখা দেখি আরও কয়েকজন৷ মিছিল থেমে গেছে৷ রাস্তা জ্যাম হয়ে গেছে৷ সবাই উত্‍সুক কি হয়েছে৷ সালাম নেওয়ার পর আমি নিরুত্তর৷ নিজে থেকেই সে তরুন নেতা বলে উঠলঃ স্যার আমি শামসুল হক৷ গড়ের মাঠে মিটিংএ যাচ্ছি৷ এই ঠিকানায় দয়া করে পড়ে আসবেন কিন্তু৷ আমি আনন্দে এক রকম কোঁদেই ফেললাম আর কি৷ শামসুল হক বললেন ঃ আসবেন কিন্তু স্যার, রাস্তা ব্লক হয়ে গেছে৷ পুলিশের হুইসেল কানে সামান্যই শুনতে পাচ্ছি৷ মিছিল চলে যাওয়ার পর উত্‍সুক জনতার চাপ আমি কে ? নেতা সামসুল হক এই ভদ্রলোকেকে সালাম করল, নিশ্চয় কামেল পীর৷ মাথায় জিন্না ক্যাপ, শেরোয়ানী, জামা চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা৷ আমি সাংবাদিক এবং সাধারণ পাবলিকের উত্‍সুক্য থেকে এই বলে নিস্কিৃতি পেলাম যে, সে আমার কলেজের সাবেক ছাত্রনেতা৷ আমি শিক্ষক প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ৷ আমার কলেজের নাম সা'দত কলেজ, করটিয়া৷ সবাই এ বলে পথ ছেড়ে দিল যে, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁন সৌভাগ্যবান৷ একজন নেতা জন্ম দিয়েছেন বটে৷ অগি্নপুরষ৷ ধন্য জীবন৷

অনিয়ম আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আজীবন তাঁর জীবন খাতার কর্মসূচী ছিল৷ যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই লেখাপড়া করেছেন যেখানেই অস্বাভাবিকতা আর অনিয়ম দেখেছেন সেখানেই প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আবিরাম আন্দোলন করেছেন৷ পরিশেষে নিজে সফল হয়েছেন ও দশজনের মঙ্গল করেছেন৷

এ সময় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ডামাডোল বেজে গেছে৷ এ প্রেক্ষিতে কংগ্রেস গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীকার আন্দোলন আরম্ভ করে দিয়েছে৷ হিন্দু মুসলিম যৌথভাবেই এ আন্দোলনকে বেগবান করছেন৷ ক্ষেত্র বিশেষ হিন্দু কংগ্রেস নেতারা মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুদের অগ্রধিকার দিতে থাকলেও তাকে তুচ্ছ মনে করে আন্দোলন বেগবান করে চললেন শামসুল হক৷ শুধু কংগ্রেস নেতৃবর্গই তাঁর কাছে বার্তা পাঠাতেন তা নয়৷ মুসলমান নেতৃবৃন্দও তাঁর কাছে যুব সমাজকে সংগঠিত করার আহবান জানাতেন৷ শামসুল হক সমস্ত আহবানই অতি গোপনে এলাকার সর্ব স্তরের মানুষের কাছে প্রচার করে বেড়াতেন৷ ব্রিটিশের কাপড় বর্জন, হাতে সূতা দিয়ে খদ্দেরের কাপড় তৈরি করে পরিধান তা তার কাছে দারুন ব্যপার ছিল৷ তিনি এলাকায় এ আন্দোলনকে সাংঘাতিক জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন৷

তারপর ১৯৩৯ সালে জার্মানীর হিটলারের আগ্রাসী যুদ্ধে ব্রিটিশ, আমেরিকা, ফ্রান্স তো রীতিমত ঘাবড়িয়ে গেল৷ হিটলার এদেরকে থোড়াই কেয়ার করে রাশিয়া এবং ফ্রান্সের সীমানায় হানা দিয়ে বসল৷ ব্রিটিশের উপনিবেশ গুলো হিটলারের দখলে চলে যায়৷ জাপান পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমমূখী অভিযান চালিয়ে একেবারে ভারতের আসামের রাজধানী ইমফল পর্যন্ত এসে হাজির হল৷ সিঙ্গাপূরের কাছে জাপানীরা ব্রিটিশের টাইটানিক জাহাজ টর্পেডো নিক্ষেপ করে ডুবিয়ে দিল৷ এদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য টলটলয়মান৷ তারা ভারতীয়দের কাছে সাহায্য চাইলে ভারতীয়রা স্বাধীকার চাইল৷ এ শর্তে রাজি হয়ে বৃটিশ তার শক্তি বৃদ্ধি করল৷ তারপর ১৯৪৫ সালে যুদ্ধে থেমে গেল৷ কলেজ পাড় হয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে পা রেখে বৃহত্তর রাজনীতির চাকা ঘুরাতে লাগলেন শামসুল হক৷ যুব লীগের সম্পাদক, ছাত্রদের একছত্র নেতা শামসুল হক সভা সমিতি মিটিং মিছিল আন্দোলন তার নেতৃত্বে চলছে তো চলছেই৷ ভারতের বড় বড় নেতাদের আহবান তার কাছে অবিরাম আসেতে লাগলো৷ ভারত স্বাধীন হবে, তাকে আন্দোলন বেগবান করতে হবে৷ রাতদিন দৌড়ধাপ লেগেই আছে৷ স্বাধীনতার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, ভার্সিটির পড়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল৷ বি.এ আনার্স পাশ করার পর এম. এ পরীক্ষা দেই দেই করেও দেয়া হল না৷ মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি চাই৷ তার যুব মুসলিম লীগকে সুগঠিত করে ১৯৪৯ সালে জন্ম দিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ৷ তিনি জানতেন ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমুল্লার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ গঠিত হয়৷ মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ্ ১৯১৩ সালে শর্ত সাপেক্ষে মুসলিম লীগে যোগ দেন৷ তার শর্ত ছিল কংগ্রেসেরও নেতা থাকবেন৷ সেই সাথে সমান্তরাল ভাবে মুসলিম লীগের কাজও করবেন৷ সত্য কথা বলতে কি বিগত ৩৪ বছরে এ সংগঠনই ছিল বান্ঝা৷ এর নব জাগরণ শুরু হয় ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চের লাহোর অধিবেশনের মধ্যে দিয়ে৷ অধিবেশন ছিল মুসলিম লীগের ২৩ তম অধিবেশন৷ সভাপতিত্ত্ব করেন মিঃ মহম্মদ আলী জিন্নাহ্৷ আর এ, কে, ফজলুল হক ছিলেন ঐতিহাসিক প্রস্তাবের প্রস্তাবক৷ তরুণ নেতা শামসুল হক ঢাকা ভর্সিটির একচ্ছত্র ছাত্রনেতা৷ তিনি ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধী হিসাবে লাহোর অধিবেশনে যোগ দেন৷ তিনি অধিবেশনে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির জন্য জোরালো বক্তব্য রাখেন৷ লাহোর প্রস্তাবে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সমগ্র বাংলাদেশ সহ যে অঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই প্রদেশ সমূহে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়৷ প্রকৃত পক্ষে আঞ্চলিক স্বাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার ও সার্বভৌমত্ব অর্জনই ছিল লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য৷ সংবিধানে এসব রাষ্ট্র সমূহে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষার বিধান রাখার পক্ষেও মত প্রকাশ করা হয়৷ অবশ্য ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল মুসলিম লীগ দলীয় আইন সভার সদস্যদের এক কনভেনশনে লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করা হয়৷ এ প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি মাত্র স্বাধীন সার্বভৈম রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়৷ নেহেরু এ প্রস্তাবের নিন্দা করে বলেন-যে, এটা অবাস্তব৷ শামসুল হক এ প্রস্তাবে বিশ্বাসী ছিলেন না৷ দ্বি-জাতি তত্বে মিঃ জিন্নাহ্ বলেন যে হিন্দু মুসলিম পৃথক জাত৷ সুতরাং ভারতে দুটি রাষ্ট্রই বাঞ্ছনীয়৷ তাই পাকিস্তান প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাবেক পূর্ব বাংলার ধনিক বণিক ভূস্বামীরা এগিয়ে আসেন৷ এদের মধ্যে পূর্বাঞ্চলে আগ্রভাগে চলে আসেন দেলদুয়ারের এ, কে, গজনবী, ধনবাড়ীর নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, স্যার আব্দুর রহিম, ঢাকার নবাব পরিবার প্রমূখ৷ এরা অধিকাংশই ছিলেন কলকাতা ভিত্তিক সেন্ট্রাল জাতীয় মুসলিম সংঘের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ তারা কখনও বাংলার মুসলমানদের একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসাবে গ্রহণ করেন নি৷ এ সময় উদীয়মান তরুণ নেতা শামসুল হক বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে দিগন্তজোড়া রবি রশ্মি নিয়ে উদ্ভাসিত৷ মুসলিম লীগের ভবিষ্যত্‍ সম্ভাবনাময় যুব নেতাদের অগ্রভাগে দ্রুত হতে দ্রুততর আবস্থান নিচ্ছেন৷ এর মধ্যেই শামসুল হক, সোহওয়াদর্ী, এ, কে, ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বিপ্লবী সুবাস বোস, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, আবুল হাশিম, মওলানা আজাদ নোমানী, আসামের গোপী নাথ বর্দোলই, সা্যর আব্দুল্লাহ প্রমূখ প্রখ্যাত রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসেন৷ এ সময় হোসেন শহীদ সোহওয়ার্দীর ছোট ভগি্নপতি আবুল হাশিম ছিলেন প্রদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক৷ তিনি শামসুল হকের ক্ষুরধার যুক্তিপূর্ণ অথচ তেজোদীপ্ত বক্তৃতায় প্রথম থেকেই চমত্‍কৃত ছিলেন৷ তিনি চিন্তা করলেন এই তরুণ নেতার মত কিছু তেজোদীপ্ত নেতা অথচ জমিদারের বাইরের নেতা যদি দলে সম্পৃক্ত করা যায় তবে জাতীয় স্বার্থ উদ্ধার সহজতর হবে৷ যেমন চিন্তা তেমনি কাজ৷ তিনি প্রতিটি দলীয় ও রাজনৈতিক সভা-সমিতি, মিটিং মিছিলে সঙ্গে রাখতেন শামসুল হককে৷ ভাবী নেতা শামসুল হক আবুল হাশিমের মিটিং মিছিল ছাড়াও একে ফজলুল হক, সোহওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর বড় ধরনের সভা বা মিটিং মিছিলের অগ্রভাগে অবস্থান নিতেন৷ এরাও তাঁর বক্তৃতায় মোহিত হয়ে পুরোভাগে ঠেলে দিলেন৷ শামসুল হকের সাংগঠনিক শক্তি ছিল অসাধারণ ও বাস্তব ভিত্তিক৷ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ সময় গোটা ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে৷ হিটলার তার পাশর্্ববর্তী ক্ষুদ্র বৃহত্‍ সব দেশ একের পর এক জয় করে চলল৷ ইটালীর মুসোলিনীও একই পথ অনুসরণ করে অগ্রসর হল৷ জাপান পশ্চিম দিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে আসামের দ্বার প্রান্তে অবস্থান নিল৷ ভারতকে গ্রাস করার জন্য পক্ষ বিস্তার করে দিয়েছে৷ ব্রিটিশ সরকার দিগবিদিক দিশেহারা৷ তাঁর মিত্ররা আমেরিকার স্মরণাপন্ন হল৷ সে জাপানের নাগাশাখি ও হিরোসীমায় পরপর দুটো আনবিক বোমা নিক্ষেপ করে আড়াই কোটি লোক সহ গোটা দুটো শহর নিশ্চিহ্ন করে দিল৷ জাপান মেছমার হয়ে কম শক্তিশালী হল৷ তাদের পরদেশ বিজয়ের নেশা কেটে গেল৷ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মিত্র শক্তি জার্মানির ও ইটালির স্বৈর শাসকদের সমূলে উচ্ছেদ করে জার্মানিকে চারভাগে ভাগ করে নিয়ে নিল৷ ব্রিটিশ যুদ্ধে সাহায্য করলে ভারতকে স্বাধীনতা দেবে৷ যুদ্ধ শেষে এ ওয়াদায় টালবাহানা শুরু করে দিল৷ যুদ্ধোত্তর রাশিয়া মার্কসবাদ, লেলিনবাদ, চীনে মাওবাদের রঙ্গিন বাতাস প্রবল বেগে বইতে শুরু করেছে৷ সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সমপ্রসারণবাদ, রাজতন্ত্র টলটলায়মান৷ সর্বত্রই রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান৷ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রেসারেসিতে স্থানে স্থানে দাঙ্গা৷ ভারতের সব কটি বড় শহরে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় রক্ত শ্রোত বয়ে চলেছে৷ এ বাংলার নোয়াখালি, মির্জাপুর, চামারিফতেপুর, ঢাকা প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে৷ স্থান বিশেষে ছিটে ফোঁটা দাঙ্গা হচ্ছে৷ শামসুল হক নিজ এলাকায় সেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে সামপ্রীদায়িক সমপ্রতির ভুমিকা বজায় রেখে চলেছেন৷ অন্যত্র সমপ্রীতি সামান্য ক্ষতি হলেও শামসুল হকের টাঙ্গাইলে এর অশুভ ছায়া পড়েনি৷ এর পিছনে তাঁর অবদান ছিল অনন্য৷

এদিকে ফজলুল হকের সঙ্গে মিঃ জিন্নাহর মত পার্থক্য নগ্ন ভাবে দেখা দিল৷ আগেই মিঃ জিন্নাহ্ ব্রিটিশের যুদ্ধ নীতি সমর্থন না করার জন্য জানিয়েছিলেন৷ কংগ্রেস সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল৷ পরিস্থিতি নিজের পক্ষে নেওয়ার জন্য মিঃ জিন্নাহ্ হঠাত্‍ই পাকিস্তান দিবসের ডাক দিয়ে পেপারে বিজ্ঞপ্তি দিলেন৷ এতে বাধ সাধলেন সোহওয়াদী ও ফজলুল হক৷ কিন্তু শামসুল হক, আবুল হাশিম, মওলানা ভাসানী এ দিবস পালন করলেন৷ আবুল হাশিম এ সময় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক, শামসুল হক হলেন সাংগঠনিক সম্পাদক৷ আবুল হাশিমই শামসুল হককে এ পদে বহাল করেছিলেন৷ বাংলার বুকে মুসলিম লীগের সংগঠন দূর্বল৷ কোন কোন স্থানে এ সংগঠনের নাম গন্ধ পর্যন্ত নেই৷ আবুল হাশিম এবং শামসুল হক এ সংগঠকে চাঙ্গা করার জন্য দিন রাত এপাড় বাংলা ওপাড় বাংলার স্থান বিশেষে চোষে বেড়াতে লাগলেন৷ তিনি মুসলমানদের বোঝাতে লাগলেন মুসলিম লীগই একমাত্র সংগঠন যে নাকি তাদের সার্বিক মুক্তি আনতে পারে৷ এর কল্যাণ তার ধ্যান জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়৷ এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ১৯৪৪ সালের ৯ এপ্রিল পুরান ঢাকায় ১৫০ নং মোগলটুলি মুসলিম লীগের একটি আঞ্চলিক অফিস স্থাপন করেন৷ এ কর্মী শিবির স্থাপিত হলে কলকাতার সঙ্গে তার সম্পর্ক এক রকম ছিন্ন হয়ে যায়৷ একান্ত দরকারি কাজ ছাড়া তার আর কলকাতা যাওয়া হত না৷ এর আগে আবুল হাশিম ও সোহওয়ার্দীর সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না৷ নাজিমউদ্দিন ও নূরুল আমিন বিরোধী যুব সমাজ মুসলিম লীগের সঠিক যুব নেতৃত্ব খুঁজছিল৷ তারা শামসুল হকের মধ্যে তাদের আশার আলো দেখতে পেয়ে তাকে তাদের পকেট রাজনীতির দাবার গুটি বানাতে সচেষ্ট হলেন৷ কিন্তু শামসুল হকতো অন্য ধাতুতে গড়া৷ তিনি তাদের হাতের পুতুল হতে নারাজ৷ তাই তাদেরকে পরিহার করে চলতে লাগলেন৷ মুসলিম লীগ ছিল তত্‍কালে মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতার পকেট সংগঠন৷ এ সংগঠন জনগণের কল্যাণ দূরে থাক তাদের কথা মোটেই ভাবত না৷ তারা বাংলাকে চিরদিনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করাছিল তাদের ঘৃন্য দালালি৷

যে সমস্ত কর্মী মোগলটুলীর এই শাখা অফিসকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার নতুন রাজনীতির আবহ সৃষ্টি নিযুক্ত ছিলেন তার মধ্যে উদীয়মান তরুণ নেতা শামসুল হক ছিলেন প্রান কেন্দ্র৷ এছাড়া কমরুদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আলি আহমদ, শওকত আলী, তাজউদ্দিন, আতাউর রহমান, শামসুজ্জোহা, মোহাম্মদ আল মাস, আব্দুল আউয়াল, হজরত আলী, বদিউজ্জামান প্রমুখের নাম সর্বাগ্রে আসে৷ পরবর্তি সময়ে শেখ মুজিব, শাহ আব্দুল আজিজ, মোস্তাক আহমদ এবং আরও কয়েক নেতা কলকাতা থেকে বাংলার রাজনীতি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় ওখান থেকে ঢাকায় এসে শামসুল হকের সঙ্গে যুক্ত হন৷

এ সময় ভারত পাকিস্তান চুড়ান্ত পর্যায়ে এসে গেছে আযাদী লাভের৷ মিঃ জিন্নাহ্ হবেন পাকিস্তানের প্রধান ব্যক্তি আর মিঃ গান্ধী ভারতের দন্ড মুন্ডের কর্তা৷ একথা ঘোষিত হলেও কংগ্রেস ফায়দা লুটের জন্য লর্ড মাউন্ট বেটেনকে নামে মাত্র বড় লাট নিযুক্ত রেখে দিল৷ লর্ড মাউন্ডবেটেন ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে রোয়েদাদ ঘোষণা করেন৷ এর ফলে সীমানা নির্ধারনের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশেই কাজ শুরু হয়ে গেল৷ তিনি তখন আর মুসলিম রীগের রাজনীতির বলতে গেলে বাইরে৷ ভারত বাড়তি সুযোগ সুবিধা পেতে থাকল৷ মাউন্ড ব্যেটেন তাতে সন্মতি দিলেন৷ শামসুল হক এসব বুঝতে পেরেও করার তাঁর কিছু ছিল না৷ তিনি তখন আর মুসলিম লীগের রাজনীতির বলতে গেলে বাইরে৷ কারণ মুসলিম লীগ তাদের নেতৃত্ব ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগঠনকে হাতের পুতুল করে রেখে ছিলেন৷ তারপর কিছু বিপথগামী যুব নেতৃত্ব শামসুল হক বিরোধী করে এ সময়েই কমরুদ্দিনের পক্ষাবলম্বন করে গণ আজাদী লীগ নামে একটি যুব প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো হল৷ এটা ছিল শামসুল হকের পরিকল্পনার মাথায় কুঠারাঘাত করার জন্য৷ কিন্তু শামসুল হক সব বাঁধা উপেক্ষা করে অতি দ্রুত ১৫০ নং মোগলটুলী অফিসে গণতান্ত্রিক যুব লীগ দাঁড় করান৷ ফলে দেখা গেল নাম সর্বস্ব গণ আজাদী লীগ কমরুদ্দিনের নেতৃত্বে রইল আর সব নেতা কর্মীই শামসুল হকের সংগঠনে ভীড় জমালেন৷ ওদের আন্দোলন ছিল প্রস্তাবিত ভারত রাজ্যের৷ এ জন্যই কমরুদ্দিনের গণতান্ত্রিকব যুব লীগ শামসুল হকের গণ তান্ত্রিক যুব লীগের কাছে দারুণ মার খেল৷ কিন্তু তবুও শামসুল হকের জন্য এটা শেল হয়ে রইল৷

মুসলিম লীগের কর্ম সংগ্রহের রশিদ বই পাওয়ার জন্য নেতাদের উপর শামসুল হকের চাপ৷ পূর্ব বাংলার সব নাবাব বাহাদুর ঢাকার মুষ্ঠিমেয় নবাব পরিবারের নেতৃত্বে মুসলিম লীগে জিম্মি হয়ে ছিল৷ আর যারা এদের বিরোধী ছিল তাদেরকে তারা নানাভাবে দমাতে বদ্ধকর হল৷ তাদের প্রধান ও প্রথম লক্ষ্য শামসুল হককে শায়েস্তা করা৷ এ সময়ে দুই যুব নেতা শামসুল হক ও শেখ মুজিব নতুন কর্মী সংগ্রহের জন্য লীগ নেতা মওলানা আকরাম খানের উপর চাপ দিতে লাগলেন রশিদ বইয়ের জন্য৷ দুই নেতা তাদের দাবী বলিষ্ঠ করার জন্য মুসলিম লীগ ওয়াকারর্স ক্যাম্প নামে কর্মী সম্মেলন ডেকে বসলেন৷ মওলানা আকরাম খান কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এ বাংলার কর্মী সংগ্রহের রশিদ বইয়ের দ্বায়িত্বে ছিলেন৷ তিনি দম্ভকবে এদের সংগঠন সহ এদের রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে রশিদ বই দিতে অস্বীকার করলেন এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের অবগত করিয়ে দিলেন৷

ওয়াকার্স ক্যাম্পের নিবেদিত তরুণ কর্মীদের প্রতি লীগ নেতা আকরাম খানের এই আচরণই প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম লীগের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ৷ ক্ষুদ্র উপদলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে উঠে সংগঠনিক সমস্যাকে বিচার করলে তিনি সহজেই উপলব্ধি করতেন যে ১৫০ মোগলটুলী অফিসে শামসুল হক যে কর্মী বাহিনী সৃষ্টি করেছেন তারাই ছিল মুসলিম লীগের সত্যিকারের শক্তি৷ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবে এ শক্তিকে বাদ দিয়ে তিনি নতুন লীগ গঠন করতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু তিনি এদের ছাড়া নতুন নেতা কর্মী পান নাই৷ তাই তিনি সফল হতে পারেন নি৷ কিন্তু শামসুল হক লীগ সংগঠনের বাইরের এ শক্তির সার্বিক মদদ পেতেন৷ এ সময় শামসুল হক প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, শহীদ সোহরোওয়ার্দী, এ, কে ফজলুল হক, ভাসানী সহ-তত্‍কালীন বড় বড় নেতাদের সংস্পর্শে আসেন৷ প্রাতস্মরণীয় বড় মাপের নেতাদের আর্শিবাদ তাঁর জীবনে অনেক সহকর্মীর হিংসার আগ্নেয়গিরির জন্ম দেয়৷ যা হোক প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম নিজেও ছিলেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন অসাধারণ গুণধর ব্যক্তিত্ব৷ তিনি ছিলেন রত্ন৷ তাই রত্ন চিনতে ভুল করেন নি৷ শামসুল হকের মধ্যে ভবিষ্যত্‍ সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব দেখতে পেলেন৷ তাই তিনি যুব নেতা শামসুল হকের একান্ত অনুগত রাজনৈতিক সহযোদ্ধা করে নিলেন৷ তিনি শামসুল হকের যুক্তিপূর্ণ ক্ষুরধার ও ত্যাজোব্যঞ্জ ব্যাঞ্ছকবক্তৃতায় প্রথম থেকেই চমত্‍কৃত ছিলেন৷ তিনি চিন্তা করলেন শামসুল হকের মত কিছু তেজোদীপ্ত তরুন নেতাকে যদি দলে সম্পৃক্ত করা যায় তবে ঈস্পিত ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থ উদ্ধার একান্ত সার্থক হবে৷
মিঃ জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব ঃ
১৯৩৯ সালে মহম্মদ আলী জিন্নাহ্ বহুখ্যাত দ্বিজাতি তত্ব ঘোষণা করেন৷ তার মতে মুসলমান গণ ভারতের সংখ্যালঘু সমপ্রদায় নয়, বরং মুসলমান একটি বৃহত্‍ জাতি৷ হিন্দুরা হল আর একটি বড় জাতি৷ উভয়েরই আলাদা আলাদা কৃষ্টি ও বৈশিষ্ট রয়েছে৷ বড় কথা ধর্ম আলাদা বিশ্বাস আলাদা৷ তাই চুড়ান্ত পর্যায়ে প্রমাণ হল যে, পূর্বাঞ্চলের বাঙ্গালী মুসলমান জাতির রাষ্ট্র ও চিন্তার সাথে জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্বের বিস্তার ব্যবধান রয়ে গেল৷

শামসুল হকের জীবনে লাহোর প্রস্তাবের প্রভাব ঃ
লাহোর প্রস্তাবের সূদুর প্রসারী প্রভাব শামসুল হকের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনাকে দারুণ ভাবে প্রলম্বিত করে৷ তিনি এ সময় বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরাট আবদান রাখতে শুরু করে দেন৷ মা বাবার বাড়িঘর আত্মীয় স্বজন সব ভুলে যান৷ তিনি দেশের জনগণকেই সব চরম চাওয়া ও পাওয়া মনে করতে থাকেন৷ এখন তার মন ও মগজে পাকিস্তানের স্বাধীনতা বাস্তবায়ন৷ উল্কার বেগে ছুটে বেড়াতে লাগলেন সারা উপমহাদেশ৷ মিটিং মিছিল, সংঘ-সংগঠন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে৷ নেতাদের সহচার্যও হুকুম পালন বড় কর্তব্য বলে মনে করেন৷ আবুল হাশিম, সোহরোওয়ার্দী, ফজলুল হক, ভাসানী সহ ছোট বড় নেতারা যেখানেই জনসভা করেন সেখানেই শামসুল হকের ডাক যেন আগে ভাগেই নির্দিষ্ট করা থাকে৷ বক্তা হিসেবে তো বটেই সাংগঠনিক কাজে তাঁর দক্ষতা তুলনাবিহীন৷ যেখানেই গেছেন সংগঠন দাঁড় করিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ ও কর্মসূচি দিয়ে সক্রিয় করে রেখে এসেছেন৷ তাই তরুণ নেতা হিসেবে প্রবীণদের কাতারে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন৷

ভারতবর্ষে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি ডান বাম যত রাজনৈতিক দল আছে বাস্তব কর্মসূচি দিয়ে ব্রিটিশ তাড়াও আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে৷ চীন, রাশিয়ায় মার্কসবাদ, নেলিনবাদ, মাওবাদ অপ্রতিরোধ্য গতিতে ডানা বিস্তার করেছে৷ সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, উপনিবেশবাদ কেউ টিকতে পারছে না৷ সবারই বেহাল অবস্থা৷ সব মতবাদের নেতারা নিজ দেশের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত৷ তন্ত্র মন্ত্র পরে কায়েম করা যাবে৷ আগে ভারত স্বাধীন কর৷ কিন্তু ফাকড়া দেখা দিল অন্য খানে৷ এ দিকে আবার নিজেদের মধ্যে দ্বন্ধ কলহ শুরু হয়ে গেছে৷ নব গঠিত মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কংগ্রেস কিছুতেই ভারতকে দ্বিখন্ডিত হতে দেবে না৷ তা যে কোন মূল্যে৷ মুসলিম লীগকে ও মুসলমানদের দাবীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ভারত বর্ষের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় রক্ত গঙ্গা বইয়ে যেতে লাগল৷ ওদিকে আবার মুসলিম লীগের ভিতরেও কন্দোল৷ এ, কে ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টির মত পার্থক্য৷ দলীয় মত বিরোধ দু দলে তুঙ্গে৷ মিঃ জিন্নাহ ও এ, কে, ফজলুল হক নীতির প্রশ্নে আপোষহীন৷ শেষে এ বিরোধ প্রকাশ্যে দেখা দিল৷ মিঃ জিন্নাহ কনভেনশন ডেকে ব্রিটিশ সরকারের অশুভ যুদ্ধ নীতিকে সমর্থন না করার জন্য একাই দলীয় নেতা কর্মীদের আহবান জানিয়ে দিলেন৷ মিঃ জিন্নাহ্ এখানেই থেমে রইলেন না৷ তিনি পাকিস্তান দিবসের কর্মসূচিও গ্রহণ করলেন৷ কিন্তু বাংলার বড় মাপের দুই নেতা ফজলুল হক ও শহীদ সোহরোওয়ার্দী জিন্নাহর এ নীতিকে মেনে নিলেন না৷ তারা বাংলার ক্ষেত্রে তার হস্তক্ষেপ পছন্দ করলেন না৷ শামসুল হক ও আবুল হাশিম এ বিরোধ পছন্দ করেন নি৷ তাদের মন মগজে দেশের স্বাধীনতা৷ তাই তারা দু'জন পাকিস্তান আন্দোলন ও সাংগঠনিক কাজে তরিত্‍ বেগে একস্থান থেকে অন্য স্থানে প্রতিদিনই মিটিং মিছিল করে বেড়াতে লাগলেন৷ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এ সময়েই আবুল হাশিম বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শামসুল হক সাংগঠনিক সম্পাদক নিযুক্ত ছিলেন প্রাদেশিক গত ভাবে৷ এতে তাদের গতি অপ্ররিরোধ্য হয়ে দাঁড়ালো৷ তারা দলকে বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌছে দিতে বদ্ধ পরিকর৷ সুতরাং সাংগঠনিক ও কর্ম নির্দেশনার কাজই বড় হয়ে দাঁড়াল তাদের কাছে৷ বিশেষ করে তরুণ নেতা শামসুল হকের উপর যাবতীয় ভার অর্পিত হল৷ এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তিনি ঢাকার ১৫০ নং মোগলটুলী অফিসকে কেন্দ্র বানালেন৷ সারাদিন, রাতের বারটা একটা পর্যন্ত অনুরক্ত ভক্ত নেতা কর্মী মিটিং মিছিল আছেই ফুসরত নেই তাঁর৷ কলকাতার কর্মীদের সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ৷ সদ্য স্বাধীন দেশ ব্রিটিশ আন্দোলনের মুখে ভারত ও পাকিস্তানকে ইতিমধ্যেই সাধীনতা দিয়ে দিয়েছে৷ কর্মীদের মধ্যে কেমন যেন হতাশা অথচ তারা কাজ করতে চায়৷ বিশেষ করে যুব সমাজ৷ ১৯৪৭ আগষ্টের মুসলিম নেতারা প্রসাদ রাজনীতির ষড়যন্ত্র জুড়ে দিয়েছে৷ ত্যাগী নেতারাও বিছিন্ন৷ তবুও শামসুল হককে কেন্দ্র করে আবুল হাশিম, সোহরোওয়ার্দী, ভাসানী ও উপদলের কর্মীরা মোটামোটি একত্রে থাকেন৷ ঢাকাতে অফিস থাকাতে একটি সুবিধা হল সারা পূর্ব বাংলায় নাজিম উদ্দিন সরকারের বিরোধী ছাত্র ও যুবকেরা রাজনীতির ক্ষেত্রে তাকেই অবলম্বন করে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন৷ মন্ত্রী মিনিস্টাররা বা মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা কিংবা প্রদেশিক এ দেশীও নেতারা সংগঠনে তালিকাভূক্ত নেতা কর্মীদের খোঁজ খবর নেন না৷ অথচ তাদেরই হুকুমের দাশ হিসেবে কাজ করতে হয়৷ নেতারা কোঠারি স্বার্থ বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যস্ত৷ এতে কে মুসলিম লীগে থাকলো আর কে গেল তাতে তাদের কিছু যায় আসেনা৷ এমতাবস্থায় নেতা কর্মীদের মনে চাপা ক্ষোভ ধুমায়িথ হচেছ৷ তারা নতুন কোন ইসু খুঁজে বেড়াচ্ছেন৷ তরুণ নেতা শামসুল হককে পেয়ে তারা যেন অবচেতন মনে সেই ইসুটি পেয়ে গেল৷ নবীন প্রবীণ নেতারা ১৫০ নং মোগলটুলীর শাখা অফিসকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে নতুন নেতৃত্বের চিন্তায় বিভোর ছিলেন৷ এদের মধ্যে উদিয়মান যুব নেতা শামসুল হক ছিলেন সবার মধ্যমনি৷ এছাড়া কামরুদ্দিন আহাম্মেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শওকত আলী, তাজ উদ্দিন, শামসুজ্জোহা, মহম্মদ আলমাস, মহম্মদ আব্দুল আউয়াল, হজরত আলী, বদিউজ্জামান প্রমূখের নাম উল্লেখযোগ্য৷ পরবর্তি সময়ে শেখ মুজিব, শাহ্ আব্দুল আজিজ, খন্দকার মোস্তাক আহম্মদ, শামসুল হকের নতুন চিন্তা চেতনার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন৷ উপযুক্ত নেতৃবর্গ ছিলেন কোলকাতা ভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী৷ আর তারা তখন ওখানকার কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন৷ শামসুল হক দেখলেন মুসলিম লীগ কোঠারী স্বার্থ পকেট রাজনীতি ও প্রসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত৷ তাদের ধ্যান ধারনা চলমান প্রেক্ষাপটে দেশের স্বার্থ অচল৷ নতুন নেতা কর্মীদের মধ্যে মতভেদ বেড়েই চলেছে এবং ভবিষ্যতে আরও চলবে৷ এ সমস্ত গঠনমূলক চিন্তা থেকে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শামসুল হক সংগঠনের গোড়ায় হাত দেন৷ তাই সে বছরই মোগলটুলী হতে সাংগঠনিক ক্রিয়াকর্ম তার নেতৃত্বে পরিচালিত করেন৷ তিনি এর জন্য ঢাকাকে উপযুক্ত স্থান মনে করেন এবং একে প্রাণ হিসেবে গড়ে তোলেন৷ কারণ এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল অনুকুলে৷ তাই এ সংগঠনের প্রাণ প্রদীপ জ্বালাতে এখানেই সর্বাধিক প্রয়াস পান৷ ঢাকার নেতা কর্মীরা প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের আওতামুক্ত৷ যারা খপ্পরে পড়েছে তারা হাতেগোনা কয়েকজন এবং তাদের সাংগঠনিক শক্তি সম্পর্কে তিনি ভাল ভাবেই অয়াকেবহাল আছেন৷ ঢাকার নবাব পরিবার তত্‍সঙ্গে আরও কিছু অলস কর্মী ও ভূস্বামী মুসলিম লীগ নামক সংগঠনকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন৷ তাদের বাদ দিয়ে কোন কিছু করা অসম্ভব ছিল৷ কিন্তু শামসুল হক এটাকে মোটেই গ্রাহ্য করলেন না৷ এজন্য তাঁকে জানী দুশমন দ্বারা নিগৃহীত হতে হয়৷ জনগণ স্বর্তঃফূর্তভাবে এ নির্যাতন প্রতিহত করেন৷ ঢাকার সর্বস্তরের মানুষের কাছে শামসুল হক তখন ঈদের চাঁদের মত প্রিয়৷ তারা ঢাকার মাস্তান সর্দার যারাই শামসুল হকের ক্ষতি করতে আসবে তাদেরকে কিছুতেই ছেড়ে দেবে না৷ শামসুল হকের যত জটিল সমস্যাই হোক ঢাকা বাসীদের সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং তাতে সফলকাম হয়েছেন৷ বলতে গেলে তখন শামসুল হক এবং ঢাকাবাসী এক ও অভিন্ন ছিলেন৷ তাঁর ডাকে অত্যাল্প সময়ের ব্যবধানে হাজার হাজার লোক সশস্ত্র জঙ্গি রূপে সাড়া দিত৷ বহু ঘটনায় এর প্রমান পাওয়া গেছে৷

মোগলটুলী অফিসকে কেন্দ্র করে শামসুল হকের নেতৃত্বে ভিতরে এবং বাইরে যে সমস্ত মুসলিম লীগের নবীন প্রবীণ নেতা কর্মীরা অবস্থান করছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেরই মনের গভীরে দোদুল্যমানতা ছিল৷ মূল সংগঠনের মুসলীম লীগ সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ইচ্ছা তাদের ছিল না৷ তারা প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম লীগকে নতুনভাবে সংগঠিত করে তার মধ্যে নিজেদের শক্তিকে সুসংহত করতে চেয়েছিলেন৷ এজন্য কোলকাতা ফেরত্‍ তরুণ নেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবর রহমানকে তিনি সহযোগী শক্তি মনে করলেন৷ শামসুল হককে নানাভাবে প্রভাবিত করে শেখ মুজিবকে নিয়ে ওয়াকার্স ক্যাম্প নামে মুসলিম লীগের এক সন্মেলন আহবান করলেন৷ কর্মী সংগ্রহ করার জন্য মওলানা আকরম খানের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন৷ এ সময় সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে মওলানা আকরম খান ছিলেন মস্তবড় মুসলিম লীগের নেতা৷ তার উপর ছিল এর দায়িত্ব৷ তিনি চাইতেন দলীও অন্ধ স্বার্থ এবং যাতে অন্য কেউ নেতা কর্মকর্তা না হতে পারে৷ তাদেরকে ভারতের দালাল, রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে আখ্যায়িত করে মামলা চাপতে চাইলেন৷ তিনি শামসুল হককে কোন পাত্তাই দিলেন না৷ মোগলটুলী ক্যাম্পটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার স্থান৷ এখানে যারা আছেন তারা শামসুল হকের অনুসারী এবং দিন দিন ভারি হতে চলেছে৷ শেষে এমন হতে পারে তাকে ফেলে দিয়ে শামসুল হক সর্বেসর্বা হয়৷ এটা ছিল আকরম খাঁনের অমূলক ধারনা৷

শামসুল হককে মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কার ঃ
নবলব্ধ পাকিস্তানের উপরওয়ালারা ষড়যন্ত্র আর তোয়াজে বিশ্বাসী ছিলেন না তরুন সমাজ৷ কারণ পূর্বাংশে যারা পাকিস্তনের বীজ বপন করলেন তারা হলেন উপেক্ষিত৷ কেন্দ্র কিংবা প্রদেশে কোথাও তাদের স্থান নেই৷ উপেক্ষিত এই নেতাদের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শামসুল হক, মওলানা ভাসানী প্রমুখ প্রধান৷ অথচ যারা আরামকে হারাম করে দিয়ে পাকিস্থানের আজাদীর জন্য আন্দোলন করলেন তারা রয়ে গেলেন পর্দার বাইরে৷ পাকিস্তানের ইসু ভিত্তিক ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় মওলানা আকরাম খাঁ স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে মধুপরে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ঘাটপি মেরে রয়ে গেলেন আর খাজা নাজিম উদ্দিন রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে লন্ডনে চলে গেলেন৷ কী আশ্চর্যের ব্যপার৷ নির্বাচনে বিজয় লাভের পর তারা মিঃ জিন্নাহর আলীর আনুকুল্যে হর্তাকর্তা হয়ে গেলেন৷ বঙ্গীয় কমিটিগুলি ভেঙ্গে দিয়ে নবাব ও ভূস্বামীদের ঢুকানো হল৷ এখানে নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের বাদ দিয়ে দেয়া হল৷ এই ভাবে শামসুল হকের মত উদীয়মান নেতা মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কৃত হলেন৷

শামসুল হক এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে তিনি কমরুদ্দিন আহমেদ, মোস্তাক আহম্মেদ, শেখ মুজিবর রহমান প্রমুখকে নিয়ে ১৯৪৮ সালে ওয়াকার্স ক্যাম্প গঠন করে সম্মেলনও করে ফেললেন৷

বংশ পরিচয়ঃ শামসুল হকের পূর্ব পুরষ মাইঠাইন টেউরিয়া অধিবাসী নয়৷ এলাকার বহু লেকের মত তারাও যমুনা তীরবর্তী গাঙ্গের শনকলী চরের বাসিন্দা ছিলেন৷ আরও শোনা যায় পূর্ব পুরুষ নাকি বিক্রমপূরের অধিবাসি ছিলেন৷ নদী ভাঙ্গন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণেই তারা এসে বসতি স্থাপন করেন মাইঠাইন টেউরিয়াতে৷ এ বংশের কিছু বয়ঃবৃদ্ধ লোক আছেন তাদের কাছে জানা যায়৷ এখনও তাদের বংশধরেরা ঐ চর এলাকায় আছে৷ সে যাই হোক যতটুকু সিদ্দিক ভাই সাহেব (ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপনের কাছে) মরহুম নূরুল হক, আলহাজ আজমল হক, ইউসুফ, সরোয়ার, সিরাজুলহক, সাইফুল এদের কাছ থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি তার উপর ভিত্তি করে শামসুল হকের পূর্ব পুরুষের বংশ তালিকা নিম্নে প্রদর্শিত হলঃ


শামসুল হকের স্ত্রীর বংশ তালিকা ঃ
স্ত্রী আফিয়া খাতুন৷ পিতাঃ সেকান্দার আলী এন্ট্রাস পাশ, গ্রামঃ করিমপুর, জেলাঃ নরসিংদি৷ প্রথমে করিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষগতা করেন৷ পরে ঐ একই পেশায় নারিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অবসরপ্রাপ্ত হন এবং এখানেই ৭২ নং বাসা করে অবসর জীবন যাপন করেন৷ আফিয়া খাতুন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন৷ শ্রেণীতে কোনদিন এক ছাড়া দুই রোল নম্বর হয়নি৷ প্রথম বিভাগে এন্ট্রাস পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজীতে অনার্স সহ প্রথম শ্রেণীতে এম, এ পাশ করেন৷ কর্মজীবনে ইডেন গার্লস কলেজে অধ্যাপিকা ও পরে অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন৷ পরে দু মেয়ে নিয়ে আমেরিকাতে স্থায়ীভাবে বাস করছেন৷

কিন্তু শামসুল হক দমবার পাত্র নন৷ তিনি আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবর রহমান, আনোয়ারা বেগম, মোস্তাক আহম্মেদ, কমরুদ্দিন আহমদ, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী আরও অনেকে মুসলিম লীগের গণ বিরোধী কার্যকলাপ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগলেন৷ তারা প্রথমে নারায়নগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলীর সহায়তার রহমত উল্লাহ্ বিদ্যালয়ে কর্মী সভার ডাক দিলেন৷ ক্ষমতাসীনরা এটা জানতে পেরে পুলিশ ও রাইফেলসের লোক দিয়ে বন্ধ করে দিলেন৷ এর পর পাইক পাড়াতেই একই কায়দায় সভা ভেঙ্গে দিয়ে ওয়াকার্স ক্যাম্পের কর্মীদের হয়রানী করতে শুরু করল৷ শামসুল হক এসব হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে এই প্রসাদ ষড়যন্ত্রীদের চূড়ান্ত আঘাত হানার অপেক্ষায় রইলেন৷ এ সময়ের উদীয়মান নেতা ও সাহসী কর্মবীর শামসুল হকের জীবনের দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা উল্লেখের দাবী রাখে৷ একটি ঘটনা ময়মনসিংহের গফরগাঁয়ের মওলানা পাঁচবাগী কমীদের ভয়ানক নির্যাতন৷

গফরগাঁ ছিল ময়মনসিংহের একটি গুরুত্বপূর্ন এলাকা৷ বলতে গেলে এলাকা ছিল মুসলিমলীগ বিরোধী এবং কংগ্রেস সমর্থক৷ মওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী ছিলেন একটু ভিন্ন ধর্মী৷ তিনি একজন বিপ্লবী নেতাও বটে৷ জীবনে তিনি কৃষকদের সংগঠিত করে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের মাঝে সুফল এনে দিয়েছিলেন এবং বক্তা হিসেবেও শামসুল হকের মত তুখোড় ছিলেন৷
১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে মুসলিম লীগের একটি সম্মেলন হয়৷ এই সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকা থেকে মামসুল হক একদল সেচ্ছাসেবক যোগাড় করেন৷ এ দলের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক আব্দুল গফুর, এনামুল হক, আব্দুল ওয়াদুদ, শওকত আলী প্রমূখ৷
সমস্ত গফরগাঁ ছিল যেন মওলানা পাঁচবাগীর দূর্ভেদ্য দূর্গ৷ তিনি এখানে বড় বড় সভা সমিতি মিটিং মিছিল করেছেন৷ কৃষককুল তার সশস্ত্র বাহিনী৷ তাদের হুকুম করলে তারা আগুনে ঝাপ দিতেও কুন্ঠাবোধ করতেন না৷ তিনি শেরে বাংলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ তিনি ছিলেন পাকিস্তান বিরোধী কংগ্রেস নেতা৷ তার গঠিত ইমারত পার্টি দিয়ে এখানে যেন ভিন্নধর্মী আন্দোলন মুহুর্তে নস্যাত করে দিতে পারতেন৷ মুসলিম লীগের বড় বড় নেতা এসেছিলেন এই সম্মেলনে৷ তাদের মধ্যে ছিলেন লিয়াকত আলী খান, হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী, আবুল মুনসুর আহমদ, খাজা নাজিমুদ্দিন, হাবিবুল্লাহ বাহার, নূরুল আমিন ও আরও অনেকে৷
এই সম্মেলনের প্রচার উপলক্ষ্যে ঢাকার স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী স্থানীয় হোসেন পুর হাঁটে গিয়েছিলেন প্রচার উপলক্ষ্যে৷ হোসেনপুর বাসী ছিলেন পাঁচবাগীর অন্ধ ভক্ত এলাকা৷ সেচ্ছাসেবক বাহিনী কেবলই টিনের চোঙ্গা ফুকে প্রচার আরম্ভ করেছে আর যাবা কোথায়, চারদিক থেকে ভীমরুলেরমত এসে লাঠি সোঠা নিয়ে এলোপাথারী আক্রমণ৷ শামসুল হক সাথী কর্মীদের বাঁচাবার জন্য যে ভুমিকা নিয়েছিলেন তা কোনদিন ভুলবার নয়৷ তিনি সাথীদেরকে দ্রুত সরিয়ে দিয়ে নিজে বীরের মত অটল রইলেন৷ ফলে তাকে আঘাতের পর আঘাত করে জর্জরিত করা হয়৷ এক পর্যায়ে শামসুল হকের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী মনে করেছিল যে, পাঁচ বাগীর লোকেরা তাঁকে মেরে লাশ বানিয়েছে৷ কিন্তু ব্রক্ষপুত্রের ধারে দু-জন লোকের কাঁথে ভর দিয়ে এসে তার দলের লোকের সাথে মিলিত হলেন৷ তারা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন৷ কিন্তু দেখা গেল তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটছেন৷ শেরোয়ানী পাজামা স্থানে স্থানে নাই৷ আনেক রাতে খেয়া পাড় হয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলেন কিন্তু এই অকুতোভয় সেনানীর জান কোরবান করা পরিশ্রমের পর সন্মেলন সফল হয়৷ তাঁর এই বীরগাঁথা শ্রবণ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শামসুল হকের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন৷

এই সম্মেলনের কিছুদিন পর নির্বাচনের পূর্বে মুসলিম লীগের একদল প্রথম শ্রেণীর নেতা গফরগাঁয়ে এসেছেন এই খরব প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন এলেই চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে৷ নেতারা যে বগীতে ছিলেন তার কাঁচ ভাংচুর করে এবং তাদেরকে ফিরে যেতে বাধ্য করে৷ এটা পাঁচবাগী মওলানা ইমারত পার্টির নেতা কর্মীদের কান্ড৷ এই খবর শামসুল হকের রাজনৈতিক দিক নির্দেশক আবুল হাশিম তাঁকে ডেকে যে কোন মূল্যে একটি জনসভা করার নির্দেশ দেন৷ এই উদ্দেশ্যে শামসুল হক, শাহ আজিজুর রহমান, শেখ মুজিবর রহমান প্রমুখ গফরগাঁয়ের ডাক বাংলাতে অবস্থান করেন৷ কিন্তু পাঁচ বাগীর লোকদের যুদ্ধংদেহী ভাব দেখে ফিরে আবুল হাশিমের নিকট যান এবং তাকে নিয়ে শামসুল হক আবার গফরগাঁয় ফিরে আসেন৷

জনসভার মাত্র একদিন আগে তাদের এ আগমন৷ গফরগাঁয়ের হাজার হাজার মানুষ তাদেরকে স্টেশনে ঘিরে ফেলে এবং তারা বহু কষ্টে তাদেরকে বুঝিয়ে নিজেদের নিরাপদ করেন৷ তারপর পাঁচবাগী পীর সাহেবকে কাছে ডেকে আবুল হাশিম তাকে ও উপস্থিত লোকদের বোঝাতে সক্ষম হন৷ প্রায় তিরিশ মিনিট কাল হাশিম সাহেব বক্তব্য রাখার পর পীর সাহেব পাকিস্তান কি, কেন এবং মুসলিম লীগ সংগঠন কি চায় তা বুঝাতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং পরে ভোজ সভায় দাওয়াত খেয়ে শামসুল হক, আবুল হাশিম নির্বিঘ্নে বিরাট সভা করে ফিরে আসেন৷


টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন

যার অবদানে সারা বাংলায় মুসলীম লীগের জয় জয়কার, যার অবদানে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের গদি প্রাপ্তি সেই সিংহপুরুষকে পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থ বাদীরা বার বার দূরে নিক্ষেপ করেছে সেই শামসুল হক কোন দিন হোটে যাবার পাত্র নয়৷ তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন মুসলিম লীগ সরকারকে চরম শিক্ষা দেওয়ার জন্য৷ সে সুযোগও পেয়ে গেলেন৷ এলো পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে ৩৫টি আসনের উপ নির্বাচন৷ শামসুল হক এবার স্বতস্ত্র প্রার্থী হিসেবে দক্ষিণ টাঙ্গাইল উপ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে দাঁড়ালেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রার্থী হলেন কে, কে, পন্নী, যুক্তফ্রন্টের এ্যাডভোকেট আমির আলী, সেকান্দার আলী ও আব্দুল জলিল৷

প্রসঙ্গক্রমে কিছু কথা বলতে হয়৷ ১৯৪৯ সালের প্রথম দিক৷ পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার নির্বাচন দিলে মওলানা ভাসানী ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার দক্ষিণ পূর্ব (বাসাইল, মির্জাপুর ও নাগরপুর মুসলিম আসনে) কেন্দ্র থেকে পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন৷ এই নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে করটিয়ার প্রভাবশালী জমিদার খুররম খান পন্নী, টাঙ্গাইলের উকিল বারের সদস্য আমির আলী মোকতার, আব্দুল জলিল এম, এ ও জনৈক সেকান্দার আলী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন৷ মওলানা ভাসানী বিজয়ী হন৷ এতে খুররম খান পন্নী মওলানা ভাসানীর নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করার জন্য গুটি কতক খোঁড়া যুক্তি এনে নির্বাচন কমিশনার বরাবরে আবেদন করেন৷ এ আবেদনের ভিত্তিতে প্রদেশিক গভর্নর আজিজ আহম্মদ চৌধুরী উপযুক্ত ব্যাখ্যা ছাড়াই মওলানা ভাসানীর সদস্য পদ খারিজ করে দিলেন৷ শুধু তাই নয় পুরো নির্বাচনই বাতিল করে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে প্রার্থীদের কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবে না বলে এক প্রজ্ঞাপনজারী করেন৷ ফলশ্রুতিতে দাঁড়াল নির্বাচন বাতিল হয়ে উপ নির্বাচনের পথ খোলা হয়ে গেল৷ এ ষড়য়ন্তের মূল ছিল একটাই আর তা হল মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন না৷ মুসলিম লীগ সরকারের বেহায়াপনা ধরা পরে পরের উপনির্বাচনের সময়৷ খুররম খান পন্নীকে প্রার্থী করার জন্য তার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হল অথচ অন্য তিন জনের উপর থেকে তুলে নেওয়া হল না৷

১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল টাঙ্গাইল দক্ষিণ মুসলিম আসন বাসাইল, মির্জাপুর ও নাগরপুরে প্রদেশিক সরকার নতুন করে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন৷ এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর পুরানো ঢাকার ১৫০ নং মোগলটুলীর নেতা কর্মীরা ফুঁসে উঠে৷ মওলানা ভাসানীর নির্বাচিত সদস্যপদ বাতিল করায় এর বদলা নেওয়ার জন্য এমন একজন সুযোগ্য প্রার্থী টাঙ্গাইল হতে খুঁজতে ছিলেন যাকে দিয়ে এই অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচন বৈতরণী পার করিয়ে আনা যায়৷ অনতিবিলম্বে প্রার্থী জুটেও গেল একজন৷ তারা এক তরুণকে উপযুক্ত মনে করলেন৷ এই প্রার্থী আর কেউ নয় তিনি হলেন উদীয়মান নেতা সময়ের সাহসী কন্ঠস্বর শামসুল হক৷ তিনি ইতোপূর্বে করটিয়া সা'দত কলেজের ছাত্র সংসদ আদায় করে নিয়েছিলেন খুররম খান পন্নীর কাছ থেকে৷ মোগলটুলী অফিসে সম্মিলিত নেতা কর্মীরা মন্ত্রনায় বসে গেলেন৷ এদের মধ্যে মোস্তাক আহমদ, শওকত আলী, শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহমদ, নবাবজাদা হাসান আলী ও আরও অনেকে৷ তারা শামসুল হককে মুসলিম বিরোধী প্রার্থী দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নিলেন৷ তারা মনে করলেন এই শামসুল হক খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কলেজ ছাত্র সংষদ আদায় করে নিয়ে এবং নিজ হয়েছিলেন সা'দত কলেজের প্রথম ভি. পি৷ সুতরাং শামসুল হককে দাঁড় করিয়ে জমিদার কে, কে, পন্নীর বিরুদ্ধে ভোট যুদ্ধে বিজয়ী করে আনতে পারবেন৷ এ প্রতাপশালী জমিদার শামসুল হককে কলেজ হতে বহিস্কার করার হুমকী দিয়েও তাকে দমাতে পারেনি৷ তাঁর বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক চাপ, ভয় ভীতি প্রয়োগ করেও ছাত্রসংসদ আদায়ে নিবৃত করতে পারেনি৷ দলীয় অফিসে নেতাদের প্রস্তাব সানন্দে মাথা পেতে নিলেন এবং আল্লাহর নাম ভরসা করে নির্বাচনে নেমে পড়লেন৷ এরপর অন্যান্য সকলেই মোটামুটি এ ব্যাপারে একমত পোষণ করলে ও হাতে গোনা কিছু নেতা কর্মী মনে মনে সন্দেহ প্রবণ হলেন৷ তারা এ ব্যাপারে সাবধান হওয়ার জন্য নারায়নগঞ্জের খান সাহেব ওসামান আলীর বাসায় এক গোপন বৈঠকে মিলিত হলেন৷ এদের মধ্যে শওকত আলী, আজিজ আহমদ, আলমাস আলী, শামসুজ্জোহা প্রমূখ উল্লেখযোগ্য৷ তারা স্থির করলেন যে, যদি ধূর্ত মুসলিম লীগের সরকার শামসুল হককে কোনভাবে টোপ দিয়ে দলে ভিড়িয়ে মনোনয়ন দিলে তারা তাকে সমর্থনতো করবেনই না অধিকন্তু তারা অন্য একজন প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেবেন৷ অবশেষে শামসুল হক তাদের ধারণা অমূলক প্রমাণ করে ওয়াকার্স ক্যাম্পের মনোনয়ন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী যুদ্ধে অবর্তীর্ন হলেন৷

প্রাদেশিক প্রধান মন্ত্রী নূরুল আমিন সরকারের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং নির্লজ্জ দলীয় পকেট রাজনীতির বিরুদ্ধে সমগ্র প্রদেশের নেতাকর্মী এবং জন সাধারনের মধ্যে দারুণ অসন্তোষ দানা বাঁধছিল৷ এলাকার জনগণ দারুণভাবে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল৷ কারণ জনগণ মুসলিম লীগ সরকারকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ তারা পাকিস্তান কায়েমের সময় যে বিশ্বাস নিয়ে ভোট দিয়েছিলেন এখন সেই বিশ্বাস আর সরকারের উপর রাখতে পারছে না৷ তাদের সিদ্ধান্ত এই বেইমান মুসলিম লীগ সরকারের প্রার্থীকে তারা ভোট দেবেন না৷ তারা বিরোধী প্রার্থী শামসুল হককে খাঁটি লোক ও উদীয়মান তরুণ নেতা মনে কত্মে তাকেই ভোট দেবেন৷

রাজনৈতিক মহলেও এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ঘটল৷ টাঙ্গাইল উপ নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে শামসুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী রূপে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা হলে বিরোধী মহলে সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল৷ তাদের মধ্যে অনেকেই শামসুল হককে অর্থ, শ্রম দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসলেন৷ এগিয়ে এলেন তরুন নেতারাও শামসুল হককে সাহায্য করার জন্য ছাপাখানার মালিকরা বিনা পয়সায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দিলেন৷ হাজার হাজার বিজ্ঞাপন, পোস্টার, বাশাইল, মির্জাপুর ও নাগরপুর ছেয়ে গেল৷ সবার মুখে এক রব শামসুল হককে ভোট দাও৷ নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিপুর অর্থের প্রয়োজন৷ কিন্তু শামসুল হকের তা নেই৷ তাকে সাহায্য করার জন্য জনগণই যথেষ্ট৷ জনগন তার কাছে পয়সা চায় না৷ বিনা পয়সায় এবং নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে শামসুল হককে ভোট দেবে৷ শামসুল হক যখন প্রার্থী পদ নির্বাচন অফিসে জমা দেন তখন তার পকেটে মাত্র চৌদ্দ পয়সা ছিল৷

তার এক ভক্ত আনসারী আলমাস তার এলাকা থেকে শামসুল হকের জন্য ৫০০ টাকা চাঁদা তোলেন৷ তাছাড়া কমার্সের চেম্বার থেকে সাখাওয়াত হোসেন ৫০ টাকা, আতাউর রহমান ৫০ টাকা, কাদের সর্দার ১৫০ টাকা দেন৷ নির্বাচনের জন্য কর্মীরা সর্ব সাকুল্যে ১৩০০ টাকা চাঁদা আদায় করেন৷ কিন্তু খুররম খান পন্নীর টাকার কাছে এ অর্থ বুদ্বুদ্ তুল্য৷ তাকে সরকার টাকা দেয়, গাড়ি দেয়, লোকজন দেয় কিন্তু শামসুল হকের এসবের কিছুই ছিল না৷ তাঁর এক বন্ধু নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য একটি জীপ গাড়ি দিয়েছিলেন৷ তাই নিয়ে তিনি নির্বাচনে যেতেন৷ কিন্তু তাঁর পুরাতন রেলী ব্রাদার্সের সাইকেল ছিল৷ তাই নিয়ে তিনটি থানা বাসাইল, মির্জাপুর এবং নাগরপুরে প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়াতেন৷

শামসুল হকের র্নিবাচনের অর্থ সাহায্যের জন্য একটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল৷ শামসুল হক তার নির্বাচনী হেড অফিস টাঙ্গাইলের ঘ্যাগের দালানের উপর দোতলায় বসে আছেন৷ এমন সময় খুররম খান পন্নী সাহেবের স্ত্রী এক ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত৷ তিনি শামসুল হককে ব্রিফকেস তুলে দিয়ে বলল্লেন, এর ভেতরের সমস্ত টাকা আপনার নির্বাচনের জন্য দান করে দিলাম৷ শামসুল হক তাকে অত্যন্ত ইজ্জতের সাথে চেয়ারে বসিয়ে বিনীতভাবে জানালেন যে ঐ টাকা তিনি নিতে পারেন না৷ আজ নিলে কালই রটে যাবে যে, তিনি কৌশলে জাদুকরী কাদায় কে, কে, পন্নীর স্ত্রীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছেন৷ কেস হলে তার নির্বাচন বাতিল হয়ে যেতে পারে৷ সুতরাং ঐ টাকা নেয়া যায় না৷ শামসুল হক তার দোয়া চেয়ে আবার সেই ব্রিফকেস বিলকিস বেগমের কাছে ফেরত দিলেন৷

শামসুল হকের দুটি অভাবিত জনসভার উল্লেখ না করলেই নয়৷ নাগরপুর থানার সামনের মাঠে সরকারি দলের পক্ষ থেকে একটি মস্তবড় জনসভার আয়োজন করা হয়৷ জনসভার নির্ধারিত তারিখের কিছু দিন পূর্ব থেকে মাইক যোগে ব্যাপক প্রচার হচ্ছিল বলে সভায় বিপুল জন সমাগম হয়৷ তাতে নূরুল আমিন সহ পাঁচজন মন্ত্রী, খুররম খান পন্নী এবং এলাকার বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন৷ নূরুল আমিন ছিলেন সভাপতি৷ সভার শেষে তিনি ভাষণ দিচ্ছেন৷ এমন সময় শামসুল হক সাইকেল যোগে প্রচার শেষে কয়েকজন কর্মীসহ সভার একপাশে চুপ করে দাঁড়ালেন৷ তাঁকে দেখামাত্র সভাস্থলের লোকজন "শামসুল হক জিন্দাবাদ" ধ্বনি দিয়ে উঠে পড়ে৷ তারা চিত্‍কার করে বলতে থাকে যে, তারা শামসুল হকের বক্তব্য শুনতে চায়৷ নূরুল আমিন সহ অন্যান্যরা জনতাকে শান্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন৷ কিন্তু জনগণ তাদের কথায় শান্ত না হয়ে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে৷ এক সময় শামসুল হক লাফ দিয়ে মঞ্চে উঠে জনতাকে শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করে৷ জনতা তার অনুরোধের সাথে সাথে মন্ত্রমুগ্ধের মত যার যার মত বসে পড়েন৷ শামসুল হক স্বভাব সুলভ দরাজ কন্ঠে আবেগময় সূরে ভাষণ শুরু করেন৷ তখন নূরুল আমিন ও অন্যান্যরা চুপচাপ তড়িঘড়ি করে সভাস্থল ত্যাগ করে চলে যান৷ শামসুল হক দু'ঘন্টা ব্যাপী জ্বালাময়ী ভাষায় সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন৷
থানা বাসাইলেও এমটি ঘটে৷ সরকার পক্ষের লোকেরা বাসাইল থানা উপকন্ঠে একটি জাঁকজমকপূর্ণ জনসভার আয়োজন করে৷ সমস্ত জনসভার মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে জমকালো জনসভা৷ এই বাসাইলেই খুররম খাঁন পন্নীর বাড়ি৷ সুতরাং জন সমাগম চোখ ধাঁধাঁনো জনসভা, মন ভোলানো সমাবেশ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়৷ প্রধান মন্ত্রী নূরুল আমিন সহ পাঁচজন মন্ত্রী সেদিনও সভায় যথারীতি উপস্থিত আছেন৷ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলা থেকে মুসলিম লীগের অনেক জাঁদরেল নেতা এসেছেন৷

সভার কাজ শুরু হয়েছে৷ এমন সময় শামসুল হক দু'জন কর্মী সহ সভা স্থলের অদূরে এক কোণে চুপ করে দাঁড়ান৷ জনসভার ভেতর গুঞ্জন উঠল৷ হৈ চৈ পড়ে গেল শামসুল হক এসেছেন৷ তারপর ধ্বনী উঠতে শুরু করলঃ শামসুল হক জিন্দাবাদ৷ দেখতে দেখতে প্রায় সমস্ত লোক শামসুল হকের চারপাশে এসে ভিড় করে দাঁড়াল৷ তখন নূরুল আমিন ও অন্যান্যরা জনতাকে শান্ত হয়ে বসার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন৷ ইতোমধ্যে কয়েকজন কর্মী শামসুল হককে সাথে নিয়ে মঞ্চে উঠে পড়েন৷ নূরুল আমিন মাইকের সাহায্যে তখনও পরিস্থিতি আয়ত্বে আনার চেষ্টা করছেন৷ এ সময় জনৈক কর্মী নূরুল আমিনের সামনে থেকে মাইক টান মেরে নিয়ে আসেন৷ তখন নূরুল আমিনের এক কর্মী ঐ যুবককে আক্রমণ করে৷ সাথে সাথে শত শত লোক এসে ঐ কর্মীকে টেনে হিঁচড়ে গণ ধোলাই দিয়ে ধাক্কা মেরে মঞ্চের নিচে মাঠে নামিয়ে দেন৷ শামসুল হক জনতাকে সম্ব্বোধন করে বলেনঃ যেহেতু এখানে আমাকে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না৷ চলুন আমরা ঐ উঁচু যায়গায় মিটিং করি৷ একথা বলে মঞ্চ থেকে নেমে যথাস্থানে গেলেন৷ মুহূর্তে নূরুল আমিনের সভা শূণ্য ময়দান হয়ে পড়ে রইল৷

শামসুল হক মাঠের এক প্রান্তে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন৷ তিনি বলেনঃ আমরা কোন্ কারণে পাকিস্তান আনলাম ? পাকিস্তান এনেছি দুটো ভাত কাপড়ের জন্য, বাসস্থানের জন্য, শিক্ষার জন্য, রোগে ওষুদ, জানমালের নিরাপত্তার জন্য৷ তা কি আমরা পেয়েছি ? ইত্যাদি সম্পর্কে দীর্ঘ বক্তৃতা রাখেন৷

পূর্ব বাংলার দালাল গোষ্ঠি পশ্চিম পাকিস্তানকে উর্বর করার জন্য তাদের প্রভুদের পদ লেহন করছে৷ এ পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বানানোর কৌশলে পুরাপুরি ব্যস্ত৷ তাদের প্রভুরা যা কয়- দালালেরা তাই পালনে বদ্ধ পরিকর৷ ভাষা সম্পর্কে বলেন যে, বাংলার পরিবর্তে উর্দর্ু করা হবে৷ জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হবে না৷ দিন দিন এদেশের মানুষ ঋণে জর্জরিত হয়ে বাড়ি ঘর সহ ভূমিহীন হচ্ছে৷ এগুলো যাতে না হতে হয় সেজন্য ওদের ধনিক বণিক জমিদার পুত্রকে ভোট না দেওয়ার জন্য উপস্থিত জনগণকে বলেন৷ তাকে ভোট দিয়ে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে সভা শেষ করেন৷

এই নির্বাচনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আকরাম খাঁ, সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন ভোটারদের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করে, পাবলিসিটি করেও বিভ্রান্ত করতে পারেন নি জনগণকে৷

অবশেষে ঈস্পিত ভোট প্রদানের দিন এলো৷ ২৬ এপ্রিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল৷ ভোটাররা কোন প্রকার অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে ইতিহাসের সঠিক রায়ই সেদিন দিলেন৷ শামসুল হক প্রায় ১৮০০ ভোটের বিপুল ব্যবধানে জয় লাভ করেন৷ এই নির্বাচনের ফলাফল তত্‍কালীন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তীতে বাংলার মহান স্বাধীনতা লাভে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে৷ এদেশের ভাষার আন্দোলন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সহ সব স্বার্থ রক্ষার মূলে প্রোথিত হয়ে আছে শামসুল হকের এই বিজয়ের মধ্যে৷ এই বিজয়ের মধ্যে দিয়ে নিপীড়িত শোষিত বঞ্চিত মানুষ এক দিকে যেমন চেতন হতে পেরেছিল অন্যদিকে প্রতি পক্ষের দূর্বলতা ধরা পড়েছিল৷ যে কোন বিচারে এই বিজয় ছিল ঐতিহাসিক মাইল ফলক৷
শামসুল হকের একান্ত ভক্ত রূপসীযাত্রা, টাঙ্গাইলের মরহুম সোমেজ উদ্দিন সরকার বলেনঃ শামসুল হকের মার্কা ছিল ধানের অাঁটি, তার নির্বাচনী প্রচার প্রপাগান্ডা চালাতেন এই বলেঃ "শামসুল হক মানুষ খাঁটি, ভোট দেন ভাই ধানের অাঁটি" আর খুররম খান সাহেবের মার্কা ছিল সাইকেল৷ এই মার্কার উদ্দেশ্যে জনগণের মধ্যে প্রচার করে বেড়াতেন, "সাইকেলের পাম্প নাই, মুসলিম লীগের ভোট নাই"৷ "নাগরপুর থেকে মির্জাপুর শুনি, শামসুল হকের জয় ধ্বনি"৷ হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী শামসুল হকের বিজয়ে বলেনঃ রাজনীতির ভবিষ্যত্‍ শূন্যতা পূরণ করেছিল৷ আমরা এখান থেকেই মুসলীম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাব৷ এই বিজয়কে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে এ দেশে বিরোধী শক্তি সুসংগঠিত রূপে আত্মপ্রাকাশ করে এবং শামসুল হকের নেতৃত্বেই তত্‍কালীন পাকিস্তানে সর্ব প্রথম বিরোধীদল আওয়ামী লীগ গঠিত হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এই দলের বিজয়কে কেন্দ্র করেই দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালে জন্ম হয়েছে একটি জাতির, স্বাধীন দেশ "বাংলাদেশ"৷

নির্বাচিত হওয়া সত্তেও শামসুল হককে মওলানা ভাসানীর মত পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভায় আসন গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি৷ তাঁর বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলের আমির আলী মোকতার সামান্য নির্বাচনী ত্রুটির অজুহাতে শামসুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ এক সময় তিনিও এ আসনের প্রার্থী ছিলেন৷ লজ্জা জনক অবস্থায় জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া সত্তেও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এ মামলা করেন৷ প্রাদেশিক সরকারের বিচারপতি আমান উদ্দীন আহম্মদ, এনায়েতুর রহমান এবং শহর উদ্দিনকে নিয়ে একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করেন এবং সেই ট্রাইবুনালের উপর নির্বাচনী মামলাটির দ্বায়িত্ব অর্পিত হয়৷ ট্রাইবুনাল তাদের প্রথম বৈঠকে আইন বহির্ভূতভাবে বিধি জারি করেন যে মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত র্নিবাচিত প্রতিনিধি শামসুল হক ব্যবস্থাপক সভায় আসন গ্রহণ করতে পারবেন না৷ এই মামলাটি ছিল একদম ঠুনকো নির্বাচনী ইস্তেহার সংক্রান্ত৷ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল থেকেই পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন৷ এ নির্বাচনেও বাজে ওজুহাতে মুসলিম লীগ সরকার সদস্যপদ বাতিল করে দেয়৷ কারণটি ছিল মওলানা ভাসানী কপর্দকহীন মানুষ৷ কীভাবে নির্বাচনের বিরাট অংকের টাকা সংগ্রহ করলেন ? মওলানা ভাসানী রাগে দুঃখে অভিমানে আসাম চলে যান৷ কিন্তু ধুবড়ী শহরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আসাম সরকার আটক করে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন৷ সুতরাং তিনি এই ধুবরী জেলেই অবস্থান করছিলেন৷ শামসুল হকের সহকর্মী টাঙ্গাইলের সোনাট গ্রামের হজরত আলী টাঙ্গাইলের মটু মিয়া মওলানা ভাসানীর সঙ্গে ধুবরী জেলে দেখা করেন এবং শামসুল হকের একটি ইস্তেহারে স্বাক্ষর নিয়ে আসেন এবং এতে জেলারের কোন সিল এবং স্বাক্ষর ছিল না৷ ইস্তেহার বিলির মুহূতেই কমরুদ্দিন, শওকত আলী বদিউজ্জামান প্রমূখ তত্‍ক্ষনাত্‍ সে বিজ্ঞাপন বিলি বন্ধ করে দেন৷ কিন্তু তার পূর্বেই বেশ কিছু সংখ্যক বিজ্ঞাপন এলাকায় বিলি হয়ে যায়৷

বিজ্ঞাপনটি বিলি বন্ধ করার নির্দেশ সত্তেও তার কপি মুসলিম লীগ কর্মী এবং সরকারের হস্তগত হয়৷ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর এই মর্মে তারা শামসুল হকের নির্বচন বাতিলের আবেদন করে যে, নির্বাচনে তিনি ভাসানীর স্বাক্ষর জাল করে ফল লাভের উদ্দেশ্যে অসত্‍ পন্থা অবলম্বন করেন৷ তারা আরও বলে যে, মওলানার স্বাক্ষরযুক্ত বিজ্ঞাপনটিতে জেল কতর্ৃপক্ষের অনুমোদন নেই৷ সুতরাং বিজ্ঞাপনটি জাল তাতে কোন সন্দেহ নেই৷ সুতরাং নির্বাচনী বিজয় বাতিল করতে হবে৷

এই নির্বাচনী মামলা ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে এবং শহীদ সোহরোওয়ার্দী ট্রাইবুনালের সামনে শামসুল হকের পক্ষে সেই মামলায় উদ্দেশ্যে ঢাকা আসেন৷ এই সময় ১৯ জুলাই ১৯৫০ প্রাদেশিক সরকারের নির্দেশে স্বরাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারী তাকে জানালো যে, ঢাকায় অবস্থানকালে তাঁর নিজের কার্যাবলী নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে৷ ঢাকা শহরের বাইরে তিনি অন্য কোন জায়গায় যেতে অথবা কোন জনসভাতে বক্তব্য করতে পারবেন না৷ ট্রাইবুনালের কাজ শেষ হলে পরে সঙ্গে সঙ্গে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে তাঁকে পূর্ব বাংলা পরিত্যাগ করতে হবে এবং সরকারের এই নির্দেশ পত্র পাওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী সংবাদপত্র প্রতিনিধীদের কাছে তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের মঙ্গল ও উত্তরোত্তর উন্নতি কামনা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকার গণতন্ত্রের মূলনীতিকে কেন যে উপেক্ষা করে চলেছেন তার কারণ উপলব্ধি করতে তিনি অক্ষম৷ প্রায় ১ বত্‍সরকাল টাঙ্গাইলে নির্বাচনী মামলা চলার পর তার রায় বের হয় এবং শামসুল হকের নির্বাচনকে ট্রাইবুনাল বাতিল ঘোষণা করল৷

শামসূল হক রচিত আওয়ামী লীগের মূলদাবী ঃ
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে বিবেচনার জন্য শামসুল হক "মূলদাবী" নামে একটি ছাপা পুস্তিকাতে লিপিবদ্ধ তাঁর বক্তব্য পাঠ করেন৷ এই মূলদাবীই সম্মেলনের পর সামান্য পরিবর্তিত অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগে প্রথম খসড়া ম্যানিফেষ্টারূপে প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়৷ পুস্তিকাটির মুখবন্ধের প্রারম্ভে তিনি বলেন ঃ "১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন মনে করে যে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বদেশের যুগ প্রবর্তক ঘটনাবলীর ন্যায় লাহোর প্রস্তাব ও একটা নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি করে৷ বিরুদ্ধ পরিবেশে মানবের দেহ, মন ও মস্তিঙ্কের উন্নতি ও পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়৷ মানুষ পরিবেশের দাশ একথা আধুনিক গুণীজনও স্বীকার করেন৷ বিরুদ্ধ পরিবেশে পূর্ণ ইসলামিক মনোভাব এবং সমাজ বিধান গড়ে তোলা সম্ভব নয়৷ ভারতের মুসলমানগণ বহু শতাব্দী সঞ্চিত অভিজ্ঞতা হতে এ মহা সত্য উপলব্ধি করেই বিরুদ্ধ পরিবেশ বা দারুল হরবের পরিবর্তে ইসলামিক পরিবেশ বা দারুল ইসলাম কায়েম করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ছিল৷ কিন্তু পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র হলেও মুসলমানের জন্য প্রতিষ্ঠিত করবার এবং পাশ্চত্য সভ্যতা ও শিক্ষা প্রভাবিত ইসলাম বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী, ধনতান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক পরিবেশ গড়ে তুলবার ইচ্ছা তাদের ছিল না৷ শামসুল হকের লিখিত মূলদাবীকে স্রষ্টা ও সৃষ্টির কর্তব্য সম্পর্কে বর্ণানা করা হয়েছেঃ রব বা স্রষ্টা হিসেবেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব মানুষের সাথে আল্লার সবচাইতে ঘনিষ্ট সম্পর্ক৷ বস্তুতঃ রব বা স্রষ্ট্রা পালন বা পেসন কর্তা হিসেবে বিশ্ব ও সৃষ্টিকে ধাপের পর ধাপ, স্তরের পর স্তর, পরিবর্তনের পর পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে কতকগুলি স্থায়ী ও সাধারণ ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতির নিয়মানুসারে এক অবস্থা হতে অপর অবস্থার ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিতরূপে চরম সুখ, শান্তি ও পূর্ণতা প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে নেবেন৷ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে আল্লাহ্ শুধু মুসলমানের নয় জাতি ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবের৷ রবই আল্লাহর সত্যিকার পরিচয়৷ রব হিসেবে রবুনিবয়াত বা বিশ্ব পালনই তাঁর প্রথম ও প্রধান কাজ৷ সুতরাং দুনিয়ার উপর আল্লাহর খলিফা বা প্রতিভূ হিসেবে মানব এবং খেলাফত হিসেবে রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান কাজ ও কর্তব্য হল আল্লাহর উপায় ও পদ্ধতি অনুসারে বিশ্ব পালন করা জাতি ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সামাজিক সুখ শান্তি, উন্নতি কল্যাণ ও পূর্ণ বিকাশের জন্য চেষ্টা ও সাধনা ও সংগ্রাম করা৷

শামসুল হক মুসলিম লীগ সম্পর্কে পুস্তিকাটিতে আরও বলেনঃ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কখনও দল বিশেষের প্রতিষ্ঠান ছিল না৷ এটা ছিল ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের জাতীয় প্লাট ফরম বা মঞ্চ৷ এর উদ্দেশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের মূলনীতি গুলোকে কার্যকারী করে তুলতে হবে৷ প্রয়োজন নতুন চিন্তাধারা, নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতির ও কর্মসূচি এবং মুসলিম লীগকে মুসলিম জনগণের সত্যিকার জাতীয় প্লাট ফরম বা মঞ্চ হিসেবে গড়ে৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান পকেট লীগ নেতৃবৃন্দ্র উপযুক্ত কর্মপন্থা অনুসরণ না করে তাদের নিজেদের কায়েমী স্বার্থ এবং প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য মুসলিম লীগের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা ভেঙ্গে চলেছেন৷ এ উদ্দেশ্যেই তারা মুসলিম লীগকে দল বিশেষের প্রতিষ্ঠান করে ফেলেছেন৷ শুধু তাই নয় মানুষের প্রতি আর্শিবাদ স্বরূপ ইসলামকেও ব্যক্তি দল ও শ্রেণী বিশেষের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এবং অসাধুভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে৷ কোন পাকিস্তান প্রেমিক এমনকি মুসলিম লীগের ঝানু কর্মীগণ পর্যন্ত নীতি ও কর্মসূচী সম্পর্কে কোন রূপ প্রশ্ন উপস্থাপন করতে অথবা প্রস্তাব করতে পারে না৷ কেউ যদি এরূপ করবার চেষ্টা করে তাহলে তাকে পাকিস্তানের শত্রু বলে আখ্যায়িত করা হয়৷ মূল দাবীতে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলিতে বয়স্কদের ভোটাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, আইনের চোখে সমতা, ধর্মের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুদের ন্যয় অধিকার, দেশ রক্ষা অধিকার, বৈদেশিক নীতি, মানুষের সমান অধিকার, কাজ করার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, নারীর অধিকার ছাড়াও ইসলামী রাষ্ট্র এবং কৃষি পুর্ণগঠন ও শিল্প বিপ্লব সম্পর্কে যা বলা হয় তা বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য৷ ইসলামী রাষ্ট্রের রূপ সম্পর্কে তাতে বলা হয়ঃ
১৷ পাকিস্তান খেলাফত অথবা ইউনিয়ন আব পাকিস্তান রিপাবলিকস্ বৃটিশ কমনঅয়েলথের বাইরে একটি স্বাধীন সর্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হবে৷
২৷ পাকিস্তানের ইউনিটগুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রনের পূর্ণ অধিকার দিতে হবে৷
৩৷ তাড়াতাড়ি অর্ডিন্যান্স জারী করে তেভাগা দাবী মেনে নিতে হবে৷
৪৷ রাষ্ট্রের ধাপে ধাপে অবিলম্বে সমবায় ও ও যৌথ প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷
৫৷ নিম্নলিখিত বিষয়ে কৃষকদের অবিলম্বে সাহায্য করতে হবে ঃ
ক) সেচ ব্যবস্থার সুবিধা ও সার প্রস্তুতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন,
খ) উন্নত ধরনের বীজ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আমদানি ও উত্‍পাদন,
গ) সহজ ঋণ দান ও কৃষি ঋণ হতে মুক্তি৷
ঘ) ভূমি করের উচ্ছেদ না হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভূমিকর শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কমানো৷
ঙ) ভূমি করের পরিবর্তে কৃষি আয়কর বসানো৷
চ) খাদ্য শষ্য প্রভৃতি জাতীয় ফসলের সর্বনিম্ন ও সর্ব উর্ধ দর নির্ধারণ করে দিতে হবে এবং পাটের দর বেঁধে দিতে হবে৷
ছ) খাদ্য শষ্যের ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকা উচিত৷ পাট ব্যবসা ও বনানীর লাইসেন্স রহিত করতে হবে৷
জ) সকল রকমের সমবায় সমিতি গুলিকে সাহায্য ও উত্‍সাহ দিতে হবে৷
৬৷ কালে সমস্ত ভূমিকে রাষ্ট্রের জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করতে হবে এবং সরকারের অধিনায়কত্ব ও তত্বাবধানে যৌথ ও সমবায় কৃষি প্রথা খুলতে হবে৷
দেশীয় শিল্পকে নানা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মূল দাবীতে নিম্নলিখিত কর্মসূচীর উল্লেখ করা হয়ঃ
১৷ প্রাথমিক শিল্পগুলিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিনত করতে হবে৷ যেমনঃ যুদ্ধ শিল্প, ব্যাংক-বীমা, যান বাহন, বিদু্যত্‍ সরবরাহ, খনি, বন-জঙ্গল ইত্যাদি এবং অন্যান্য ছোট খাট শিল্প গুলিকে পরিকল্পনার ভিতর দিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রের তত্বাবধানে আনতে হবে৷
২৷ পাট ও চা শিল্পকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিনত করতে হবে এবং পাট ও চা ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকবে৷
৩৷ কুটির শিল্পগুলিকে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে বিশেষভাবে সাহায্য ও উত্‍সাহ দান করতে হবে৷
৪৷ বিল, হাওর ও নদীর উপর হতে কায়েমী স্বার্থ তুলে দিয়ে সরকারের কতর্ৃত্বাধীনে মত্‍স জীবিদের মাঝে যৌথ উপায়ে বন্টন করে দিতে হবে৷ সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মাছের চাষ ও মত্‍স ব্যবসার পত্তন করতে হবে৷ ফিশারী বিভাগের দ্রুত উন্নয়ন করে এই সমস্ত বিষয়ে শিক্ষা প্রসার করতে হবে ও উন্নত ধরনের গবেষণাগার খুলতে হবে৷
৫৷ শিল্প ও ব্যবসায়ে ব্যক্তিগত একচেটিয়া অধিকার থাকতে হবে৷
৬৷ ব্রিটিশের নিকট হতে স্টালিং পাওনা অবিলম্বে আদায় করতে হবে এবং তা দ্বারা যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে হবে ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে৷
৭৷ দেশের অভ্যন্তরীণ বৈদেশিক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালনা করবার ভার রাষ্ট্রকে গ্রহন করতে হবে৷
৮৷ সমস্ত ব্রিটিশ বৈদেশিক ব্যবসাকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিনত করতে হবে৷
৯৷ শিল্পে বৈদেশিক মূলধন খাটানো বন্ধ করতে হবে৷
১০৷ শিল্পে মুনাফার হার আইন করে বেঁধে দিতে হবে৷

শামসুল হক মূল দাবীতে সর্বশেষ নিম্নোক্ত আহবান জানান ঃ
মানব সভ্যতার চুড়ান্ত মুক্তি সংগ্রাম যাতে বিলম্বিত না হয় সেজন্য জনতাকে তাদের সমস্ত ব্যক্তিগত ও দলগত বিভেদ বিসর্জন দিয়ে এক কাতারে সমবেত হওয়ার জন্য মুসলিম লীগ কর্মী সন্মেলন আহবান জানাচ্ছে৷ সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের ফোঁস ফোঁস শব্দ আজ সমাজের আনাচে কানাচে সর্বত্র শোনা যাচ্ছে৷ সেই ফোঁস ফোঁস শব্দই যেন এ যুগের সঙ্গীত৷ আমাদের কওমী প্রতিষ্ঠান এই সরীসৃপদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে তাদের বিষদাঁত উত্‍পাটন করতে বদ্ধ পরিকর৷ হজরত আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ) বলেছিলেন ঃ যদি আমি ঠিক থাকি, তবে আমাকে অনুসরণ কর, আর যদি আমি ভ্রান্ত হই, আমাকে সংশোধন কর৷ আমরা সেই আদর্শকেই সামনে ধরে কওমী প্রতিষ্ঠান সমস্ত দেশবাসীকে সমতালে এগিয়ে আসতে আহবান জানাচ্ছে৷ আসুন আমরা কোটি কোটি নর নারীর সমবেত চেষ্টায় গণ আজাদ হাসিল করে সোনার পূর্ব পাকিস্তানকে, সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তুলি৷

শামসুল হকের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ, কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও তার কার্যকরী ভুমিকা ঃ
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব হতে দেশে খাদ্য শষ্যের সংকট দেখা দেয় এবং তা ১৯৫১ সালে দুর্ভিক্ষ রূপ ধারন করে৷ মানুষকে রাস্তা-ঘাটে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়৷ যারা বোঁচে আছে তারা খাদ্যের অভাবে মৃতু্যর দিন গুণছে৷ এদের মধ্যে কৃষক, জেলে, তাঁতী, মুচি, মেথর, হিন্দু ও মুসলমান সকলেরই একভাগ্য মৃতু্য৷ এই দুর্ভিক্ষ পূর্ব পাকিস্তানে প্রকট৷ পশ্চিম পাকিস্তানে কোন খাদ্য ঘাটতি নেই বরং খাদ্যশষ্য বিদেশে রপ্তানি করে পাকিস্তান সরকার তা মুনাফা ও টাকা উবৃত্ত গুণছে৷ কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধকল্পে সে রকম কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না৷ শামসুল হক ও তার গণতান্ত্রিক যুবলীগ নিয়ে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন৷ গণতান্ত্রিক যুব লীগ গঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর৷ শামসুল হক ছিলেন এর নেতৃত্বের পুরোভাগে৷ এ সংগঠন এ মাসের ১৮ ও ১৯ তারিখে গঠিত হয়৷ শামসুল হক নিজেই একটি সার্কুলার প্রস্তুত করে খাদ্য সংকট দূর করার জন্য সারা পূর্ব পাকিস্তানের যুব সমাজের কাছে অতিসত্বর পাঠিয়ে দেন৷ এর প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক যুব লীগের রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির উদ্দ্যোগে একটি সম্মেলন ঈশ্বরদীতে অনুষ্ঠিত হয়৷ শামসুল হক প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন৷ আরও যারা যোগদেন তাদের মধ্যে আতাউর, কমরুদ্দিন, মিসেস আনোয়ারা খাতুন, লিলি খান, প্রমূখ প্রধান৷ এতে গৃহীত ইস্তেহারে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব স্থান পায়৷ তাতে বলা হয়ঃ খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও৷ মুসলিম লীগ সরকারের আমলাতান্ত্রিক গাফিলতির মুখোস উম্মোচন করে দাও৷ জনগণকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোল৷ নবগঠিত গণতান্ত্রিক যুব লীগের প্রতি সরকারের শত্রুতাপূর্ণ আচরণের জন্য উপরে উল্লেখিত আচরণের কর্মসূচি অনুযায়ী কোন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হয়নি৷ তা সত্তেও এই সংগঠনের কর্মীরা সীমিতভাবে হলেও দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গঠনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন৷ এই সংকট সমাধান সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিছাড়া অন্যকোন চেষ্টাই হয়নি৷ তখন পর্যন্ত খাদ্য সংগ্রহের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয় নাই৷ বড় জোতদার, মজুতদার ও মহাজনদের কেশাগ্র স্পর্শ না করে সাধারণ কৃষকদের নিকট হতে ধান, চাল সংগ্রহ করাই সরকারের নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ মজুতদার, মুনাফাখোর মহাজন ও জোতদারকে তোষন করে কৃষকদের ধান আটক করা নীতিতে খাদ্য সংগ্রহ হতে পারে না৷ তারপর বিদেশ হতে খাদ্য আমদানির কোন উদ্যোগ গণবিরোধী মুসলিম লীগ সরকার করে নাই৷

যে খাদ্য সরকারের কাছে মজুদ আছে, প্রচার করছে তাতে সন্দেহ আছে৷ কারণ তার কোন বিতরণ ও বিভিন্ন দুর্ভিক্ষ উপদ্রুত এলাকায় বিতরণের পরিকল্পনা নেই৷ পরিকল্পনাহীন বিশৃঙ্খল প্রচার সর্বস্ব প্রক্রিয়ায় পূর্ব পাকিস্তান ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত হতে যাচ্ছে৷ খাদ্য সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে শামসুল হক যুব সমাজের পক্ষ থেকে নিম্নে বর্ণিত পদক্ষেপ গ্রহন করার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী করা হয়৷
১৷ কৃষকের নিকট হতে জোর জবরদস্তি বা বাধ্যতামূলকভাবে ধান চাল কেড়ে নেওয়া চলবে না৷ অবিলম্বে সমস্ত জোতদার, মজুদদার ও মহাজনদের নিকট হতে বাড়তি খাদ্য বাজেযাপ্ত করে নিতে হবে৷
২৷ ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে সমঝোতা করে অন্য দেশের সঙ্গে খাদ্য শষ্য আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে৷
৩৷ সরকার কতর্ৃক সংগৃহীত খাদ্য কাল বিলম্ব না করে ঘাটতি এলাকায় সস্তা দরে মানুষের কাছে সরবরাহ করতে হবে৷
৪৷ পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেক গ্রাম-গজ্ঞ শহরে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে৷ সেই সাথে রেশনিং এলাকায় আগামী ফসল না আসা পর্যন্ত সস্তা দরে খাদ্য শষ্য বিতরনের ব্যবস্থা করতে হবে৷
৫৷ যে সমস্ত পরিবার দুস্থ ও কপর্দকহীন অবস্থায় পড়েছে তাদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য রিলিফের ব্যবস্থা করতে হবে৷ বন্যা পিড়িত অঞ্চলে দ্রুত খাদ্য শষ্য পাঠাতে হবে৷
৬৷ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম সরকারের প্রত্যক্ষ নজরদারীতে কমাতে হবে৷
৭৷ কৃষকের ক্রয় শক্তি বৃদ্ধির জন্য অর্থকরী ফসল যেমন, পাট, চা ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধি করে সর্ব নিম্ন দর বেঁধে দিতে হবে৷ পাটের সর্বনিম্ন দর মনপ্রতি ৪০ টাকা বোঁধে দিতে হবে৷
৮৷ মজুদ ও মধ্যবিত্ত কর্মচারীদের মাহিনা বা বেতন বৃদ্ধি করতে হবে৷
৯৷ জিন্নাহ্ তহবিল হতে দুই তৃতীয়াংশ অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ ও বন্যা পিড়িতদের সাহায্যের জন্য বরাদ্দ করতে হবে৷

উপরে বর্ণিত কর্মসূচি যাতে যথাশীঘ্র কার্যকর করা সম্ভব হয় তার জন্য গণতান্ত্রিক যুবলীগ কর্মী সভা পূর্ব পাকিস্তানের যুব সমাজ ও জনগণের নিকট আহবান জানানো হল৷


১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলন ও আওয়ামী মুসলিম লীগের ভূমিকাঃ

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষাবস্থা মারাত্মক আকার ধারন করে একথা পূর্বেই বলা হয়েছে৷ রাস্তা-ঘাটে, গ্রাম-গজ্ঞে, মানুষকে না খেয়ে মরে থাকতে দেখা যায়৷ মানুষ এবং কাক-কুকুড়ে কাড়াকাড়ি বড়লোকদের উচ্ছিষ্ট নিয়ে৷ সর্বত্র দেখা যেত মানুষের কঙ্কালসার দেহ৷ দুটো ভাতের জন্য হাতে ভাঙ্গা টিনের থালা বা মগ নিয়ে ভিক্ষা করতে দেখা গেছে৷ খাদ্যের জন্য গ্রাম গজ্ঞ হতে বুভুক্ষ মানুষের ঢল শহরে চলে আসছে৷ রাস্তাঘাটে মরে পড়ে থাকা মানুষকে মাটি দেওয়ার লোক পাওয়া যেত না৷ ক্ষুধার্থ মানুষের আর্ত-আহাজারিতে ক্রমেই আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠতে লাগল৷

এই সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকার দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ না করে যারা দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন তাদের দমনের নির্মম পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং এ ব্যপারে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করে৷ সেই মোতাবেক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১১ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান আসেন৷ নামকা ওয়াস্তে দুর্ভিক্ষ সচক্ষে দেখার জন্য নয় আসছেন আসলে আওয়ামী লীগ, যুব লীগ ও ছাত্র লীগের কর্মীদের নির্মমভাবে দমনের জন্য৷ লিয়াকত আলীর ঢাকা উপস্থিত কালে সারাদেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা এবং প্রদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগ এ দিনই আরমানি টোলা ময়দানে একটি সভার এবং অপর একটি বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে৷ এই সভা ও বিক্ষোভ মিছিল যথা সময়ে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়৷ প্রথম পর্যায়ে এই বিক্ষোভ বন্ধ রাখার জন্য চাপ প্রয়োগ করলেও নেতা কর্মীরা তাতে রাজি না হয়ে সভা এবং বিক্ষোভের কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন৷

এ জনসভাগুলো শামসুল হক এবং শেখ মুজিব অত্যন্ত প্রাণবন্ত করে তোলেন৷ তাদের উভয়ের বক্তব্যই সরকারের বিরুদ্ধে সাড়াশি আক্রমন ছিল৷ এক পর্যায়ে শেখ মুজিব এদেশের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরনের কথা উল্লেখ করে খুব উত্তেজনাপূর্ন বক্তব্য রাখেন৷ তিনি দুর্ভিক্ষে শত শত লোক মারা যাওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী নূরুল আমিনকে দায়ী করেন এবং তাকে প্রকাশ্যে জন সভায় এনে গুলি করে হত্যার হুমকি প্রদান করেন৷ এই সভায় পূর্ব বাংলার মন্ত্রী সভার বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন পূর্বক মন্ত্রী সভার ব্যাপারগুলি তদন্ত করে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করে প্রস্তাব গৃহীত হয়৷ পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে প্রাপ্ত বয়স্কদের সার্ব জনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পুনঃ নির্বাচনের দাবী জানান হয়৷ সভার পর পাঁচ সহস্রাধিক লোকের মিছিল হয়৷ মিছিলটি আরমানিটোলা হয়ে বাবু বাজার পাড় হয়ে নবাব পুরের দিকে যায়৷ সরকারের পেটোয়া বাহিনী নবাব পুরের রেল ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়ার ফলে মিছিল ফুল বাড়িয়া রেল ষ্ট্রেশনের নাজিরা বাজার রেল ক্রসিং এর সামনে উপস্থিত হয়৷ সেখানেও গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ এস. ডি. ও উত্তর সেই সময় সেখানে উপস্থিত হন৷ তার সাথে মিছিলে নেতৃত্বদানকারী শেখ মুজিব ও শামসুল হকের উত্তপ্ত বাক যুদ্ধ হয়৷

মওলানা ভাসানীর অভ্যাস ছিল যেখানেই নামাজের সময় হত সেখানেই তিনি নামায আদায় করতেন৷ নামাজের সময় হয়েছে দেখে মওলানা ভাসানী রেলক্রসিং এর পার্শে নামায পড়তে দাঁড়িয়ে যান৷ তার উপর পুলিশের লাঠিপেটা আঘাত নিবারণ করে শওকত আলী তাদেরকে হঠিয়ে দেন৷ তার সাথেও এস, ডি, ও সাহেবের তর্ক-বিতর্ক হয়৷ পুলিশ এই পর্যায়ে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে আরম্ভ করে৷ পুলিশের নির্দয় আক্রমনে মিছিলকারীরা চারদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়৷ শামসুল হক সহ ১১ জন নেতা কর্মী ঐখানেই গ্রেফতার হন৷ শেখ মুজিব, কাজী গোলাম মাহবুব, আব্দুল ওয়াদুদ, শওকত আলী প্রমুখ নাজিরা বাজার রেল ক্রসিং থেকে দৌড়ে ১৫০ নং মোগলটুলি অফিসে উপস্থিত হন৷ শওকত আলী তখন ঐ বাড়িতে থাকতেন৷ তিনি জানান যে ওখানে থাকা নিরাপদ নয়৷ কিন্তু শেখ মুজিব সে সময় অন্যত্র যেতে রাজি হলেন না৷ শওকত আলী তাদেরকে বাহির হতে তালা লাগিয়ে সাবধান করে গেলেন যে, তারা যেন বাহিরে না আসেন৷ বলা যায় না পরিস্থিতি উত্তপ্ত৷ পুলিশ তাদেরকে আটক করতে পারে৷ রাত তিনটার দিকে পুলিশ তালা ভেঙ্গে মোগলটুলির বাড়িতে ঢোকে৷ ভিতরে যারা ছিলেন তারা এর পূর্বেই ওপর থেকে অন্য বাড়ি হয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন৷

১২ অক্টোবর পল্টন ময়দানের এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বিভেদ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে হুশিয়ার দিয়ে বলেন যে, তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে৷ ১৯৫০ সালের ১৪ আগষ্ট এক ভাষণে লিয়াকত আলী খান বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ্রকে ভারতের লেলানো কুকুর বলে গালমন্দ করেন৷ তার এই ভাসণের পর থেকে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবর রহমান সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের উপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন৷ লিয়াকত আলী খানের নির্দেশে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধকারীদের নির্যাতন শুরু হলেও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য সরকারীভাবে বাস্তব কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি৷ ক্রমান্বয়ে খাদ্য পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে৷ দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে৷ শামসুল হক জেলে যাবার পর দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য কোন আন্দোলন হয়নি৷

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়৷ এর অনেক আগ থেকেই নবলব্ধ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির ধুম্রজাল সৃষ্টি হচ্ছিল৷ জানা যায় ভারতীয় মুসলীম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে ভাষার প্রশ্নে উদর্ুর্কে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয়৷ এতে পূর্বাঞ্চলের দালালবর্্বস্ব নেতারা ভক্তি গদগদ কন্ঠে তাতে সায় দিয়ে আসেন৷

ভারত রাষ্ট্রের অধিকাংশ অঞ্চলের ভাষা হিন্দী ছিল৷ তাই সেখানে অতি সহজেই ভারত রাষ্ট্রের সরকারি ভাষা হিন্দী হবে মহত্মা গান্ধী এর সমাধা দিয়ে দিলেন৷ কিন্তু পাকিস্তানে এর কোন সঠিক কিছু দেখা গেল না৷ তার কারণও অবশ্য বিদ্যমান ছিল৷ পাকিস্তানের দু অংশের মাঝখানে ১২০০ মাইল ব্যবধান৷ পশ্চিম পাকিস্তানে নানা ভাষা ভাষী মানুষের বাস৷ সেখানকার একেক অঞ্চলের ভাষা একেক রকম৷ পাঞ্চাবে পাঞ্চাবী ভাষা, বেলুচিস্থানে বালুচ, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ভাষা পশতু প্রভৃতি৷ এ রকমভাবে নানা ভাষার বেড়াজাল৷ উদর্ু ছিল মাত্র দু'ভাগ মানুষের ভাষা৷ তাও তারা ছিল দিল্লী, আলীগড়, আজমীর, প্রভৃতি স্থান হতে আগত মহাজের শ্রেণীর মানুষ৷ বসত গড়েছে পশ্চিম খন্ডের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা জায়গায়৷ সুতরাং ওখানে কিছুতেই ভাষার মতে এক হওয়া যাচ্ছিল না৷ কিন্তু পূর্বঞ্চল বাসীদের ভাষার প্রশ্নে কোন জটিলতা ছিল না৷ এখানকার শতকরা ১০০ জনের ভাষাই ছিল বাংলা ভাষা৷ আর জন সংখ্যার দিক দিয়ে এখানে তুলনামূলভাবে ৫৬% আর ওখানে ৪৪%৷ আগেই সরকারি ভাষা প্রশ্নে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হোক এটা কাম্য ছিল জনগণের৷ কিন্তু বাংলার মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেল এক অনভিপ্রেত কান্ড৷ ১৯৪৭ সালে জুলাই মাসের গোড়ার দিকে ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চেন্সেলর ডক্টর জিয়া উদ্দিন আহমদ হঠাত্‍ ঘোষণা দিয়ে বসলেনঃ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উদর্ু৷ পশ্চিম পাকিস্তানীরা একথা নির্বাকে মেনে নিলেও পূর্ব পাকিস্তানে আগুনে ঘৃতাহূতি হল৷ একে একে সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়তে আরম্ভ করল৷ তবে এর প্রবন্ধাকারে প্রতিবাদ জানালেন জ্ঞান তাপস ও বিভিন্ন ভাষাবিদ পন্ডিত ডক্টর মোঃ শহিদুল্লা৷ তিনি তত্‍খনাত্‍ আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে যুক্তি তুলে ধরলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা, অফিস আদালতেরর ভাষা বাংলা হবে এবং রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবেও তিনি বাংলার দাবীকে অগ্রহন্য বলে উল্লেখ করলেন৷ একথা পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হওয়ার অব্যবহিত পরে ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর অর্থত্‍ ৮ দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেমের সম্পাদনায় ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষার দাবীতে পুস্তিকা প্রকাশ করলেন৷ এতে নিবন্ধ লেখেন ডঃ কাজী মোতাহার ও আবুল মুনসুর৷ গণতান্ত্রিক যুব লীগের পক্ষ থেকে ভাষা সৈনিক, ভাষা আন্দোলনের রূপকার শামসুল হক রাজনৈতিক ও সংগঠিতভাবে দাবি উত্থাপন করেন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলাতো রাষ্ট্রভাষা হতেই হবে৷ পশ্চিম পাকিস্তানে ভাষা কি হবে এবং সেই সঙ্গে দ্বিতীয় ভাষা কি হবে তা জনগণের উপর ছেড়ে দেওয়া হোক৷
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত রাষ্ট্রের পোস্টকার্ডে, এনভেলাপে, মানি ওর্ডার ফরমে, মুদ্রায় ইত্যাদিতে ইংরেজীর পাশাপাশি উদর্ু ব্যবহার শুরু হলে বাংলাদেশের মানুষের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়৷ তারা মনে করলেন উর্দু তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে৷ আদতেই হচ্ছিল তাই৷ ১৯৪৭ সালেই ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন শুরু হয় এবং প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন হয়৷ আহবায়ক নিযুক্ত হন তিনি টাংগাইলের আর একজন কৃতি সন্তান ঘাটাইলের শামসুল আলম৷ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ অবাক হয়ে দেখতে পেল ১৯৪৭ সালের সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তখন আর কারও সন্দেহ রইল না যে রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে কি জঘণ্য ষড়যন্ত্র চলছে শাসক গোষ্ঠির মধ্যে৷ সুতরাং শামসুল হক আহবান জানান আমরা বাংলা ভাষা ভাষী যারা আছি, যে যেভাবে এবং যেখান থেকেই হোক আন্দোলন গড়ে তোল৷ সময় আর নেই৷ প্রতিবিধান না করে বসে থাকলে চলবে না৷ শাসক শোষক ও গণবিরোধীদের রুখতে হবে৷

১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রয়ারী থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সপ্তাহকাল ব্যাপী কলকাতায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যুব সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ গণতান্ত্রিক যুব লীগের পক্ষ থেকে এতে শামসুল হক, আব্দুর রহমান চৌধুরী, শহিদুল্লা কায়ছার, লিলি খান, লায়লা আরজুমান্দ এই বানু কমরুদ্দিন, শওকত আলী প্রমুখ যোগদান করেই এই পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের সমর্থন আদায় করেন এবং নাজিমউদ্দিণ গণ পরিষদের উক্তির প্রতিবাদ ও গণ পরিষদের সদস্য ধীরেন নাথ দত্তকে অভিনন্দন জানান৷

গণ পরিষদের সিদ্ধান্ত এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের বাংলা ভাষা বিরোধী কার্য কলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলা মুসলীম ছাত্রলীগ বিভিন্ন ছাত্রাবাস এবং তমুদ্দিন মসলিমের যৌথ উদ্দ্যেগ্যে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে সাংষ্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভা আহবান করা হয়৷ যারা এ সভায় উপস্থিত হন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে শামছুল হক, রমেশ দাস গুপ্ত, আজিজ আহম্মেদ, অজিত গুহ, আবুল কাশেম সরদার, ফজলুল করিম, শামস উদ্দিন, তোফাজ্জল আলী, আলী আহম্মেদ, মহিউদ্দিন, শামছুল আলম, শওকত আলী, আব্দুল আউয়াল, মহম্মদ তোয়াহা, অলী আহাদ, শহীদুল্লা কায়ছার, লিলি খান, তাজউদ্দিন আহম্মেদ, প্রমুখের নাম উল্লেখ যোগ্য৷ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কামরুদ্দিন আহম্মেদ৷

ভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠ ও সাংগঠনিক রূপ দেয়ার জন্য এই সভায় রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সর্বদলীয় পরিষদ গঠিত হয় এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগ গণ আযাদী লীগ, তমুদ্দুন মজলিশ, সলিমুল্লা মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলীম হল ইত্যাদি ছাত্রাবাস থেকে ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রাবাস এদের প্রত্যেকটি থেকে দু'জন করে প্রতিনিধি তার সদস্য হিসাবে মনোনীত হন৷ সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক হিসেবে মনোনীত হন শামছুল আলম৷ বাংলাকে পাকিস্থানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার তালিকা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়ার সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ১ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট আহবান জানিয়ে অপর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়৷ ১১ মার্চ আয়োজিত সাধারণ ধর্মঘট সাফল্য মন্ডিত করার আহ্বান জানিয়ে শামছুল হক, নঈম উদ্দিন আহমদ, তফাজুল আলী, এম, এল, এ মিসেস আনোয়রা খাতুন এম, এল, এ, আলী আহমেদ, এস, এম, ফজলুল হক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম চৌধুরী ৩ মার্চ ঢাকা থেকে একটি বিবৃত্তি প্রদান করেন৷ বিবৃতিটি কলকাতার অমৃত বাজার ইংরেজী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ তার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলঃ (১) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্থ্নের প্রাদেশিক ভাষা ও পাকিস্তান গণ পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবিতে কিছু কাল যাবত্‍ ব্যাপক আন্দোলন চলছে৷ বিবৃতির শেষ ছিল আমরা দুই তৃতীয়াংশ অধিবাসী বাংলায় কথা বলি৷ অথচ পরিতাপের বিষয় যে এই ভাষাকে রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্র লীগ ও তমুদ্দীন মজলিস ১১ মার্চ রোজ বৃহষ্পতি বার সাধারণ হরতাল ঘোষণা করেছেন৷

১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট৷ রাষ্ট্র ভাষা কর্ম পরিষদ ১০ মার্চ ফজলুল হক হলের বৈঠকে প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়৷ প্রত্যেক হল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে এই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ তৈরী করা হয়৷ এই বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে শামসুল হক (আওয়ামী লীগের প্রথম সম্পাদক) মহম্মদ তোয়াহা বামপন্থী নেতা ও তাজউদ্দিন আহাম্মদ (একাত্তরের মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী পরে কারাগারে নিহত)৷ সরদার ফজলুল করিম (ঢাকা ভার্সিটির অধ্যাপক) কমরুদ্দিন, (পরে রাষ্ট্রদুত) আনোয়ারা খাতুন (প্রাদেশিক পরিষদের এক সময়ের সদস্য) অধ্যাপক আবুল কাশেম (তমুদ্দুন মজলিশের সাধারণ সম্পাদক) শামছুল আলম, অজিত কুমারগুহ, রমেশ দাশ গুপ্ত, নঈম উদ্দিন, লিলি খান, সলিমুল্লা মুসলিম হলের ঘাটাইল নিবাসী টাংগাইলের কৃতি সন্তান শামছুল আলমকে সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদের আহবায়ক নিযুক্ত করা হয়৷

১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘটকে সফল্য মন্ডিত করার জন্য শহরে ব্যাপক ভাবে পরদিন পিকেটিং করা জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ কে কোথায় কখন পিকেটিং করবে তারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ এদিন সকালের দিকে রমনা ডাকঘরের সামনে যে সমস্ত ছাত্ররা পিকেটিং করে তাদেরকে পুলিশ ঘিরে ফেলে আটক করে এবং পরে কোতয়ালী থানায় নিয়ে রাতে ছেড়ে দেয়া হয়৷ হাই কোর্টের সামনে বিক্ষোভ চলাকালে সেখানে এ, কে, ফজলুল হক সহ অন্যান্য উকিলরা ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করেন৷ ছাত্ররা তাদেরকে কোর্ট বর্জন করতে অনুরোধ করে৷ সে দিনের মত তারা কোর্টে না গিয়ে বাসায় ফিরে যান৷ শামছুল হক, শেখ মুজিব, আলি আহম্মদ, কামরুদ্দিন, ফজলুল করিম, গোলাম মাহবুব, বরকত প্রমূখ, সেক্রেটারির দু\'গেটের সামনেই শক্ত বাঁধার সৃষ্টি করে বিক্ষোভ করছিলেন৷ নেতৃত্বের পূরোভাগে ছিলেন শামছুল হক৷ পুলিশ তাকে, শেখ মুজিবকে, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলীকে গ্রেফতার করে ওয়াইজ ঘাট থানায় নিয়ে আটক করে৷

তারপর ১২, ১৪ ও ১৫ মার্চ অনবরত ধর্মঘট চলতে থাকে৷ এতে সারা দেশসহ ঢাকা অচল হয়ে পড়ে৷ বাধ্য হয়ে নাজিমুদ্দিন ৭ দফার চুত্তিতে স্বাক্ষর করলে ধর্মঘটের অবসান হয়৷ তাতে ভাষা সহ বন্দীদের মুক্তি দেয়ার শর্ত থাকে৷
চুক্তি মোতাবেক ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় শামছুল হক সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ্র জেল থেকে বেরিয়ে আসেন৷ মুক্তির পর তাদের একটি ট্রাকে চড়িয়া শহর প্রদক্ষিণ করান এবং সন্ধ্যায় ফজলুল হক হলে তাদের সম্বর্ধনা দেয়া হয়৷

১৬ মার্চ সাধারণ সভা থাকলেও সভা শেষে পরিষদ ভবন ঘেরাও করে স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার, মত্রীবর্গ ও কয়েকজন সদস্য কে ছাত্ররা সন্ধ্যা পর্যন্ত আটক করে রাখে৷ পরে পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে তাদেরকে মুক্ত করে৷
এই অবস্থায় ঢাকা শহরে ১৭ ও ১৮ মার্চ ধর্মঘট বিক্ষোভ সভা সমাবেশ চলতে থাকে৷ সুচতুর গভর্ণর জেনারেল জিন্নাহ এ অবস্থা দেখার জন্য ১৯ তারিখে ঢাকা আগমন করেন৷ এর আগে হোসনে শহীদ সোহরোওয়ার্দী মুসলীম লীগ সমর্থক বগুড়ার মহম্মদ আলী কুষ্টিয়ার ডাঃ আব্দুল মোতালেব, কুমিল্লার তোফাজ্জল আলী কে রাষ্ট্রীয় মন্ত্রীত্ব, রাষ্ট্র দূত প্রভৃতি পদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলনকে ব্যাহত করার চেষ্টা করেন৷ তিনি ১৯ মার্চ ঢাকায় আগমন করেন এবং ২১ মার্চ ঢাকায় রেস কোর্স ময়দানে নাগরিক সম্বর্ধনায় যোগদান করেন৷ ভাষণে বলেনঃ উর্দূ এবং একমাত্র উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা৷ সাথে সাথে শামছুল হক নো নো বলে দাঁড়িয়ে যান৷ সাথে সাথে অন্যান্য ছাত্র জনতাও প্রতিবাদ করেন৷
মিঃ জিন্নাহ রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নিলেন এবং ২৪ মার্চ রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে সন্ধ্যায় তার চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহম্মদের বাসায় এক ঘরোয়া আলোচনায় মিলিত হন৷ এই সাক্ষাতের সময় সংগ্রাম পরিষদের কর্ম পরিষদ সদস্য শামসুল হক কমরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম , তাজউদ্দিন আহমদ, মুহম্মদ তোয়াহা , আজিজ আহমদ, আলি আহাদ, নঈম উদ্দিন, শামসুল আলম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন৷

গভর্ণর জেনারেল মিঃ জিন্নাহ প্রথমেই নাজিম উদ্দিনের ভাষা কর্ম পরিষদের বৈঠকে নাজিম উদ্দিনের চুক্তি মানেন না৷ এ চুক্তি ছিল জোর পূর্বক তারা নাজিম উদ্দিনের কাছ থেকে স্বীকৃতি স্বাক্ষর আদায় করে৷ আর চুক্তি অবৈধচুক্তি হলে উভয় পক্ষের স্বাক্ষর থাকতে হবে৷ কিন্তু এ চুক্তিতে এক পক্ষের স্বাক্ষর নাজিমুদ্দিনের অন্য পক্ষ ভাষা কর্ম পরিষদের স্বাক্ষর নেই৷ সুতরাং তা বাতিল৷ এতে উভয় পক্ষের ভীষণ তর্ক বিতর্ক শুরু হয়৷ ভাষা প্রশ্নে মিঃ জিন্নাহ্ অনড় থাকেন এবং সমগ্র উদর্ুর পক্ষে এক ভাষা না হলে দেশের নিরাপত্তা বিঘি্নত হবে৷ এতে তোয়াহা কানাডা, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের উদাহরণ মিঃ জিন্নাহ্র কথা খন্ডন করলেন৷ তাতে মিঃ জিন্নাহ্ রেগে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে চাইলেও পারেন নাই৷

ইতোমধ্যে এশার নামাযের সময় হয়েছে শামসুল হক মিঃ জিন্নাহ্ কে স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি আরও ক্ষেপে যান৷ কারণ তিনি নামায পড়তেন না৷ এতে যারপর নেই চটে যান৷ তিনি মনে করেন শামসুল হক তাকে ঠাট্টা করার জন্যই নামাজের কথা বলেছেন৷ আদতে শামসুল হক খুব নামাযী ছিলেন, তাই মিঃ জিন্নাহ্ কে তিনি ও কথা বলেছিলেন৷ এর পরও শামসুল হকের সাথে তার অনেক বাকযুদ্ধ, বাদানুবাদ হয়েছিল৷ ফলকথা মিঃ জিন্নাহ্ তাদের কোন দাবীই মানেন নি৷ এরকম অপরিসমাপ্তি বাক বিতন্ডায় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ কিছু আদায় না করতে পারলেও ভবিষ্যত্‍ আন্দোলনের বীজ ভালভাবেই রোপন করে ছিলেন৷

এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মহম্মাদ আলীর মৃতু্য ঘটে৷ খাজা নাজিমুদ্দিন পরবর্তি গর্ভণর জেনারেল নিযুক্ত হন এবং নূরুল আমিন হন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী৷ শামসুল হক ১৯৪৯ সাল হতে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে ও মামলা সংক্রান্ত ঝামেলায় ব্যাপৃত থাকায় ভাষার প্রশ্নে তেমন অগ্রসর হন নাই৷ খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী তার সম্মানে এক জন সভায় পল্টন ময়দানে ঘোষণা দিলেন উর্দ্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা৷ এর বিরুদ্ধে তিন দিন পর অর্থাত্‍ ৩০ জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার সমর্থনে এবং রমনা এলাকায় শামসুল হকের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল হয়৷ বিকেলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে বিরোধী দলীয় কর্মী সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ শামসুল হক এ থেকেই আবার রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন শুরু করেন৷ পরদিন বৃহস্পতি বার ঢাকা বার লাইব্রেরীতে একটি সর্বদলীয় সভা আহবান করা হয়৷ দল মত নির্বিশেষে এ সভায় সংশ্লিষ্টরা যোগদান করলে মওলানা ভাসানী এ সভার সভাপতিত্ব করেন৷

এই সর্বদলীয় কর্মী সভায় শামসুল হক, আবুল হাশিম, খালেক নেওয়াজ খান, কমরুদ্দিন আহম্মদ, আবুল কাশেম, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহম্মদ, অলি আহাদ, শামসুল আলম সহ প্রমুখ নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন৷ ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য সভায় বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্র সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়৷

৪ ফেব্রয়ারি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের আহবানে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবীতে রাজধানী ঢাকা নগরীতে ছাত্র ধর্মঘট গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনে ছাত্র-সভা সহ প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট আহবানের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়৷ ভাষার দাবী সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয়৷ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং তা পরিচালনার অর্থ সংগ্রহের জন্য ১১ ও ১৩ই ফেব্রয়ারি পতাকা দিবস পালন করা হয়৷ এই সভায় মওলানা ভাসানী শামসুল হক, গোলাম মাহাবুব, গাজীউল হক, কমরুদ্দিন, আবুল কাশেম, শামসুল আলম সহ প্রায় সব নেতাই উপস্থিত থাকেন এবং দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রেখে সভাকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলেন৷ এই দিবসকে সাফল্যের সঙ্গে পালনের মূল কৃতিত্ব পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ আর এর নিশান ফরমা বরদার ছিলেন শামসুল হক৷

২০ ফেব্রয়ারি ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির বৈঠক বসে সন্ধ্যায় ৯৪ নবাবপূর রোডস্থ আওয়ামীলীগ অফিসে৷ এতে সভাপতিত্ব করেন খেলাফতে রাব্বানী পার্টির নেতা জনাব আবুল হাশিম৷ এখানে উল্লেখ করা দরকার শামসুল হকের মত আবুল হাশিমকেও মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করে স্বার্থ বাদীরা৷ এটা ছিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের জরুরী বৈঠক৷

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে আন্দোলন কারীদের সঙ্গে একাত্বতা ঘোষণার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য কয়েকজন রাজবন্দীদের মধ্যে শওকত আলী, শেখ মুজিবর রহমান অনশন ধর্মঘট শুরু করেন৷ ঢাকায় সরকার ২১ ফেব্রয়ারি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ১৪৪ ধারা জারী করেন৷ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সামনে তখন একটাই প্রশ্ন আর তা হল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা যাবে কিনা৷ অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে বলেন যে, সেটা করলে তার পরিনতি হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না৷ আবুল হাশিম, কমরুদ্দিন আহম্মদ, খরবাত হোসেন প্রমূখ নেতারাও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে একই ধরনের বক্তব্য প্রদান করেন৷ অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, যুক্তি সহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে তীক্ষ্ণ ধারালো অভিমত রাখেন এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য মরনপণ জেদ ধরেন৷

কোন সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে সর্বদলীয় কমিটির বৈঠক গভীর রাত পর্যন্ত চলে৷ অবশেষে কমিটির বিবেচনার জন্য শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করা এবং পরদিন ২১শে ফেব্রয়ারির কর্মসূচী বাতিলের এই প্রস্তাবটি পেশ করেন৷ প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে অলি আহাদ ও আব্দুল মতিন, প্রবল আপত্তি জানালে প্রস্তাবটি ভোটে প্রদান করা হয়৷ অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গোলাম মাহাবুব, গাজীউল হক প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে ভোট দেন৷ মহম্মদ তোয়াহা ভোট দানে বিরত থাকেন৷ কারণ তিনি ছিলেন বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী৷ তার উপর থেকে নির্দেশ ছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ এবং ভোট দানে যেন বিরত থাকেন৷ তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ বজায় রাখতে পেরেছিলেন৷ আব্দুল হাসিম, শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহম্মেদ, খয়রাত হোসেন, কাজী গোলাম মাহাবুব সহ এগার জন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন৷ ভোটে পরাজিত হবার পর অলি আহাদ সবার উদ্দেশ্যে হুমকি দেন যে, আগামীকাল যে কোন মূল্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবেন৷ এর উত্তরে সভাপতি আবুল হাশিম অবশ্য বলেন যে, তাহলে সর্ব দলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে৷ এ কথাটাও প্রস্তাবের মধ্যে গণ্য হবার পর সভাপতি শেষ হয়ে যাওয়ার আগে তৃতীয় একটি প্রস্তাব ২০ তারিখের এই বৈঠকে গৃহীত হয়৷ আর তা হলো ২১ ফেব্রয়ারি সকালে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব বিদ্যালয় সভায় সর্ব দলীয় কমিটির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া ও ব্যাখ্যা করার জন্য শামসুল হকের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়৷
হলগুলির মধ্যে তৃতীয় আরেকটি গ্রুপ ইতোমধ্যে সোচ্চার হয়ে উঠে৷ গভীর রাতে ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে ১১ জন ছাত্রনেতার বৈঠক এবং ২১ ফেব্রয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে৷ এ গোপন বৈঠকের খবর প্রথম এবং দ্বিতীয় গ্রুপের কেউই জানত না৷ এই ছাত্র নেতাদের মধ্যে ছিলেন গাজীউল হক, মোহাম্মদ সুলতান, হাবিবুর রহমান শেলী, এম, আর, আকতার মুকুল, জিল্লুর রহমান, কমরুদ্দিন, আব্দুল মোমিন, আনোয়ারুল হক খান, ডঃ মঞ্জুর হোসেন, এস, এ বারী, এটি ও আনোয়ার হোসেন৷

২১ ফেব্রয়ারি ও শামসুল হক
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রয়ারী ছিল বৃহস্পতিবার৷ সেদিন খুব সকাল থেকেই দলে দলে ছাত্র/ছাত্রীরা ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ হল থেকে এসে বিশ্ব বিদ্যালয়ের কলা ভবনে আম তলায় সমবেত হতে থাকে৷ বেলা ১১ নাগাদ তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় তিরিশ হাজারে৷ চারদিকে শুধু গগণ বিদারী মুহর্ূমুহু শ্লোগান- "রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই"৷ এ শ্লোগানে মুখরিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্র/ছাত্রীরা মাতোয়ারা৷ এমন সময় শামসুল হক এসে উপস্থিত হলেন৷ তাঁর স্বভাবজাত পোষাক ছিলঃ গায়ে চাপানো কালো রং এর শেরওয়ানী ও সাদা পাজামা আর মাথায় ছিল জিন্নাহ্ ক্যাপ৷ তিনি এসে বসলেন মধুর রেস্তেরায়৷ এখানে উপস্থিত সকল ছাত্রকে এ কথাটি বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা ঠিক হবে না৷ সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা মেনে চলা উচিত৷

কিন্তু তার এ বক্তব্য শোনার মত মানসিক অবস্থা তখন ছাত্রদের অনেকেরই ছিল না৷ ছাত্ররা চারদিক থেকে উত্তেজিত হয়ে নানা প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করছিল৷ তিনি সংযত অথচ দৃঢ় আত্ম প্রত্যয় নিয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন৷ সমবেত ছাত্রদের অসহিষ্ণু হাসান হাফিজুর রহমান ভয়ানক উত্তেজিত ভাবে শামসুল হককে অসৌজন্য মূলক উক্তি করেন৷ তার মাথা থেকে টুপি নিয়ে দূরে ছুড়ে মারেন এবং আরও বলেন যে, তুমি বিশ্বাস ঘাতক, তোমার কথা বলার কোন অধিকার নেই৷ তুমি বেরিয়ে যাও৷

এতে জনাব শামসুল হক এতটুকুও বিচলিত হলেন না৷ গণতন্ত্রের প্রবক্তা ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির নিশান বরদার এই অগি্ন পুরুষ সেদিন চরম ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছিলেন৷ শান্ত অথচ নির্ভীক ভাবে বক্তব্য পেশ করেছিলেন বিশ্ব বিদ্যালয় কলা ভবনের আমতলার ভাষাসৈনিক ছাএদের সমাবেশে৷

পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক এম, আর, আকতার মুকুলের প্রস্তাবে এবং কমরুদ্দিন আহম্মেদের সমর্থনে গাজী উল হক এই ঐতিহাসিক সভার সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন৷
এবার নেতাদের বক্তব্য দেবার পালা৷ সভাপতি সর্বপ্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শামসুল হককে তার বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ করেন৷ এতে কিছু ছাত্র দ্বিমত পোষণ করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি তার বক্তব্য যুক্তি সহ পেশ করেন৷ শামছুল হক অত্যন্ত রাগী লোক ছিলেন৷ সাহস ছিল অসাধারন৷ চমত্‍কার ভাবে অদুর ভবিষ্যতের দুঃখ জনক পরিনতির প্রেক্ষিতে কি ঘটতে পারে তা উল্লেখ করেন৷ অনির্দিষ্ট কালের জন্য, ৫৪ এর সাধারন নির্বাচন স্থগিত হতে পারে৷ গণতন্ত্রকে এ স্বৈরাচারী সরকার গলাটিপে হত্যা করতে পারে৷ ১৪৪ ধারা জারী আছেই৷ সুতরাং মিছিল হলে গুলি হবে৷ আন্দোলন আগুনে পরিনত হবে৷ সারা দেশে সাংগঠনিক শক্তি নেই৷ দেশ প্রস্তুত নয়৷ সর্বোপরি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে অকাট্য বক্তব্য রাখেন তিনি৷ তিনি একজন গুরুত্ব পূর্ণ উদীয়মান তদুপরি তিনি ছিলেন তত্‍কালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক৷ অবশ্য বক্তৃতার পর সভাস্থল ত্যাগ করার পূর্বে তিনি ব্যক্তি গত ভাবে আন্দোলনের পক্ষে সমর্থনের কথা অকপটে জানিয়ে দেন৷ জনাব হকের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক জনাব আব্দুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বক্তব্য পেশ করেন৷ এটাই সিদ্ধান্ত তা তিনি জানিয়ে দেন৷ এই সময় সিলেটের ছাত্রনেতা আব্দুস আযাদ (আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী হন পরবর্তীতে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার কৌশল হিসেবে দশজনী মিছিলের প্রস্তাব করেন৷ তুমুল করতালির মাধ্যমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ সভা ঘন্টা খানেক চলার পর সমপ্ত হয়৷

শামছুল হকের মতের বিরোধী বামপন্থী নেতা সাবেক ন্যাপ ভাসানী ভাষা আন্দেলনের সক্রিয় অংশ গ্রহণ কারী এ আই, এম, তোয়াহ সে দিন শামছুল হকের বক্তব্য সম্পর্কে সাক্ষাত্‍কারে বলেনঃ শামছুল হক সাহেবের বক্তৃতার কথা মনে হলে আজও আমার অবাক লাগে৷ তার সাথে আমার রাজনৈতীক মত পার্থক্য ছিল৷ তিনি আশ্চর্যজনক ভাবে ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে বক্তব্য রেখে ছিলেন৷ কিন্তু সেদিনের উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজের কটূক্তি আর বিরূপ বাক্য বানের সামনে তিনি যে ভাবে তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে ছিলেন তা মনে পড়লে আজও আমার বিষ্ময় জাগে৷ গণতান্ত্রিক মূল্য বোধের প্রতি গভীর নিষ্ঠা থাকলেই বোধ হয় এমনটি সম্ভব৷ ঘটনার অনেক দিন পর ন্যাপ ভাসানী প্রেসিডিয়ামের সদস্য বলেছেন একটি কথা বলা প্রয়োজন৷ না বললে অন্যায় হবে৷ এ কথা সত্য জনাব শামসুল হক সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গাঁর সিদ্ধান্ত নেয়া হল তখন শামসুল হক আমাকে বলেন যে এ সিদ্ধান্ত মেনে এবং সংগ্রামের সাথে৷

ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন তার সাক্ষাত্‍কারে বলেনঃ ১৪৪ ধারা ভাঙ্গাঁর সিদ্ধান্তের সাথে সাথে শামসুল হক সাহেব বললেনঃ যে আমি ১৪৪ ধারা ভঙ্গঁ না করার পক্ষে ছিলাম এবং রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটির মুখপাত্র হিসেবে সেই কমিটির সিদ্ধান্তই আমার বক্তবের মাধ্যমে উপস্থিত করেছি৷ যেহেতু অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রী ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে রায় দিয়েছে সেহেতু এই রায় মেনেন নিলাম এবং সংগ্রামের সাথে একাত্মতা করলাম৷

মওলানা ভাষানী ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি আর শামসুল হক ছিলেন সম্পাদক৷ ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির মাত্র ক'দিন আগে দশজনের একটি ঘরোয়া বৈঠক হয়েছিল৷ এ বৈঠকে শামসুল হক, আজিজ আহমেদ ও ইয়ার মামুদ খান সহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন ৷ আলোচনা হচ্ছিল ২১ ফেব্রয়ারির কর্মসূচি নিয়ে৷ ক্ষমতাসীন লীগ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করতে পারে এরূপ আশংকা করা হচ্ছিল তখন৷ এ প্রসঙ্গে আলোচনা কালে এক সময় মওলানা ভাষানী খুব উত্তেজিত হয়ে বললেনঃ যদি ১৪৪ ধারা জারী করা হয় তাহলে সর্বশক্তি নিয়ে তা ভঙ্গঁ করব৷ মওলানা ভাষানীর এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে শামসুল হক খুব ধীর স্থির ভাবে অতি বিনয়ের সাথে বললেনঃ মওলানা সাহেব, আমাদের কোন চরম সিদ্ধান্ত নেয়া বোধ হয় ঠিক হবেনা৷ কারণ আন্দোলনে এখন যে ভাবে গতিশীল হয়ে উঠছে তাতে লীগ সরকার শংকিত হয়ে পড়েছেন৷ এ অবস্থায় যদি ১৪৪ ধারা জরি করা হয় এবং তা ভঙ্গ করা হয় তাহলে সরকার যে কোন চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে৷ তা রক্তপাত হতে পারে৷ ফলে ভাষা আন্দোলনের গতি স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে এবং সাথে সাথে আমাদের সংগঠনিক তত্‍পরতা ও বাধাঁগ্রস্থ হবে৷ সুতরাং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে আমরা আমাদের কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাব৷ এতে এ আন্দোলন দেশব্যাপী একটি গণ আন্দোলনের রূপ লাভ করবে৷

প্রখ্যাত কলাম লেখক হাফিজ উদ্দিন আহমদ লিখেছেন যে সেদিন ঢাকার কারকুন বাড়ি জনাব ইয়ারমামুদ খানের বাস ভবনে মওলানা ভাসানীর সাথে ঘরোয়া বৈঠক শেষে জনাব শামসুল হক সাহেব আমাকে নিয়ে নবাব পুরস্থ আওয়ামী মুসলীম লীগের অফিসে যান৷ যাবার সময় রিকশায় বসে শামসুল হক সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলামঃ ভাইজান আপনি তো ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন৷ আমি কিন্তু মওলানা ভাষানীর মত সমর্থন করি৷ শামসুল হক সাহেব কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেনঃ মওলানা সহেব ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছেন৷ আসামে লাইন প্রথা উচ্ছেদের নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ বিদেশী শাসক হটাও আন্দোলন করতে গিয়ে কখনো ভায়োলেন্সের পক্ষে গিয়েছেন৷ কিন্তু স্বাধীন দেশের সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনে ভায়োলেন্সে যাওয়া ঠিক নয়৷ জাতি যদি একবার ভায়োলেন্সের পথে এগুতে থাকে তাহলে জাতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন৷ সুতরাং স্বাধীন দেশে নিয়মত্রান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়৷ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেনঃ আমারা ভাষা আন্দোলনকে সারা দেশের জনগণের মধ্যে বিস্তৃত করে পর্যায় ক্রমিকভাবে দুর্বার আন্দোলনের রূপ দিতে চেয়েছিলাম৷ যার ফলে ভাষা আন্দোলন এমন রূপ নিত যে, এর সামনে যে কোন প্রশাসনিক বা সরকারী প্রতিরোধ চূরমার হয়ে ধ্বসে যেত৷ তাই আমরা সেদিন চরম পথ নিতে চাইনি৷ আমরা নিয়ম তান্ত্রিক আন্দোলনকে ধাপে ধাপে অপ্রতিরোধ্য গতি সম্পন্ন করতে চেয়েছিলাম মাত্র৷ আমরা আশংকা করছিলাম, চরম সিদ্ধান্ত নিলে সরকারি স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপ চরমে উঠবে এবং আমাদের আন্দোলনের মূল কাঠামো বা শক্তিকে সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হবে৷ প্রকৃতপক্ষে সরকার সে সুযোগের জন্য ওত্‍ পেতে বসে ছিল৷ আর বাস্তবে ঘটেছিল তাই৷
এদিনে ছাত্র-ছাত্রীরা যখন বিশ্ব বিদ্যালয় এলাকায় জমায়েত হতে থাকে তখন অন্য দিকে ঢাকার এস, পি, মাহাবুব ইদ্রিসও বিশ্ব বিদ্যালয় গেইটের সামনে পুলিশের অবস্থান জোরদার করতে থাকেন৷ গাজীউল হকের ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তাবের পর পরই দশ জন দশ জন করে পরে ঢেউয়ের মত "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" শ্লোগান দিতে দিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে থাকেন জঙ্গি ছাত্র/ছাত্রী আর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষের নেতা কর্মীরা দু'জন দু'জন করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করতে থাকেন৷ এরপর একটার পর একটা দশজনী মিছিল স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ করল৷ প্রথম দিকে এদের বেশ কিছু সংখ্যক কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠালেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় পরে এদেরকে পুলিশ বাসে করে ভাওয়ালের জঙ্গলের ওদিকে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসে৷

মিছিল দশজন আর দুজন করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নামবে কথা৷ কিন্তু ক্রমে জঙ্গি রূপ ধারন করে বাঁধ ভাঙ্গা ঢেউয়ের মত মারমুখী হয়ে রাস্তায় নামে৷ আর সংসদ ভবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে৷ শামসুল হক পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছিলেন৷ তাই তিনি ছাত্রদেরকে এই ভয়াবহ পরিস্তিতির মধ্যে রেখে চলে যেতে পারলেন না৷ বিশ্ব বিদ্যালয় আমতলায় গাজী উল হকের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি৷ জঙ্গি মিছিল সহকারে ছাত্ররা পরিষদ ভবনের দিকে এগুতে থাকলে পুলিশ প্রথমে তাদেরকে বাধা প্রদান করে ও পরে লাঠি চার্জ করে৷ ছাত্ররা পাল্টা হিসেবে ইট পাটকেল ছুড়ে৷ এমন সময় হঠাত্‍ একটি কাঁদানে গ্যাসের শেল গাজী সাহেবের পায়ের উপর ফাটে৷ তিনি জ্ঞার হারিয়ে ফেলেন৷ শামসুল হক তাঁকে আড় কোলে করে বিশ্ব বিদ্যালয়ের দোতলায় নিয়ে শোয়ালেন এবং শুশ্রূষা করতে থাকেন৷
এদিকে বেলা তিনটার দিকে পূর্ব বাঙ্গলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হবে৷ মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাক হোস্টেলে হাজার হাজার ছাত্র আবার জমায়েত হতে শুরু করল৷ কলা ভবনের ছাত্ররাও এখানে এসে হাজির হল৷ তখনকার দিনে পরিষদ ভবন ছিল জগন্নাথ হল৷ মেডিকেল ব্যারাক হোস্টেলের সামনের রাস্তা দিয়ে কিছু দূর এগুলেই এই পরিষদ ভবন৷ ফলে এই রাস্তায় যাতায়াত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য ছাত্ররা প্রচেষ্টা নিলে আবার ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ শুরু হয়৷ এমন সময় শামসুল হক ছাড়া অধিকাংশই হয় গ্রেফতার না হয় গা ঢাকা দিয়েছিলেন৷ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ আমদানি করা হল৷ ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ হোস্টেলে ঢুকে কয়েক দফা লাঠি চার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে৷ জবাবে ছাত্ররা ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশি হামলার বদলা নিতে শুরু করে৷ এ ছাড়া মেডিকেল হোস্টেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দু\'টো মাইকের ব্যবস্থা করায় কর্মীদের নির্দেশ দেয়ার সুবিধা হল৷

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রয়ারি বৃহস্পতিবার তিনটা দশ মিনিটের সময় হঠাত্‍ করে একদল সমস্ত্র পুলিশ মেডিকেল ব্যারাক হোস্টেলে (আজ যেখানে মেডিকেল আউটডোর) গেটের মধ্যে প্রবেশ করে গুলি বর্ষণ করল৷ ঘটনাস্থলেই কলা বিভাগের শেষ বর্ষের দু'জন জব্বার ও রফিক উদ্দীন শাহাদত্‍ বরণ করলেন৷ হাসপাতালে আহতদের সংখ্যা ৯৬ জন ছিল৷

শামসুল হক আহতদের শুশ্রূষা ও নিহতদের লাশের হেফাজত করতে করতে তার জামা কাপড় রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল৷ সেবা ও চিকিত্‍সা করার জন্য ডাক্তার ডেকে আনা, ওষুদের ব্যবস্থা করার জন্য তাঁর পরিশ্রমের অন্ত ছিল না৷ সেদিকে তার কোনই খেয়াল ছিল না৷ তার খেয়াল নিজে মরুক তবু ছাত্রদের বাঁচাতে হবে৷ ছাত্রদের গুলি বর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার সরকারী, বেসরকারী, অফিস, আদালত, দোকান-পাঠ এবং যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেল৷ গুলি বর্ষণের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢাকায় হরতাল পালিত হল৷ হাজার হাজার ছাত্র জনতা ছুটে এলো মেডিকেল হাসপাতালে৷ সন্ধ্যার দিকে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত ও বাদামতলীর এক প্রেসের কর্মচারী আব্দুস সালামের মৃতু্য হল৷

নিকটেই সংসদের বাজেট অধিবেশন চলছিল৷ প্রশ্নোওরের পূর্বেই বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ্রের সঙ্গে স্পিকারের তীব্র বাদানুবাদ চলছিল৷ রংপুরের খয়রাত হোসেন, ঢাকার আনোয়ারা বেগম, কুমিল্লার আহমদ আলী সহ বিরোধী খয়রাত হোসেন কতর্ৃক আনীত মুলতবী প্রস্তাব স্পিকার অগ্রাহ্য করল৷

এ সময় পাবনার মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ চিত্‍কার করে বলে উঠলেন যখন আমাদের বক্ষের মানিক, আমাদের রাষ্ট্রের ভাবী নেতা মৃতু্য শয্যায় শায়িত, তখন আমরা পাখার নিচে বসে হাওয়া খাব-এ আমি বরদাস্ত করতে পারি না৷ আমি জালেমের এই জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদ গৃহ পরিত্যাগ করছি এবং মানবতার দোহাই দিয়ে আপনার মাধ্যমে মাননীয় সকল সদস্যের কাছে পরিষদ কক্ষ ত্যাগের আবেদন জানাচ্ছি৷ এরপর বিরোধী দলীয় সকল সদস্য ও মওলানা আব্দুল রশিদ তর্ক বাগিশ পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন৷ এর কয়েকদিন পর স্বৈরশাহী মুসলিম লীগ সরকার খয়রাত হোসেন, মওলানা তর্কবাগিশ ও আরও কিছু সদস্যকে গ্রেফতার করে৷

২১ সন্ধ্যায় ঢাকা শহরে কারফিউ জারী করা হয়৷ সশস্ত্র পুলিশ মহল্লায় মহল্লায় টহল দিতে শুরু করে৷ রাতে ৬২ জনকে গ্রেফতার করা হয়৷ এদিকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এ মর্মে সিদ্ধান্ত নিল যে, পরিষদের হরতাল প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ বাতিল বলে গণ্য হবে৷ তাই ২১ ফেব্রয়ারি সন্ধ্যায় কয়েকজন ছাত্র ও যুব নেতা মেডিক্যাল হোস্টেলে বৈঠকে মিলিত হন৷ তারা পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদকে আহ্বয়ক নিযুক্ত করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ পুর্ণগঠন করে এবং ২২ ফেব্রয়ারি শুক্রবার সকালে মেডিক্যাল হোষ্টেলে ভাষা আন্দেলনে শহীদদের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে এবং সেই সঙ্গে এই দিন হরতাল প্রতিপালিত হবে৷

সলিমুল্লাহ্ হল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজের মাইক থেকে এই কর্মসূচির কথা ঘোষণা করা হয়৷ চারজন শহীদের লাশ তখন মেডিকেল হাসপাতালের মর্গে ছিল৷ সন্ধ্যা থেকে মেডিক্যালের ছাত্ররা মর্গ পাহারা দিতে শুরু করে যাতে সরকারের পুলিশ সেনা বাহিনীর সহায়তায় লাশগুলি ছিনতাই করে নিতে না পারে৷ কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হল না৷ রাত আড়াইটার দিকে ঐ পেটোয়া বাহিনীদ্বয় মর্গে হামলা করে এবং লাশগুলি ছিনতাই করে নিয়ে যায়৷

সৌভাগ্যের বিষয় তিন জন ছাত্র নিজেদের জীবন বাজী রেখে কারফিউএর মধ্যেই এদের অনুসরণ করে৷ সকালে এসে খবর দিল যে, লাশগুলি আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে৷ আর সেই কবরগুলো সনাক্ত করে এসেছে৷ এইসব নাম না জানা ছাত্রদের বদৌলতেই পরবর্তিকালে শহীদদের কবরগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে৷

২২শে ফেব্রয়ারী সকাল থেকেই শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান গুলোতে সৈন্য বাহিনী টহল দিতে শুরু করে৷ সকাল দশটায় মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে লক্ষাধিক ছাত্র জনতা শহীদদের গায়েবানা জানাজায় শরিক হল৷ ইমামতি করলেন মওলনা ভাসানী৷ কিন্তু সরকার সভার অনুমতি দিল না৷ মওলানা ভাসানী মোনাজাতে প্রায় আধ ঘন্টা দোয়ার মাঝে স্বৈরচার সরকারের পতন বাংলাদেশের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণ শাষণ অবসান, স্বাধীকার কামনা করে সরকারের চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করে মুনাজাত শেষ করলেন৷ অন্যদের মধ্যে ফজলুল হক, পরিষদ সদস্য খয়রাত হোসেন, মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ, শামসুল হক প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন৷ শহীদদের লাশের অভাবে শহীদের রক্তমাখা জামা কাপড় লাঠির মাথায় বেঁধে নিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা শুরু হল৷ এই ঐতিহাসিক মিছিল হাইকোর্ট ও কার্জন হলের মাঝ বরাবর সশস্ত্র বাহিনী হামলা চালালো৷ ঘটনাস্থলে একজন শাহাদত্‍ লাভ করল এবং বহু সংখ্যক আহত হল৷ শোভাযাত্রা দুই অংশে বিভক্ত হয়ে আগের অংশ নবাব পুরের দিকে আর পিছনের অংশ নাজিম উদ্দিন রোড দিয়ে এগিয়ে গেল চক বাজারের দিকে৷ এদিকে আর একদল ছাত্র-জনতা জগন্নাথ কলেজ এলাকা থেকে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে মর্নিং নিউজ পত্রিকার ছাপাখানা জুবিলী প্রেসে আগুন ধরিয়ে দিল৷ আর একই সময়ে পুলিশ নবাবপুর রোডের কয়েক স্থানে গুলি বর্ষণ করল৷ হাই কোর্টের কর্মচারী শফিকুর রহমান শহীদ হলেন এই গুলি বর্ষনে৷

পরদিন ২৩ ফেব্রয়ারী দৈনিক আজাদের শিরোনাম ছিল নিম্নরূপ ঃ
* পুলিশ এবং সৈন্যদের গুলিতে ৪ জন নিহত এবং শতাধিক আহত: ৭ ঘন্টার জন্য কারফিউ জারী৷
* শুক্রবার শহরের অবস্থা অবনতি সরকার কর্তৃক সামরিক বাহিনী তলব৷
* শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে শহরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করা হয়৷
* বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ব বঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ সদস্যদের সুপারিশ৷
* পুলিশের জুলুমের প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের পরিষদ সদস্য পদে ইস্তেফা৷

২২ ফেব্রয়ারি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিল, যে জায়গায় গুলি বর্ষিত হয়েছে সেখানেই রাতারাতি শহীদ মিনার গড়ে তুলতে হবে৷ ঢাকার মেধাবী ছাত্র বদরুল আলমের (পরবর্তিতে শিশু বিশেষজ্ঞ) নকশার উপর ভিত্তি করে সে রাতেই সেখানে নির্মিত হল শহীদ মিনার৷ তার অক্লান্ত পরিশ্রমে এই শহীদ মিনার নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল৷ তিনি আর ইহ জগতে নেই৷ তিনি ছিলেন নও গায়ের কৃিত সন্তান ডাক্তার মন্জুর হোসেন৷
এই শহীদ মিনার চারদিন স্থায়ী ছিল৷ চতুর্থ দিন ২৫ ফেব্রয়ারি আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন আনুষ্ঠানিক ভাবে এই শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন৷ পর দিন পুলিশ এই শহীদ মিনার ধ্বংস করে দেয়৷
এদিকে ২২ ও ২৩ ফেব্রয়ারি ঢাকায় পূর্ণ হরতাল পালিত হয়৷

সলিমুল্লাহ্ হলে মাইক যোগে "অর্ডার অব দা ডে" ঘোষণা অব্যহত থাকে৷ প্রকৃত পক্ষে সলিমুল্লাহ্ হল থেকে যে ঘোষণা করা হয় সেটাই ঢাকাবাসী সানন্দে গ্রহন করে৷ একুশে ফেব্রয়ারি বিকেল থেকে শুরু করে ২৬শে ফেব্রয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় সরকারি প্রশাসন অচল ছিল৷ এ বিষয়ে মোহম্মদ তোয়াহা বলেনঃ- বাইশ-তেইশ দুইদিন গ্রামের লোকেরাও ঢাকায় এসে মিছিল করে গিয়েছে৷ এ অবস্থায় পুলিশ এক রকম হাল ছেড়ে দিয়েছে৷ তিনি বলেনঃ এই সময় রাস্তা ঘাটে তারা ঘুরে বেড়ান৷ পুলিশ তাদের ধরে না৷ মেডিক্যাল কলেজের গেটের সামনে একজন উচ্চ পদস্থ পুলিশ শামসুল হককে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, তারাইতো ক্ষমতায় এসে গেলেন৷ নামে মাত্র সরকার টিকে আছে৷

এ সময় শামসুল হক প্রায় সর্বক্ষণ মেডিক্যাল হোস্টেলেই অবস্থান করে আহতদের সেবা ও আগত নিহতদের খোঁজ নিয়ে সময় কাটান৷ সর্বদাই তার চোখে মুখে উদ্বেগের চিহ্ন দেখা যেত৷ সারা দেশে তো সংগঠন নেই৷ দ'ুদিন পরেই সরকার প্রশাসন শক্ত করে আন্দোলন কারীদের ব্যপক ভাবে ধরপাকড় করবে৷ তখন উপায়৷ ইত্যাকার চিন্তাই তার প্রায় সময় কেটে যায়৷

আরও একটি বিষয় লক্ষ করার মত ছিল৷ তা হল বেশ কয়েকটি সচিবালয় সর্বক্ষণ তালা ঝুলানো থাকে৷ তা খুলবার মানুষ ছিল না৷ সরকারি কর্মচারীরা পর্যন্ত অফিসে আসত না৷

২৪শে ফেব্রয়ারি নূরুল আমিন কলকাতার দুটি পত্রিকার সম্পাদকীয় পাঠ করে প্রদেশিক পরিষদে সদস্যদের শোনান৷ দৈনিক "স্বাধীনতা" পত্রিকা বলেনঃ পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে ঢাকায় ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে৷ আনন্দ বাজার বলেনঃ পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলন ও হিন্দুদের অবস্থা৷ তিনি এদিন থেকে সংসদ অধিবেশন মূলতবি ঘোষণা করেন৷

২৫ ফেব্রয়ারি প্রতিবাদ দিবস হিসেবে আবার সর্বত্মক হরতাল ঘোষণা করা হয়৷ কেবলমাত্র কাঁচা বাজার সকালে দু'ঘন্টার জন্য খোলা রাখার অনুমতি দেয়া হয়৷ এই দিন কতর্ৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ ছাত্রাবাস গুলো বন্ধ করে দিল৷ পুলিশ নিরাপত্তা আইনে বহু ছাত্র, অধ্যাপক ও রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করে৷ এদের মধ্যে আবুল হাশিম, খয়রাত হোসেন, মওলানা তর্কবাগীশ, গোবিন্দ লাল মুখার্জী, অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক পুলিন দে প্রমূখ৷

২৭ ফেব্রয়ারি ফজলুল হক হল এলাকা থেকে যুবলীগ নেতা অলি আহাদ, বাম নেতা তোয়াহাকে আটক করে সরাসরি জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ৷

এ সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে হাফিজ উদ্দিন লেখেনঃ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে যারা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ২১শে ফেব্রয়ারির পর প্রায় সবাই আত্মরক্ষার জন্য গা ঢাকা দিয়েছিলেন৷ জনাব শামসুল হককে দেখা গেছে উন্মাদের মত ছুটোছুটি করে ছাত্রদের সহযোগিতায় অহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে৷ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এজন্য শামসুল হকের ভূমিকা চির ভাস্কর হয়ে থাকবে৷ সেই মর্মান্তিক ও বিয়োগান্ত ঘটনার দিন বিকেলে প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত সময়ে আমরা শামসুল হকের সঙ্গে ছিলাম৷ পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি দেখে আমারা চলে যেতে চাইলে তিনি বাঁধা দেননি৷ তাঁকে মেডিকেলের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রেখে আমরা চলে যাই৷

এক সাক্ষাতকারে জনাব অলি আহাদ বলেনঃ পুলিশ কিছুক্ষণ পর আনুমানিক চারটার দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হককে ডেকে পাঠালেন৷ আমি সেই শোকাভিভূত মুহূর্তে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল থেকে হাসপাতালের ইমাজেন্সি ওয়ার্ডে গেটের সন্মূখ চত্তরে শামসুল হকের সঙ্গে দেখা করি৷ সদ্য সংঘটিত মর্মান্তিক ও নৃশংস হত্যাকান্ড উভয়ের বাক শক্তি হরণ করে নিয়েছিল৷ প্রকৃতিস্থ হবার পর অত্যন্ত ধীর ও শান্ত কন্ঠে উদ্ভূত পরিস্থিতি মূল্যায়নে নিবিষ্ট হলাম৷ এসব ঘটনার প্রেক্ষিতেই ভাষা আন্দোলনে শামসুল হকের আবদান অম্লান করে রেখেছে৷

অলি আহাদ আরও বলেনঃ এই গণ জাগরণ ধরে রেখে বৃহত্তর কোন আন্দোলন সাংগঠনিক শক্তি তখন ছিল না৷

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন ঃ এরপর দলের উপর থেকে নির্দেশ এলোঃ হরতাল অনিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না৷ দেশ তৈরি নয়, সুতরাং হরতাল গুটানো দরকার৷

২৫শে ফেব্রয়ারী ২ টা থেকে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে সর্ব দলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটি ও সিভিল কমিটির এক যৌথ বৈঠক হয়৷ বৈঠক চলে ৫-৫০ পর্যন্ত৷ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন-শামসুল হক, কমরুদ্দিন, আহমদ, মোস্তাক আহমদ, এম, এম, রহীম, তাজউদ্দিন আহমদ, এস, এম, হক, এম, এ, হাই এবং শামসুদ্দিন আহমদ, এম, এল, এ৷ এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান৷ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল,
১৷ ২৬/০২/৫২ তারিখ থেকে সাধারণ ধর্মঘট স্থগিত রাখা৷
২৷ প্রধান মন্ত্রী নূরুল আমিনের কাছে ৯ দফা চরমপত্র প্রদান৷
৩৷ ৫ মার্চ শহীদ দিবস ও সাধারণ ধর্মঘট৷
৪৷ ছাত্র ধর্মঘট অব্যহত থাকবে৷

আন্দোলনে ভাটা পড়ার পর পরই সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিল৷ স্বরাষ্ট্র বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারী করা হলঃ ২৮ ফেব্রয়ারি থেকে ৩০ দিনের মধ্যে স্ব-স্ব জেলা প্রশাসকের নিকট হাজির হবার জন্য শামসুল হক ও অন্যান্য যারা ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন তাদেরকে জোর নির্দেশ দিল৷

১৯ মার্চ শামসুল হক গ্রেফতার বরণ করেন৷ খবরটি ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ ১৯ মার্চ ছিল বুধবার৷ বেলা ১২ ঘটিকায় ঢাকা জেলা মেজিট্রেটের নিকট হাজির হন৷ তাঁকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হল৷ সঙ্গে নেতা কর্মী ও শুভানুদায়ী অনেকেই ছিলেন৷ তারা ভগ্ন হৃদয়ে নিজ নিজ বাড়ী ফিরে গেলেন৷

গ্রেফতারের পূর্বে শামসুল হক ম্যাজিষ্টেটের কাছে জানতে চান তার বিরুদ্ধে কোন গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করা হয়েছে কিনা৷ কিন্তু এর কোন সদুত্তর তিনি পান নি৷ এটাই ছিল শামসুল হকের মত নিঃস্বার্থ নেতার করুণ পরিনতি৷

নিম্নোক্ত গানটি তখন যত্রতত্র শোনা যেতো৷

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি৷
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি৷
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙ্গানো ফেব্রয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি৷
গীতিকারঃ আব্দুল গফফার চৌধুরী
শিল্পীঃ মর্তুজা বশির৷


শামসুল হক বিভিন্নমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন

শামসুল হক নানাবিধ দুসপ্রাপ্য গুণের অধিকারী ছিলেন৷ তার লিখিত বই পুস্তক হতে প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে৷ তাইতো তাঁকে আমরা একজন ভবিষ্যত্‍ সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদই নয় লেখক হিসেবেও পরিচয় পাই৷ অতি শক্ত বিষয় তিনি অতি সহজ করে লিখতে পারতেন৷ তিনি তার সুচিন্তিত লেখাগুলো প্রথম প্রকাশ করেন ১৯৪৪ সালে৷ প্রকাশনা দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করেন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনের ১৫০ নম্বল মোগলটুলী অফিসকে৷ দূরুহ রাজনীতির কর্মকান্ডের মাঝে লেখাকে সমান তালে চালিয়ে একসময় লেখক হিসেবে প্রচুর সুনাম কুড়ান৷ এই লেখক জীবনের পূর্ণতা অনায়াসে তার কলেজ জীবনের সুবিখ্যাত শিক্ষক লেখক প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ প্রভূত সাহায্য করেন৷

শামসুল হকের সরকার বিরোধী লেখা প্রকাশিত পাকিস্তান কি, কেন এবং কোন পথে৷ এর ভূমিকা লিখে দেন প্রিন্সিপাল সাহেব৷ এ বইটিতে ছিল পাকিস্তানী শাসকদের কুকীর্তি ও পূর্বাংশের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ৷ শোষন বঞ্চনা দিয়ে বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্রের কড়াল গ্রাসে নিক্ষেপ করেছিল৷ তার বাস্তবতা ছিল বিধায় বইটি প্রকাশ করার সাথে সাথেই পাকিস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করে প্রকাশনা বন্ধ করে দেন৷ প্রকাশিত সমস্ত কপিগুলো প্রকাশনা দপ্তর থেকে আটক করে সরকারী দপ্তরে নিয়ে গায়েব করে দেয়৷

ওংষধস রং ঃযব ড়হষু ংড়ষঁঃরড়হ ইংরেজী বই খানি এ সময়ের লেখা ছিল৷ বইটি প্রকাশ করে মোগলটুলীর এক কোণের সংর্কীর্ণ দপ্তরে গচ্ছিত করে রাখেন৷ পরবর্তিতে এর আর কোন হদিস মেলেনি৷তবে তাঁর লিখিত তৃত্বীয় বই ছিল "বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম"৷ উপযুক্ত নামই তিনি দিয়েছিলেন৷ তার এই বই খানিতে ইসলামী চিন্তার জগতে নতুন কিছু তিনি সংযোজন করেছেন৷ বইটি পড়লেই এর সারবত্তা বুঝা যায়৷

তাঁর আরও একটি বই এর নাম শোনা যায়৷ তার জ্ঞাতি ভাই ভাতিজাদের কাছে৷ তার নাম তিনি দিয়েছিলেন ওংষধস ধহফ ঝড়ংরধষরংস. ইসলামী ধর্মীয় চেতনাবোধ ও সাম্যবাদ বা সমাজবাদ তার গভীরতা কার কতটুকু তা তিনি বইখানিতে তুলে ধরেছেন৷ বিখ্যাত কমিউনিষ্ট নেতা পি, সি, যোশী শামসুল হকের ইসলাম ও সাম্যবাদের বিশ্লেষনধর্মী চিন্তা চেতনার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান৷ তবে এ বই খানির অস্তিত্বেরও বিলুপ্তির ঘটেছে৷ এখন আর তার অতিত্ব নেই৷ শোনা যায় মস্তিঙ্ক বিকৃতির চিকিত্‍সার জন্য করাচী পাঠানোর সময় এ বই খানি সহ আরও কিছু বইয়ের পান্ডুলিপি তার নিকটজনের কাছে রেখে দেয়া হয়েছিল৷ পরে সব গায়েব হয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া যায়৷

মোট কথা একমাত্র "বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম" বইখানি ছাড়া দ্বিতীয় কোন বই-ই আজ আর বর্তমান নেই৷ এ বইটি ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৯৮৭ সালে তৃতীয় সংস্করন প্রকাশ করেছে৷
শামসুল হকের শেষ জীবন

৫২ এর রক্তখরা ভাষা আন্দোলনের পর সরকার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারী করলেন৷ শামসুল হককে অবশ্যই বিনাশর্তে আত্মসমর্পন করতে হবে৷ তার অপরাধ তিনি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেছেণ৷ নইলে তার বিরুদ্ধে সার্চ ওয়ারেন্ট জারী করে বাড়ি-ঘর, স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে৷ এর পরই তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুজি শুরু হয়ে গেল৷ শশুরবাড়ী সহ নিজবাড়ী টাঙ্গাইল জেলাস্থ গ্রামে নাগরপুর থানার মাইঠাইন টেউরিয়ায় পুলিশ বারবার হানা দিয়ে তাঁকে না পেয়ে অতি শিঘ্র আত্মসমর্্পনের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে৷ এখানে বলা ভাল শামসুল হকের বাড়ী তখন নাগরপুর অধীন দেউলী ইউনিয়নের মাইঠাইন টেউরিয়া গ্রামে ছিল৷ বর্তমান ইউনিয়ন দেলদুয়ার উপজেলার অধীন৷ নূরুল আমিন সরকার এ সময় হালে পানি পেয়েছে মেনে করলেন৷ ভাষা আন্দোলনের নেতা কর্মীরা পালাতক৷ শেখ মুজিব আগেই জেলে অবস্থান করছিলেন৷ এসব কারণে ২১ এর পরে আন্দোলনে ভাটা পড়ল মনে করে নেতা কর্মীদের যার বিরুদ্ধে যেভাবে পারলেন দমন পীড়ন শুরু করলেন৷ শামসুল হক যে কয়জন নেতাকর্মী হাতের কাছে পেলেন তাদের সাথে গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে দীর্ঘ পরামর্শ করলেন৷ সাব্যস্ত হল তিনি ঢাকাতেই আত্মসমর্্পন করবেন৷ নাহলে তার স্ত্রী কন্যা বাবা ভাইদের উপর জুলুম নেমে আসতে পারে৷ ইতোমধ্যেই এধরনের অশুভ পায়তারা শুরু হয়ে গেছে৷ ১৯৫২ এর ১৯ মার্চ রোজ বুধবার বেলা ১২ টায় ঢাকার মেজিষ্ট্রেট কোর্টে নেতা কর্মীসহ হাজিরা দেন৷ শামসুল হককে হাকিম গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন৷ গ্রেফতারের সময় ম্যাজিষ্ট্রেট কে প্রশ্ন করেছিলেন তাকে কেন গ্রেফতার করা হল ? কিন্তু উত্তর মেলেনি৷ এর পরবর্তি নানাবিধ ষড়যন্ত্র আরম্ভ হয়ে গেল৷ তাঁর নিজ হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কারের বিষয় পাকা পাকি হতে চলল৷ এক সময় ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে সম্মেলন ডেকে তাঁকে সাধারণ সম্পাদক থেকে সরিয়ে দেয়া হল৷ জেলের ভেতরে শারীরির ও মানষিক অত্যাচার চরম পর্যায়ে পেঁৗছল৷ তাঁর স্ত্রী অফিয়াকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলল৷ আফিয়া শামসুল হককে ডিফোর্স দিলে সরকার তাকে উচ্চতর ডিগ্রির সুযোগ দিয়ে মেয়েদ্বয়সহ অষ্ট্রেলিয়ার সিডনী বিশ্ব বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিলেন৷ শোনা যায় জেলের অভ্যন্তরে বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়৷ এর ফল ফলতে দেরি হল না৷ অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর মস্তিঙ্ক বিকৃতি দেখা দিল৷ স্বাস্থ্যও গেল ভেঙ্গে৷ সরকার অবস্থা বেগতিক দেখে পর বছর ১৯৫৩ এর ১৩ ফেব্রয়ারী মুক্তি দিলেন তাঁকে৷ জেল গেটের বাইরে হাজার হাজার মানুষ মালা, ফেষ্টুন, ব্যানার সহ সাগ্রহে বর্তমান৷ শামসুল হক জেল গেটের বাইরে এলেন৷ মুহূর্মুহু করতালি আর শ্লোগান৷ আকাশ বাতাশ মুখরিত৷ স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে স্মিত হাস্যে হাত নেড়ে অভিনন্দনের জবাব দিলেন৷ কিন্তু কি আশ্চর্য! জনতার ভিতর ঢুকে কোথা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি জনতা খুঁজেও পেল না৷ উপস্থিত জনতা হতোদ্যম হয়ে নিজ নিজ স্থানে চলে গেলেন৷ এরপর ১০/১২ বত্‍সর উদ্ভ্রান্তের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি৷ হাতে থাকত চাঁদা আদায়ের রশিদ বই৷ বগলে নানাবিধ কাগজ-পত্র৷ পরিচিত জন পেলেই তাকে ধরে নতুন দল করবেন বলে চাঁদা চাইতেন৷ যথারীতি রশিদ লিখে দিতেন৷ এ সম্পর্কে প্রখ্যাত লেখক হাফিজ উদ্দিন লিখেছেনঃ আমি একদিন তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম৷ প্রিয় হক ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল৷ চোখে বইছিল বেদনাশ্রু৷ ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট কেন্দ্র ও প্রদেশের সরকার গঠন করেন অথচ তখন শামসুল হক সামান্য চিকিত্‍সার অভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন৷ রোগ শোক জরা র্জীর্ন পোষাক নিয়ে৷

এ সময় টাঙ্গাইল মাহ্ফিলের পক্ষ থেকে শামসুল হকের চিকিত্‍সার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান৷ এর সঙ্গে আরও একটা প্রতিষ্ঠান তাঁর চিকিত্‍সার জোর দাবি করেন৷ সরকার তখন বাধ্য হয়েই তাঁকে চিকিত্‍সার জন্য করাচী মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন৷ ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে হাসপাতালে পাঠান হয়৷

দীর্ঘ তিন বত্‍সর চিকিত্‍সারপর চিকিত্‍সকগণ বলেন যে, তাঁর কোন রোগ নেই৷ মানসিক যেটুকু অসুবিধা আছে তা আপনজনদের সানিধ্যে থাকলে ভাল হয়ে যেতে পারে৷ এ ব্যাপারে স্ত্রী অফিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হলে ১৯৫৭ সালে শামসুল হক দেশে ফিরে আসেন৷ আবার অনাদর অবহেলায় পূর্বের মত অবস্থায় পাগল হয়ে গেলেন৷

নিরুদ্দিষ্ট আবস্থায় ঢাকা সহ বিভিন্ন যায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, চাঁদা তুলেছেন৷ গরিব মিসকিন হাত বাড়ালে সব টাকাই বিলিয়ে দিয়েছেন৷ খাওয়া নেই, ঘুম নেই, ঘুরছেন তো ঘুরছেই৷ এমনি সময় একদিন ১৯৬৪ সালের শ্রাবন মাসের দিকে নিজ বাড়ি মাইঠাইন টেউরিয়া আসেন৷ একদিন থাকার পর হঠাত্‍ আবার অদৃশ্য হয়ে যান৷ আত্মীয়-স্বজন আনেক খোঁজা-খুজির পরও তাঁর হদিস করতে পারেননি৷ তারপর দীর্ঘ ৪২ বত্‍সর কেটে গেল৷ এমনি অবস্থায় "দৈনিক আমার দেশ" পত্রিকায় এক প্রতিবেদন ছাপা হল৷ তাতে লেখা হল ১৯৬৫ সালে শামসুল হক হটাত্‍ নিখোঁজ হন৷ এ নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছিল৷ পরে নিভৃত পল্লী জোগারচর গ্রামে এই নেতার কবরে সন্ধান দিয়েছেন স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা৷ পত্রিকায় বড় বড় হরফে প্রকাশ হলঃ ৪২ বছরপর আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শামসুল হকের নিখোঁজ রহস্য উদ্ঘাটন৷ টাঙ্গাইলের জোগারচর এলাকার অধিবাসী চিহ্নিত করে রেখেছেন শামসুল হকের কবর৷

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ৪২ বছর পর তাঁর কবরের সন্ধান মিলেছে৷ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ও ভাষা আন্দোলনের রূপকার জাতীয় এ নেতাকে এক সময় নিজের গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ থেকে বহিস্কার করা হয়৷ এরপর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় ১০ বছর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি৷

টাঙ্গাইলের নিভৃত কদিম হামজানি প্রকাশ জোগার চর গ্রামে শামসুল হকের কবরের সন্ধান দিয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ লোক৷ তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে কবরটি চিহ্নিত করেও রেখেছেন৷ এ নেতাকে মৃতু্য আগ পর্যন্ত খুবই কাছ থেকে দেখেছেন এ সব প্রত্যক্ষদর্শীরা মৃতু্যর পর তাই কাফনের কাপড় কিনে জানাজার পর স্থানীয় লোকজন গোরস্থানে তাঁকে দাফন করেন৷ এ ঘটনার দীর্ঘ ৪২ বছর পর মুখ খুলেছেন এসব প্রত্যক্ষদর্শীরা৷ তাঁরা বলেছেন, এ সময় একমাত্র রাজনৈতিক কারণেই এ ঘটনা গোপন রাখা হয়েছিল৷ পরে ঘটনাটি সবাই ভুলে যায়৷

অতি সমপ্রতি একটি ক্যালেন্ডারের সূত্র ধরেই ৪২ বছর আগের রহস্য উদঘাটন হয়েছে৷ আজ সন্ধানে বেরিয়ে এসেছে শামসুল হকের জীবনের বিয়োগান্ত শেষ দিনগুলি এবং করুণ মৃতু্যর কারণ৷

প্রত্যক্ষদশীরা দাবী করে বলেছেনঃ টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রায় ২০ কিঃ মিঃ উত্তর পশ্চিমে কালীহাতী উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নের জোগারচর গ্রামে তত্‍কালীন নামকরা কংগ্রেসী নেতা মৌলভী মহিদ্দন আনসারীর বাড়িতে ৭ দিন অসুস্থ থাকার পর শামসুল হক মারা যান৷ পরে কাদিম হামজানি কবরস্থানে দাফন করা হয়৷

দীর্ঘ ৪২ বত্‍সর আগের ঘটনা যেভাবে প্রকাশ পায়

কালীহাতী উপজেলার কাদিম হামজানি গ্রামের মৃত বাহাদুল তালুকদারের ছেলে ডাঃ আনসার আলী তালুকদার (৭৫) সমপ্রতি টাঙ্গাইল শহরের বেপারী পাড়ায় তার মেয়ের বাসায় বেড়াতে যান৷ সেখানে রঙ্গিন একটি ক্যালেন্ডারে শামসুল হকের ছবি দেখতে পান তিনি৷ ক্যালেন্ডারে আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও ভাষা আন্দোলনের রূপকার ক্যালেন্ডারের ছবিটি মনোযোগ দিয়ে দেখার পর ডাঃ আনসার আলীর ৪২ বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়৷ বিষয়টি নিয়ে এলাকার প্রবীণ লোকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি৷ সেই আলোচনার সূত্র ধরেই এ প্রতিবেদনের কথা হয় সে সময়ের প্রত্যক্ষ্যদর্শী জোগারচর গ্রামের ডাঃ আনসার আলী তালুকদার (৭৫), মুজাফর আলী আকন্দ (৮০), মোসলেম উদ্দিন মন্ডল (৭৫), আজহার আলী (৭০), আব্দুল গনি (৭০) ও পাল পাড়ার কিশোর মোহন শীল (৯১) সহ আরও আনেকের সঙ্গে৷ সেখানে খোলামেলা আলোচনায় বিস্তারিত বেরিয়ে আসে শামসুল হকের মৃতু্যর কারণ৷ জানাজা কাফন দাফনের কাহিনী৷ তারা জানান মৃতু্যর আগ পর্যন্ত শামসুল হক যেভাবে সময় কাটিয়েছেন কাদিমহামজানি প্রকাশ জোগারচর গ্রামে৷

প্রত্যক্ষদর্শী ডাঃ আনসার আরী তালুকদার বলেন, তিনি নিজে তত্‍কালীন মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন৷ রাজনীতি করার সুবাদে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনতেন ও জানতেন৷ বিভিন্ন সভা সমাবেশে শামসুল হকের ভাষণ শুনেছেন৷

তিনি প্রতিবেদককে বলেনঃ ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি ১১ সেপ্টেম্বর দুপুড় ২ টার সময়ে মহিউদ্দিন আনসারী (তত্‍কালীন নামকরা কংগ্রেস নেতা) কলকাতা থেকে সিরাজগঞ্চ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে কোন একস্থান থেকে শামসুল হককে বাড়িতে নিয়ে আসেন৷ তখন শামসুল হক শারিরীক ও মানসিকগতভাবে ভীষন অসুস্থ ছিলেন৷ সে সময় হাতেগোনা কয়েকজন সচেতন শিক্ষিত লোকছাড়া শামসুল হককে কেউ চিনতেন না৷ অসুস্থ শামসুল হক মহিউদ্দিন আনসারীর বাড়িতে ৭ দিন থাকার পর হঠাত্‍ খুব জ্বর হয়৷ স্থানীয় হোমিও চিকিত্‍সক শুকলাল শামসুল হকের চিকিত্‍সা করেন৷ প্রচন্ড জ্বরে শামসুল হক শনিবার ১১ই সেপ্টেম্বর দুপুর দুইটা থেকে আড়াইটার মধ্যে মারা যান৷ সেদিন ছিল শনিবার হাটবার৷ হাটে গইজা খলিফার দোকান থেকে ডাঃ আনসার আলী ও কংগ্রেস নেতা মহিউদ্দিন আনসারীর মেঝ ছেলে রইছ উদ্দিন আনসারী কাফনের কাপড় কিনে আনেন৷ মহিউদ্দিন আনসারীর বাড়ীর সামনের ছোটমাঠে (বর্তমান পুকুর) জানাজা অনুষ্ঠিত হয়৷ এরপর শামসুল হককে কদিম হামজানি কবরস্থানে দাফন করা হয়৷

শামসুল হকের পরিবারকে সে সময় মৃতু্যর খবর জানান হয় নি কেন ? এ প্রশ্নের জবাবে ডাঃ আনসার আলী বলেন, মহিউদ্দিন আনসারী ছিলেন নামকরা একজন কংগ্রেস নেতা৷ অপরদিকে শামসুল হক ছিলেন আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক৷ সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী রাজনীতি করলেও তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছিল৷ একজন কংগ্রেস নেতার বাড়িতে শামসুল হক মারা যাওয়ার ঘটনাটি নিয়ে রাজনৈতিক কলহ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে এমন আশংকা করেই শামসুল হকের মৃতু্যর ঘটনা গোপন রাখা হয়৷ এরপর এক সময় সবাই বিষয়টি ভুলে যায়৷

প্রত্যক্ষদশী ডাঃ আনসার আলীর দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে শামসুল হকের একমাত্র জীবিত সহোদর ভাই হাজী আনোয়ারুল হকের দেয়া তথ্যের অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷ সমপ্রতি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের টেউরিয়া গ্রামে শামসুল হকের পৈত্রিক বসত বাড়িতে আনোয়ারুল হকের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়৷ তিনি বলেন, ১৯৬৪ সালের প্রথমদিকে শামসুল হক হঠাত্‍ বাড়িতে আসেন৷ তখন ছিল বর্ষা মৌসুম৷ নৌকা যোগে বাড়িতে এসেই নতুন দল গঠনের জন্য তাদের কাছে চাঁদা চান৷ শামসুল হক তখন অনেকটা ভারসাম্যহীন অবস্থায় ছিলেন৷ একদিন বাড়িতে থাকার পর হঠাত্‍ উধাও হয়ে যান৷ আনেক চেষ্টা করেও আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ তিনি বলেনঃ কিছুদিন আগে শুনেছেন জোগার চরে তার কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে৷ ঘটনাটি সত্য হলে সরকারের কাছে তাদের দাবী যথাযোগ্য মর্যাদায় কবরটি সংরক্ষণ করা হোক৷ আরেক প্রত্যক্ষদশর্ী জোগারচরের মুজাফর আলী আকন্দ (৮০) বলেন, শামসুল হক মাঝে মধ্যেই মহিউদ্দিন আনসারীর বাড়িতে আসতেন৷ সর্বশেষ আসেন ১৯৬৫ সালের দিকে এবং সেবারই অসুস্থ হয়ে মারা যান৷ তিনি বলেন, তার পরিস্কার মনে আছে মহিউদ্দিন আনসারীর বড় ছেলে আব্দুল কাদের আনসারী ও মেয়ে জামাই মোকছেদ আলী আকন্দ (বর্তমানে দু-জনই মৃত) নিজ হাতে শামসুল হকের লাশ গোছল করান৷

প্রত্যক্ষদর্শী মোছলেম উদ্দিন (৭৫) বলেন, শামসুল হক এ গ্রামে পাগলের মত ঘোরাফেরা করতেন৷ বেশিরভাগ সময়েই নদীরপাড়ে বসে থাকতেন৷ নৌকা যেতে দেখলেই চিত্‍কার করে বলতেন, এই মাঝি নৌকা ভিড়া, আমি শামসুল হক৷

আরেক প্রত্যক্ষদশর্ী কিশোরী মোহন শীল (৯১) যিনি ছিলেন কংগ্রেস নেতা মহিউদ্দিন আনসারীর পারিবারিক ক্ষৌরকার৷ তিনি বলেনঃ শামসুল হককে ঐ বাড়িতে অনেকবার দেখেছি৷ তিনি যে এতবড় নেতা তা জানতাম না৷ মাঝে মধ্যেই আনসারী সাবের ছেলেরা শামসুল হককে জোর করে ধরে তাকে দিয়ে চুল কাটাতেন৷ কংগ্রেস নেতা মহিউদ্দিন আনাসারীর মেয়ে রোকেয়া বেওয়া (৫৫) বলেন, প্রায় ৪০/৪২ বত্‍সর আগে তাদের বাড়িতে একজন পাগল মারা যায়৷ কিন্তু তিনি শামসুল হক কিনা তা তিনি জানতেন না৷ মহিউদ্দিন আনসারীর একমাত্র জীবীত ছোট ছেলে হায়দার আলী আনসারী বলেন, ছোটবেলায় এ কাহিনীটি তিনিও শুনেছেন৷ এ সম্পর্কে ডাঃ আনসার আলী এবং মুজাফর আলী সহ অন্য বয়স্ক ব্যক্তিরা ভাল ভাবেই অবগত আছেন৷

এ ব্যপারে প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা ও টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মির্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল বলেন, ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে শামসুল হকের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয় ঢাকার গুলিস্তানে৷ খুবই নোংরা পোশাকে অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন তিনি৷ তিনি (মুকুল) ও শামসুল রহমান খান শাহজাহান তাঁকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করিয়েছিলেন৷ শামসুল হকের নিরুদ্দেশে তারা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করেছেন৷ সমপ্রতি জোগারচরে তাঁর কবরের ব্যাপারে তিনি বলেনঃ তিনিও শুনেছেন ঘটনাটি৷ সত্য হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ কারণ তাঁর সঙ্গে মহিউদ্দিন আনাসরীর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল৷ সেই সুবাদে শামসুল হক মাঝে মধ্যে যেতেন আনসারীর বাড়িতে৷

কাদিমহামজানি গ্রামে এসব প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলার পর ডাঃ আনসার আলী তালুকদার প্রতিবেদককে নিয়ে যান কাদিমহামজানি কবরস্থানে৷ সেখানে চিহ্নিতকরে রাখা একটি কবর দেখিয়ে বলে, এখানে ৪২ বছর আগে শামসুল হককে তারা কবর দিয়েছিলেন৷ তাঁরা বেঁচে না থাকলে সারাজীবন এতবড় একটি ঘটনা অজানাই থাকতো৷

সাপ্তাহিক ন্যায়কথা পত্রিকার খবর

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের কবর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সংরক্ষণের দাবী৷

** ৪২ বছর পর কবর জিয়ারত ও দোয়া পাঠ করল স্বজনেরা৷
ন্যায্য কথা রিপোর্টঃ ভাষা আন্দোলনের রূপকার ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের কবর পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সংরক্ষনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন শামসুল হকের পরিবারের সমন্বয়ে গঠিত শামসুল হক স্মৃতি ফাউন্ডেশন৷

৩০ জুন/২০০৮ শনিবার সন্ধ্যা ৬ টায় টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ দাবী জানানো হয়৷ সাংবাদিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন শামসুল হকের একমাত্র জীবিত ছোটভাই হাজী আনোয়ারুল হক৷ লিখিত বক্তব্য পাঠ করেনঃ ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আলহাজ আবুল কালাম মোস্তফা লাবু৷ বক্তব্য রাখেন ফাউন্ডেশনের আহবায়ক ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন৷ সাংবাদিক সন্মেলনে বক্তারা শামসুল হককে একজন জাতীয় নেতার মর্জাদা দেওয়ার দাবী জানিয়ে বলেন, শামসুল হকের কবর কালিহাতী উপজেলার জোগারচর কাদিমহামজানী কবরস্থান থেকে স্থানান্তর করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়া হোক৷ তারা বলেনঃ শামসুল হক ছিলেন, চক্রান্তের শিকার৷ এই নেতার মস্তিঙ্ক বিকৃতির পর তাঁর নিজ হাতে গড়া রাজনৈতিক দলের কোন লোক খোঁজ খবর নেয়নি৷ এমনকি দীর্ঘ ৪২ বছর পরও নিখোঁজ হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা হয়নি৷ জোগারচরের ঐসব প্রবীণ ঐসব প্রত্যক্ষদর্শী ব্যাক্তিরা বেঁচে না থাকলে কোন দিনই হয়তো রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হতো না৷ এর আগে ফাউন্ডেশনের নেতৃবৃন্দ এসব দাবী নিয়ে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক আখতার আলী সরকারের সঙ্গে সাক্ষাত করেন৷ জেলা প্রসাশক দাবী বাস্তবায়নের জন্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন৷

সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হকের ভাতিজা মওলানা সাইদুল ইসলাম, আমিনুর রহমান, শহীদুল ইসলাম, শামসুল হকের বোনের নাতনী শাহনেওয়াজ পারভীন শান্তি ও দূর সম্পর্কীয় নাতি ডাঃ মোকলেছুর রহমান সহ অনেক আত্মীয়-স্বজন৷ ফাউন্ডেশনের আহবায়ক ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেনঃ তারা ব্যাপক অনুসন্ধান ও খোঁজ খবর নিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন কালিহাতীর কাদিম হামজানী কবরস্থানেই শামসুল হককে দাফন করা হয়েছিল৷ শামসুল হকের ছোটভাই হাজী আনোয়ারুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেনঃ তারা নিশ্চিত হওয়ার পরই পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে কবর জিয়ারত, মোনাজাত ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন৷ এখন কবর নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দের কোন অবকাশ নেই৷

তিনি বলেন ১৯৬৪ সালের বাংলা আশ্বিন মাসে বর্ষাকালে শামসুল হক সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিলেন৷ একদিন থেকে চলে যান৷ সে সময় শারীরিক ও মানষিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল৷ বাড়ি থেকে কখন কোথায় চলে গেলেন অনেক খোঁজা-খুঁজি করেও তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি৷

কবরস্থানের অন্যান্য কবরের উপর পুনরায় কবর দেয়া হলেও শামসুল হকের কবরের উপর আর কোন কবর দেয়া হয়নি৷ প্রবীন লোকদের অনুরোধেই এটা করা হয়ে৷ কবর জিয়ারতের সময় শামসুল হকের একমাত্র জীবিত ছোটভাই হাজী আনোয়ারুল হক উপস্থিত ছিলেন৷ এছাড়াও শামসুল হকের ভাতিজা মোঃ সহিদুল ইসলাম, রেজাউল করিম, আনিসুর রহমান, ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন, শামসুল হকের চাচাতো ভাই সিরাজুল ইসলাম, শাহ্নেওয়াজ পারভীন শান্তি পুস্পস্তবক অর্পণ করেন৷ কবর জিয়ারতকালে শামসুল হকের একসময়ের ঘনিষ্ট কর্মী এবং আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল গফুর বেপারী বলেনঃ যে তিনি দু'আনা পয়সা দিয়ে নেতার হাত ধরে দলে যোগ দিয়েছিলেন৷

শামসুল হক স্মৃতি পরিষদের আহবায়ক এবং হক সাহেবের ভাতিজা ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন বলেনঃ তারা শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই কবর জিয়ারত ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করে দোয়া পাঠ করছেন৷ সদস্য সচিব আবুল কালাম মোস্তফা লাবু বলেনঃ প্রয়োজনে ডি, এন, এ, টেস্ট করলেও তাদের আপত্তি নেই৷

প্রতিদিন শত শত মানুষ কবরটি দেখার জন্য জোগারচর গোরস্থানে ছুটে আসছেন৷ জেলা আওয়ামীলীগ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ভিডিও সিডি তৈরির নির্দেশ দেন৷

পূর্বাকাশ পত্রিকার প্রতিবেদনঃ যেভাবে শামসুল হকের কবরের সন্ধান পাওয়া যায়ঃ
রোববার, ৮ জুলাই/০৭ইং
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও ভাষা সৈনিক শামসুল হকের মৃতু্য রহস্য উদ্ঘাটন এবং তাঁর কবরের সন্ধান পাওয়া নিয়ে সমপ্রতি টাঙ্গাইলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু তাঁর মৃতু্য সংবাদ অনেক আগেই প্রকাশ হয় এবং তা নিয়ে অনুসন্ধানও চলে৷ পারিবারিক সূত্রে জানা যায়ঃ শামসুল হকের ভাতিজা ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন জানান ১৯৭৩ সালেই তাঁর মৃতু্য সংবাদ পাওয়া যায়৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঐ বছর টাঙ্গাইল আসেন৷ বিন্দুবাসিনী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেনঃ মরহুম শামসুল হকের মাটিতে দাঁড়িয়ে ...................৷ এর আগে বঙ্গবন্ধু কখনো শামসুল হকের নামের আগে মরহুম শব্দ ব্যবহার করেননি৷ এই তিনি প্রথম মরহুম শব্দ ব্যবহার করলেন৷ পরে শামসুল হকের ছোটভাই (তখন জীবিত ছিলেন) নূরুল হক, সিরাজুল হক ও ভাতিজা শহিদুল ইসলাম মঞ্চে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে শামসুল হককে কেন মরহুম বলেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কে বা কারা তার পার্টি অফিসে খবর দেয় ১৯৬৫ সালে শামসুল হক যমুনার চরে মারা যান এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়েছে৷ তখন থেকেই পারিবারিকভাবে তাঁর কবরের অনুসন্ধান চলে৷

১৯৯০ সালে টাঙ্গাইল শহরের থানাপাড়ার আব্দুর রহমান মাতবর কালিহাতী উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নের জোগারচর গ্রামে ছেলে বিয়ে করান৷ আব্দুর রহমান সেখানে বেড়াতে গিয়ে জানতে পান ঐ গ্রামে শামসুল হকের কবর রয়েছে৷ তিনি তখন দারুল উলুম মাদ্রাসার গেটের উত্তর পার্শে মনোহারী দোকান করতেনসিরাজুল ইসলাম৷ শিক্ষকতার ফাঁকে এখানে দোকান পরিচালনা করতেন৷ সুতরাং আব্দুর রহমান মাতাব্বর অতি সহজেই তাঁর কাছে খবর পেঁৗছে দেন৷ কিন্তু তিনি তখন এ খবরের সত্যতা সম্পর্কে বিশ্বাস করতে পারেন নি৷

সমপ্রতি জোগারচর কাদিমহামজানি গ্রামের ডাঃ আনসার আলীতালুকদার (৭৫), মোসলেম উদ্দিনকে (৭০) চিকিত্‍সার জন্য নিয়ে আসেন শান্তিকুঞ্জ মোড় সংলগ্ন শামসুল হক মেমরিয়াল হাসপাতালে ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন এর কাছে৷ সেখানে হাসপাতালের ব্যানারে একটি ক্যালেন্ডারে শামসুল হকের ছবি দেখে ডাঃ আনসার আলীর ৪২ বত্‍সর আগের কথা মনে পড়ে যায় এবং ডাঃ আনসার আলী বলেনঃ ১৯৬৫ সালে তিনি (শামসুল হক) জোগারচর গ্রামে মারা যান এবং স্থানীয় কদিম হামজানি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়৷ পরে চলতি বত্‍সরের ১৬ই ফেব্রয়ারী চার সদস্যের একটি দল জোগারচর গিয়ে এলাকার ১০ জন প্রবীন ব্যাক্তি ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন, ডাঃ আনসার আলী তালুকদার, মুজাফর আলী আকন্দ (৮০), মোসলেম উদ্দিন মন্ডল (৭৫), আজাহার আলী (৭০), আব্দুল গনি (৭০), কিশোরী শীল (৯১), রোকেয়া বেওয়া (৫৫), ডাঃ শুকলাল (৮০) প্রমূখের সঙ্গে কথা বলেন৷ তারা বলেনঃ ১৯৬৫ সালের শ্রাবণ মাসের কোন এক শুক্রবার যমুনা পাড়ের জেলেরা একজন পাগল প্রকৃতির লোককে অসুস্থ অবস্থায় স্থানীয় পটল বাজারে নিয়ে আসে৷ তত্‍কালীন কংগ্রেস নেতা মহিউদ্দিন আনসারী শামসুল হককে দেখে চিনতে পারেন৷ তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদ থাকলেও ব্যক্তি সম্পর্ক ভাল ছিল৷ ফলে শামসুল হককে তিনি তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান৷ স্থানীয় হোমিও চিকিত্‍সক শুকলাল দাশ অসুস্থ শামসুল হকের চিকিত্‍সা করেন৷ এভাবে ৭ দিন অসুস্থ থাকার পর শনিবার হাটের দিন বাদ জোহর তিনি মারা যান৷ হাটে গাইজা খলিফার দোকান থেকে কাফনের কাপড় কেনা হয়৷ মহিউদ্দিন আনসারী বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় তাঁর নামাযের জানাজা শেষে স্থানীয় কদিম হামজানি কবরস্থানে দাফন করা হয়৷

প্রত্যক্ষদর্শীর একজন মোসলেম উদ্দিন (৭০) বলেন, শামসুল হক এখানে এসে পাগলের মত ঘোরাফেরা করতেন৷ পোষাক থাকত নোংরা৷ বেশিরভাগ সময় তিনি নদীর পাড়ে বসে থাকতেন৷ নৌকা যেতে দেখলেই চিত্‍কার করে বলতেন, এই মাঝি নৌকা ভেড়াও আমি শামসুল হক৷

পরবর্তিতে আরও কয়েকটি দল গঠন করে আলাদা অবস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে অনুসন্ধান করা হয়৷ সবার রিপোর্ট মিলে যায়৷ কবরটি শামসুল হকের বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷

৪২ বছর পর নিখোঁজ শামসুল হকের কবরের সন্ধান লাভ ! শহরে স্থানান্তরের দাবী৷

কালিহাতীর জোগারচরে (কাদিমহামজানী) ৪২ বছর পর আবিস্কৃত নিখোঁজ শামসুল হকের কবর জিয়ারত করেন তাঁর আত্মীয় স্বজন৷
পূর্বাকাশ প্রতিবেদনঃ ৪২ বছর পর আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নিখোঁজ শামসুল হকের কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে দাবি৷ কালিহাতী উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নে জোগারচর কাদিমহামজানী গ্রামের লোকজন তাদের গ্রামের একটি পুরনো কবরকে শামসুল হকের কবর বলে দাবী করেন৷ পরে শামসুল হক স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সদস্যরা সরজমিন পরিদর্শন ও স্থানীয় প্রবীণ লোকদের সাথে কথা বলে কবরটি শামসুল হকের বলে সিদ্ধান্তে আসেন এবং কবরটি টাঙ্গাইল শহরে স্থানান্তরের দাবি জানান৷ এক্ষেত্রে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য ডি, এন, ও পরীক্ষা করার প্রয়োজণীয়তার কথাও উল্লেখ করা হয়৷ শামসুল হকের ভাতিজা ও নবগঠিত শামসুল হক ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আলহাজ আবুল কালাম মোস্তফা লাবু বলেন, তারা টিম নিয়ে সেখানে গিয়ে ছিলেন৷ ঘটনার বর্ণানা শুনে এবং গ্রামবাসীর দেখানো কবরটি শামসুল হকের কবর বলে তারা প্রায় নিশ্চিত৷ কবরটি টাঙ্গাইল শহরে স্থানান্তর প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ নিরালা মেড়ের গ্যাগের দালানটি যেহেতু ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, সেখানে একপার্শে শামসুল হকের মাজার করা যেতে পারে৷ এই ঘ্যাগের দালানেই ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল তাঁর নির্বাচনের প্রধান অফিস ছিল৷ এখান থেকে তিনি নির্বাচনের পরের দিন সন্ধ্যায় ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে গ্রেফতার হন৷ তাহলে ৪২ বছর পরে হলেও ভাষা সৈনিক এ জাতীয় নেতাকে সন্মান জানাতে পারা যাবে৷ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান খান ফারুক বলেন, শামসুল হকের শেষ জীবনে এসে মস্তিঙ্ক বিকৃত হয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন৷ কাদিমহামজানিতে যে কবরটি এলাকাবাসী শামসুল হকের বলে দাবী করছেন তা সত্য হতে পারে৷ তবে এটা প্রকাশ হতে এতো বছসর লাগল কেন ? এখানে খানিকটা সন্দেহ থেকে যায়৷ তারা স্থানীয় নেতাদের বিষয়টি ভালভাবে পর্যবেক্ষন করতে বলেছেন৷ পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে আলোচনা পর্যালোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে৷

উল্লেখ্য দেলদুয়ার উপজেলার টেউরিয়া গ্রামের অধিবাসী ভাগ্য বিড়ম্বিত নেতা শামসুল হক প্রায় ৪২ বত্‍সর আগে নিখোঁজ হন৷ তারপর থেকে তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি৷ সমপ্রতি জোগারচর গ্রামে কয়েকজন প্রবীন লোক দাবী করেন তারা ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শামসুল হককে ঐ গ্রামের কাদিমহামজানি করবস্থানে করব দিয়েছেন৷

শামসুল হকের নিখোঁজ রহস্য টাঙ্গাইলে টক অব দ্যা টাউন
মহব্বত হোসেন
২৪/০৬/০৭/রবিবার

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের নিখোঁজ রহস্য উদ্ঘাটনের খবরটি ছিল টাঙ্গাইলের টক অব দ্যা টাউন৷ আমার দেশ পত্রিকায় সংবাদটি প্রকাশের পর পত্রিকায় দোকান গুলোতে কৌতুহলী মানুষের ভীড় পড়ে যায়৷ শহরের আনাচে কানাচে চলে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা৷ বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে সংবাদটি ছিল কৌতূহলোদীপক ব্যাপক চাঞ্চলের সৃষ্টি হয়৷ অনেকেই ছুটে যান টেউরিয়া গ্রামে তার পরিত্যক্ত বসত ভিটা দেখতে৷ কালিহাতি উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নের কাদিমহামজানি গ্রামের পুরানো কবরস্থানেও ছুটে যান অনেকে৷ প্রত্যক্ষদর্শী ডাঃ আনসার আলী সহ অনেকেই এ ঘটনা "আমার দেশ" পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পত্রিকা কতর্ৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান৷ তারা বলেনঃ মৃতু্যর আগে অন্তত একটি সত্য ঘটনা প্রকাশ করে যেতে পেরে তারা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন ৷ এছাড়া শামসুল হকের আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই বিষয়টি সম্পর্কে তাদের পতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন৷ তারা যথাযথ মর্যাদায় শামসুল হকের কবরটি সংরক্ষণ করার দাবী জানিয়েছেন সরকারের কাছে৷

নতুন প্রজন্মের যারা শামসুল হক সম্পর্কে জানতেন না তারা তাদের এই অভিজ্ঞতার জন্য দায়ী করেছেন ইতিহাস বিদদের৷

উল্লেখ্য আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক শামসুল হক প্রায় ৪২ বছর আগে নিখোঁজ হন৷ তাঁর এই নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে রহস্য সৃষ্টি করে৷ সম্প্রতি কালিহাতীর জোগারচর গ্রামে তাঁর করবের সন্ধান পাওয়া গেছে৷ স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে শামসুল হকের মৃতু্যর ঘটনা৷ প্রত্যক্ষদর্শী এসব প্রবীণ ব্যক্তি বলেছেন শুধু রাজনৈতিক কারণেই দীর্ঘ ৪২ বত্‍সর মৃতু্যর ঘটনা ধামাচাপা পড়েছিল৷

কালিহাতী (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধী জানান, গতকাল "আমার দেশ" পত্রিকায় ৪২ বঃসর পর আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের নিখোঁজ রহস্য উদ্ঘাটন প্রকাশিত হওয়ার পর এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়৷ এলাকার বিভিন্ন হাট বাজার ও বিভিন্ন মহলে এ ব্যাপার নিয়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয়৷ নাগরপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান "দৈনিক আমারদেশ পত্রিকা" এই এলাকায় ছিল হটকেক৷ গতকাল মূহূর্তের মধ্যে দৈনিক "আমার দেশ" পত্রিকা শেষ হয়ে যায়৷ পাঠকেরা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন "আমার দেশ" পত্রিকা৷
অনেকে স্থানীয় প্রতিনিধিকে টেলিফোন করে পত্রিকার খোঁজ করেন৷ না পেয়ে বাধ্য হয়ে পত্রিকার ফটোকপি সংগ্রহ করেন৷ দৈনিক "আমার দেশে" প্রকাশিত এ সংবাদ ছিল টক অব দ্যা নাগরপুর৷ শামসুল হকের গ্রাম একসময় নাগরপুর উপজেলার অধীন ছিল৷ সেই সূত্রে তিনি নাগরপুরের অধিবাসী ছিলেন৷ এ প্রসঙ্গে আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খন্দকার আব্দুল বাতেন "আমার দেশ"কে বলেনঃ শামসুল হক টাঙ্গাইল ও নাগরপুরের অহংকার৷ তাঁকে নাগরপুর ও টাঙ্গাইলবাসী শ্রদ্ধার সাথে মনে রাখবেন৷ ভাষা সৈনিক এ মহান নেতা কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়৷ তিনি আরও বলেনঃ ঘটনাটি যদি সত্যি হয় তবে এ অবিস্মরনীয় নেতার কবরটি যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণ করতে হবে৷

সখিপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি বলেনঃ আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সম্পর্কে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য "দৈনিক আমার দেশ" ও প্রতিবেদকে অভিনন্দন জানিয়েছেন সখীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ, সখিপুর প্রেস ক্লাব ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব৷ বাংলাদেশ কৃষক লীগের উপ পরিষদের সদস্য সাবেক এম, পি কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহান বলেনঃ শামসুল হকের মত বিদগ্ধ রাজনীতিবীদদের মৃতু্য রহস্য জাতি ৪২ বছরেও জানতে পারেনি৷ এটা তাদের জন্য লজ্জার ব্যাপার৷ শামসুল হকের মত নেতা যদি বোঁচে থাকতেন তাহলে টাঙ্গাইল তথা দেশ ভাল কিছু পেতে পারত৷ ৪২ বছর পর যারা তাঁর কবরের সন্ধান দিয়েছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই৷

উপজেলা আওয়ামীলীগ সম্পাদক শওকত শিকদার বলেনঃ বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের মত নেতাদের হাত ধরেই আজকের আওয়ামী লীগের জন্ম৷ বাঙ্গালী জাতিকে তিনি সেদিনই ঋণী করেছেন- যেদিন শামসুল হক মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য কারাবরণ করেন৷ ৪২ বছর পর হলেও তার কবরের সন্ধান পাওয়ায় শুকরিয়া আদায় করছি এবং যারা এই রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই৷ সখীপুর প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যাপক মোসলেম আবু শাফী শামসুল হকের কবরের সন্ধান দেওয়ায় "আমার দেশ" ও প্রতিবেদকে অভিনন্দন জানিয়েছেন৷

সামসুল হক যতবড় নেতা ছিলেন সে তুলনায় তাঁর স্মৃতিকে উজ্জ্বল করে রাখার প্রচেষ্টা খুব সামান্য৷ তাঁর মহান অবদানের কথা উল্লেখ করলে সহজেই এর অপ্রতুলতা ধরা পড়ে৷ পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগের বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষন বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বললে মস্ত বড় পাপ মনে করা হতো৷ অথচ অসীম সাহসীকতার সাথে মুসলিম লীগের কোঠারি রাজনীতির বিরুদ্ধে শুধু বিদ্রোহই করে ক্ষান্ত হননি পালটা একটা রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগও গঠণ করেন৷ যার সভাপতি করেছিলেন মওলানা ভাসানীকে আর নিজে হয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক৷ এখানেই শেষ নয় দোর্দান্ত প্রতাপশালী মুসলিম লীগ প্রার্থীকে নির্বাচনে পরাজিত করে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ একদিন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ভেঙ্গে স্বাধীন সার্বভৌম রাংলাদেশ জন্ম নেবে তার বীজ এখানেই নিহিত ছিল৷

তিনি কতটুকু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মহান নেতা ছিলেন তার প্রমান মেলে তত্‍কালীন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মেজর গনির সাক্ষাতকারে৷ তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান হলে তিনি ঢাকা চলে আসেন৷ এখানে জনাব শামসুল হকের সঙ্গে এক সময় দেখা হয়৷ তিনি তাঁকে (মেজর গণি) সময় করে তাঁর সাথে সাক্ষাত করার জন্য অনুরোধ করেন৷ তিনি (গনি) একদিন তার বাসায় গেলেন এবং দুইজনের মধ্যে রুদ্ধদ্বার কক্ষে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়৷ তিনি (শামসুল হক) বলেন, পাকিস্তান তো হল৷ এখন একে রক্ষা করাই হল বড় কথা৷ বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়ের মধ্যে ১২শত মাইল ব্যবধান৷ মাঝখানে ভারতের মত বিশাল এবং শক্তিধর দেশ৷ শুধু তাই নয় পূর্ব বাংলার তিনদিক দিয়ে ভারত বেষ্টিত৷ ভারত ইচ্ছা করলে যে কোন সময় তাকে দখল করতে পারে৷ এখানে দেশরক্ষা বাহিনী কোন শক্তিশালী ঘাঁটি নেই৷ এমতাবস্থায় এখানে শক্তিশালী দেশরক্ষা বাহিনীর একটা ঘাঁটি একান্ত প্রয়োজন৷ ভারত আজও অখন্ডতার স্বপ্ন দেখে৷ সে বাংলা বিভক্তি মেনে নিয়েছে৷ অবস্থার চাপে এই বিভক্তির ভিতরেই তারা বাংলার ঐতিহ্য বীজ লুকিয়ে রেখেছে৷ সময় মতো স্বমূর্তিতে আত্ম প্রকাশ করতে পারে৷ অপরিনামদর্শী পাকিস্তানী শাসক বর্গ এ সত্য উপলব্ধি করতে পারছেন না৷ অথবা অনুভব করলেও বেলুচ পাঠান দিয়ে উপনিবেশিক কায়দায় পূর্ব বাংলাকে শাসন করতে চায়৷ এটা মেনে নেওয়া যায় না৷ সুতরাং তিনি যখন সেনাবাহিনীতে আছেন তখন বাঙ্গালী বাহিনী গঠনের দায়িত্ব নিতে পারেন৷ আর তিনি (শামসুল হক) বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা ভাবনা করেছেন৷ এ ব্যাপারে অনুকুুল সাড়াও পাচ্ছেন প্রচুর৷ সেনাবাহিনীতে যাতে অধিক বাঙ্গালী নিয়োগ করা যায় তজ্জন্য তারা চাপ প্রয়োগ করতে পারবেন৷ মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারায় ব্যস্ত৷ সুতরাং তার দ্বায়িত্ব তিনি পালন করুন৷ তার (শামসুল হক) দায়িত্ব তিনি পালন করবেন৷

শামসুল হক সাহেবের এ বক্তব্য তাকে (মেজর গনি) আরও বেশি অনুপ্রানীত করলো৷ এরপর থেকেই তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনে সক্রিয় তত্‍পরতা শুরু করেন৷

মেজর গনির সাক্ষাত্‍কারে দেখা যায় শামসুল হক শুধু একটি বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্যেই তার চিন্তা ভাবনা সীমাবদ্ধ রাখেননি৷ তখন থেকেই একটি সার্বভৌম পূর্ব বাংলার চিন্তা করেন যার একটি সুসজ্জিত সেনাবাহিনী থাকবে৷ ১৯৭০ এর নির্বাচনে জনগণ যে সব দাবীর সমর্থনে আওয়ামীলীগকে নিরঙ্কুশ মান্ডেট দিয়েছিল, সেসব দাবীর মধ্যে এ দুটি ছিল অন্যতম৷ যা শামসুল হক আগেই চিন্তা করেন৷

১৯৪৯ এর ২৬ এপ্রিল উপ-নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন৷ বাসাইল, মির্জাপুর ও নাগরপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে তার কর্মীদেরকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য নির্বাচন পরবর্তী এক কর্মী সভার আয়োজন করেন তাঁর নিজ গ্রামে৷ এই কর্মী সভায় শামসুল হক তাঁর বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেনঃ হোসনে শহীস সোহরাওদীরে সভাপতি করে তারা একটি বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন করবেন৷ কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরায়ার্দীর কাছ থেকে অনুকুল সাড়া না পেয়ে এ, কে, ফজলুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে উত্তর পাননি৷ নতুন দল গঠনের জন্য ইতোমধ্যেই একটি গঠনতন্ত্র তৈরি করেন এবং সে মোতাবেক গঠনতান্ত্রিক কাঠামো দাঁড় করেন৷ শেরে বাংলার কাছ থেকেও সাড়া মেলেনি৷ পড়ে বগুড়ার মোহম্মদআলীর স্মরণাপন্ন হন৷ তিনি নানা অজুহাতে পাশ কাটিয়ে যান৷ এর মধ্যে সংবাদ পেলেন যে, মওলানা ভাসানী ধুবড়ীর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় এসে আলী আমজাদ খানের বাসায় অবস্থান করছেন৷ শামসুল হক তাঁর নিকট ছুটে যান৷ দীর্ঘ আলাপ আলোচানরা পর ১৫০ নং মোগলটুলীতে একটি কর্মী সভার আয়োজন করেন৷ এখানে সাব্যস্থ হয় ২৩/২৪ জুন কর্মী সন্মেলন রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হবে৷

সন্মেলনের নির্দিষ্ট দিনে তিনি শতাধিক নেতা কর্মী সহ উপস্থিত হন৷ মওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করেন৷ শামসুল হক মূলদাবী নামে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রথম খসড়া ম্যানিফেষ্টা উস্থাপন করেন৷ বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রতিনিধি ও স্থানীয় কর্মীদের এই সন্মেলনে অনেকগুলি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়৷ তন্মধ্যে বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন, মন্ত্রীমন্ডলীর কার্যকলাপ, ছাত্রসহ রাজবন্দীদের মুক্তি, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা চালু, খাদ্য সংকট দূর করার জন্য তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি গঠন প্রভৃতি৷

২৩ জুন অধিবেশন শেষে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়৷ এতে মওলানা ভাসানী সভাপতি এবং শামসুল হক সাধারন সম্পাদক মনোনীত হন এবং শেখ মুজিবর রহমান ও মোস্তাক আহমদ যথাক্রমে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন৷ এতে ঘোষণা করা হয় পরদিন বিকেল ৫:৩০ মিনিটে আর্মানিটোলা ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হবে৷

নতুন দল আওয়ামীলীগের আত্মপ্রকাশ ও জনসভার সংবাদ ঢাকা শহরের লোকের মুখে মুখে৷ জনসভায় যোগদানের জন্য চারদিকে সাজ সাজ রব৷ এতে কায়েমী স্বার্থবাদী দল মুসলিম লীগের মাথা গরম হয়ে যায়৷ তারা কিছু কুখ্যাত গুন্ডা বাহিনী ঠিক করল যাতে জনসভা না হতে পারে৷ শামসুল হকরা সভায় উপস্থিত হওয়ার আগেই লীগের গুন্ডারা মঞ্চের চেয়ার টেবিল ভাংচুর করে দ্রুত সরে পড়ে৷ পরবর্তীতে সভায় হামলা করার সাহস আর পায়নি৷ শামসুল হক এ সভায় মুসলিমলীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতায় হুশিয়ার করে দেন যে মুসলিম লীগ খান্ত না হলে তারাও জনগনকে নিয়ে তাদের গুন্ডাবাহিনী মোকাবেলা করবে৷

৪২ বছর পর
আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক
নেতা সামছুল হক এর
নিখোঁজ রহস্য উদ্ঘাটন ও কবরের সন্ধান লাভ৷

এই লেখাটি ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপনের লেখা ও বক্তৃতা থেকে আংশিক পরিবর্তিত আকারে নেয়া হয়েছে৷

৪২ বছর পর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক জাতীয় নেতা, ভাষা সৈনিক বঙ্গরত্ন শামছুুল হক এর মৃতু্যর রহস্য উদঘাটনের পিছনে যার অনেক অনুসন্ধান অনেক গবেষণা দীর্ঘ এক যুগের ব্যাপক জিজ্ঞাসা মনের সফল সাধনা যাঁর নিরলস ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতে এই রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে তার নাম ডাঃ মোঃ সাইফুল ইসলাম (স্বপন) পিতা মোঃ আবুব্কর সিদ্দীক, নেতা শামছুুল হক এর (চাচাত) ভাতিজা শামসুল হক মেমোরিয়াল হসপিটাল- (গরীবদের চিকিত্‍সার আশ্রয়স্থল) থানা পাড়া, টাঙ্গাইল এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান৷ তিনি শক্ত হাতে হাল না ধরলে ঐতিহাসিক এই সত্যটি কোন কালেই আলোর মুখ দেখতো না৷ ১৯৫৬ সালে জুরিক ম্যান্টাল হাসপাতালের ডাঃ মাকসুদুর রহমান, ডাঃ সাঈদ হায়দার এর তথাকথিত সিজোফ্রেনিয়ার রুগী নেতা সামছুুল হক চিকিত্‍সা শেষে টাঙ্গাইল ফিরে এলে, স্ত্রী ডঃ আফিয়া হক শশুর দবির উদ্দিন এবং শ্বাশুরি শরিফুন্নেসার কাছ থেকে চির বিদায় নেন৷ দুই মেয়েকে (শাহীন ও শায়কা) মানুষ করার জন্য আলাদা থাকতে শুরু করেন এর পর থেকে সামছুল হক স্ত্রী ও কন্যার বিরহে ভারসাম্যহীন হতে থাকেন৷ পিতার নাবুঝ হৃদয় যোগ্য পুত্রের জীবন্ত লাশ বইতে বইতে শাহসাহেব এবং হেকিম সাহেবের দারস্থ হলে ফতোয়া দেওয়া হয় যে, হক সাহেব সাধারন জিন্দেগীর বাইরে কামেলিয়্যাত হাছেল করেছেন৷ তাকে আর লোকালয়ে রাখা যাবে না৷ নির্জন একাকী পরিবেশে তাকে ধ্যান মগ্ন থাকতে দিতে হবে৷ হেকিমি চিকিত্‍সা মতে ১৯৫৮ সাল থেকে এক মাল্লা বিশিষ্ট জাবরার চরের গেন্দু মাঝীর পিনিস নৌকায় নেতা সামছুল হক জল-হাওয়ায় দিনের পর দিন বিচরণ করতে থাকেন কখনো ধলেশ্বরী জনপদে কখনো যমুনার জনপদে৷ নৌকার চাল, ডাল, চিড়া, মুড়ি, গুড়, দুধ, চিনি বিস্কুট রান্না বান্নার সকল সামগ্রী শেষ হলে প্রতি মাসেই বাড়ি আসতেন নেতাজী৷ একবছর চিকিত্‍সা শেষে জনাব হকের স্বাস্থ্যের উন্নতি না হওয়ায় তার পিতা দবীর উদ্দিন ১৯৫৯ সালে শোকে দূঃখে হঠাত্‍ ইন্তেকাল করেন৷ ১৯৬০ সালে নেতাজীর বিবাহ বিচ্ছেদের পর ডঃ আফিয়া খাতুন ও ডঃ দ্বীন এর শুভ বিবাহ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সামছুল হক একবারে ভেঙ্গে পরেন৷ তাত্‍ক্ষনিক ভাবে নিজ গ্রামে চলে আসেন, সবাইকে নিয়ে এলাসিন স্কুলে মিটিং করেন এবং নতুন পার্টি খেলাফতে রাব্বানিয়াত গঠনের কথা বলেন৷ ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক ফেরিওয়ালার মত কখনো নৌকায় কখনো গাড়িতে ঢাকার অলিতে গলিতে নিজের নতুন পার্টির প্রচার একাই করেছেন এবং রশিদ দিয়ে চাঁদা কালেকশন করেছেন, এটা তার ভেতর ভীষণ হতাশার বহিঃপ্রকাশ৷ ১৯৬৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সামছুল হক শেষ বারের মত নিজ বাড়িতে আসেন তার মা তখন মৃতু্য সজ্জায়৷ নেতার আপন তিন ভাই ভীষণ বিরক্ত হলেন জনাব হকের উপর কারণ মায়ের সু চিকিত্‍সা নাই, পথ্য নাই, সেবা যত্ন নাই৷ সামছুল হক পরিস্থিতি বুঝে নিজ বাড়িতে প্রাণ প্রিয় মাকে শেষ বারের মত দেখে পাশেই আপন চাচী জবেদা গনীর কাচারী ঘরে উঠলেন রাত ভর নামাজ পড়লেন একটুও ঘুমালেন না৷ শিশুদের মত একটু বেলা করে দরজা খুলে ঘরের বাইরে মজলিশে এসে পাড়ার সব শিশু সহ অভিভাবকদের ডাকলেন৷ নিজ হাতে বিলাতি দুধ গুলে শিশুদের খাওয়ালেন৷ নতুন পার্টির জন্য সবার কাছে সদস্য পদের বিনিময়ে টাকা চাইলেন৷ গ্রামের সকল শিশু তার হাতের দুধ খেয়ে ধন্য হলো৷ অভিভাবকরা সাধ্যমত যে যা পারলেন সাহায্য করলেন৷ তিনি খেলাফতে রাব্বনীয়াত পার্টির রশিদ দিতে ভুললেন না৷ বিদায়ের আগে সবাইকে ডেকে উপদেশ দিলেন মেয়েদের শিক্ষার কোন বিকল্প নেই, নারীদের শিক্ষিত করতে হবে ভবিষ্যত্‍ বাণী করলেন আমি একদিন হারিয়ে যাব এই দেশ একদিন নিশ্চিত নেতা বিহীন হবে তখন মানুষ আমাকে স্মরণ করবে এবং আমাকে পাবে কথাগুলো শেষ করেই ভাইদের তিরস্কার কাঁধে নিয়ে ৩০ সেপ্টম্বর ১৯৬৪সালে বাড়ি থেকে চিরতরে নিরুদ্দেশের পথে রওনা হন৷ চোখের সামনে ছেলের এহেন অবস্থা আর ছেলে নিরুদ্দেশের খবরে মাতা শরিফুন্নেছাও ১৯৬৮ সালে মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়লেন৷ উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর "সামছুল হক তোরণ" টাঙ্গাইলে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় "এলেঙ্গা সামছুল হক মহাবিদ্যালয়৷" ১৯৬৯ এ ছিলিমপুর হাইস্কুল মাঠের নির্বাচনী সভায় সামছুল হক অনর্্তধান রহস্য উদ্বঘাটন কমিটির ঘোষনা দেন শেখ মুজিব এবং ১৯৭৩ সালে টাঙ্গাইল মিটিংএ "মরহুম" সামছুল হকের টাঙ্গাইল বলে সামছুল হককে সম্ভোধন করলে জন মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্ম হয় যে, নেতা সামছুল হকের নিশ্চত মৃতু্য হয়েছে৷ তখন থেকেই ডাঃ স্বপন খুঁজে বেড়ান বাংলার বিভিন্ন জনপদ কোথায় নেতার খোঁজ পাওয়া যাবে, পাওয়া যাবে নেতার অনর্্তধানের বিষয়টি৷
যোগ্য লোকের অভাবে সামছুল হকের অনর্্তধান রহস্য রহস্যই থেকে যায় সুদীর্ঘ ৪২ বছর পর্যন্ত৷ জাতীয় নেতা বঙ্গরত্ন ১৯৬৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর নিজ বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে মাস খানেক আগের মত নৌকা বিহার শেষে বাড়ি ফেরার পরিবর্তে ঘিওর মানিকগঞ্জ অঞ্চলে যাবরার নৌকাকে বিদায় দিয়ে পাবনার প্রবীণ ন্যাপ নেতা আব্দুল হালিমের সাথে চট্টগ্রাম চলে যান৷ ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রামে অবস্থান শেষে তিনি কলকাতায় বিচরণ করতে থাকেন৷ ১৯৬৫ সালে জুনের শেষের দিকে কলকাতায় কংগ্রেস নেতা মওলানা মহির উদ্দিন আনছারীর সাথে সাক্ষাত্‍ হলে মওলানা তাকে সিরাজগঞ্জ নিয়ে আসেন৷ যমুনার তীর ঘেষা অঞ্চলে তিনি দুই তিন মাস অবস্থান করেন৷ কখনো কোন নৌকায়, কখনো কোন খাদ্যের ছোট হোটেলে, কখনো দোকানে, কখনো কোন বাড়ীতে,কখনো বা কোন খোলা মাঠে৷ হটাত্‍ তিনি ভীষণ অসুস্থ হলে কংগ্রেস নেতা নিজ বাড়ীতে এনে তার পরিবারের সবাইকে পরিচয় দিয়ে বললেন তিনি সামছুল হক আওয়ামীলীগের জন্ম দাতা বড় নেতা৷ বর্তমানে একজন বড় মাপের দরবেশ, তোমরা তাঁর সেবা করতে ভুল করবে না৷ কথা মত বাড়ীর সকলেই নেতার সেবা যত্ন ও খাবার দাবারে যত্নশীল হল৷ মহির উদ্দিন আনছারির নির্দেশেই বাড়ীর নিজস্ব নাপিত এবং চিকিত্‍সক নেতার সেবা করতে থাকেন৷ সাত দিনের কোন চিকিত্‍সা-সেবাই কাজে লাগলো না৷ পরিশেষে সামছুল হক ১৯৬৫ সালে সেপ্টেম্বরে পাক ভারত যুদ্ধের পর মৌলভী মহির উদ্দিন আনছারীর বাড়ীতে অসুস্থ অবস্থায় ১১ সেপ্টেম্বর শনিবার বাদ যোহর তার মৃতু্য হলে এই মহান নেতার জানাজা শেষে কদিম হামজানী কবর স্থানে নায়ক মান্নার বাবা এবং দাদা সহ গণ্য মান্য শতাধিক লোকের উপস্থিতীতে নেতা কে সমাহিত করা হয়৷ একটি শর্তে যে, বিষয়টি মহির উদ্দিন আনসারীর মৃতু্যর আগ পর্যন্ত গোপন রাখতে হবে রাজনৈতিক কারণে৷ কংগ্রেস নেতা তার এবং তার পরিবারের কোন ক্ষতি হতে পারে এই ভেবে লাশটি সলিল সমাধি করতে চাইলে উপস্থিত জনতা বাধ সাধে পরে শর্ত সাপেক্ষে তাকে দাফন করা হয়৷ শর্তটি ছিল আনসারির মৃতু্যর আগ পর্যন্ত খবরটি গোপন রাখতে হবে৷ মৃতু্যর পর খবরটি প্রকাশ করা তোমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়বে৷ দুইজন ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনীতিবিদ হওয়ায় একজনের বাড়িতে অন্য জনের মৃতু্য নানা ধরনের রাজনৈতিক কলহ তৈরি হতে পারে বিধায় মৃতু্য দাফন খবরটি গোপন রাখা হয়৷ তাছাড়া আমরা শুনেছি তাঁর আপনজন বলতে এই দুনিয়ায় কেহই নাই৷ স্ত্রীর সাথে ছাড়া ছাড়ি হবার পর মেয়েরা - ভাইয়েরা কেহই নেতার খোঁজ খবর নিতেন না৷ উপস্থিত সকল মুসুল্লিগণ শর্ত মেনেই নির্দিষ্ট স্থানে তাকে দাফন করেন৷ গোর রক্ষক বছরের পর বছর কবরটি সুরক্ষিত এবং সুনির্দিষ্ট করে রাখেন৷ প্রকৃতিও গোররক্ষককে সহসাই উইপোকার বড় বড় ঢিপ বানিয়ে স্মরণ করাতেন যে, এই কবরটি একজন মহান ওলি-আল্লাহর, একজন বৈপ্লবিক-দার্শনিক রাজনীতিকের৷ সুতরাং এই কবরটি ধ্বংস হবার নয়৷ বাতেনি কবরটি একদিন জাহের হবে একজন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির মহান ইচ্ছায় আমি মনে করি আপনি নেতার রক্তের সেই মহান মানুষ৷ আমি লোক চিনতে ভুল করিনি আপনি এখুনি চলুন কবর জিয়ারত করুন আপনার চাচার কবর বুঝে নিন৷ সারা দেশকে বলে দিন নেতা সামছুল হক রুহানী জগতের বাসিন্দা এবং কদিম হামজানিতে তার কবরস্থান রয়েছে সুনির্দিষ্ট এবং অত্যন্ত তাজিমের সাথে৷ ৪২ বছর পর ব্যাপক অনুসন্ধানের পর এই মহান নেতার মৃতু্যর রহস্য ও কবরের সন্ধান মিলেছে৷ আর এই মহান কাজের নেতৃত্বে ছিলেন সামছুল হকের পরিবারের সদস্য ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন এবং পরিবারের প্রায় সকল সদস্য এবং আত্নীয় বর্গ৷
৪২ বছর পর মৃতু্য রহস্য উদঘাটনের নেপথ্য কাহিনীঃ
২০০৭ সালের ০৭ জানুয়ারি কদিম হামজানী প্রকাশ যোগার চর অঞ্চলের ডাক্তার আনসার আলী তালুকদার (৭৫) বয়স, পিতা মরহুম বাহাদুল্লা তালুকদার একজন হোমিও চিকিত্‍সক টাঙ্গাইল হোমিও কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল, মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন৷ টাঙ্গাইল শহরের বেপাড়ী পাড়ায় তার বেহাই বাড়ী আঃ রহমান (আব্দুল মাতব্বর) এর বাড়ী বেড়াতে এসে সামছুল হক মোমোরিয়াল হসপিটালের একটি রঈীন ক্যালেন্ডারে চোখ পড়তেই দেখেন সেই চেনা মুখ সামছুল হকের ছবির পাশে লেখা রয়েছে আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও মহান ভাষা আন্দোলনের রূপকার অন্য পাশে গোটা বিশ্বের কল্যাণকামী চিন্তা নায়ক ও সংগ্রামী সৈনিকদের একজন - সামছুল হক৷ ক্যালেন্ডারের প্রতি মনোসংযোগের পর অজ্ঞাত সারেই ৪২ বছর পুর্বে নেতা সামছুল হকের দাফনের কথা মনে পরে যায়৷ তিনি তার বেহাইকে বললেন সামছুল হক-দরদী কে এই মহান ব্যক্তি যিনি মহান ব্যক্তির নামে হসপিটালটির নামকরণ করেছেন৷ আমি বিশ্বাস করি, যে মহান ব্যক্তির মধ্যে এমন গভীর সামছুল হক প্রেম লুকায়িত আছে তিনি অতিশয় জ্ঞানী-প্রজ্ঞাদীপ্ত এবং ইতিহাস অনুসন্ধানী, আমি তার হসপিটাল পরির্দশণ সহ তাকে দেখতে চাই৷ তার নিকট নেতার মৃতু্য রহস্য বলতে চাই৷ বেহাই আব্দুর রহমান বললেন, এই হসপিটালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়াম্যান সামছুল হকের চাচাত ভাতিজা ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন ৷ চলুন তার হসপিটাল এখনই পরিদর্শন করে ডাঃ স্বপনের সাথে কথা বলি৷ আমি জানি এই হসপিটালের আয় থেকেই পালিত হবে সামছুল হকের জন্ম বার্ষিকী এবং নিখোঁজ বার্ষিকী৷ ১৪ই এপ্রিল (এক বৈশাখ) ২০০৬ এর হসপিটাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন ডাঃ স্বপন প্রধান অতিথি ডঃ আশরাফ সিদ্দিকীর সামনে৷ কথা মত ডাঃ আনসার আলী তালুকদার ১৬-০২-২০০৭ সালে হসপিটালটি পরিদর্শন করে মুগ্ধ হন৷ ডাঃ স্বপনের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, নিজে এত বড় গরীবের ডাক্তার (সার্জন) হবার পরও নিজের নামে হসপিটাল না করে নিজের অর্থায়নে অন্যের নামে হসপিটাল করা লায়ন হার্টের কাজ আমি আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করি৷ আমি আপনার কাধেঁ আমার কাধেঁর প্রচন্ড বোঝাটি তুলে দিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে চাই৷ একটু খানি হলেও পাপের বোঝা হালকা করতে চাই, এই মহান বাগ্মীময় নেতা সামছুল হককে তিনি রাজনৈতিক সুবাদে ব্যক্তিগত ভাবে জানতেন এবং চিনতেন৷ ১৯৪৯ সালে তার বক্তৃতা তিনি শুনেছেন ১৯৪৮ সালে আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে, ১৯৫৪ সালে পার্কের ময়দানে যুক্তফ্রন্ট এর মিটিংএ৷

ডাঃ আনছার আলী তালুকদার বলেন, কংগ্রেস নেতা মহির উদ্দিন আনছারীর মৃতু্যর পর আমি পাঁচ সাত জনের একটি টিম নিয়ে টাঙ্গাইল প্যারাডাইস পাড়ায় আব্দুর রশিদের বাসায় এসে খবরটি বলি৷ বলা মাত্র উনি পারলে আমাদেরকে মারতে আসেন৷ উল্টো উনি আমাদেরকে বুঝালেন যে, সামছু ভাই একজন উচু স্তরের দরবেশ বেশে বিভিন্ন মসজিদ মাজারে বিভিন্ন ফিকিরে অবস্থানরত আছেন৷ ১৯৫৭ সালে আমি আব্দুর রশিদ মির্জাপুর হাসপাতালে সামছু ভাইয়ের মৃতু্য সংবাদ শুনে নেতা বদিউজ্জামান খানকে বললে উনি ইত্তেফাকে মৃতু্য সংবাদটি ছেপে দেন৷ পরে দেখা যায় সামছু ভাই স্বশরীরে টাঙ্গাইল মাদরাসা রোডে হেটে বেড়াচ্ছেন অথচ মৃতু্য বরণ করেছেন তাঁর চাচাত ভাই এজাজ মাস্টার৷ কবি আল মুজাহিদী উত্তেজিত নেতাকে ইত্তেফাক ভবনে যেতে সহায়তা করেন এবং তার হুমকির প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ লিপি ছাপতে ইত্তেফাক বাধ্য হয়৷ সুতরাং সামছুল হকের মৃতু্যর খবরটি আমরা বিশ্বাস করি না৷ তিনি এখনো জীবিত আছেন৷ নিরাশ হয়ে আমরা ফিরে যাই৷ বছর পাঁচেক পরে নেতার কয়েকজন আত্মীয়ের খবর পেয়ে আমরা আবার টাঙ্গাইলে আসি৷ নেতার আত্মীয়রা হলেনঃ-নুরুল হক, নেতার আপন ভাই, সিরাজুল হক, নেতার আপন চাচাত ভাই, আব্দুর রশিদ মিয়া ফুফাত ভাই, আব্দুল হামিদ মিয়া ফুফাত ভাই, আব্দুস সালাম মিয়া ফুফাত ভাই, মৌলভী তাজউদ্দিন মিয়া নেতার বেহাই, মৌলভী শিকিম মিয়া নেতার বোন জামাই৷
এদের সাথে নেতার মৃতু্য সংবাদের কথা আলাপ করলে এরা আমলে না নিয়ে উল্টো আমাদের গালি গালাজ করতে থাকে৷ এভাবে দীর্ঘ ৪২ বছর নেতার মৃতু্য রহস্যটি অগোচরেই থেকে যায়৷ ডাঃ আনসার আলী তালুকদার এর মুখে এমন আজগুবী গল্প শুনে প্রথমে উনাকে আমরাও গণ ধোলাই দিতে চেয়েছিলাম৷ গণ ধোলাইয়ের লক্ষ্যে বড় ভাই শহিদুল ইসলাম ছোট ভাই রুহুল আমীন চাচা সিরাজুল হক মতি মামা মেজো মামাকে ডেকে আনলে তারা আমাকে বলে এর আগেও বহুবছর ধরে এই লোকটি ঘোরা ফেরা অব্যহত রেখেছে সামছুল হকের মৃতু্য রহস্যটি বলার জন্য অথচ আমরা কেহই ঘটনাটি খতিয়ে দেখি নাই৷ এমনকি ঐ এলাকাটি পরিদর্শন করিনাই কারণ আমাদের সদিচ্ছা ও সামর্থ কোনটাই নাই৷ আল্লাহ তোমাকে সবদিকেই যোগ্য বানিয়েছেন ইচ্ছা করলে তুমি এই রহস্যের একটা সুরাহা করতে পার৷ এমন কথায় আমার ইচ্ছা শক্তি জাগরুক হল৷ তাত্‍ক্ষনিকভাবে একটি প্রথমিক তদন্ত টিম (ডাঃ সাইফুল, ডাঃ শফিকুল, ব্যাংকার শহিদুল, মাতব্বর আব্দুর রহমান, মাতব্বর চান মিয়া, মাতব্বর তারা মিয়া) তদন্ত টিম ১৭-০২-২০০৭ ও ১৮-০২-২০০৭ ইং তারিখে জোগার চর অঞ্চলের প্রায় একশত লোকের সাক্ষাত্‍কার গ্রহণের পর ষাট উধর্্ব লোকদের মুখথেকে বেড়িয়ে আসে এক করুণ মৃতু্যর ইতিহাস৷ মওলানা মহির উদ্দিন আনসারীর ছেলে হায়দার আনসারি বলেন, বড় ভাই কাদের আনসারী, রহিছ আনসারি, দুলাভাই মোকছেদ আলী আকন্দ-সবাই নেতা সামছুল হককে মৃতু্যর পর গোসল করান বাবার নির্দেশে৷ মৃতু্যর আগেও একাধিক বার নেতা সামছুল হক আমাদের বাড়ীতে এসেছেন৷ কাদের আনসারীর জীবিত বৌ বললেন, একজন নেতা গোছের আদা পাগলা লোককে আমার শশুর আমাদের বাড়িতে প্রায়ই খাবার দিতে বলতেন সর্ব শেষে অসুস্থ অবস্থায় ৭ দিন অবস্থানের পর তার মৃতু্য হয়৷ রোকেয়া বেওয়া, মহির উদ্দিন আনসারির মেয়ে বললেন, অসুস্থ অবস্থায়ও প্রথম দুই তিন দিন আমরা ঐ কথিত পাগল লোকটিকে নামাজ পড়তে দেখেছি, অচেতন অবস্থায় তার স্ত্রী এবং দুটি মেয়ের কথা বলতে শুনেছি শেষের দিন শনি বার তিনি প্রায় অচেতন ছিলেন৷ হুমায়ন, বিপ্লব, সোহেল আনসারী বললেন, দাদার মুখে শুনেছি সামছুল হক ছিলেন মস্ত বড় রাজনৈতিক নেতা৷ ভাষা আন্দোলনের পর দীর্ঘ এগার মাস জেলখানায় তার মগজ ধোলাই করা হয়৷ পরে আওয়ামী রাজনীতিতে তিনি আর মূল ধারায় ফিরতে পারেন নাই৷ পথে পথে রাজনৈতিক ফেরিওয়ালার মত ঘুরেছেন৷ পথিকের বেশে রাজনৈতিক ফেরিওয়ালার মত সারা দেশে নৌকায় নৌকায় ঘুরেছেন৷ মোসলেম উদ্দিন-৭৫, মোজাফ্ফর আলি আকন্দ-৮০ আব্দুল গনি-৭০,আজাহার আলী-৭০, শাফি তালুকদার-৬৫,বাবর তালুকদার-৬২, গোর রক্ষক, মোতাহার শেখ-৯০ এরা বললেন, রাজনৈতিক কারণেই আমরা নেতা সামছুল হককে চিনতাম৷ একাধিক বার আমরা তাকে এই অঞ্চলে দেখেছি৷ কখনও সিরাজগঞ্জে কখনও যোগার চরের নৌকা ঘাটে, কখনও নদীর তীরে লোকালয়ে হাটতেন৷ রাত হলে অনেক সময় ভিড়ানো নৌকাতে রাত্রি যাপন করতেন, কখনো দোকানে, কখনো কারো বাড়ীতে৷ স্থানীয় লোকজনকে তিনি ডেকে বলতেন, আমি সামছুল হক নতুন পার্টি করব, খোলাফায়ে রাশেদীনের মত দেশ চালাবো, এক জন মানুষও অভুক্ত থাকবেনা, সবাই সুশিক্ষার সুযোগ পাবে৷ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবেনা সুতরাং আমাকে চাঁদা দাও৷ যমুনা নদীর তীরে মাঝি মাল্লাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলতেন ঐ, মাঝি নৌকা ভিড়াও জানো না আমি সামছুল হক বলছি৷ দিনের পর দিন এভাবে তিনি রাজনৈতিক ফেরিওয়ালার মত তার মত প্রচার করছেন এই অঞ্চলে৷ খেয়ে না খেয়ে অসুস্থ অবস্থায় দীর্ঘ দিন যোগার চর অঞ্চলে বিচরণের পর হঠাত্‍ ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হন৷ নেতা সামছুল হক নিজেও হোমিও চিকিত্‍সায় পারদশর্ী ছিলেন, তিনি নিজে হোমিও ঔষধ কিনে খেতেন৷ মুমূষর্ু অবস্থা হলে এলাকাবাসী তাঁকে কংগ্রেস নেতা মহির উদ্দিন আনসারীর বাড়ীতে পেঁৗছে দেন৷ ০৭ দিন অসুস্থ থাকাকালীন এলাকার সুপরিচিত হোমিও ডাক্তার শুকলাল তাঁর চিকিত্‍সা সেবায় নিয়োজিত থাকেন৷ কিশোরী মহনশীল তার দাড়ি মোচ, মাথার চুল সুসজ্য করার কাজে নিয়োজিত থাকেন৷ ৭ দিন অসুস্থ থাকার পর পাক ভারত যুদ্ধের পরের শনিবার অর্থাত্‍ ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ সাল বাদ যোহর তিনি মৃতু্য মুখে পতিত হন৷ মৃতু্যর আগে তিনি কাউকে দোষারোপ করেননি শুধু মাত্র নিয়তিকে দায়ী করেছেন৷ বাদ আছর তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয় মৌলভী মহির উদ্দিন আনসারীর ইমামতিতেই৷ ঐ দিন হাটের দিন থাকায় আনসারী সাহেব লাশ সলিল সমাধির পরিবর্তে দাফন করতে বাধ্য হন স্থানীয় জনগনের ইচ্ছায়৷ এর আগে আনসারীর বড় ছেলে আঃ কাদের আনসারী ও মেয়ের জামাই মোকছেদ আলী আকন্দ নিজ হাতে সামছুল হক এর লাশ গোসল করান৷ ডাঃ আনসার আলী ও রহিজ উদ্দিন আনসারি গইজা খলিফার দোকান থেকে কাফনের কাপড়এনে নেতাজীকে কাফন পড়ান, এবং সুনির্দিষ্ট জায়গাতে নেতাজীকে করব দেয়া হয় ৷
প্রথমে এটি পারিবারিক কবরস্থান হলেও বর্তমানে এটি এলাকাবাসীর একমাত্র বৃহত্‍ গোরস্থানে রূপ নিয়েছে৷ গোর খাদেমের মতে কবরটি প্রকৃতিগত কারণেই সুনিদিষ্ট এবং চিহৃিত স্থানেই রয়েছে৷ এই কবরটি দেখিয়ে ডাঃ আনসার আলী তালুকদার বললেন ৪২ বছর আগে একটি হলফ নামা মেনে নিয়ে বঙ্গরত্ন সামছুল হক কে কবর দিয়েছিলাম৷ আমি আমার নেতার ভাতিজার হাতে সত্য অর্পণ করলাম৷ আমরা এলাকাবাসী দায়মুক্ত হলাম৷ আমরা বেঁচে না থাকলে আর ডাঃ সাইফুল ইসলাম (স্বপন) কে খুঁজে না পাওয়া গেলে এত বড় একটি ঐতিহাসিক সত্য আজীবন অজানাই থেকে যেত৷ আজকে আমরা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি৷
কবর জেয়ারত শেষে ডাঃ স্বপন শপথ বাক্য পাঠ করেন যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন জনাব সামছুল হকের জন্ম-মৃতু্য দিবস তিনি পালন করবেন এবং দেশবাসীকে তিনি এই সত্যটি জানাবেন৷ কারণ ডাঃ স্বপন দেখছেন আজও যোগার চরের ষাট উর্দ্ধ মানুষের মন সামছুল হক-এর হৃদয় বিদারক মৃতু্যতে এক করুণ হাহাকারের সৃষ্টি করে৷ ২১ ফেরু্রয়ারি ২০০৭ -ভাষা সৈনিক হিসেবে নেতা সামছুল হকের পদক প্রাপ্তি অনুষ্ঠানের পর পাবলিক লাইব্রেরিতে পরিবারের সদস্য ও সাংবাদিকদের সামনে ঘটনাটি প্রকাশ করলে সবাই হেসে উড়িয়ে দিলে নিজেকে খুব ছোট মনে হল৷ আমি দমবার পাত্র নই৷ আমাদের যত আত্নীয় আছে সবার কাছেই গেলাম ঘটনাটি শুনার পর, সবাই আলাদা আলাদা এলাকাটির ষাট উধর্্ব লোকদের সাক্ষাত্‍কার গ্রহণ শেষে (মাসব্যাপী) নিজেদের মতামত আমাকে জানালেন যে হক সাহেবের মৃতু্য ওখানেই হয়েছে৷ দীর্ঘ তিন মাস আমি টাঙ্গাইলের স্থানীয় পত্রিকায় ঘটনাটি ছাপাতে চাইলে কেহই সাহায্য করলো না৷ ঘটনাটির সরজমিন তদন্ত না করেই আমাকে নিরাশ করলো৷ পরিশেষে হক কথার প্রাক্তন বাতর্া সম্পাদক বর্তমান চট্রগ্রামে দৈনিক আজাদীর সহ সম্পাদক-মহবুবুল আলম সাহেবের সন্ধান পেলাম সাংবাদিক তোফাজ্জল সাহেবের মাধ্যমে৷ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কাছে নেতা সামছুল হকের প্রশংসা শুনতে শুনতে তিনি সামছুল হক ভক্ত হয়ে যান৷ আমি সাংবাদিকের মাধ্যমে ঘটনাটি তাকে জানালে তিনি একটি চিঠির মাধ্যমে আমাকে আশ্বস্থ করেন এবং ১৬/০৫/০৭ এবং ২০/০৫/০৭ সংখ্যায় সামছুল হকের মৃতু্য রহস্যটি পরপর ২ দিন প্রকাশ করেন এবং আমার বরাবর ১০+১০=কপি প্রেরণ করেন৷ আমি তাত্‍ক্ষনিক ভাবে সামছুল হকের সব আত্নীয়,পাবলিক লাইব্রেরির মাহমুদ কামাল ভাই এবং প্রেস ক্লাবে পত্রিকাটি প্রেরণ করি৷ তখনও ঘটনাটি টাঙ্গাইল বাসীর মনে নাড়া দিতে পারলো না৷ সর্বশেষে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে ২৩/০৬/০৭ তারিখে স্থানীয় সাংবাদিক মিঃ মহব্বতের মাধ্যমে ঘটনাটি আমার দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হতে থাকে এবং এন.টি.ভিতে জোড়েসোড়ে সমপ্রচার করা হয়৷ সামছুল হকের আপন ভাই আলহাজ্ব আনোয়ারুল হক এবং তার ছেলেদের সাক্ষাত্‍কার প্রচার করলেন এন.টি.ভি.তে৷ এখানে একটি হীন স্বার্থে ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপনের প্রচেষ্টাকে মাইনাচ ফর্মুলার মত প্রচারে আনলেন না৷ যার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সামছুল হক মেমোরিয়াল হাসপাতালটির ব্যবহৃত ক্যালেন্ডারের ছবিটিই প্রথম উত্‍স এবং ডাঃ স্বপনের অনুসন্ধানটি চট্টগ্রামের পেপারে প্রকাশিত খবরটি ২য় উত্‍স৷ উভয় উত্‍সই মাইনাচ ফমর্ুলায় ফেলা হয়৷ এখানে উল্লেখ্য হক সাহেবের ছবিটি ১৯৭০ সালে থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কোথাও বিরাজমান ছিল না৷ সাপ্তাহিক সৈনিক বাংলা একাডেমি থেকে মোঃ শহিদুল ইসলাম (সোনালী ব্যাংক), নজরুল ইসলাম (ফজলুল হক হল) ডাঃ সাইফুল ইসলাম এর যৌথ প্রচেষ্ঠায় উদ্ধারকৃত ছবিটি ভোলার আটির্স্ট কতর্ৃক আর্টকৃত ছবিটি-তথ্য উত্‍ঘাটনের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ উত্‍স যেটি হাসপাতালের ক্যালেন্ডারে ব্যবহার করা হয়েছিল৷ ২৯/০৬/০৭ তারিখে ভাই আলহাজ আনোয়ারুল হক, ভাই সিরাজুল হক, ভাতিজা রেজাউল করিম, মৌঃ সাইদুল হক, ভাতিজা শহিদুল ইসলাম, ভাতিজা রুহুল আমিন, সামছুল হক ভক্ত নেতা নুরু মাস্টার, নেতা গফুর বেপারী, আ. কা. ম. লাবু সবাই ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপনের আহবানে করটিয়ার পীরে কামেল আলহাজ বজলুর রহমান কারী সাহেবকে সাথে নিয়ে কবর জেয়ারত করেন এবং এস্ত্খোরার মাধ্যমে রুহানী জগতের খবরে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এটিই আধ্যাত্তিক নেতা সামছুল হকের কবর৷ ৩০/০৬/০৭ তারিখে সাংবাদিক সম্নেলনের মাধ্যমে নেতা সামছুল হকের মৃতু্য এবং কবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন এবং ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপনকে আহবায়ক এবং আ. কা. ম. লাবু কে সদস্য সচিব করে সামসুল হক ফাইন্ডেশন গঠন করা হয়৷ অবশেষে ২০০৭ সালে ডাঃ সাইফুল ইসলামের ব্যাপক অনুসন্ধান এবং সত্য উদঘাটনের ব্যাপ্তি থেকে ঘটনাটি জাতীয় রাজনীতিতে স্থান পেল৷ ৪২ বছর পর এক জন রাজনৈতিক বীরের পুনঃজন্ম হল৷

ইতিহাস বলে রাজনীতিতে ৫০ বছর পর সঠিক ইতিহাস লেখা হয়৷ আশা করি ৫০ বছর পর তাঁর মুতু্য রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হবে৷ আমরা দেশবাসি নেতা সামছুল হক এর রূহের মাগফেরাত কামনা করি৷ নেতা সামছুল হকের জাতীয় নেতা মযর্াদা, ভাষা সৈনিকের মযর্াদা, তাঁর কবরের জাতীয় মাজারের মযর্াদা এখন বাংলার জনগণের গনদাবী৷ এখন বঙ্গরত্ন সামছুল হক- কে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া উচিত৷ তাঁর রাজনৈতিক চেতনা, রাজনৈতিক দর্শন, রাজনৈতিক অবদান এবং তার মৃতু্যর কারণ তরুণ প্রজন্মকে সঠিক ভাবে জানাতে হবে৷ রাজনীতিবিদ ও ঐতিহাসিকদের এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব৷ এই মৃতু্য রহস্য উত্‍ঘাটনের মূল নায়ক ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন, শ্রেষ্ঠ চরিত্র ডাঃ আনসার আলী তালুকদার, দৈনিক আজাদী চট্রগ্রাম, দৈনিক আমারদেশ, এন. টি. ভি. কে জাতীয় সংবর্ধনা দেয়া উচিত বলে আমারা মনে করি৷ সত্যি তোমাদের নিরলস ভূমিকা এবং নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা তোমাদেরকে চির স্বরণীয় করে রাখবে বাংলার সঠিক ইতিহাস৷

শামসুল হকের নামে স্মরণীয় কিছু কীর্তি
আজ বাংলাদেশ স্বাধীন৷ বলতে সংকোচ নেই এটা শামসুল হকেরই ত্যাগের বাংলাদেশ৷ স্বপ্নের বাংলাদেশ৷ পুরোপুরি না হোক আংশিক তো বাস্তবে রূপ নিয়েছে৷ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা জাতি সংঘসহ পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন দেশে পত্ পত্ করে উড়ছে৷ যা সারা পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে৷ আমরা এত স্বার্থপর যে, শামসুল হককে আজ স্মরণ করার মত সে রকম ঘটা করে জন্ম দিবস পালন করিনা অথবা উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান গড়িনি৷ যা করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য বুদ্বুদ্ সাদৃশ্য৷ তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ছোটখাটো দু'একটি প্রতিষ্ঠান যা বিদ্যমান আছে তা উল্লেখ করার মত নয়৷ টাঙ্গাইল নাগরপুর রোডে এলাসিন ফেরীঘাটে নির্মানাধীন ধলেশ্বরী ব্রিজটি শামসুল হকের নামে উত্‍সর্গ করার জন্য জোরদার দাবী চলছে৷ টাঙ্গাইল জেলা সদরে শামসুল হক তোরন, এলেঙ্গা শামসুল হক মহাবিদ্যালয়, নিজ গ্রামে টেউরিয়া পাকা জামে মস্জিদ টাঙ্গাইল নাগরপুর রোডে বাসনী কলেজের উত্তরে শামসুল হক তোরন প্রভৃতি৷

যুগ স্রষ্টা শামসুল হকের ১ম খন্ড এখানেই যবনিকা টানতে হচ্ছে৷ ২য় খন্ড দেশের শক্তিশালী লেখকদের জ্ঞানগর্ভ প্রবন্দ নিয়ে বের হচ্ছে শিঘ্রই৷

বিক্রমপুর মাইঠাইন ১৮১৮ সাল
হানিফ সরকার

মধু সরকার কুদ্দুস সরকার ওয়াদুদ সরকার হায়দর সরকার

মহর উদ্দিন

ওসমান ডাক্তার ইউসুফ আলী + ইদ্রিস
আহসান আলী আমজাদ ও সামাদ + ছালাম
ইনসান আলী আঃ রহমান কমান্ডার + হায়দার ডাক্তার

আফাজ উদ্দিন

এমাজ মাস্টার আব্দুল মজিদ

আঃ খালেক মাস্টার আঃ লতিফ
আঃ আলেক গোলাম
আঃ রশিদ চান মিয়া
শাহজাহান
সোলায়মান

ওয়াদুদ সরকার

দবির উদ্দিন সরকার রিয়াজ উদ্দিন সরকার আঃ গনি মিয়া সরকার

আলহাজ আজিজুল হক

আঃ আওয়াল ফজলুল হক কামরুল হক তাহেরুল হক

সামসুল হক নূরুল হক আজমল হক আনোয়ারুল হক বোন বোন

শাহীন শায়কা হামিদুল হক সাইদুল হক

রেজাউল করিম আমিনুল ইসলাম
(সোহেল) (শাহীন)

মনিরুল হক বাবলু আলমগীর হক আলম

আব্দুল গনি মিয়া সরকার

আবুবকর সিদ্দিক সিরাজুল হক আজহারুল হক জিয়াউল হক

লাভলী হক
মোঃ শহীদুল ইসলাম মোঃ বাবু হক বিপ্লব হক
মোঃ সাইফুল ইসলাম (ডাঃ) শিরিন হক সালমা হক
মোঃ রুহুল আমীন আইরিন হক শিল্পী হক
মোঃ হুমায়ন কবীর

দবির উদ্দিন (মেয়ে)

রহিমুন নেছা জয়গুন নেছা
স্বামীঃ সিকিম উদ্দিন স্বামীঃ আলহাজ খলিলুর রহমান
গ্রামঃ বড় বেলতা গ্রামঃ রানাগাছা
থানা ও জেলাঃ টাঙ্গাইল৷ থানাঃ বাসাইল,
জেলাঃ টাঙ্গাইল৷

শামসুল হকের দুই মেয়ের পুরো নামঃ
১৷ উম্মে বতুল পাজমা তাহেরা শাহীন
২৷ উম্মে বতুল ফাতেমা তুজুহুরা সায়েকা

ছিলিমপূরের ইতিহাস (2)

 ছিলিমপূরের ইতিহাস (মোঃ নূরুল ইসলাম মাষ্টারের পান্ডুলিপি থেকে নেওয়া) (২য় অংশ) ছিলিমপুরের ছোট তরফের কাছারি বাড়ি ছোট হলেও এর নায়েব গোমস্তারা...