উৎসর্গ
শামছুল হকের ধন্য কন্যাদ্বয়
শাহীন ও শয়িকা
শামছুল হক - বিস্মরনের অপর নাম
সম্পাদনায় - নূরুল ইসলাম মাষ্টার
পুরাতন বাসষ্ট্যান্ড, টাঙ্গাইল প্রথম সংস্করনে-২০০৯
প্রচ্ছদ - ইউসুফ আলী
অলংকরন - আলহাজ আবুল কালাম (লাবু)
কম্পোজ - মোঃ নূর কুতুবুল আলম (পলাশ)
মুদ্রণ - শাহনাজ পারভীন শান্তি
বাঁধাই - আব্দুল গফুর বোপারী
যোগাযোগ - নূরুল ইসলাম মাষ্টার
২৩/১/ই, আকুর-টাকুর, মুসলিম পাড়া, টাঙ্গাইল।
ফ্যাক্স - ০৯২১-৬২১৫১।
মোবাইল - ০১৯১২-০৯৮৮৫৫।
E-mail: rupushe@yahoo.com
লেখকের আরও কিছু গ্রন্থ
টুকটাক, রূপসী ললনা, বঙ্গরত্ম শামছুল হক
হাজী বাড়ির ইতিহাস, কমল কাঞ্চন
আটিয়ার ইতিহাস, ছোটদের ভাসানী
ছোটদের শেখ মুজিব, ছোটদের জিয়া
বরনীয় লোকের স্মরনীয় বানী, রঙ্গ রস
প্রকাশক
মোঃ নূর তারকুল আলম (শিমুল)
রূপসী কম্পিউটার
৬৬ নং পৌর সুপার মার্কেট
পুরাতন বাসষ্ট্যান্ড, টাঙ্গাইল।
বাসা নং-২৩, ব্লক নং-ই
রোড নং-১, আকুর টাকুর, মুসলিম পাড়া, টাঙ্গাইল।
মূল্য-১০০.০০ (একশত) টাকা মাত্র।
বাণী
অসাধারণ ব্যাগ্মী, অগ্নি পুরুষ, অকুতোভয় শামছুল হক ছিলেন রাজনৈতিক গগণের উজ্জ্বলতম জ্যোতিস্ক। যে আশা নিয়ে তিনি ঢাকা ভার্সিটির উন্নতর শিক্ষা পরিত্যাগ করে জিন্নাহর ডাকে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন আজাদী লাভের পর দেখা গেল সে আশা গুড়ে বালি। বিক্ষুব্ধ হলেন তিনি। তাকে মুসলিম লীগ থেকে বের করে দেওয়া হল। শুধু তাই নয় নির্বাচনে বিজয়ী হলেও তাকে সংসদে বসতে দেয়া হল না। তিনি পাল্টা রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ দাড় করালেন। চল্লল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এমন সময় ভাষা আন্দোলন শুরু হল সিংহ বিক্রমে ঝাপিয়া পড়লে এ ভাষা সৈনিককে জেল হাজতে প্রেরণ করা হল। সেখানে দ্বিমুখী স্বরযন্ত্র চলল। বিষাক্ত ঔষধ প্রয়োগ করে দিল মহান নেতার মাথা নষ্ট করে। ও দিকে দল থেকে অপসারন ঘটল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। মস্তিষ্কের অসুখ নিয়ে এগার মাস পর বাইরে এসে চারদিক অন্ধকার দেখলেন। নতুন দল গঠন করবেন বলে রশিদ বই ও খাতা পত্র নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুড়ে বেড়াতেন লাগলেন। এক সময় হঠাৎই হারিয়ে গেলেন। সন্ধান মিলল না তার। শেষে যদিও সন্ধান মিলল জীবত থাকতে নয়- বি¯তৃতির অতল তলে তলিয়ে যাওয়ার পর কুদিম হামজানীর গোরস্থানে।
এ সমস্ত হৃদয় বিদারক কথা জনাব নুরুল ইসলাম মাস্টার প্রাঞ্জল ভাসায় লিখেছেন প্রথম খন্ডে। দ্বিতীয় খণ্ডে শামসুলহকের উপর লিখিত এক গুচ্ছ ব¯তু নিষ্ঠ প্রবন্ধ। আমার বিশ্বাস এ গ্রন্থটিও পাঠক সমাজে আদৃত হবে।
ইতি,
ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন
শামছুল হক মেমোরিয়াল হসপিটাল
বিসিক রোড, টাঙ্গাইল।
বাণী
আমি জানতে পেরে অত্যন্ত খুশি হলাম যে, শ্রদ্ধেয় নূরুল ইসলাম মাস্টার সাহেব আমার আপন বড় কাকার জীবনী ধারা বাহ্যিক ভাবে রচনা করে চলেছেন। বর্তমান গ্রন্থখানা তার দ্বিতীয় প্রয়াত। এ গ্রন্থখানা ছাপার অক্ষরে অত্মপ্রকাশ করলে নিশ্চয় তা আমার পড়ার সুযোগ হবে। কাকার জীবনী আমাদের বংশের ইতিহাস উনার আগের গ্রন্থখানা ঐতিহ্যবাহী কাকার অসামান্য মেধা সম্পন্ন জীবনী পড়ে আমি যার পর নেই মুগ্ধ হয়েছি। এতদিন আমি লোক মুখে শুনে আসছিলাম যে, জনাব নূরুল ইসলাম মাস্টার সাহেব আমার অলোক সামান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কাকার অনুরক্ত ভাব শিষ্য। এখন আমার কাকার, জীবন, রাজনৈতিক দর্শন, প্রজ্ঞা ও কর্মকাণ্ড তার গ্রন্থরাজী পড়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও বিনয় উত্তোরত্তর বেড়েই চলেছে। ব্যবসা সংক্রান্ত জটিল কাজে প্রতিনিয়ত ব্যপ্রিত থাকায় লেখালেখির সময় পাইনা। উনি আমাদের হয়ে গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কাকাকে জীবন্ত করে তুলেছেন। সেজন্য আমি আমার বংশের পক্ষ থেকে খোশ আমদেদ জানাই। সেই সাথে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি অশেষ।
আমার চাচা ছিলেন বিরাট বিশাল জ্ঞান সুমুদ্র। এই অতল সাগর হতে মুক্তা আহরণ করে আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে উপহার দিবেন এই কামনাই তার কাছে করব। সব শেষে শ্রদ্ধেয় নূরুল ইসলাম মাষ্টার সাহেবের নীরব কর্মময় দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।
ইতি
মোঃ আমিনুর রহমান শাহীন
শামছুল হক মেডিক্যাল হল
নিউমার্কেট, টাঙ্গাইল।
বাণী
শামছুল হক একটি নাম, একটি ইতিহাস। চল্লিশের দশকে তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গনে আবির্ভাব আর পঞ্চাশের দশকে তিরোভাব। এই স্বল্পতম সময়ে রাজনৈতিক গগনে তিনি ঝড় তুলে ছিলেন। তার মূল মন্ত্র ছিল যেখানে অন্যায় শোষন বঞ্চনা সেখানে তিনি বিদ্রোহী বীর। পাকিস্তান অর্জনে তার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যে আশায় তিনি এ অর্জনে তাঁর শ্রম ও মেধা বিলিয়ে দিয়েছিলেন বাস্তবে তাঁর প্রতিফল দেখেন নি। তাই চির অবহেলিত বাংলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ পরে আওয়ামীলীগ। তিনি হন এর মহাসচিব। এর আগে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিজয়ী হলেও সংসদে তাকে বসতে দেয়া হয় নি। আবার পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকরা বাংলা ভাষার উপর আঘাত হানে। তিনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এই ভাষা আন্দেলনে নেতৃত্ব দানের অপরাধে তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হল। সেখানে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারে মাথা বিকৃত করে দিল। এক বছর পর ছাড়া পেয়ে আর রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারন নি। নতুন দল গঠন করবেন বলে খাতা কলম বগল দাবা করে চাঁদা তুলে বেড়াতেন। ১৯৬৪ সালে হঠাৎ একদিন তিনি বাড়ি আসেন আবার সবার অজান্তেই উধাও হয়ে যান। শোনা যায় ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জোকার চর তার এক সাবেক বন্ধু মহির উদ্দিন আনসারীর বাড়িতে মৃত্যু বরণ করেন।
জনাব নূরুল ইসলাম সাহেব শামছুল হককে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করেন। এবার তাঁর নতুন বই শামছুল হক বিস্মরনের অপর নাম প্রকাশ করছেন জেনে আনন্দিত হলাম। আমি এ বইটির বহুল প্রচার কামনা করি। ইতি
ইউসুফ আলী
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী
সমবায় মার্কেট, টাঙ্গাইল।
সূচনা
সবিনয় নিবেদন করছি, জাতীয় নেতা, ভাষা সৈনিক বঙ্গরø শামছুল হক সম্বন্ধে আলোচনা/সমালোচনা করার প্রজ্ঞাশক্তি, শ্রমসামর্থ আমার নেই। তবু অনুরুদ্দ হয়ে কিঞ্চিত চেষ্টা করেছি। কোন ভাবেই যেন এ গবেষণাকে/আলোচনাকে সম্পূর্ণ ধারনা হয়। কোন ভাবেই যেন মহান নেতাকে অসম্মানিত/ছোট করা না হয়Ñ যদি তাই মনে হয় তবে ধরে নিতে হবে একটি একটি খণ্ড আলোচনা মাত্র।
আমরা এতই হতভাগ্য যে, এই মহান ব্যক্তিত্বকে জাতীয়ভাবে মর্যাদা দেয়ার কোন ব্যবস্থাই করা হয়নি। আসুন আমরা এই মনীষীকে যথার্থ মর্যাদা নিয়ে সম্মানিত হই এবং ঋণভার, দায়ভার কিছুটা হলেও লাঘব করি।
এত মানসিক শক্তি যার বক্তৃতায়, আঙ্গুলে আঙ্গুলে যার কথার যাদু লুকিয়ে, তাঁর কেন এমন রাজনৈতিক করুণ পরিণতি হবে ? ধূর্ততা, রাজনৈতিক ধূর্ততা, স্পর্শকাতরা ও অভিমান, এই তিনটি রাজনৈতিক নিয়ামকের সঠিক ব্যবহারের অভাবই তাঁর পতনের অন্যতম কারণ।
(১) অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবক্তা, আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক জননেতা শামছুল হকের অন্তর্ধান রহস্য উদঘাটনে একটি জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে তার অন্তর্ধান রহস্যের ঘটনা জনসম্মুখে প্রকাশ করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবী জানাচ্ছে শামছুল হক গবেষণা পরিষদ।
২) আজীবন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের মহান নেতা শামছুল হকের জোকার চরের কবর সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে পরিষদ।
৩) টাঙ্গাইল জেলা সদরের প্রবেশ দ্বারে মহান নেতা শামছুল হকের নামে তৎকালিন পাক সরকার “শামছুল হক তোরণ” নির্মাণ করেন। “শামছুল হক স্মৃতি কমপ্লেক্স” স্থাপনের জন্য শামছুল হক তোরণ সংলগ্ন ১০ শতাংশ খালি জায়গা বরাদ্ধ দেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি জোর দাবী জানাচ্ছে পরিষদ।
৪) মহান নেতা শামছুল হকের আজীবনের স্বপ্ন “অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সরকার” কায়েম করার জন্য দল-মত নির্বিশেষে সকলের প্রতি আহবান জানাচ্ছে পরিষদ। ইতিহাস কাউকে অস্বীকার করতে পারে না। যার যতটুকু অবদান, তা স্বীকার করতেই হবে এবং ততটুকু নতুন প্রজন্মের ছেলেÑমেয়েদের জানাতে হবে। এই মহৎ এবং অতি মহান কাজটিও সমাজ সচেতন নেতাদের দায়িত্বেরমধ্যেই বর্তায়।
রাজতৈক শিক্ষা ঃ
‘লরকে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আন্দোলন আরম্ভ হলে, দার্শনিক আবুল হাসিমের কাছে শামছুল হক তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে জনাব শামছুল হক একজন রানৈতিক দার্শনিকে পরিণত হন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী “বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম” নামক একটি রাজনৈতিক গ্রন্থ রচনা করেন যা কমিউনিষ্ট এবং ইসলামী মৌলবাদীদের গাত্র দাহনের কারণ হয়ে দাঁড়ালে উদার প্রগতিশীল মুসলিম মহলে বইটি দারুণ সাড়া এবং প্রভাব বিস্তার করে।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ঃ ১৯৩৬ সালে তিনি জাহ্নবি হাইস্কুলের প্রথম মুসলিম স্কুল ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন। টাঙ্গাইল অঞ্চলে প্রতিটি স্কুলে বাৎসরিক মিলাদ প্রথা, নামাজের জন্য নির্ধারিত সময়, মসিলিম ছাত্রদের জন্য একই টিউবওয়েলের পানি পান, এবং বৃত্তি পদ্ধতি চালু করেন। ১৯৩৬ সালে দক্ষিণ টাঙ্গাইলে গরুর চামড়া সংগ্রহ এবং বিক্রীত টাকা মুসলিমলীগ তহবিলে জমা দিয়ে সদস্য পদ লাভ করেন। করটিয়া সা’দত কলেজে ব্যাপক সংগ্রামের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে হন প্রতিষ্ঠাতা ভিপি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব কণিষ্ঠ ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৪০ সালে লাহোর কনভেনশনে যোগদান করেন এবং ঝঃধঃব বিতর্কে ঝঃধঃবং এর পক্ষে মত প্রকাশ করে জিন্নার বিরাগভাজন হন। এই সময়ে কোলকাতায় শেখ মুজিবের সাথে সামছুল হকের পরিচয় হয়। তাঁর বিখ্যাত বই “বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম” এর অংশ বিশেষ লেখার সময় শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। শেখ মুজিব নিজে সামছুল হকের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সামছুল হকের সাথে রাজনীতি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং ১৯৪১ সালে টাঙ্গাইলের মাইঠান সামছুল হকের নিজ বাড়ীতে চলে আসেন, টেউরিয়া মাঠে প্রথম একটি কর্মী মিটিং করেন। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয়বার শেখ মুজিব দক্ষিণ টাঙ্গাইলের কর্মীদের সামনে টেউরিয়া মাঠে বক্তৃতা করেন। ১৯৪৫ সালে তৃতীয়বার হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর সামনে এলাসিন মাঠে বিশাল জনসভায় জীবনের প্রথম বক্তৃতা করেন। জনাব সামছুল হকের কাছে এভাবেই শেখ মুজিবের বক্তৃতার হাতে খড়ি। আর এভাবেই দুজনের রাজনৈতিক পথ চলা। কমরুদ্দিন লিখেছেন “আমি ১৯৫৩ সালে রোমে প্লেটো ও এরিস্টোটল এর দু’টি মুর্তি যখন দেখি তখন কেন যেন তাঁদের দু’জনার সামছুল হক ও শেখ মুজিবের মত আমার মনে হয়েছিল। বলা বাহুল্য এরা দুজনেই রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় অত্যান্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত সামছুল হক ও শেখ মুজিব ছিলেন গুরু শিষ্যর মত। ১৯৪৪-১৯৪৫ সালে “মুসলিমলীগ কর্মী শিবির” ঢাকায় স্থাপিত হলে সামছুল হকের উপর পরিচালনায় দায়িত্ব আসে। তিনি নিষ্ঠার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন এবং পাকিস্তান কায়েমের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৬ সালে সিন্ধু রায়ট বন্ধ করেন এবং জিন্না তাকে সেই জন্য (অল ইন্ডিয়া মুসলিমলীগ অর্গানাইজার) খেতাবে ভূষিত করেন। এভাবেই তিনি নিজেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির ছাত্র নেতা হিসাবে জাতীয় নেতাদের নজর কারেন।
যুক্তফ্রন্ট ঃ
১৯৪৯ এর নির্বাচন্নোত্তর ৮ মে শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ঢাকা নগরবাসীর পক্ষ হতে ভিক্টোরিয়া পার্কে নির্বাচিত শামছুল হককে শতাধিক তোরণ নির্মান করে বিশাল প্রাণঢালা গণ-সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন এবং পাকিস্তানের ভাষা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁকে আখ্যায়িত করেন। শামছুল হকের বক্তৃতা শুনে ইডেন কলেজের ইংরেজী অধ্যাপিকা মিস আফিয়া খাতুন মন্ত্রমুগ্ধ হন, সভা শেষে ফজিলাতুন নেছা (প্রিন্সিপাল ইডেন কলেজ) এবং প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ এর মাধ্যমে শামছুল হকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁদের শুভ বিবাহ সু-সম্পন্ন হয় দেশের এবং নতুন রাজনৈতিক দলের সমৃদ্ধির স্বার্থেই শেরে বাংলা সমর্থনে বিষয়টি সম্পন্ন হয়।
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ৩ জনকে নমিনেশন দেয়া হয় না। ৫৪’র নির্বাচনে কামরুদ্দীন আহমেদ ও খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও শামছুল হক বিদ্রোহী প্রার্থী না হয়ে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের পক্ষে বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলতেন নিজের রক্ত মাংসে গড়া দল আমাকে নমিনেশন না দিলেও আমি বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারি না। এভাবেই তিনি তাঁর দল এবং গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে সমুন্নত রেখেছেন। তিনি সব সময় আরো বলতেন গণতন্ত্রে কোন হটকারিতার স্থান নেই। যুক্তফ্রন্ট সরকার যখন ক্ষমতায় আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শামছুল হক তখন সামান্যতম চিকিৎসার অভাবে ঢাকার রাস্তাঘাটে পাগলের মতো ঘুরে বেড়িযেছেন। তাঁর স্ত্রী এবং দু কন্যার খোঁজে। আবু হোসেন সরকার ক্ষমতায় গেলে (১৯৫৬) জননেতা আঃ মান্নান ও প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর সহায়তায় টাঙ্গাইল মাহফিলের উদ্যোগে চিকিৎসার আবেদন করলে শামছুল হককে প্রথমে করাচী পরে জুরিক মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। চিকিৎসকগণ তাঁকে মানসিক রোগী বলতে নারাজ হন এবং শুধু নিকট আত্ময়িস্বজনের পরিচর্যাতেই তিনি ভালো হবেন এই বলেই তাঁকে দেশে ফেরত পাঠান। মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব, স্ত্রী আফিয়া হক এমনকি তাঁর পরিবারের কেই তাঁকে এতুটুকু সাহায্য করেনি। ধীরে ধীরে নিঃস্ব আশাহত হয়ে ১৯৬৩ সালে সর্বশেষ শেখ মুজিবের কাছে যান এবং তাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যার খবর জানতে চান। মেখ মুজিব সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর জন্য অনেক কিছু করেছেন শুধু তাঁর নেতা সামছুল হকের জন্য সামান্যতম সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারেননি। শামছুল হকের শেষ পরিণতি আজও রহস্যবৃত। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে না তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছেÑ এটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
১৯৬৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে জনাব শামছুল হক শেষ বারের মত বাড়ি থেকে চলে যান। মৌলভী মহিউদ্দিন আনছারী কোলকাতায় তাকে দেখতে পান। মৌলভী মহিউদ্দিন আনছারী ঢাকায় ফেরার পথে শামছুল হক তার সঙ্গী হন। সিরাজগঞ্জ ষ্টেশনে শামছুল হক নেমে যান। স্থানীয় জন গণকে তিনি ডেকে বলতেন আমি শামছুল হক, নতুন প্রার্থী করব খোলাফায়ে রাশেদীনের মত দেশ চালবো। আমাকে চাঁদা দাও। যমুনা নদীর তীরে মাঝি মাল্লাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলতেন, “ঐ মাঝি নৌকা ভিড়াও, জাননা আমি শামছুল হক বলছি”। দিনের পর দিন এভাবে তিনি অসুস্থ অবস্থায় যোগারচর অঞ্চলে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন। মুমূর্ষু অবস্থা হলে এলাকাবাসী তাকে কংগেস নেতা মৌঃ মহির উদ্দিন আনছারীরর বাড়িতে পেঁছে দেন। ৭ দিন অসুস্থ থাকার পর ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ সন শনিবার দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। বাদ আছর। আজও যোগারচরের ষাষরূদ্ধ মানুষের মনে শামছুল হকের হৃদয় বিদারক মৃত্য এক করুণ হাহাকারের সৃষ্টি করে। মৃতুর ৪২ বছর পর তাঁর স্বজনরা খবর শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এখন স্বজনদের শুধুই অপেক্ষ কবে তাঁর গড়া নিজদল আওয়ামী লীগ এই কবরটির যথাযথ মূল্য দিবে। কবে তাঁর প্রাণ প্রিয় ২টি কন্যা। তাঁর কবরে এক গোছা ফুল দিয়ে সম্মান জানাবে। চোখের জলে সিক্ত হয়ে দেশ প্রেমিক পিতার রূহের মাগফেরাত কামনা করবে।
উপেক্ষিত নায়ক জননেতা শামছুল হক
ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী
রবীন্দ্রনাথ-তার ‘প্রাচীন সাহিত্য’ গ্রন্থে এক উপেক্ষিতা নায়িকা উরর্মিলার কথা বলেছেন যিনি ছিলেন অমিত প্রতাপ শ্রী রামচন্দ্র-ভ্রাতা লক্ষণের বিবাহিতা স্ত্রী। সমগ্র রামায়ণ জুড়ে এত যুদ্ধ বিদ্রহ, বিবাদ- বিসংবাদ, লংকাকাণ্ড, এত সব নর-নাড়ী মঞ্চে আসছেন-যাচ্ছেন ভ্রাতা রাম এর সঙ্গে একবাক্যে এবং এক বস্ত্রে লক্ষণ বন- গমন করলে কিন্তু সমগ্র রামায়ন কাব্যে সেই যে অশ্রƒমুখে স্বামী লক্ষণকে বিদায় দিতে একবার মাত্র প্রসাদ দ্বারে উপস্থিত হয়ে শাড়ীর আচলে অশ্রƒ মুছে শশুর রাজা দশরথের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন তার পর আর তার কোন খবর নাই। সে হল আদিযুগের আদি কবির ব্যাপার।
কিন্তু এযুগে মাত্র ৪৭ বৎসর পূর্বে যে লোকটি রাষ্ট্র ভাষা বাংলা কে প্রতিষ্ঠার জন্য কত ত্যাগ ও তিতিক্ষা বরণ করে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গেলেন অনাদরে উপেক্ষায়- তার কথা এক ডাঃ বদরুদ্দিন উত্তম ছাড়া আর কে তেমন ভাবে তুলে ধরেছেন প্রামানিক- গ্রন্থে? সৌভাগ্যক্রমে বিগত ১ ফেব্র“য়ারি ‘টাংঙ্গাইল জেলা সমিতি’ এই মহান ব্যক্তিত্বের বিভিন্নমুখী আবেদনের উপড় তার জন্মদিনে একটি সেমিনার আয়োজন করেন, যেখানে একুশে আন্দলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ভাষা সৈনিক ও ব্যক্তিত্ববর্গ তথ্যপূর্ন আলোচনাও রাখেন।
এই মহান ব্যক্তিত্বের নাম শামসুল হক। তিনি ১৯১৮ সালের ১ ফেব্র“য়ারি টাংঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার মাইঠান গ্রামে, এক দরিদ্র সংসারে জন্মগ্রহণ করে। তার পিতার নাম মরহুম দবির উদ্দিন মিয়া। তিনি ছিলেন পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং ছাত্র হিসাবে ছিলেন অত্যান্ত মেধাবী। ১৯৩৮ সালে তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষ জাহ্নবী স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং পরে যথাক্রমে করটিয়া সা‘দত কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই-এ এবং ১৯৪৫-এ সম্ভবতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পাশ করেন। এই সময় থেকেই এমনভাবে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জরিয়ে পরেন যে শেষ পর্যন্ত তার এম. এ পরিক্ষা দেওয়া সম্ভব হলনা। ছাত্রাবস্থাতেই হযরত মহানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জনাব অবুল হাশিম (যার ধারায় ছিলেন বিশেষ ভাবে প্রভাবিত), মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষানী এবং অন্যান্য প্রগতশীল নেতাবৃন্দ। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও স্বাধিকরের স্বার্থে-বিশেষ করে জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচারের পিষ্ঠ মজলুম মানবতার স্বার্থে তিনি ঢাকা থেকে কোলকাতা, কোলকাতা থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল, চট্রগ্রাম, সিলেট এমন কি সুদুর আসাম পর্যন্ত পরিভ্রমন করেছেন, একটি মাত্র পুরাতন চামড়ার বেগ এবং বোতাম বিহিন কালো সেরোয়ানি পরে-কলকাতা শহরসহ আসামের সুদুর করিমগঞ্জ অঞ্চল পর্যন্ত যাতে তা সাবেক স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। সে জন্য অনিদ্রায় অনাহারে থেকেও সোহরাওয়াদী, আবুল হাশিম, ভাসানী ও অন্যন্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শুধু উল্কার মত ঘুরেই বেড়ান নাই-বজ্রনির্ঘোষে যেসব ভাষণ, যুক্তি ও বক্তব্য রেখেছেন-তা জনমনে বিপুল সাড়াও জাড়িয়েছে। করিমগঞ্জে শতকরা ৫১ ভাগ ভোট পেয়েও র্যাডক্লিফ কমিশনের কারসাজিতে তা শামসুল হক এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেবগণ চেয়েছেন মুসলিম লীগ যাতে প্রভাবশালী এবং সুবিধাভোগী জমিদার নেতৃবৃন্দের তল্পীবাহক প্রতিষ্ঠান না হয়। আসামের ন্যায্যভাবে প্রাপ্ত ভূখণ্ড ভারতে পড়ার জন্য তিনি প্রকাশ্যে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এবং জিন্না সাহেবেরও সমালোচনা করেছেন। কারণ গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাঁদের মতো আর কোন নেতাই ত জীবন বাজি রেখে এতো অক্লান্ত পরিশ্রম করেন নাই সেজন্য তাঁদের কষ্ট ছিল খুবই স্বাভাবিক। কায়েমী স্বার্থবাদীদের খপ্পর থেকে মেহনতি ও দরিদ্র কৃষক জনতার স্বদেশকে রক্ষার জন্যই কিছুদিন পরই আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়-যার অন্যতম প্রধান কর্মী এবং সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কাজ করতে থাকেন তিনি-ভাসানী হন সভাপতি।
১ সেপ্টেম্বর (১৯৪৭) জনাব অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেব প্রতিষ্ঠিত তমদ্দুন মজলিসই রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে আন্দোলন শুরু করে। বিভিন্ন পর্যায় পার হয়ে অবশেষে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ- যার আহবায়ক ছিলেন সলিমুল্লাহ হল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম। অন্যান্য বিশিষ্ট সংগ্রামী ছাত্র নেতাদের সঙ্গে সক্রিয় সদস্য ছিলেন কর্মীপুরুষ টাঙ্গাইলের শামসুল হক যে সম্বন্ধে ডঃ বদরুদ্দীন উমর এবং অন্যান্য গবেষকদের গ্রন্থ বিস্তৃত বিবরণ আছে শামসুল হকসহ অন্যান্য বীর সংগ্রামী ছাত্র নেতাদের ডাকেই ১৯৪৮-এর ১১ই মার্চ সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা শহরে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেয়া হয়। এর পূর্বদিন ১০ মার্চ ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের যে সভা বসে তাতেও শামসুল হকের কণ্ঠ ছিল বলিষ্ঠ। অতঃপর সেক্রেটারিয়েটের ১নং গেটে যে পিকেটিং হয় তাতেও অন্যান্য সংগ্রামী ছাত্র নেতাদের সঙ্গে শামসুল হকও ছিলেন এবং পুশিলী জুলুমের শিকার এবং অবশেষে গ্রেফতারকৃত হয়ে কোতোয়ালী থানায় নীতও হন। গ্রেফতারকৃত নেতাদের আশুমুক্তির দাবীতে প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ছাত্রদের সঙ্গেও তাঁর নাম জড়িয়ে ছিল। অতঃপর ১৬ মার্চ ব্যবস্থাপক পরিষদ ভবন ঘেরাও, পুলিশী নির্যাতন-সর্বত্র সব ছাত্র জনতাদের সঙ্গেই ছিলেন শামসুল হক। ১৯ শে মার্চ (১৯৪৮) জিন্না সাহেবের ঢাকা আগমন, ২১ শে মার্চ (১৯৪৮) রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দুর সপক্ষে তাঁর সেই বহুল আলোচিত আপত্তিকর ভাষণ ২৪ মার্চ কার্জন হলে জিন্না সাহেবের সমাবর্তন ভাষণ, ঐদিনই আলোচিত আপত্তিকর ভাষণ, ঐদিনই সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিটে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে যেসব ছাত্র নেতৃবর্গ উপস্থিত ছিলেন তাতে শামসুল হকও ছিলেন এবং বিভিন্ন ছাত্র নেতৃবৃন্দের ভাষণ ও বক্তব্য অনুসারে জিন্না সাহেবের সঙ্গে তুমুল কথা কাটাকাটি হয় শামসুল হকেরই। জিন্না সাহেব রাগতভাবে বলেন-ষ্টপ অল দিস ননসেন্স-লুক জেন্টলমেন-আই কলড ইউ টু হিয়ার মি, এন্ড নট টু হিয়ার অন’। রাগান্বিত হয়ে অতঃপর তিনি শামসুল হককে বলেন, ‘ইউ আর দি ম্যান হু অলওয়েজ ক্রিয়েট ট্রাবল; আই রিমেমবার ইউ ক্রিয়েটেড ট্রাবল এট দি কনভেওনশন অলসো এলং উইথ মৌলানা হযরত মোহানী এন্ড আবুল হাশিম।
বিদায় গ্রহণ কালে শামসুল হক দৃপ্ত কণ্ঠে বলে এসেচিলেন- ‘প্রিয় কায়েদে আযম! আপনার ডাকে আমরা লেখাপড়া ছেড়ে (তিন এম-এ পরীক্ষায় বসতে পারেন নাই) সমস্ত শক্তি নিয়ে দেশের স্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আজ বলছি-পৃথিবীর এমন কোন শক্তিই নাই যে আমাদের এই ন্যায়সঙ্গত ভাষার দাবীকে অস্বীকার করতে পারে।’ এরপর ১৯৪৯-এ শামসুল হক ও অন্যান্যদেরসহ মওলানা ভাসানীকে কারাগারে প্রেরণ, জেল থেকে এক বছর পর মুক্তি পেয়ে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠণ, টাঙ্গাইলের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিপুল ভোটে সরকার দলীয় প্রার্থী খররম খান পন্নীকে পরাজিত করা; জমিদার মহাজনদের খপ্পর থেকে বিরোধী দলকে সংগঠিত করে আওয়ামী মুসলিম লীগের দলবৃদ্দি-যা পরবর্তীতে ১৯৫৪-যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনেও রাখে একটি বলিষ্ঠ ভুমিকা।
নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়েই ১৯৪৬-৪৭-৪৮-এ আমার পিতা টাঙ্গাইলের ডাঃ আবদুস সাত্তার সিদ্দিকী সাহেবের সঙ্গে (যিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল একাদিক্রমে স্থানীয় ইউনিয়ন পঞ্চাযেৎ, ইউনিয়ন বোর্ড, ঋণ সালিশী বোর্ড, জুট বোর্ডের সভাপতি এবং কিছুকাল বৃটিশ আমলের টাঙ্গাইল লোকাল বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন) শামসুল হকের সঙ্গে পরিচিত ঘটে এবং কয়েকবার আমাদের গ্রামের বাড়িতেও তিনি মেহমান হন। তাঁর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮-এ করটিযা সা’দৎ কলেজে পরীক্ষাকেন্দ্র নির্বাচনের পর। এই সময় প্রায়ই তিনি ছাত্র নেতা জালালউদ্দীন (পরে মন্ত্রী), আবদুল হামিদ চৌধুরী (পরে এম.পি.) প্রমুখের সঙ্গে করটিযা ও টাঙ্গাইল এসে বিভিন্ন ছাত্র ও রাজনৈতিক সম্মেলনে যোগ দিতেন। বক্তৃতা মঞ্চেও হাস্য-রসাত্মক ছোট ছোট কাহিনীর মাধ্যমে কিছুটা শেরে বাংলা ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীর মত-তাঁর বক্তব্য হত রসালো এবং জ্বালাময়ী।
১৯৪৮-এর মার্চের শেষের দিকে অথবা এপ্রিলে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব টাঙ্গাইল ভূয়াপুরের ইব্রাহিম খান সাহেবের (পদত্যাগ গজনিত শূণ্যপদে) নির্বাচনের প্রচারণার জন্যই ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের পথে করটিয়া সা’দত কলেজেও তশরিফ আনবেন। খবর পেয়ে শামসুল হক তাঁর সাঙ্গপাঙ্গসহ পূর্ব রাত্রীতেই সা’দৎ কলেজের ভিপি, নেতৃবৃন্দের শলা-পরামর্শক্রমে স্থির হয়, সামনেই প্রাদেশিক উপনির্বাচন এবং রাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন না হতে পারলে নাজিমুদ্দীন সাহেবের মন্ত্রীত্বই থাকে না! কাজেই এই সুবর্ণ সুযোগ। তাঁকে কলেজে এলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী পূর্ণ করার ওয়াদা আদায় করতে হবে।
ছাত্রদের এই আমন্ত্রণে টাঙ্গাইলের পুলিশ কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা কর্মীদের আপত্তি সত্ত্বেও খাজা সাহেব কলেজ মিলনায়তনে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই মিলনায়তনের সব দরজা বন্ধ-ভিপি আব্দুল লতিফ চৌধুরী ও অন্যান্য ছাত্র নেতাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা এবং এক পর্যয়ে তাঁকে ঢাকার ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ১১ই মার্চ (১৯৪৮) এর ৭-দফা প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য ওয়াদা করে যেতে চাপ দেয়া হয়। উর্দু-বাংলা মিশ্রিত ভাষায় তিনি বিষয়টি জরুরীভাবে আবার ‘খেয়াল’ করবেন বলে জানান এবং চা-নাশতা না খেয়েই বিদায় হন- যা স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ভালো লাগে নাই।
সেই দিনই রাত্রে নেতৃবর্গ উপদেশ রাখেন পরদিন টাঙ্গাইল শহরে ডাক-বাংলোর পাশে (মন্ত্রীর অবস্থানস্থল) এবং মহকুমা প্রশাসকের বাসার পূর্ব দিকে আমতলায় সভা হবে এবং মুখ্যমন্ত্রী গতকালের ‘ওয়াদার’ প্রেক্ষিতে একটি স্মারকলিপি দেয়া হবে। স্থির হয় ঐ সভায় সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা থেকে আগত কোন ছাত্র নেতা। করটিযা সা’দত কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীতে ভরে যায় আমতলা। কিন্তু ছাত্র নেতৃবৃন্দের দেখা নেই। অগত্যা একরূপ জোর করেই আমাকে সভাপতির আসনে বসিয়ে দেয়া হয় আর সা’দৎ কলেজের ছাত্র নেতা মুহম্মদ নুরুল হোদা (একাত্তরে শহীদ ও প্রাক্তন এম.পি.এ), নূরুল ইসলাম, আমিরুজ্জামান পুতুল (পরে সাব-রেজিষ্ট্রার), কুমুদিনী কলেজের ছায়েরা সিদ্দিকী, রওশনারা বেগম শেফালী (পরে ম্যাজিষ্ট্রেট), জনৈকা হিন্দু ছাত্রীনেত্রী, রুবি খাতুন এবং আরও অনেকে চমৎকার বক্তব্য রাখে। সভাপতির বক্তব্য শুরুর পূর্ব মুহুর্তেই দেখা গেল পুরাতন জেলখানার দিক থেকে ছুটে আসছে লাঠিধারী লাল পাগড়ি পরা পুলিশ এবং তারপরই বেধড়ক পিটুনী। কুমিদিনী কলেজের ছাত্রীগণ বইখাতা ফেলেই যে যেদিকে পারলো, চম্পট। অন্যান্য ছাত্র নেতা ও ছাত্রদেরও সেই অবস্থা। অনেক পালাতে না পেরে ডারইনের থিয়োরীকে সঠিক মনে মনে করে কাছেরই গাছে পর্যন্ত উঠে গেল। অন্যতম বক্তা সেই হিন্দু মেয়েটির সঙ্গে দু’একজনকে দেখা গেল আত্মারক্ষায় পূর্বদিনের বড় পুকুরে গলা পানিতে নেমে গেছে। আমি নিজেকে এক সময় আবিষ্কার করলাম পাশের এক গরুর গোয়াল ঘরে!
গন্ডগোলে ইতিপূর্বেই নগদ ত্রিশটাকা সহ আমার মানিব্যাগটা লাপাত্তা। সেই রাত্রেই বেশ কিছু স্থানীয় ছাত্র নেতাকে থানায় ধরে নেয়া হল। এই খবর পাওয়া মাত্র আমি পরদিন অতি প্রত্যুষে ১০ মাইল পায়ে হেঁটে গ্রামের বাড়ি চলে আসি। ভালোভাবে খবরাদি নিয়ে তবেই আবার কলেজে ফিরে আসি।
এরপরও শামসুল হক ভাইয়ের সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে, কখনো ঢাকায়, কখনো টাঙ্গাইলে এবং আমাদের গ্রামের বাড়িতেও। আমার বাবা তাঁকে অত্যন্ত øেহ করতেন এবং আর্থিকভাবেও সহযোগিতা বা চাঁদা দিতেন।
টাঙ্গাইলের প্রাদেশিক উপনির্বাচনের বিপুল ভোটাধিক্যে বিজয় রাজনীতির যে নতুন দিক নির্দেশনা দেয়, তাতে সে যুগে অনেকেই (বিশেষ করে মওলানা ভাসানীও নাকি) মনে করতেন যে তিনিই হবেন ভবিষ্যৎ পূর্ব বাংলার প্রধান মন্ত্রী। ইডেন কলেজের ইংরেজির অধ্যাপিকা এবং উচ্চাবিলাসী সহপাঠিনী ঢাকার সেকান্দর আলী সাহেবের মেয়ে আফিয়া খাতুনের সঙ্গে বিবাহের কার্য কারণও সম্ভবতঃ সেখাইে নিহিত ছিল।
তারপর ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সাথে-কিরুপ ওতপ্রোতভাবে তিনি জড়িত ছিলেন তা বিভিন্ন ভাষা-সৈনিক- বিশেষ করে বদরুদ্দীন উমর সঠিকভাবেই লিপিবদ্ধ করেন।
১৯৫২-এর ২১ শে ফেব্র“য়ারির দিকে যে ঘটনা ঘটে সেদিন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং দোতলার করিডর থেকে আমতলায় ভাষা সৈনিক গাজীউল হক এবং হাসান হাফিজুর রহমানের পাশেই টুপি ও শেরোয়ানী পরা অবস্থায় তাঁকে দাঁড়ানোও দেখেছি। যদিও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ নিয়ে শামসুল হকের সঙ্গে তরুণদের মতদ্বৈধ দেখা দেয়, তবে তিনি ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তের বার্তাবহ মাত্র। গাজীউল হক ও তরুণ নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা ভাঙতে চাইলে, এটাও ঠিক যে, তিনি কোন বাঁধা ত দেন নাই বরং শেষ পর্যন্ত একাত্মতাই স্বীকার করেন-এ তথ্যও বিভিন্ন ভাষা সৈনিকদের স্মৃতিচারণ বক্তব্য ও গ্রন্থ থেকেই জানা যায়।
ইতিমধ্যে তাঁর সংগ্রামী ভূমিকার জন্য অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার তাঁকেও আবার জেলে পাঠান। ফুটফুটে দুই কন্যার মধ্যে দ্বিতীয়টি জেলে থাকতেই জন্মগ্রহণ করে বলে জানা যায়। শোনা যায়, জেলে থাকতেই তাকে স্লো-পয়েজন করা হয় এবং ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দু’টি কন্যাসহ তাঁর স্ত্রী আফিয়া খাতুনকেও বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্সের নাম করে বিদেশে পাঠানো হয়। জেল থেকে ফিরে প্রাণপ্রতিম কন্যা দু’টি যার একটিকে তিনি মোটেই দেখেন নাই, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এই সময় তাঁর আত্মীয়কূলের কাছ থেকে কোন সহানুভূতি তো দূরের কথা শারীরিক অত্যাচারেও নাকি জর্জরিত হতে হয় এসব গুজবও ছিল। একটি ছেড়া পাজামা, আচকান ও ছেঁড়া টুপি পরে তাঁকে পথচারী বন্ধুদের কাছে ভিক্ষা চাইতেও দেখা গেছে। শোনা যায় গৃহহীন আশ্রয়হীন শামসুল হক এ সময় বুড়ীগঙ্গায় নৌকার হোটেলে অবস্থান করতেন এবং তারই কোন এক সময় পত্মী, প্রাণপ্রিয় সন্তান, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় পরিজনহীন অবস্থায় একদিন চিরতরে হারিয়ে যান এই নির্মম পৃথিবী থেকে।
“মহান ভাষা আন্দোলনে মরহুম শামসুল হকের সঙ্গে, যেসব বীর ভাষাসৈনিকগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের বিস্তৃত ইতিহাস লিখিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্য হলো দেশের বিবেকবান গবেষক ও বুদ্দিজীবীদের কাছে এই আবেদনটাই রাখা যে বাংলা ভাষা, স্বাধীনতা, ও জনগণের পূর্ব গণতান্ত্রীক রাষ্ট্র কায়েমের জন্য তাঁর যে প্রাণপাত পরিশ্রম, সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষা ছিল, আমরা যেন তা ভুলে না যাই। অন্তত একুশের, বিজয় দিবসের ও স্বাধীনতা উৎসবের মহান দিনগুলিতে তাঁর কথা যেন স্মরণ করি।
শামসুল হক বিস্মরণের অপর নাম
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
প্রিয় সুধি-সজ্জন, মাননীয় প্রধান অতিথি জনাব জিল্লুর রহমান, প্রাজ্ঞ প্রধান আলোচক বদরুদ্দীন উমর, বিশেষ অতিথিবর্গ, বিশেষ আলোচক, আলোচকবর্গ ও প্রিয়বর সভাপতিÑ আসসালামু আলাইকুম।
গত ৩১ মার্চ টাঙ্গাইলে আমার কয়েকটি বইয়ের প্রকাশন- অনুষ্ঠানে একজন আলোচক আক্ষেপ করে বলেন, ‘আপনি এত বিষয়ে লেখালেখি করেছেন কিন্তু আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনীতির প্রধান রূপকার, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, টাঙ্গাইলের গৌরব শামসুল হক সাহেব সম্পর্কে একটি শব্দও কোথাও বলেন নি।’ লিখিত বক্তৃতা করি বলে, রাতও বেশি হওয়ার কারণে এই আক্ষেপের উত্তরে কিছু বলতে পারিনি। একথা সত্য নয় আমি শামসুল হককে নিয়ে ভাবি না। আমার ভাবনা গভীরতর বলেই তার সম্পর্কে চলতিপন্থি হতে আমার দ্বিধা। আর দ্বিধা থেকেই তাকে সচেতন এড়িয়ে চলা।
শামসুল হক সম্পর্কে মুদ্রিত পাঠ, স্মৃতি-শ্র“তি-কিংবদন্তি কোনোটাই স্পষ্ট-স্বচ্ছ নয়। ‘তাজউদ্দীন আহমদের ডায়রি’তে তার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি তথ্য পাওয়া যায়। তাজউদ্দীন আহমদ তার প্রতি খুব সদয় নন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডায়রিতে ১৯৪৯ সালের জুনের কোনো দিনলিপি নেই। ১৮ এপ্রিল ১৯৪৮ রবিবার থেকে ১ অক্টোবর ১৯৪৯ শনিবার এর মাঝখান ফাঁকা। ২৩ জুন ’৪৯ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার কোনো বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় না।
ড. শ্যামলী ঘোষ আওয়ামী লীগ বিষয়ে যে গবেষণা-গ্রন্থটি রচনা করেছেন তাতে শামসুল হক সম্পর্কে ব্যক্তিনিষ্ঠ কোনো আলোচনা করেন নি। আবু আল সাঈদ-এর ‘আওয়ামী লীগের ইতিহাস’ গ্রন্থে শামসুল হক সম্পর্কে ভাসা ভাসা কয়েকটি চিত্রকল্প ছাড়া তথ্যবহুল কোনো আলোচনা নেই।
আজকের প্রধান আলোচক জনাব বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থের তিন খণ্ডে যা বলেছেন তার অধিকাংশই তাজউদ্দীনের ডায়রির বরাত দিয়ে। এমতাবস্থায় স্মৃতি-শ্র“তি-কিংবদন্তির উপর নির্ভর করে শামসুল হক সম্পর্কে কোনো কিছু লেখা বা বলা সমীচীন মনে করি নি।
আজকের বিশেষ আলোচক কবি আল-মুজাহিদী এবং আমি একই ছাত্র সংগঠণের সহকর্মীরূপে কাজ শুরু করলেও মননজগতে আমরা ভিন্ন ভিন্ন গ্রহে অবস্থান করি। মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর স্তুতি-কীর্তন করে কবিতা লিখে আল-মুজাহিদী আমার কাছে যতটা-না অপ্রিয়, তারচেয়ে বেশি অপ্রিয় হয় স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে তার বিভিন্ন কার্যকলাপে। এই যে দূরত্ব এ কিন্তু বৈরিতা নয়, এহলো মতাদর্শগত অবস্থান। শামসুল হক ও তার সমকালীনদের মধ্যে এই ব্যবধান বেড়ে গিয়ে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে প্রায় সবাই তাকে উপেক্ষা করে। সামসময়িক লেখকগণ শুধু তার অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন, কীর্তিকে নয়। এখন প্রশ্ন হলো, কি তার কীর্তি ? আওয়ামী লীগ গঠণ ও ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকাÑ এ কোনো ব্যক্তিক বিষয় নয়Ñ সামষ্টিক। এই সমষ্টির মধ্যে চিন্তার বৈপরীত্য দেখা দেয়Ñ সম্পর্কের বৈকল্য অবধারিত। ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আধুনিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতি দ্বন্দ্ব এখানে তিনি আওয়ামী বলয়ে বন্ধুহীন শুধু নন, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তন্ন তন্ন করে খুঁজে এভাবেই তাকে আমি পেয়েছি।
শামসুল হক সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা খুবই কঠিন। কিন্তু কেন এমন হলো এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ভাবছি। এমন নয় যে, তিনি এলেবেলে ছিলেনÑ তারপরও তার সম্পর্কে এত ধোঁয়াসা কেন ? যিনি আওযামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা- সাধারণ সম্পাদক, যিনি আওয়ামী লীগের মেনোফেস্টো প্রণয়ন করেন; পূর্ব বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও মাতৃভাষার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা যার, যার কাছে গণভোটে পূর্ববঙ্গের মন্ত্রিসভার সকল সদস্য উপনির্বাচন এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে প্রচারণায় নামার পরও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠানকারী মুসলিম লীগ প্রার্থী জমিদার পুত্র খুররম খান পন্নী উপনির্বাচনে পরাজিত হন, যে নির্বাচনে পীর মাশায়েখ ফতোয়া দেয় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে ভোট না দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে; যে নির্বাচন ছিল স্বতন্ত্রÑ ভোটার ছিল শুধুই মুসলিমান; সেই নির্বাচনে শামসুল হক বিজয়ী হন। কীভাবে সম্ভব হয় তাও বিবেচনায় রাখা দরকার!
রাজনীতির অঙ্গন কুসুমান্তীর্ণ নয়, অতীতেও ছিল না, বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। রাজনীতির কুশীলবরা সার্কাসের দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে চলা ব্যক্তিত্ব। যে পড়ে যায় সে দর্শকের হাসি-ঠাট্টা-করুণার পাত্র হয়, উৎরে যাওয়া ব্যক্তিই কেবল বরমাল্য পায়। তবে এ বরমাল্য কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর ঞযব চধঃৎরড়ঃ কবিতা যারা পাঠ করেছেন তারা বিষয়টি ভালো করে অনুধাবন করতে পারবেন।
শামসুল হক কালপুরুষÑ কালজয়ী নন; শামসুল হক ঐতিহাসিক চরিত্রÑ ইতিহাস নিয়ন্ত্রক; নায়ক নন। যেমন তার গুরু আবুল হাশিম মুসলিম লীগের বিস্তুতি ও বিকাশে অনন্য অবদান রাখার পরও ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছেন কিন্তু ইতিহাস গড়তে পারেন নি। এই না পারায কোনো গ্লানি নেইÑ ষড়যন্ত্র খোঁজার কোনো অবকাশ নেই। ক্ষমতার রাজনীতি দাবা খেলার মতোÑ বড়ে দিয়ে রাজাকের বন্দি করা হয় বটেÑ কিন্তু বড়ে সবসময়ই কুপোকাত হয়। রাজনীতির ক্ষেত্রে আবুল হাশিম-শামসুল হকেরও একই দশা। এ নিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে পরিবেশ দূষণ করা যাবে কিন্তু ওদের নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। শামসুল হকের পরবর্তী প্রজন্ম তার কথা ভাবে নি বরং তাকে নিয়ে বিড়ম্বনাবোধই করেছে বলে অনুমান-নইলে তার স্মৃতি-কীর্তি ও ইতিহাস এমন করে মুছে গেল নে ? সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে! তৃতীয় প্রজন্ম হুজ্জত-হুচুগে আকৃষ্ট হয়ে শামসুল হককে নিয়ে নতুন করে আলোড়ন তুলতে চায়Ñ যার বড় প্রমাণ তার নামের আদ্যো ‘বঙ্গরতœ’ সন্নিবেশ করা। এই প্রচেষ্টা যদি অন্য দশটা ফেরিওযালার মতো হয় তবে শামসুল হকের ক্ষতিই হবেÑ তিক্ততার দমকা বাতাস উঠবেই।
ইসলামী সাম্য আর মাক্সীয় সমাজ-বিবর্তন-বিকাশের সমন্বয় ধারণা ছিল তারÑ হতে পারে এ অসম্ভব। কিন্তু এই অসম্ভব কিন্তু তার ব্যক্তি-রাজনীতিক-লেখক সততআকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। ‘মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করেছে গমন’ সেই পথে রণে ভঙ্গ’ দিয়ে নিজ পথে চলতে চাইলে অজনা-অব্যবস্থা অভিজ্ঞতার অপ্রতুলতার মুখোমুখি হতেই হবে। এসবকে পায়ের ভৃত্যসম-জ্ঞান না করলে মুখথুবড়ে পড়তে হয়। শামসুল হকের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তিনি যাদের সহযাত্রী ছিলেন তাদের পথ সুনির্দিষ্টই ছিলÑ সেখানে শামসুল হক মনে করতেন।
কার্লামার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেল্স্ সন্দোহাতীতরুপে মানুষের চিন্তা-জগত এবং কর্মক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছেন। ধর্মের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে হলে ধর্ম অর্থে মার্কস্ কি বুঝেছিলেন তা খুব সাবধানতার সাথে পর্যালোচনা করা উচিত। এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, ধর্ম সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণ অর্থেই কার্লামার্কস্ ধর্মকে অস্বীকার করেছেন। ধর্মের প্রচিলিত অর্থ যে বস্তুজগত এবং মানুষের প্রগতিশীল ও কল্যাণকর প্রচেষ্টা বর্জিত সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিকতাÑ একথা আগেই বলা হয়েছে। ধর্মের সাথে ইহকাল, বস্তুবাদ এবং মানুষের দৈহিক ও দৈনন্দিন জীবনের সম্পর্ক তাঁর জানা ছিলো না। খ্রিস্টান প্রভাবান্বিত পাশ্চাত্য জগতে তিনি ধর্ম ও রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ পৃথক ও বিচ্ছিন্নভাবে জনসাধারণের শোষণের যন্ত্ররূপে ব্যবহূত হয়ে দেখেছিলেন। রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদ ও পূঁজিবাদের মারফর এবং ধর্ম সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিকতার নামে জনসাধারণকে শোষণ করত। তাই কার্লমার্কস্ সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও অধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণাকরেছিলেন। মানসুষের দৈহিক ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পর্ক বর্জিত ধর্রে প্রয়েজনীয়তা মানবজীবনে অস্বীকার করে কার্লমার্কস্ নতুন কিছু করেননি।
আচ্ছন্ন মানুষ তার চারপাশের লোকদের জন্য হয় ভীতির কারণ, নয় করুণার পাত্র। শামসুল হকের ক্ষেত্রে দুটোই সত্যÑ তার কোনো বন্ধু ছিল না। এই যে বন্ধু ছিল না এও কিন্তু শামসুল হকের নিজ দায়। যে মাগীয় স্তুরে তার বাস সেখানে পৌঁছানো সাধারণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর পক্ষে সম্ভব ছিল নাÑ সে কারণেই তিনি অপ্রকৃতিস্থ বলে ধারণা জন্মে। ক্ষমতাবাদী মানুষরা মাগীয় উন্নত চিন্তার ধার ধারে নাÑ কত।
সহজে ক্ষমতা করায়ত্ব করা যাবে সেদিকেই থাকে সজাগ দৃষ্টি। কেননা ধর্ম- বিষয়ক তার চিন্তা-চেতনাতেই এই মার্গীয় পরিচয় পাওয়া যায়:
আধুনিক অর্থে ধর্মকে ইসলাম সাড়ে তেরশো বছর আগে অস্বীকার করেছে।
ইসলামের বৈরাগ্য নেই। অন্য কথায় ইহজগতকে অস্বীকার করে কেবল পরজগত নিয়ে ইসলামের কারবার নয়। সত্যিকার ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ম অর্থ হলো ইহকাল ও পরকাল, বস্তবাদ ও অধ্যাতœবাদ এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সমন্বয়। ইসলাম এর কোনটাকেই অস্বীকার করেনি; একের সাথে অপরের সমন্বয় সাধন করেছে। অধ্যাত্মবাদ ও বস্তবাদ উভয়ের উগ্রতা ও চরম মাদকতাকে অস্বীকার করে, ইসলাম মানজীবনের সব সমস্যা ও সংঘাতের এমন এক অপূর্ব সমন্বয় সাধন করে যার তুলনা আর তুলনা আর কোন ধর্ম বা মতবাদে নেই।
একই সঙ্গে তার কালটিও বিবেচনা রাখতে হবে। ভারতের মুসলমানরা হিন্দু জুজুর হাত থেকে বেঁচেছেÑ শামছুল হকরা ১৯৪৬-এর ভোটে বাঙালিদের সামনে যে সোনালী ভবিষ্যতের চিত্রকল্প অঙ্কন করেন তা এক ঝট্কায় শুধু ধূসর নয়, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ইসলামী-সাম্যের ‘মুসল্লি’ মসজিদে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত, পশ্চিমাঞ্চলের ঔপনিবেশিক প্রভুদের খয়ের খাঁ আর পদলেহকরা প্রভূর জুতায় পা গলিয়ে পূর্বাঞ্চলকে অবজ্ঞা, শোষণ, নিপীড়ন শুরু করেছেÑভাষার উপর করেছে আঘাতÑ এৎবধঃ খবধফবৎ কায়েদে আজম’ নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে, এই অবস্থায় আবেগের ভেলায় চড়ে যারা ক্ষমতার রাজনীতি শুরু করতে চায় তারা শামসুল হককে সামনে নিয়ে আসলেও তার আনাড়িপনা ও নিষ্কাম-নির্লোভ-নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম ও মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস পছন্দ করতে পারে না। তারা ধর্ম এবং মানুষ এই দুটি উপকরণকে মনে করে ক্ষমতা দখলের উপযোগ। অহর্নিশি গণমানুষের কথা যারা ভাবে তারা যে উপেক্ষিত হবে তা বলাইবাহুল্য। শামছুল হকের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। তিনি যাদের দ্বারা আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের সমর্থন প্রত্যাহারের ফলেই তিনি আর পদে বহাল থাকেননি। এই কিটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অঙ্গুলি তোলা হয়। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট ছিল- তিনি লক্ষ্যের পথে পরিকল্পিত উপায়ে এগুতে তৈরি ছিলেন। তার গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আধুনিক রাজনীতির ছক ভালই শিখিয়েছিলেন। তাই তার পদক্ষেপ ছিল সুনির্দিষ্ট ও সময়োপযোগী। শামছুল হকের প্রতি যদি কোনো অবিচার হয়েই থাকে তা আদর্শিক-সামষ্টিক-কোনো ব্যক্তি সে জন্য দায়ী হতে পারে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বিংশ শতাব্দীর চারের দশকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা। এই সময়কে যদি আমরা বিচার করতে পারি তাহলে শামছুল হককে যথার্থ চিত্রিত এবং জীবনদর্শনকে উপলদ্ধি করতে পরবো। এই জায়গাটায় ভুল হলে সবকিছুই ভ্রান্ত পথে চালিত হবে। শামসুল হকের জন্মের কালে সমাজ গড়নে মধ্যবিত্ত কিংবা নিুমধ্যবিত্ত ছিল নাÑ ছিল ভূস্বামী, ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির তল্পিবাহক, ছিল চাকরিজবিী, ছিল বণিকশ্রেণী। অবশিষ্টরা সবাই পল্লীবাসী। পল্লীজীবন ছিল ভিন্নমাত্রিক। সেখানে বৃহৎ-মাঝারি-ক্ষুদ্র ৃষক আর কৃষিশ্রমি ধর্মবর্ণ নির্েিশষে একটা লোকজ সমাজ ও সংস্কৃতির বন্ধন ছিলÑজীবন্ত সংস্কৃতি। ধর্মীয় আচারনাুষ্ঠানের পার্থক্য থাকলেও প্রত্যক্ষ কোনো বিদ্বেষ ছিল না। ১৯৩৫- এর ভারত শাসন আইনমুলে ১৯৩৭-এ নির্বাচনথÑ ‘পৃথক নির্বাচন’ ধর্মীয় বিভেদ চালান হয় গ্রামে। মুসলমান আলাদা জাতি, তার কৃষ্টি আলাদা, তার তাহজিব-তুমুদ্দুন আলাদাÑ জনমনে এই বোধ ইনপুট করা হয়। ১৯৪০-র ২৩ জুন ‘লাহোর প্রস্তাব’ ধর্মবৈপরীত্যকে স্থায়ী রূপ দেয়। আজকের আলোচনার বিষয় এ নয়।
শামসুল হকের জন্ম নিুআয়ের কৃষক পরিবারে। তার পিতা দবির উদ্দিন সরকার ছিলেন একজন মাতব্বর। শামসুল হক যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন এ ধরনের মুসলিম পরিবারে অন্তত একটি ছেলে উচ্চতর শিক্ষগ্রহণ করুক এবং ‘বুবু’দের সমকক্ষ হোক এই প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। শামসুল হক সেই ভাগ্যবান সন্তান উপরন্ত, তিনি ছিলেন মেধাবী-মনোযোগী শিক্ষার্থী। শিক্ষগ্রহণের পাশাপাশি তিনি তার নিজ ধর্ম-সম্প্রদাযের অধঃপতিত অবস্থার প্রতি দৃষ্টি ফেরান। নিজ ধর্ম সম্পর্কে তার উপলব্ধি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য ঃ
ইসলামের শান্ত শীতল ছায়াতলে এসে সকল মত, পথ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের এক মহা সমন্বয় হবে। ইসলামই একমাত্র ডাযলেকটিক ধর্মÑ ইসলামেই আছে সব সমস্যার সমাধান, সব সংঘাত ও সংঘর্ষের চিরন্তন ও মহাসমন্বয় বা শান্তি। দুনিয়ার প্রত্যেক মানুষ ও জীবকে ইচ্ছায় হোক, অনচ্ছিায় হোক, জচ্ঞাতসারে হোক, অজ্ঞাতসারে হোক সৃষ্টির স্বাভাবিক ক্রমবিকাশের নীতি অনুসারে আপনা হতেই মুসলিম বা শান্তিকামী হতে হবে। মানবতা ও সৃষ্টি পুরোপুরি মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠবেইÑ দুনিয়ায় চিরন্তন শান্তি বা ইসলাম কাযেম হবেই।
তাই তিনি দেখতে পান হিন্দুরাই সবকিছুর মুলেÑ মূলত ঔপনিবেশিক শাসককুলই যে সব তা জানার সুযোগ তার ছিল নাÑ যারা জানতেন তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই সেকথা চেপে যান। তিনি মুসলি লীগের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নেনÑ ছাত্র হিসেবে ছাত্রদের সংগঠিত করতে তৎপর হন। সা’দৎ কলেজ করটিয়ায় অধ্যয়নকালে তিনি ছাত্রসংসদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন। অধ্যক্ষ মহোদয় মুসলিম রাজনীতির প্রতি অনুরাগ ছিল বলে সহজেই ছাত্রসংসদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ছাত্রসংসদের প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন শামসুল হক। এভাবেই পূর্ববঙ্গের নব্য শিক্ষিত মুসলিম তরুণ সমাজের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন।
এখানে আরো যে কথাটি মনে রাখতে হবে তা হলো সে সময় কলকাতা ছিল সকল কিছুর ন্দ্রেবিন্দু। উৎপাদন ও সম্পদের ভাণ্ডার পূর্ববঙ্গের কোনো গুরুত্ব ছিল না। ঢাকা একটি জেলা শহর বৈ আর বেশি কিছু নয়। যদিও বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা ছিল পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে ‘রাজধানীÑঢাকা; আবার ক্ষমতার রাজনীতির ক্ষেত্রে ঢাকা পড়ে যায়। এই সময় আবুল হাশিম যখন মুসলিম লীগকে গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে দিতে পুর্ববঙ্গে আসেন এবং বিশেষ করে ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি পরিচিত হন তাদের দু’জন শিক্ষকের সঙ্গেÑ কামরুউদ্দিন আহমদ ও সেকান্দার আলীÑ একই সঙ্গে তরুণ সপ্রতিভ শামসুল হকের সঙ্গেও। শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রথম দর্শনেই শামসুল হকের মধ্যে দেখেছিলেন তার সত্যিকার ভাব-শিষ্যের ছায়াÑ এই প্রথম গুরু মানার যোগ্য ব্যক্তিত্ব পান শামসুল হক। গুরু-শিষ্য দু’জনই আলোর ঝলক দিয়ে দৃশ্যপট থেকে সরে যান।
শামসুল হকের অপ্রকৃতস্থ হওযার অন্যতম কারণ হিসেবে যদি তার বৈবাহিক জীবনকে দায়ী করা হয় তাহলে যারা ইতিহাস জানে না তারা আঁতকে উঠবেন। আমরা দেখতে পাই, শামসুল হক টাঙগাইল উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে ঢাকায় আসার পরপরই এই বিয়ে সংঘটিত হয়। পাত্রী সেকান্দর আলী মাস্টার সাহেবের বিদূষী কন্যা আফিয়া খাতুন ইংরেজির প্রভাষক। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি শ্রেণী অবস্থানের একধাপ উঁচুতে উঠেন বটে কিন্তু তার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য পাল্টায় না। শামসুল হক ভাববিলাসী, আফিয়া পুরোপুরি মর্ত্যবাসিনী। ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছে তুমি এমএলএ হয়েছো, কি দরকার বাপু প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়ে, তারচেয়ে ভাল বশমানা অন্যরা যা করছে তাই কর, তুমি মন্ত্রী হও, আমি স্কলারশীপ নিয়ে আমেরিকা থেকে আরো উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে উচ্চসমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করি’ এই ছিল তার বৈবাহিক অভিজ্ঞতা। স্বপ্নচারী শামসুল জক পুনর্বার হোঁচট খেলেন প্রথম খেয়েছিলেন পাকিস্তানি মুসলমানদের ইনসাফের বহর দেখে, এবার হলেন স্ত্রীর বাস্তববুদ্ধির চেহারা দেখে।
একই সময়ই খাজা বিরোধী শহীদ সোহরাওয়াদি অনুগত রাজনৈতিক কর্মীরা ‘মুসলিম লীগ কর্মী শিবির’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করায় মূল লক্ষ্য একটি রাজনৈতিক দল গঠন। এ লক্ষ্যে মৌলানা ভাসানীকে আসাম থেকে আনা হয়। সারা পূর্ববঙ্গে শামসুল হক তখন সুপরিচিত, তুখোর বক্তা মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার বক্তৃতা শুনে-আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সব ঠিকঠাক চলছিল বিপত্তি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি। আওয়ামী মুসলিম লীগ ও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় ১৪৪ ধারা ভাঙা ঠিক হবে না। আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শামসুল হক ২১ ফেব্র“য়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। গ্র“প করে গ্রেফতার বরণ করে, তিনিও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার দায়ে গ্রেফতার হন। প্রসঙ্গটি এজন্যই তুলছি যে, তিনি আপোষকামী বা অহঙ্কারী ছিলেন না। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই প্রধান তিনি তা বিশ্বাসই করতেন তাই নয়, প্রমাণও করেছেন্
বাংলাদেশের নির্বাচন ও সংসদ নিয়ে ‘মাদারীর খেল’ নতুন নয় এ আমাদের উত্তরাধিকার। উপনির্বাচনে জিতলেও মুসলিম লীগ সরকার তাকে পরিষদে বসতে দেন নি। নির্বাচনী হিসাবে গরমিল দেখিয়ে যেমন করে মৌলানা ভাসানী ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করা হয় ঠিক তেমনি শামছুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ধুবরী জেলে বিন্ধ মৌলানা ভাসাণীর দস্তখত করা প্রচারপত্র। এর বিরুদ্ধে তিনি যে মামলা করেন তার কোনো নিষ্পত্তিই হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ঐ উপনির্বাচনের সময় পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রিসহ প্রায় সকল মন্ত্রী মাসাধিককাল নির্বাচনী এলাকায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ঘোরাফেরা করে। এই অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই অভিযুক্ত করা হয় বিজয়ীকে। এভাবেই পূর্ববঙ্গের মানুষ জালিম মুসলিম লীগ সরকারের ইনসাফের মুখব্যাদান করা চেহারা দেখতে পায়। জানার জন্য বলছি, মওলানা ভাসানী ও শামসুল হকের নেতৃত্বে যে দল গঠন হয় আবুল হাশিম সেই দলে কিন্তু যোগ দেন না।
শামসুল হককে যতটা বুঝেছি তাতে ‘হুক্কুল এবাদ’ আর ‘সাম্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠার সমন্বয় বিশ্বাসী ছিলেন তা আবুল হাশিমেরই শিক্ষা। প্রকৃত ইসলাম আর সাম্যবাদের মধ্যে পার্থক্য খুব একটা বড় বলে তারা মনে করতেন না:
জ্ঞাতসারেই হোক অজ্ঞাতসারেই হোক, মার্কস্বাদ ইসলামে পতেই অগ্রসর হচ্ছে। এখন নিঃসন্দেহে একথা বলা যেতে পারে, যাঁরা অন্ধ মার্কস্বাদী, যাঁরা মনে করেন মার্কসবাদ অভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁরা ভ্রান্ত। ইসলাম সম্পর্কে সম্যক ও সত্যজ্ঞান না থাকায় দরুনই তাঁরা এ দাবি করেন। তাঁদের এই ভ্রম সংশোধন করে ইসলামী আদর্শকে পুরোপুরি স্বীকার না করলে এ কখনো সম্পূর্ণ হবে না। মার্কস্বাদ যখন আল্লাহ্ এবং ইসলামকে মেনে সব দ্বন্দ্ব ও বৈষম্যকে মিলিয়ে ইসলামের আলোতে আলোকিত হয়ে সবার ভেতর একটা সুষ্ঠু, সুন্দর সাম্য ও সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম হবে সেদিনই সেটা পূর্ণতা প্রাপ্ত হবে; আর তখনই আসবে প্রকৃত সাম্যবাদ।
শামসুল হক কালপুরুষ বলেই তার উত্তরাধিকারের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ব্যক্তিক একান্তই ব্যক্তিক স্তরে। মতাদর্শে ও নীতিতে পার্থক্য এবং লক্ষ্যাদর্শে ভিন্নতা হলেই কাউকে আমি শত্র“ ভাবি না। সবারই লক্ষ্য মানুষ-সমাজ-সংস্কৃতির অধিকতর উন্নতিসাধর, বিকাশ ও সুস্থতার জন্য নিয়ত কাজ করা, সেখানে বৈরিতার খুব একটা অবকাশ আছে বলে মনে করি না।
পরিেেষ বিনতিভাবে বলতে চাই, অভিভাবকত্ববাদী সমরনায়কচক্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশে একই কারবার জারি রেখেছে। আমরা একটু পর্যবেক্ষণশীল হলেই বুঝতে পারব, পাকিস্তানে যে লড়াই তা গণতন্ত্রের নয়, গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নয় পাকিস্তান দাবির চালকদের সঙ্গোপন বাসনা ছিল ইসলাম-ইনসাফ-তাহজিব- তমুদ্দুন ও মুসলমান ‘আলাহেদা’ জাতি প্রচার করে কুলাক-নবাব-খাজা-গজাদের রাষ্ট্র কায়েম করা। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে মুষলিম লীগ তার নখদন্ত বের করে। সমরনায়কচক্র পালাক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রভুত্বকামী পাকিস্তানি বিকৃত মানসিকতদায় আক্রান্ত সমরনায়কচক্র একই মাপের বুট জুতায় পা ঢুকিয়ে দেয়। তাই ১১ জানুয়ারি ২০০৬-র উদ্দেশ্যই বিএনপি ও ধর্মসন্ত্রাসীদের ধ্বংস নয়, স্রেফ নেতৃত্বের অদল-বদল পাকিস্তানি কায়দায়। আইয়ুব মুসলিম লীগের উপর ভর করে, জিয়াউল হক আইয়ুবের পথেই হাঁটে, মোশাররফও কম যায় না মিলিয়ে দেখুন বাংলাদেশ জিয়ার পর এরশান, এরশাদের পর খালেদা খালেদার পর যে-ই আসুক সে তারেক বা অন্য কেউ নাম বদলাবে কিন্তু লক্ষ্য ও আদর্শ অভিন্ন থাকবে। সবই মানুষ ঠকানোর কারবার মাত্র। এ-কাথাও মনে রাখতে হবে, আইয়ুব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ‘হাইজ্যাক’ করতে করাচীর ক্লিপটনে যে কনভেনশন অনুষ্ঠান করেন তার কনভেনর ছিলেন আল্লামা আবুল হাশিম। এভাবেই মুসলিম লীগ কনভেনশন পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার পোষকতা করে। এও মনে থাকার কথা, ১৯৭৭-এ বাংলাদেশের আলেম-পীর-মাশায়েখদের বিশাল কনভেনশন করে জিয়াকে অভিনন্দিত করা হয় জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ দু’টি রাষ্ট্রের গণমানুষের স্বাপ্ন বার বার বুটপিষ্ট হয় এই ত্রাণ কর্তাদের দ্বারাই। আজকের এই পৃথিবীতে স্বপ্ন ও কল্পনাবিলাসের কোনো স্থান নেই। তবে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মত যদি কেউ স্বপ্ন দেখতে পারেন আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো আমরা ইন্টারনেটে পৃথিবীকে সংহত করেছি। সংহত রতে চাই সংহতি, সংসহিতর জন্য সম্বল থাকতে হয়। আমাদের সম্বল হোক শামসুল হকের দেশপ্রেম, নিষ্কাম-নির্লোভ পরহিতে আত্মোৎসর্গ।
জয় হোক বাঙালির।
জয় হোক বাংলার।
২১শে ফেব্র“য়ারী ও শামছুল হকের ভূমিকা
বদর উদ্দিন উমর
৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভা সমাবেশ
২১শে ফেব্র“য়ারী খুব ভোর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু হয়। নেতৃস্থানীয় ছাত্রদেরকে পাছে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে বাধা দেয় সেজন্য তাঁদের কয়েকজন খুব সকাল করেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে উপস্থিত হন। এইভাবে প্রথমে গাজীউল হক ও পরে মহাম্মদ সুলতান, এস.এ.বারী এটি প্রভৃতি ছাত্র-নেতারা এলাকায় পুলিশ মোতায়েনের পূর্বেই সেখানে প্রবেশ করে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দুজন দুজন করে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠাতে শুরু করেন।১*
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকেও ছাত্রেরা পিকেটিং এর জন্য শহরের কিছু এলাকায় যান। সেলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র নেতারা এই ধরনের পিকেটিং এর বিরোধিতা করেন এবং তার ফলে অনেক ক্ষেত্রে খোলাখুলি মৃতবিরোধ শুরু হয়। অবশেষে ছাত্রেরা নবাবপুর এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।৩
পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকেই বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করতে শুরু করেন। ৯টা সাড়ে ৯টার মধ্যেই আমতলার নীচে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর সমাবেশ ঘটে।৪ কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহমেদ,মহম্মদ তোয়াহা, আবদুস সামাদ প্রভৃতি ছাত্রদের সঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এই সময় শেরওয়ানী ও জিন্নাহ টুপী পরিজিত শামছুল হক মধুর রেস্তোরায় উপস্থিত হলে ছাত্রেরা তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ঘেরাও করে উত্তজিতভাবে কথাবার্তা শুরু করেন এবং শামসুল হকও তাঁদেরকে ১৪৪ ধারা যাঁদের মাধ্যমে এইসব চিঠি পাঠানো হয় তাঁদের মধ্যে স্কুলছাত্রী জাহানারা লাইজু, মেডিকেল কলেজ ছাত্র মঞ্জুর, নিযামুল হক প্রভৃতি।২
ভঙ্গ না করায় এবং নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে নানা যুক্তি দিতে থাকেন। এই বিতর্ক ও বাদানুবাদের এক পর্যায়ে হাসান হাফিজুর রহমান উত্তেজিতভাবে শামসুল হককে ঃৎধরঃড়ৎ বলে গালাগালি দিয়ে তাঁর মাথা থেকে টুপী ছিনিয়ে নিয়ে দুরে ফেলে দেন। ৫
সকাল সাড়ে সাতটা থেকেই ঢাকার সিটি ডি.এস.পি. সিদ্দিক দেওয়ানের পরিচালনায় পুলিশ বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিজেদের অবস্থান গ্রহণ করে। খুব সকাল থেকে ঢাকা সিটি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ মাহমুদ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের অবস্থান দেখে বেড়াতে থাকেন। সকাল ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় গেটের সামনে ঢাকার এস.পি.মাহমুদ ইদরিস পুলিশ অবস্থান আরও জোরদার করেন। এর ফলে সেখানে সিটিডি.এস.পি.এস.এ.এফ এর ১ জন ইন্সপেক্টর ২ জন হেড কনস্টেবল ও ২০ জন কনস্টেবল এবং ১জন ইন্সপেক্টর,১ জন সাব-ইন্সপেক্টর, ১জন সার্জেন্ট, ২ জন হেড কনস্টেবল ও ১৪ জন লাঠিধারী কনস্টেবল মোতায়েন করা হয়। মেডিকেল কলেজ গেটের সামনে এস.এ.এফ. এর ১ জন হেড কনস্টেবল ও ১০ জন কনস্টেবল এবং সেলিমুল্লাহ মুসলিম হল এর সামনে ১ জন হেড কনস্টেবল ও ১০ জন কনস্টেবলকে মোতায়েন করা হয়। এই কসস্টেবলরা ছিলো অস্ত্রসজ্জিত।৬
এই সময় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এইভাবে পুলিশ মোতায়েনের যুক্তি হিসেবে পুলিম কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বলা হয়,
খুব সকাল থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, সিটি, টহলে বের হয়ে বিভিন্ন পুলিশ অবস্থান দেখে বেড়ান। বিশ্ববিদ্যাল এলাকায় তিনি দেখেন যে ছাত্রেরা যানবাহন দাঁড় করাচ্ছে, যাত্রীদেরকে বাস, ট্যাক্্ির, রিক্্রা ও মোটরগাড়ী থেকে নামতে বাধ্য করছে এবং ঐসব যানবাহনের চাকা থেকে হাওয়া বের করে দিচ্ছে যাতে সেগুলি পরবর্তীতে আর ব্যবহার করা না যায়। পুলিশ অফিসাররা যানবাহন ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য এতে বাধা প্রদান করতে গেলে তাদেরকে কুৎসিৎ ভাষায় গালাগালি করা হয় এবং বিশেষ করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিঃ ইদরিস সকাল ৭-৪৫ মিনিটে খবর পান যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ও মেডিকেল কলেজ এলাকায় ভিতরে ও বাইরে বহু সংক্যক ছাত্রের সমাবেশ হয়েছে এবং তারা তাদের দ্বারা ঘোষিত হরতাল জোরপূর্বক কার্যবর করার জন্য চালক ও যানবাহনসমূহকে দাঁড়াতে এবং যাত্রীদেরকে নেমে পড়তে বাধ্য করছে। এই গোলযোগপূর্ণ স্থানে পুলিশ সুপার সকাল ৮-১৫ মিনিটে উপস্থিত হয়ে দেখেন যে, ছাত্রেরা সত্যিই জোর-জবরদস্তি করছে যানবাহন থামিয়ে দেওয়ার জন্য ঠিক সেইভাবে যেভাবে তাঁর কাছে রিপোট করা হয়েছিল। এই সব কার্যকলাপ থেকে বিরত হওয়ার জন্য এস.পি. ছাত্রদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি দেখলেন যে তাঁর প্রতিবাদের কোন ফল হচ্ছে না এবং যেহেতু গন্ডগোলের আশঙ্কা করছিলেন সেজন্য তিনি ঐ বিশেষ এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করেছিলেন।৭
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, আমতলায় এবং মধুর রেস্তোরায় সংখ্যক ছাত্র জমায়েত হয়ে উত্তেজনাপূর্ণভাবে নানা ধরনের আলোচনা করছিলেন এভং যাঁরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে ছিলেন তাঁদের বক্তব্য খন্ডন করছিলেন। আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তখন অল্প সংখ্যক ছাত্র ছাড়া বাকী সকলেই মোটা-মুটি এটা ঐক্যমতে পৌঁছালেও কিভাবে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় সে বিষয়ে কোন সুষ্ঠু ধারণা তখনো পর্যন্ত কারো ছিলো না। চারিদিকে একটা বিশৃঙ্খল ভাবও বিরাজ করছিলো।৬
গাজীউল হক এভং এম.আর.আখতার (মুকুল) অলি আহাদকে পূর্ব রাত্রিতে ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ের বৈঠক তাঁদের স্বারা গৃহীত ১৪৪ দ্বারা ভঙ্গের পক্ষে মতামত খুব প্রবল থাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ ও মুসলীম ছাত্র লীগের উপস্থিত নেতৃবৃন্দ খুব হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় কাজী গোলাম মাহবুব অলি আহাদকে জিজ্ঞেস করেন তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবেন কিনা। এর জবাবে অলি আহাদ বলেন যে, সেটা সাধারণ ছাত্রসভাতেই স্থির হবে। ১০
২১ শে ফেব্র“য়ারী আমতলা ছাত্রসভা শুরু হওয়ার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলার ডক্টর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রক্টর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী,সেলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট ডক্টর ওসমান গণি, কলা অনুষদের ডীন ডক্টর জ্বরেরুী এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ নিউম্যান সেখানে উপস্থিত হন।১১ দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ ডক্টর গোলাম জিলনিীও প্রায় একই সময়ে সেখানে যান১২ এবং ছাত্রের যাতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করেন তার জন্য তাঁরা সকলে ছাত্রদের বোঝাতে চেষ্টা করেন।
ঢাকার হেলা ম্যাজিষ্ট্রেট কোরেশী এলিস কমিশনের কাছে যে সাক্ষ্য প্রদান করেন তার থেকে জানা যায় যে, বেলা দশটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যখন ছাত্রেরা সভার কাজ আরম্ভ করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রারকে বলেন ভাইস-চ্যান্সেররের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে এবং তাঁকে অনুরোধ করতে যাতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ছাত্রদে;র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা থেকে বিরত করতে চেষ্টা করেন। Í অল্প পরেই কোরেশী এবং তার ঠিক পরই ভাইস-চ্যান্সেলর অন্যদেরকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গেটের সামনে উপস্থিত হন। কোরেশী তাঁদেরকে অনুরোধ করেন ছাত্রদেরকে বোঝাতে যাতে তারা যানবাহন চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি এবং ১৪৪ ভঙ্গ না করে।১৩
এই সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের আমতলায় ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ছিলো আনুমানিক একহাজার।১৪ ভাইস চ্যান্সেলর যখন ছাত্রছাত্রীদেরকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করা এবং শান্তি রক্ষা করা ইত্যাদি সম্পর্কে বলতে থাকেন তখন ছাত্রেরা তাঁকে অনুরোধ করেন তাঁদের সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য। এর জবাবে ভাইস-চ্যান্সেলর বলেন যে, ছাত্রেরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে না এবং সভার পর শান্তিপূর্ণভাবে একে একে বাইরে চলে যাবে এই শর্তে তিনি ছাত্রদের সভায় সভাপতিত্ব করতে সম্মত আছেন। ছাত্রেরা তাঁর এই শর্ত মানতে অস্বীকার করায় ভাইস-চ্যান্সেলরও তাঁদের সভায় সভাপতিত্ব করার ব্যাপারে অসম্মতি জানান।১৫
এর ঠিক পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সভার কাজ শুরু হয়। এই সময় ভাইস-চ্যান্সেলর সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল কর্মকর্তা ও শিক্ষক তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই কিছু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ান এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন।১৬
মুসলিম ছাত্র লীগের খালেক নওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুব, নুরুল আলম প্রভৃতি স্থির করেছিলেন যে ঐ দিনের সভায় তাঁরা কাজী গোলাম মাহবুবকে সভাপতি করবেন।১৭ কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে উদ্যোগী হওয়ার পূর্বেই পূর্ব রাত্রে ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মোস্তফা রওশন আখতার (মুকুল) সভাপত হিসেবে গাজীউল হকের নাম প্রস্তাব করেন এবং প্রস্তাবটি সমর্থন করেন কমরুদ্দীন শহুদ।১৮
সভা শুরু হওয়ার পর একে একে শামসুল হক, মহম্মদ তোয়াহা, কাজী গোলাম মাহবুব এবং খালেক নওয়াজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সপক্ষে বক্তব্য রাখেন ও যুক্তি প্রদান করেন। অন্যদিকে আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মতপ্রকাশ করে বলেন যে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা অবশ্য প্রয়োজনীয়। অলি আহাদকে এই সভায় বক্তব্য রাখার জন্য কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ অনুরোধ জানালে তিনি বলেন যে, তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে চান কিন্তু অনুরোধ জানালে তিনি বলেন যে,তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে চান কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও চান যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের স্বার্থে সংগ্রাম পরিষদ অটুট থাকুক। কাজেই তিনি এমন কোনবাক বিতন্ডা চা না যার দ্বারা সংগ্রাম পরিষদের ঐখ্য বিনষ্ট হয়।১১
সভা প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর অবশেষে গাঝীউল হক সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সপক্ষে মতপ্রকাশ করে তিনি বলেন যে, এ ভাবেই তাঁরা নুরুল আমীন সরকারের চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে চান। সভায় শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব প্রভৃতি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখলেও তাঁদের বক্তব্যের সপক্ষে তেমন কোন সমর্থন ছিল না। সভাপতি গাজীউল হক কর্তৃক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় সমবেত ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তেজনায় অস্থির হয়ে ওঠেন এবং‘১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে হবে’ রাাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি শ্লোগান দিতে থাকেন।২০ এই সময় আবদুস সামাদ প্রস্তাব করেন যে, কিছুটা সুষ্ঠু, ও সুশৃঙ্খলভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য ১০ জন করে এক এক ব্যাচে বের হওয়া দরকার, কারণ সকলে একসঙেক্ষগ বের হতে চাইলে চারদিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।২১ প্রস্তাবটি গৃহীত হলে সভা শেষ হয় এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় গেটের সামনে সমবেত হতে শুরু করেন। সময় তখন ছিলো বেলা ১১টা।২২
১৪৪ ধারা ভঙ্গ
সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যওয়ার পর পূর্বে যাঁরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রয় সকলেই সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে একত্মতা প্রকাশ করে সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেন। এ প্রসঙ্গে শামছুল হকের উল্লেখ করে গাজীউল হক বলেন।
একথা সত্য, জনাব শামছুল হক সভায় ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু যখনই ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো তখনই শামছুল হক আমাকে বললেন, এ সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিলাম। এবং আমি এ সংগ্রামের সঙ্গে আছি। সুতরাং সেদিন যে কোন কারনেই হোক ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিরুদ্বে যারা ছিলেন আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তারা প্রায় সবাই আমাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেন। এবং আন্দোলন অংশ নেন। এদের অনেকেই ঐদিন গ্রেফতার হন। জনাব শামছুল হকও পরবর্তীকালে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন।
যে সব ছাত্র-ছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাইরে যাবেন তাদের নামের একটা তালিকা রাখার জন্য মহাম্মদ সুলতানকে দায়িত্ব দেওয়ায় তিনি সেই অনুযায়ী গেটের গোড়ায় উপস্থিত হলেন। ঠিক এই সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল সে সম্পর্কে হাবিবুর রহমান শেলী বলেন,
আইন ভাঙ্গার প্লানে এমন একটা আতঙ্কিতভাবে র্ছিল যে, অনেকে ভাল করে করে বুঝতে পারল না কি করতে হবে। আগের রাতে যাদের মধ্যে আইন ভাঙ্গার ব্যাপারে একটু ইতস্ততভাবে ছিল দেখলাম, তাদের সেই দোটানা ভাব কখন কেটে গেছে। পুলিশ কাদুনে গ্যাস ছাড়বে বলে অনেকে রুমাল ভিজিয়ে নিল। ভিড়ের মধ্যে আমিও আমার রুমালটা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর মনে কেমন যেন একটা লজ্জা হচ্ছিল। প্রক্টরের গেটের কাছে ক্রমশ ভিড় জমছে কিন্তু রাস্তায় বের হওয়ার কোন উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। চতুর্দিকে একটা বিশৃঙ্খলার ভাব। কেউ কারও কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে হাবিবুর রহমান শেলীর নেতৃত্বেই এই প্রথম ১৪৪ ধারা বঙ্গকারী স্কোয়াডটি গেট থেকে বের হয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ে।৪ এ সম্পর্কে হাবিবুর রহমান বলেন,
আমি দেখলাম, আমাদের আগের দিনের প্লান প্রায় ভেস্তে যাবার জোগাড়। হঠাৎ করে আমার মনে হল, আমরা কয়েকজন যদি গেটের বাইরে গিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গি তবে কেমন হয়। আমাকে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে হবে এমন কোন পূর্ব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে আমার মনে নেই। আমি যেহেতু আগের দিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার উপর জোর দিই সেজন্য বন্ধুদের একটা প্রত্যাশা ছিলো যে, আমি প্রথমে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য এগিয়ে যাবো। যারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য এগিয়ে এলেন মোহাম্মদ সুলতান তাঁদের নাম লিখে নিলেন। আমি তাঁকে বললাম: “তুই আমার পঙ্খীরাজটা (সাইকেল) দেখিস, আমি চললাম।” গলা ফাটিয়ে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেলাম কয়েকজনকে সাথে করে।৫
এইভাবে প্রথম দলটি নিয়ে হাবিবুর রহমান ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্যে বের হয়ে যাওয়ার ঠিক পরই ইব্রাহিম, তোহা, আবদুস সামাদ, আনোয়ারুল হক খান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রভৃতি ছাত্রদেরকে নিয়ে বাইরে যান। শাফিয়া খাতুন, সুফিয়া ইব্রাহিম, রওশান আরা বাচ্চু, শামসুন্নাহার প্রভৃতি বেশ কয়েকজন ছাত্রীও ঐ সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ছাত্রদের দুই তিনটি দল বাইরে যাওয়ার পর তারাও কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গেটের বাইরে গিয়ে পড়েন। তাঁদের প্রথম দলের নেতৃত্বে ছিলেন শাফিয়া খাতুন। মেয়েদের কয়েকটি দল বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এস, এ, বারী এটি, শামসুল হক (ছাত্রনেতা), আনোয়ারুল আজিম, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ,সৈয়দ ফজলে আলী, বদরুল আমীন প্রভৃতি আরও অনেক ছাত্র শ্লোগান দিতে দিতে গেট পার হয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। মহম্মদ সুলতান,হাসান হাফিজুর রহমান, আজহার প্রভৃতি তাঁদের নাম টুকে রাখছিলেন।৬ বস্তুতঃপক্ষে, এই পর্যায়ে ছাত্রেরা দলে দলে পৃথকভাবে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর না হয়ে ঢেউএর পর ঢেউ এর মতো বাইরে যাচ্ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ-কারীদের নাম লিখে রাখা আর সম্ভব হচ্ছিলো না। ৭ তাছাড়া পুলিশ তখন তাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়তে শুরু করায় সকলেই সে সময় কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো।৮
১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যাঁরা বাইরে যাচ্ছিলেন তাঁদেরকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিজেদের গাড়ীতে তুলছিলো এবং গাড়ী ভর্তি হলে সেগুলিকে থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করছিলো। কোন ছাত্রীকে অবশ্য সেদিন তারা গ্রেফতার করেনি।১
পুলিশ বহু বাস-ট্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি জমা করে রাখে। সমগ্র এলাকাটিতে একটি যুদ্ধংদেবী পরিবেশ বিরাজ করছিল।
গাজীউল হক কর্তৃক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরই ছাত্ররা প্রথমে দশ জন দশ করে পরে দলে দলে ঢেউয়ের পর মত ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে থাকেন। আর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষের নেতা কর্মীরা, দু’জন করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিত্যাগ করতে থাকেন। শামসুল হক পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ছাত্রদেরকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে রেখে নিরাপদ চলে যেতে পারলেন না। বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় গাজীউল হকের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। মিছিল সহকারে ছাত্ররা পরিষদ ভবনের দিকে এগুতে থাকলে পুলিশ প্রথমে তাঁদেরকে বাধা প্রদান করে। কিন্তু পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মিছিল এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলে পুলিশ মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে থাকে। এর জবাবে ছাত্ররাও পুলিশের প্রতি ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে। এই অবস্থা বেশ কিছুক্ষণ চলে। কাঁদানে গ্যাসের একটি ‘সেল’ আমগাছের কাছাকছি গাজীউল হকের গায়ের উপর পড়ে এবং সেটা ফাটার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। পাশে দাঁড়ানো শামসুল হক তখন তাঁকে জড়িয়ে ধরেন।৯ গাজীউল হককে ধরাধরি করে বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের দোতলায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়া হয়। ১০
কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ এবং ইট ছোঁড়াছুঁিড়র এক পর্যায়ে পুলিশ হঠাৎ বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে অনেক হতাহত হন।
ঘটনার এই দ্রুত পরিবর্তনে সকলেই অনেকটা বিহুল হয়ে পড়েন। আব্দুল মতিন ইমার্জেন্সির সামনের লনে বসে পড়ে কাঁদতে থাকেন এবং সেদিন ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্তের সঠিকতা সম্পর্কে তিনি চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।১১
২১শে ফেব্র“য়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহতের সংখ্যা সরকারীভাবে ৪ জনের কথা বলা হয়েছিলো। প্রকৃত পক্ষে নিহতের সংখ্যা ছিল আরো অনেক বেশী। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সেসব লাশ তুলে নিয়ে গুম করে ফেলোছিলো।১২
গুলিবর্ষণের কিছুক্ষণ পরে আবুল হাশিম, শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, কাজী গোলাম মাহবুব, আবদুল গফুর, ফজলুল হকের কে, এম, দাস লেনস্থ বাড়ীতে গুলিবষণের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য মিলিত হন।১৩
হাফিজ উদ্দিন আহমদ লিখেছেন যে, ‘প্রসঙ্গত’ উল্লেখ করা যায় যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে যাঁরা বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছিলেন, ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্র“য়ারির বিয়োগাস্ত ঘটনার পর তাঁদের অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন। জনাব শামসুল হককে দেখেছি, প্রায় উন্মাদের মতো ছুটাছুটি করে ছাত্রদের সহযোগিতায় আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে শামসুল হকের এ ভূমিকা চির ভাশ্বর হয়ে থাকবে। সেই মর্মান্তিক ও বিয়োগান্ত ঘটনার দিন বিকেল প্রায় পাঁচটা পর্যন্টত আমরা জনাব শামসুল হকের সাথে ছিলাম্ পরিস্থিতির মারাতœক অবনতি দেখে আমরা চলে যেতে চাইলে তিনি বাধা দেননি। তাঁকে মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রেখে আমরা কয়েকজন চলে যাই।১৪
সেদিনের সে মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে জনাব অলি আহাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন; গুলির কিছুক্ষণ পর আনুমানিক অপরাহ্ন চার ঘটিকার দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক খবর পাঠালেন। আমি সেই শোকাভিভুত মুহুর্তে মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল থেকে হাসপাতালে ইমার্জেন্সি গেইটের সম্মুখের চত্ত্বরে তাঁর (শামসুল হক) সাথে সাক্ষাৎ করি। সদ্য সংঘটিত মর্মান্তিক ও নৃশংস হত্যাকান্ডে আমরা উভয়েই মর্মাহত। হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি আমাদের উভয়ের বাকশক্তি হরণ করে নিয়েছিল। প্রকৃতিস্থ হবার পর অত্যন্ত ধীরে ও শান্ত কন্ঠে উদ্ভুত পরিস্থিতি মূল্যায়নে নিবিষ্ট হলাম। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতেই ভাষা আন্দোলনে জনাব শামসুল হকের অবদান াম্লান করে রেখেছে।১৫
২২শে ফেব্র“য়ারিও পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালায়। এতে বেশ কয়েকজন হতাহত হন। তাতে পরিস্থিতি শান্ত না হয়ে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। আন্দোলনের ঢেউ ঢাকার পাশ্ববর্তী গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। ২২ ও ২৩শে ফেব্র“য়ারি তারিখে গ্রামের লোকেরাও বহুসংখ্যায় মিছিল নিয়ে ঢাকা এসেছিলেন। এ সময়ে পুলিশ হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। এ বিষয়ে মহম্মদ তোয়াহা বলেনঃ বাইশ-তেইশ দুইদিন গ্রামের লোকেরাও মিছিল করে এসেছে। বাইশে-তেইশের ব্যাপক সধংং ঁঢ়ংঁৎমব- এর পর পুলিশ হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমরা এই সময় রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াই। কেউ ধরে না। মেডিক্যাল কলেজ গেটের সামনে একজন বড় পুলিশ অফিসার শামসুল হককে বলেছিলেন, আমরা কি বলবো। আপনারাই তো ক্ষমতায় এসে গেলেন।’১৬
কিন্তু দুঃকজনক হরেও সত্য, এই গণ-জাগরণ ধরে রেখে বৃহত্তর কোন আন্দোলন গড়ে তোলার মত সাংগঠনিক শক্তি তখন ছিল না।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, এরপর পার্টি থেকে রহংঃৎঁপঃরড়হ এলো ষ্ট্রাইক রহফবভরহরঃব ঢ়বৎরড়ফ- এর জন্যে চালানো যায় না। দেশ তৈরী নয়। কাজেই গুটানোর দরকার।১৭
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে- এরকম একটা অবস্থা যে হতে পারে বা হবে, সে ব্যাপারে শামসুল হকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আগেই বলেছিলেন।
মৌলভী মহি উদ্দীনের বাড়ীতে শামছুল হকের শেষ প্রয়াণ
খন্দকার আনোয়ার হোসেন
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের দূর্দমনীয় যোদ্ধা মৌলভী মহীউদ্দিন আনসারী জন্ম টাঙ্গাইল জেলার জোকার চরে। তিনি অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের একজন অকুতোভয় নেতা হিসেবে বৃটিশ রাজের ভিত কাঁপিয়ে তুলেন। তাঁর সাহস, সাংগঠনিক ক্ষমতা নেতৃত্বের প্রজ্ঞা সে সময়কার টাঙ্গাইল তথা পূর্ব বঙ্গে তাঁকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তোলে। একজন সুবক্তা হিসেবেও তিনি সবার নজর কাড়েন। ১৯৩০ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মহাত্মা গান্ধী তদানীন্তন ভারত সরকার প্রবর্তিত আবগারী আইন ভংগ করার ঘোষণা দেন। সেই আন্দোলনকে বেগবান করে তোলার জন্য হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গই একমত পোষন করেন। এ উপলক্ষ্যে প্রায়ই মতবিনিময় সভা হতো। এই সভায় মৌলভী মহি উদ্দিন আনসারী নিয়মিত উপস্থিত থেকে অপূর্ব বান্মিতার মাধ্যমে কর্মী এবং নেতৃবর্গকে অনুপ্রাণিত করে তুলতেন। সঙ্গেী হিসাবে পেয়েছিলেন জাতয়িতাবাদী চিন্তাধারার আর এক সাহসী যোদ্ধা টাঙ্গাইলেরই কৃতী সন্তান আবু খাঁকে। আনসারী সাহেব একজন সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাংলার আনাচে কানাচে বৃটিশদের বিরুদ্ধে বক্তৃতাদিয়ে বেড়াতেন। তাঁর অনলবর্ষী বক্তৃতায় বৃটিশ সরকারকে ভীত ও অসহিষ্ণ করে তোলে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আনসারী সাহেবকে ইংরেজ সরকার কারাগারে পাঠান। কিন্তু জেল জুলুম নির্যাতন তাঁে কখনও লক্ষ্য চ্যুত করতে পারে নি। তাঁর দৃঢ় আস্থা ছিল বৃটিশ বেনিয়ারা একদিন এদেশ ছাড়তে বাধ্য হবে। সে স্বপ্ন সার্ভক হয়েছে।
আজ মহি উদ্দিন আনসারী আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর কালজয়ী আদর্শ স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালী জাতিকে চিরদিন অনুপ্রেরণা যোগাবে। মৌলবী মহিউদ্দিন আনসারী আরও একটি কারনে আমাদের কাছে স্মরনীয় হয়ে আছেন। তা হলো বঙ্গরতœ শামছুল হক জোকার চর তার বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাসত্যাগ এবং তারই ইমামতিতে সমাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি ছিলেন শামছুল হকের প্রিয় বন্ধু। উভয়য়ে একই জেলার লোক এবং উভয় ছিলেন আবাল্য। শামছু হক ছিলেন আওয়ালীগের প্রতিষ্ঠাতা বক্তা সাবেক সম্পাদক মৌলবী মহি উদ্দিন ছিলেন গান্ধী পন্থী কংগ্রেসের প্রখ্যাত নেতা। দলগত উভয়ে ভাবে উভয়ে উত্তরমেরু ও দক্ষিণ অর্থাৎ বিপরীত। রাজনৈতিক আদর্শেল কোন মিল নেই। কিন্তু এক জাযগায় দারুন মিল দেখা যায় তা হল উভয়ে একই জেলা টাঙ্গাইলের লোক এবং রাজনীতির উর্দ্ধে একে অপরের বাড়িতে সময় পেলেই যেতেন। সুতরাং শামছুল মস্তিস্ক বিকৃতির পরও অন্ততঃ বন্ধু মহি উদ্দিনের বাড়ি.............. ভুলেন। এই যোগ সূত্রের আরও একটি কারণ ছিল উভয়ের বাড়ি ধলেশ্বরীরর পড়ে। যদিও এক জনের বাড়ি নাগরপুর থানায় আরেক জনের বাড়ি কালিহাতি থানায়। শামছুল হকের চিকিৎসা * যখন ইতিহল তখন মেডিকেল বোর্য সাজেশন দিল ........ জীবন নদীতে জন্ম হওয়ায় বাস করতেন। তিনি যমুনা নদী হতে ধলেশ্বরীরর উপ.........হয়ে ভাটির দিকে তার নিজ বাড়ি দিকে যেতেন তখন মৌলবী মহিউদ্দিন সাবের বাড়িতে উঠতেন। এজন্যও উভয়ের একত্র অবস্থান দেখা যায় শামছুল হক তাঁর বাড়িয়ে এলে তাঁর পারিবারিক ক্ষৌরকার বিশোরী মোহনশীলকে দাড়ি মোচ মাথার চুল এবং কাপড় চোপড় পরিস্কার করে দেওয়াতেন। এটা ছিল বন্ধুর প্রতি বন্ধুর দায়িত্ব। শামসুল হকের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের ৭দিন পূর্বে মৌলবী সহি উদ্দিন কংগ্রেসের জনসভা শেষ করে জোকার চর ইস্টিসার মার্টে নেমে পটল বাজার হয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন। বাজারের এ জায়গায় বহু লোকের ভিড়। জেলেরা বলতে ছিল এ পাগলকে তারা অচেতন অবস্থায় ধলেশ্বরীর পাড় থেকে উদ্ধার করে এখানে এনেছে। আরও বলতেছিল এই পাগলা যে কোন উজান ভাটি নৌকা দেখলে বলতো এই মাঝি আমি শামসুল হক বলছি। নৌকা ভিড়ার এই কথা শোনা মাত্র মৌলবী মহিরউদ্দিন উপস্থিত জনতাকে বললেন এ মস্ত বড় নেতা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি, আমার বন্ধু তোমরা শিঘ্র একে আমার বাড়ি পৌছে দাও। ডাক্তার শুকলালকে এখনই ডেকে পাঠাও। আহ-হা-আল্লাহ কী লীলা কী লোক কী। আর কিশোরীকে পাঠিয়ে দাও। চুল দাড়ি কামাতে হবে। চল চল নিয়ে চল। আমার এ ছিল মৌলবী মহিউদ্দিনের বন্ধুর প্রতি বন্ধুত্বর কর্তব্য। কথায় অসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।
অ ভৎরবহফ হববফ রং ধ ভৎরবহফ হফঁফ.
আওয়ামী লীগের জন্ম কথা ও শামছুল হক
আবু আল সাঈদ
পটভূমি
আওযামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় ১৯৪৯Ñ এর ২৩ জুন। পাকিস্তান হাসেলের মাত্র ২১ মাসের মধ্যে মুসলিম লীগÑবিরোধী এ-রকম একটি সুগঠিত রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকা ঐ সময়ের রাজনৈতিক পট-পরিসরে অপ্রত্যাশিত কিছু ছিলো না। রাজনীতিতে পাকিস্তানের উভয় অংশ মুসলিম লীগ একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী হলেও একি দলের সরকার আদৌ একটি অভিজ্ঞ সরকার ছিলো না। অন্যদিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের অহমিকাও ছিলো তার প্রবল। মুসলিম লীগ তার অন্যায়Ñ অনাচার আর অনভিজ্ঞতা ও ব্যর্থতাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার সুযোগ নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু এর ভেতরেই মুসলিম লীগের একদল আত্মসচেতন, উদারপন্থী ও অসাম্প্রদায়িক তরুণ রাজনৈতিক কর্মী গড়ে উঠেছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেই এসেছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে এদের নেতৃত্বে ছিলেন উদীয়মান নেতা শামছুল হক। এঁরাই শুরু থেকে মুসলিম লীগের অনাচার ও ভব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেন। ১৯৪৭Ñ এর ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসনাতের বেচারাম দেউড়ির বাসায় যুব সম্মেলনে ‘পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয। সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন কফিলুদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। সম্মেলনে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি সভাপতি মনোনীত হন তসাদ্দুক আগমদ চৌধুরী। সেদিন মুসলিম লীগ এঁদের ‘ভারতের চর’ বলে অভিহিত করেছিলো। এরা পাকিস্তানের বিরুদ্দে ষড়যন্ত্র করছে বলেও সোর তুলেছিলো। তবে গণতান্ত্রিক যুবলীগ খুব বেশিদিন কাজ করতে পারি নি। গণআজাদী লীগও গঠিত হয়েছিলো এরকম ময়সীমার ভেতরেই। কমরুদ্দিন আগমদ গণআজচাদী লীগের আহ্বায়ক নিযুক্ত হয়েছিলেন। সংগঠনটি গঠিত হয়েছিলো একটা সুকঠিন প্রত্যাশা নিয়ে। লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়টি সামনে থাকলেও উদ্যোক্তারা ছিলেন উদার প্রকৃতির বামপন্থী। এছাড়া এসময়টায় কমিউনিস্ট পার্টিও পুর্ববঙ্গে কর্মরত ছিলো। কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছিলো ‘ছাত্র ফৈযারেশন’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই ছাত্র ফেযারেন সক্রিয় ছিলো। ১৯৪৮Ñ এর ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র- কর্মিসভায় পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলগি গঠিত হয়। এতে পূর্ববঙ্গ কমিটির আহ্ববায়ক হন নঈমুদ্দিন আহমদ এবং ঢাকা শহর কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন অলি আহাদ। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটি ছিলো নিুরূপঃ ১. নঈমুদ্দিন আহমদ, ২. আবদুর রহমান চৌধুরী (রবিশাল), ৩. শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর). ৪. অলি আহাদ (কুমিল্লা), ৫. আজিজ আহমদ (নেয়াখালী), ৬. আবদুল মতিন (পাবনা), ৭. দবিরুল ইসলা (দিনাজপুর), ৮. মফিজুর রহমান (রংপুর), ৯. শেখ আবদুল আজিজ (খুলনা), ১০. নওযাব আলী (ঢাকা), ১১. নূরুল কবির (ঢাকা নগর), ১২. আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া), ১৩. সৈয়দ নূরুল আলম ও ১৪. আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী।
পূর্ববঙ্গের সাথে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বস্তুত পূর্ববঙ্গের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ব, দুই অংশের মধ্যকার বৈষম্য এবং বঞ্চনা খুব অল্পদিনের ভেতরেই বাঙালির সচেতন অংশের চোখে প্রকট হয়ে উঠে। পূর্ববঙ্গের দারিদ্র্য মোচনের লক্ষ্যে গৃহীত কোনো পদক্ষেপই তখন কার্যকর ব্যবস্থা হড়ে তুলতে পারছিলো না। এছাড়া পাকিস্তানের প্রতিবিদ্বেষের তাৎক্ষণিক কারণ ছিলো ভাষা সংক্রান্ত সমস্যা। মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই হায়দারাবাদ অধিবেশনে ঘোষণা করেছিলো, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। বস্তুত এই ঘোষণার ভেতর দিয়ে আশা করা হয়েছিলো যে, পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানেরা সর্বতোভাবেই পাকিস্তানি বনে যাবে। এভাবেই বাঙালি জাতীয়তা এই জনপদ থেকে ধুয়ে-মুছে যাবে। আর এই প্রকট প্রশ্নেই পড়ে ওঠে প্রবল প্রতিরোধ। সেই প্রতিরোধের পথ ধরেই শুরু হয় ক্রমে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। এ আন্দোলনের পুরো ভাষা ছিলেন বিপ্লবী নেতা শামছুল হক।
এর মধ্যেই, অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের মে মাসের শুরু থেকেই মুসলি লীগের তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের একটা সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছিলো। ১৫০ মোগলটুলি শুধু এই সম্মেলনের প্রস্তুতি দফতরই নয়, ছিলো আবুল হাশিমপন্থী তরুণ ুসলিম লীগ কর্মীদের জন্মের আগেই। টাঙ্গাইলের শামসুল হক ছিলেন এর সার্বক্ষণিক কর্মী। তাঁকে ঘিরেই গড়ে উছেঠিলো ১৫০ মোগলটুলির যাবতীয় কর্মতৎপরতা। ১৯৪৪ সালের ৯ এপ্রিল এই দফতরটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
পূর্ববঙ্গকে ঘিরে একটা বড় ধরনের এই কর্মী সম্মেলনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এর অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক ইয়ার মোহাম্মদ। রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর পেছনে যেমন কিছু-না-কিছু ধারাবাহিকতা থাকে, তেমনি এই কর্মী সম্মেলনের প্রস্তুতিও আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিলো না। সেই ধারাবাহিকতার ইতিহাসটুকু এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে সংক্ষিপ্ত আকারে।
১৫০ মোগলটুলিতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কশপ ক্যাম্পটি ঘিরে মুসলিম লীগের তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে প্রতিবাদী চেতনা বিকাশ লাভ করেছিলো, রক্ষণশীল মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে সেটা ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছিলো। মাওলানা আকরম খাঁ তখন বঙ্গীয় মুসলিম লাগের সভাপতি। তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শে মুজিবুর রহমান, মোশতাক আহমদ, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুস সবুর খান, কামরুদ্দিন আহমেদ ও মিসেস সংগ্রহের জন্য রশিদ বই চাইলেন। কিন্তু রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থীদের প্রায় দুর্ভেদ্য দুর্গের ভেতরে তরুণদের প্রবেশির ভীতি থেকে তাঁদেরকে রসিদ বই দেয়া হলো না। এভাবেই দ্বদ্বের শুরু হলো। ফলে সম্মেলন আহ্বান করলেন তরুণ সম্প্রদায় নারায়ণগঞ্জের রহমত উল্লাহ ইনস্টিটিউটে। তবে মুসলি লীগ সরকার সভাস্থলে জারি করেন নিষেধাজ্ঞা। এই অবস্থায় খান সাহেব ওসমান আলী এম.এল.এ- কে সভাপতি করে অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হয়। পরিবর্তন করা হয় আগের সম্মেলন স্থান। এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় পাইকপাড়ায়। এতে সিদ্ধান্ত নেযা হয় যে, বড় এক প্রতিনিধিদল করাচি যাবেন এবং কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের সভাপতি খালেকুজ্জামানের কাছে এব্যাপারে অভিযোগ করা হবে। যথা সময়ে প্রতিনিধিরা করাচি উপস্থিত হয়ে অভিযোগ পেশ করলেন। কিন্তু ফল হলো উল্টো। খালেকুজ্জামান নাজিমুদ্দিন-আকরম খাঁ গংকেই জোর সমর্থন করলেন। ১৫০ মোগলটুলি পড়লো অথৈজলে। এই রকম ঘটনার মুখে মুসলিমলীগের অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ নিয়ে নানা চিন্তা-ভাবনা সংক্রমিত হয়েছিলো তরুণ রাজনীতিকদের মনে।
মুসলিম লীগের ধারণাই ছিলো না যেম পাকিস্তানের মাটিতে নতুন আর কোনো রাজনৈতিক দল গঠিত হতে পারে। নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি চৌধুরী খালেকুজ্জামান এরি মধ্যে এরকম একটা মন্তাব্য করে বসেন যে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কোনো রাকনৈতিক দল গঠিত হলেও তা জনগণের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হবে। জনগণতাদের ভারতীয় দালাল বরে ধিক্কার দিয়ে অচিরেই তাদের বর্জন করবে। চৌধুরী খালেকুজ্জামান মুসলিমলীগের সভাপতি পদে আসীন হয়ে পুর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ নিয়েই ভেবেছেন সবচেয়ে বেশি। গুরুত্বও দিয়েছেন সমভাবে। জনা যায়, তাঁর ইচ্ছা অনুসারেই ১৯৪৯ সালের ১৮ জুন পূর্ববাংলা মুসলিম লীগ ওয়ার্কি কমিটির সভা এবং কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪৯ সালের মে মাসের শুরু থেকেই পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব চলছিলো। এ-ছাড়াও অন্য আর বেশ কয়েকটা ধাক্কা গেছে প্রদেশের মুসলিম লীগ সরকারের ওপর দিয়ে। ঢাকা শহরে পানির অভাব। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যমূল্যের আকাশচম্বিতা। গ্রামে গ্রামে বিতর্কজনিত উত্তপ্ত সমস্যা। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের উর্দুভাষা শিখিয়ে পাক্কা মুসলমানে পরিণত করার ব্যাপারে চিফ মিনিস্টার নূরুল আমিন বারবার তাগাদার সম্মুখীন হচ্ছিলেন তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানিত মুরুব্বিদের কাছ থেকে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু পূর্ববঙ্গে যে-কোনোভাই হোক-না-কোনো, প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বরে দেয়া হয়েছে, পাকিস্তানের জাতির জনক জিন্নাহ’র শেষ ইচ্ছা বাস্তবায়িত করতেই হবে। খাজা নাজিমুদদ্নিও এ-বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী ছিলেন। স্মরণ করা যেতে পারে, হায়দারাবাদে অনুষ্টিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সর্বশেষ অধিবেশনে (১৯৪৭-এর ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান কায়েম হবার কয়েক মাস আগে) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো। প্রস্তাবটি এনেছিলেন চৌধুরী খালেকুজ্জামান। তিনিই এখন নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি। সুতরাং চিফ মিনিস্টার নূরুল আমিনের কাছে বিষয়টি সমস্যারই ছিলো। কেন্দ্রের শিক্ষামন্ত্রী ঢাকা জেলার ফজলুর রহমান বয়স্কদের উর্দু শিক্ষার জন্যে কয়েকটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন তখন পুর্ববঙ্গে। তিনিও তৎপর সমভাবে।
পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের কাউন্সিসল অধিবেশন শুরু হয় ১৯৪৯Ñএর ১৮ জুন। ঠিক এই সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ঘোষণা পত্র রচনায় ব্যস্ত তরুণ নেতা টাঙ্গাইলের শামসুল হক। ব্যাপারটির তদারক করছেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মুসলিম লীগের বিদ্রোহী তরুণ নেতাদের তৎপরতা সম্পর্কে চৌধুরী খালেকুজ্জামান বিশদ জানতেন। কিন্তু এ-ব্যাপারে তিনি খুব বেশি একটি গুরুত্ব দেন নি। পুর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের কতাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী দনে চৌধুরী খালেকুজ্জামান বললেন, ডব ধৎব হড়ঃ ড়ঁঃ ড়ভ ঃযব ড়িড়ফ ুবঃ. ঞযব গঁংষরস খবধমঁব যধফ ড়াবৎপধসব সধহু ড়নংঃধপষবং রহ ঃযব ঢ়ধংঃ ধহফ ড়িঁষফ ড়াবৎপড়সব ংরসরষধৎ ড়নংঃধপষবং ঃযধঃ ভধপবফ রঃ ঢ়ৎবংবহঃষু ড়ৎ রহ ভঁঃঁৎব ঢ়ৎড়ারফবফ রঃ ধিং পড়হফঁপঃবফ ড়হ ঃযব ৎরমযঃ ষরহবং. (ঞযব ঙনংবৎাবৎ, ঔঁহব ১৯,১৯৪৯). সমাপনী দিনের ভাষনে তিনি নবজাত পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য মুসলিম লীগের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বললেন, কিছু তথাকথিত নেতা রয়েছেন, যাঁরা ক্ষমতার লোভী। ক্ষমতা না পেয়ে তাঁরা গোপনে পাকিস্তানের বিরুদ্দে ষড়যন্ত্র করছেন। চৌধুরী খালেকুজ্জামান আরো বললেন, ঐ লোকগুলো পূর্ববঙ্গেই অবস্থান করছেন, শতাব্দীর দারিদ্র্য-অভিশপ্ত পূর্ববঙ্গের নাজুক অবস্থার ফায়দা নিতে চান তারা।
লক্ষ করা যেতে পারে, পুর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের অধিবেশন শেষ হবার পরপরই প্রায় অবলুপ্ত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ-এর সাংগঠনিক পরিষদের সভা ১৯৪৯-এর ২৭ জুন ২ নম্বর ফুলার রোডে অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম ছাত্রলীগের কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে চৌধুরী খালেকুজ্জামান মন্তব্য করে গিয়েছিলেন। ’৪৯Ñএর ২০ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠানের স্দিধান্ত নেয়া হয়েছিলো। এজন্য পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক সুলতান আগমদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। অন্যদিকে চকবাজার, বকশীবাজার, কাপ্তান বাজার, দক্ষিণ মৌশুণ্ডি, নারিন্দা ও সূত্রাপুর প্রভৃতি এলাকায় ৪৯Ñএর জুন মাসের ২০ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত মুসলিম লীগ ছোট ছোট জনসভার আয়োজন করে। এসব জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ‘ভারতীয় দালালদের’ তৎপরতা সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়, বৃহৎ বালা কায়েমের নামে একদল লোক পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। কমিউনিষ্টদেরতো আমরা চিনি। মুখোশ পরে থাকে, সুতরাং সাবধান!
চিফ মিনিস্টারের ধারণা ছিলো, গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও গণআজাদী লাগের মতোই আওয়ামী মুসলিম লীগও মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। ১৯৪৯থÑএর ২৪ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হবার পর ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রকাশ্য জনসভা করে ফেলার পরও চিফ মিনিষ্টার বলেছিলেন, ওটা ছ’মাসের দল। আশ্চর্যের ব্যাপার, আওয়ামী মুসলিম লীগ সক্রিয় হয়ে ওঠার পর ১৯৪৯Ñ এর ৩০ জুন করাচিতে চৌধুরী খালেকুজ্জামান সাংবাদিকদের বললেন যে, ‘এ.কে ফজলুল হক এবং শামসুদ্দিনের মতো কিছু ব্যক্তি পাল্টা মুসলিম লীগ গঠনের এক গভীর ষড়যন্ত্রে মেতেছে।’ এÑসম্পর্কে ‘দি অবজারভার’Ñ এর ১৯৪৯ সালে ১ জুলাই সংখ্যায় যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিলো, তার একটা অংশে বলা হলো: “চবৎংড়হং ষরশব গৎ. ঋধুষঁষ ঐঁয় ধহফ গৎ. ঝযধসংঁফফরহ পড়হংঢ়রৎবফ ঃড় ংঃধৎঃ ধ ঢ়ধৎধষষবষ খবধমঁব ড়ৎমধহরংধঃরড়হ রিঃয ঢ়বৎযধঢ়ং ঃযব ঁষঃরসধঃব ড়নলবপঃরাব ড়ভ ফবংঃৎড়ুরহম ঃযব ষবধমঁব রফবড়ষড়মু যিরপয ধষড়হব ফবভধঃবফ ঃযব ধঃঃবসঢ়ঃং ড়ভ ংড়সব যরময ঢ়ষধপবফ গঁংষরস খবধমঁবৎং ভড়ৎ ঃযব পৎবধঃরড়হ ড়ভ ধ মৎবধঃবৎ ইবহমধষ যিরপয ধিং ধরসবফ ধঃ মরারহম ধ ফবপবহঃ নঁৎরধষ ঃড় ঃযব রফবধ ড়ভ চধশরংঃধহ, ংধরফ ঈযড়ফিযঁৎু কযধষবয়ুুঁধসধহ, চৎবংরফবহঃ ড়ভ ঃযব চধশরংঃধহ গঁংষরস খবধমঁব রহ ধ রহঃবৎারবি ঃড় ঃযব ঢ়ৎবংং যবৎব.”
এখানেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, চৌধুরী খালেকুজ্জামানসহ অন্য আর সবাই আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে উদাসীন। বরং তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন এ.কে.ফজলুল হক সম্পর্কে। তাঁর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন তাঁরা। এদিকে রোজগার্ডেনে জন্ম নিলো আওয়ামী মুসলিম লীগ অত্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে। এর জন্ম অনুষ্ঠানে শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক প্রথম সভায় একবার কেবল এসে উপস্থিত অন্য উৎসাহী কর্মীদের নিকট মুসলিম লীগের জন-বিরোধী কার্যক্রম ব্যাখ্যা করে দু’চার কথা বলে হেঁটে কাছেই তাঁর কে.এম.দা লেনের বাসভবনে ফিরে গিয়েছিলেন।
আওয়ামী মুসলিম লীগের গঠনের পেছনে কেবল একদল তরুণ কর্মীর সাথে এর কর্মকর্তাদের আদর্শগত এবং ব্যক্তিগত দ্বান্দ্বই নয়, বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ও ভাষা সংরক্ষণ করা এবং এর প্রতি প্রদর্শিত অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্জনার বিরুদ্ধে বাঙালিদের একটি জোরালো প্রতিরোধ প্রচেষ্টাও কাজ করেছিলো। প্রথম দিকে বঙ্গীয় প্রদেশ ও আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগ শাখা একত্র করে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। এতে আসাম মুসলিম লীগ প্রাতেশিক শাখার সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলী এবং সদস্য দেওয়ান বাসেত ও দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগ প্রাদেশিক ওয়াকিং কমিটির সদস্য হন। কিছুদিনের মধ্যেই এই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। মাহমুদ আলী এ-বিষয়ে মন্তব্য করেন যে, ‘আকরম খাঁ পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগের সবচেয়ে একরোখা একনায়ক ছিলেন। তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে, মওলানা আবদুল হামিদসহ আমরা হাশিম-সোহরাওয়ার্দীরই লোক।’ এই কমিটি ভেঙে দিয়ে মাওলানা আকরম খাঁ নিজে চেয়ারম্যান হয়ে ইউসুফ আলী চৌধুরী ও আসদুল্লাহকে যুগ্ম আহবায়ক করে ডাক্তার আবদুল মোতালিব মালিক, আহমদ হোসেন, নূরুল আমিন, আবদুল্লাহ হেল বাকি, হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও মনোয়ার আলীকে সদস্য করে পূর্ণ পাকিস্তান মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি নতুন করে গঠন করলেন। বস্তুত এ-ভাবেই আমরা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রধান সংগঠকদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে পাই।
মওলানা ভাসানীও ১৫০ মোগলটুলির মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন। ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের অন্যতম সংগঠন যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন শামসুল হক, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুস সবুর খান, আতাউর রহমান খান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান, কমরুদ্দিন আহমদ, মিসেস আনোয়ারা খাতুন ও নঈমুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।
১৫০ মোগলটুলি থেকে রোজ গার্ডেন
মুসলিম লীগের পাল্টা একটি রাজনৈতিক দল গঠন উপলক্ষে সরকারি হল বা স্থান পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার ছিলো। একারণে উে তার বাসভবন অথবা নিজস্ব স্থান ছেড়ে দেবেন, সেটা চিন্তা করাও ছিলো দুরাশা মাত্র। এই রকম অবস্থায় তখন কে.এম. দাশ লেনের বিখ্যাত রোজ গার্ডেনের হল ঘরটির মালিক কে.এম. বশির তা নিঃসষ্কোচে ছেড়ে দিলেন। ১৯৪৯Ñএর ২৩ জুন রোজ গার্ডেনের হল রুমে সম্মেলন শুরু হলো। ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এমন জীবিত লোকের সংখ্যা এমন একান্তই বিরল। তাঁদের লিখিত কোনো ভাষ্য অথবা কোথাও প্রকাশিত তাঁদের সাক্ষৎকার থেকে ওই সম্মেলনে কতোজন উপস্থিত ছিলেন, তার সঠিক সাক্ষ্য মেলে না। তবে আজ ৪৫ বছর (১৯৯৩) পর উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের যেসব বক্তব্য পাওয়া গেছে, তা পরস্পরÑবিরোধী বলেই মনে হয়। ‘দৈনিক আজাদ’ তখন ঢাকায় মাত্র এসেছে (অক্টোবর ১৯, ১৯২৮)। দু’তিন লাইনের একটি ছোট প্রতিবেদন করা হয়েছিলো এÑব্যাপারে সেখানে। এছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য থেকে ধারণা করা যায়, ৩০০ থেকে সাড়ে তিনশ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন তাতে। এতে সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। আবদুল হামিদ খান ভাসানী উদ্বোধনী ভাষণ পাঠ করেন। এ.কে. ফজলুল হক কখন পূর্ব বাংলা সরকারের অধীনে এডভোকেট জেনারেল পদে অধিস্ঠিত।
‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ দলের নামটি প্রায় আগে থেকেই স্থির করা ছিলো। প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদ বলেছেন, “ঢাকা হাইকোর্টে জনাব দবিরুল ইসলারে হেবিয়াস কর্ডাস মামলা পরিচালনার জন্য জনাব সোহরাওয়ার্দী যখন ঢাকায় আসিয়াছিলেনম তখনই তিনি উত্তরÑপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নেতা মানকী শরীফের পীর সাহেবের অনুকরণে সংগঠনের নাম ‘আওযামী মুসলিম লীগ’ রাখার পরামর্শ দিয়াছিলেন।” ঐ সময়ই নাকি দলটির শুধু আওযামী লীগ নামকরণেরও প্রস্তাব এসেছিলো। শেষ পর্যন্ত আওযামী মসলিম লীগ নামই চুড়ান্ত হয়।
খুবই সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটিতে কে কোন পদে ছিলেন, তা নিয়েও যথেষ্ট দ্বিমত আছে। সে সময়কার দলিলপত্রাদি আবদুল হামিদ খান ভাসানী অথবা শেখ মুজিবুর রহমান কারুর কাছেই ছিলো না। যদ্দুর জানা গেছে, ঐ সময়কার কাগজপত্র সব কিছুই ছিলো সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের কাছে। সেখানে সেই কমিটিরই বিবরণ উল্লেখ করা হলো, যেটা সবচেয়ে সঠিক মনে করা হয়েছে। অন্য কমিটিগুলোর বিবরণও পরপর উল্লেখ করা হচ্ছেঃ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান, সহ-সভাপতি যথাক্রমে আতাউর রহমান খান এডভোকেট, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহম্মদ এমএলএ, আলী আমজাদ খান এডভোকেট, আবদুস সালাম খান এডভোকেট, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, সহ-সম্পাদক খন্দকার মোশতাক আহমদ, এ.কে.এম. রফিকুল হোসেন, কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান।
একটি বিস্ময়করঃ প্রতিভা শামসুল হক
বদি-উজ-জামান
অনলবর্ষী শামসুল হক এ দেশের রাজনৈতিক আকাশে এসেছিলেন ধূমকেতুৃর মত। নিঃসীম নীলিমার দূর দিগন্ত থেকে ধূমকেতু হঠাৎ পৃথিবীর আকাশে দেখা দেয়, আবার হঠাৎ করে হারিয়ে যায় চিরদিনের মত, তাকে আর দেখা যায় না। শামসুল হক চল্লিশের দশকে এবং পঞ্চাশের দশকের প্রথম পাদ পর্যন্ত এ অঞ্চলের রাজনৈতিক আকাশকে আলোকজ্জ্বল করে রেখেছিলেন। তাঁর প্রতিভার দ্যুতিতে সবার চোখ ঝলসে উঠেছিল। তাঁকে আরও ভালভাবে বুঝতে বা জানার আগেই তিনি হারিয়ে গেলেন।
শামসুল হকের চিন্তাধারা এবং তাঁর কার্যক্রম সবই ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। তাঁর প্রতিটি কথায় ছিল যুক্তির প্রচন্ড ধার; তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা কার্যে পরিণত করতে কোনরূপ আপোষের আশ্রয় নিতেন না। তার পথ ছিল ঋজু। এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকে এসেছেন এবং গিয়েছেন, আরও আসবেন এবং যাবেন। কিন্তু শামসুল হকের বিকল্প এ পর্যন্ত দেখা যায় নি, ভবিষ্যতে দেখা যাবে কিনা তা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারে।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট বিশাল ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যায়। কি পরিস্থিতিতে এ দেশ ভাগের প্রয়োজন হয়, তা ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন। মুসলিম লীগের আহ্বানে এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তান কায়েমের জন্য ভারতের সকল এলাকায় মুসলমানদের মধ্যে জাগরণের সৃষ্টি হয়। ছাত্রনেতা শামসুল হক বাংলার সর্বত্র আজাদীর আহ্বান ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ঝটিকার মত ছুটতে থাকেন। এই সময়ই শামসুল হক শানুষকে চিনতে শুরু করেন। মানুষের দুঃখ দুর্দশা তাকে ব্যথিত করে। পুরাতন মোগলটুলিতে বাড়ি ভাড়া করে পুরোপুরিভাবে রাজনীতিতে নামেন। তাজউদ্দিন আহমদ, হজরত আলী শিকদার এবং আরও অনেকে শামসুল হকের সহকর্মী হিসেবে কাজ করেন।
এদেশের আজাদী আন্দোলনে শামসুল হক যেমন করে সকল আরাম আয়াস ত্যাগ করে কাজ করেছেন ঠিক তেমনিভাবে তাকে দেখেছি পাকিস্তানে বিরোধী দল গড়ার ব্যাপারে কাজ করতে। স্বাধীনতার পর মুসলীম লীগের সদস্য তালিকা নিয়েও চলল অনেক ঘৃণ্য কারচুপি। যারা মুসলিম লীগের পতাকা সমুন্নত করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে ছিলেন তাদের সবাইকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। নতুন দেশকে গড়ে তুলতে সকলের অংশগ্রহণে বাধা দেয়া হয়। পাকিস্তানের মালিক-মোখতার হয়ে পড়েন মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন চক্র। মানুষের মনে ধুমায়িত হয়ে ওঠে বিক্ষোভ। এই সময় পূর্ব পাকিস্তানে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুর হামিদ খান ভাসানী গড়ে তুলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। আওয়াম অর্থ জনগণ; জনগণের মুসলিম লীগ। কিছু দিন পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচীতে গঠন করেন জিন্নাহ মুসলিম লীগ। অর্থাৎ জিন্নাহ সাহেব যে মুসলিম লীগ গড়েছিলেন সেই মুসলিম লীগ আর নেই। যে মুসলিম লীগ পাকিন্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই মুসলিম লীগ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে তার পরিবর্তেই জিন্নাহ মুসলিম লীগ।
পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী-মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে ১৮ কারকুন বাড়ী লেনে ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়ীতে সর্বদলীয় কর্শী শিবির অনুষ্ঠিত হয়। কর্মী শিবিরেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি পাল্টা রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার। বজ্রকন্ঠ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানাকে সভাপতি এবং অনলবর্ষী বক্ত শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১৯৪৯ সালর কথা। এই সময় প্রাদেশিক পরিষদে টাঙ্গাইলের একটি আসন শূন্য হয়। দীর্ঘদিন যাবত এই পদটি খালি থাকে। বিরোধী মহল থেকে বার বার দাবী ওঠেÑ উপনির্বাচন দিতে হবে। ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ সরকার অবশেষে উপনির্বাচন দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। মুসলীম লীগ করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীকে মনোয়ন দান করেন। এই আসনে জয়লাভের জন্য তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনসহ মন্ত্রী সভার সকল সদস্য টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন কেন্দ্রের সকল এলাকা চষে বেড়ান। সরকারী মাইক, গাড়ী, সরকারী লোক-জন সবাই মুসলীম লীগের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মন্ত্রীরা এলাকার উন্নয়নমূলক কাজকর্মে মুক্ত হস্তে দান করতে থাকেন। এ ছাড়া স্থানীয় নেতৃবৃন্দকেও নগদে উপঢৌকন দেয়া হয় মুসলীম লীগের পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য। বিরোধীদলের লোকজনের অভাব ছিল না, ছিলনা আন্তরিকতার অভাব। অর্থের অভাব ছিল প্রচন্ড। কিন্তু সাধারণ কর্মীদের উষ্ণস্পর্শে কোন অভাবই প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়ায়নি। এলাকায় পরিচিত মানুষ শামসুল হক, সকলের আপনজন শামসুল হক। বিভিন্ন এলাকায় গমন করলেন সাইকেলে চড়ে। সবার নিকট আবেদন জানান, তাঁকে ভোট দেয়ার জন্য। শামসুল হকের ঘনিষ্ট কর্মী টাঙ্গাইলের হজরত আলী মিকদার, বদিউজ্জামান খান, মতি উজ্জামান খান, আবু মোঃ হোসেন আবদুস সামাদ এবং আরো অনেককে সাইকেলযোগে টিনের হর্ন নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে দেখেছি ভোট ভিক্ষা করতে। জিল্লুর রহমানও সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করেন। টাঙ্গাইলের প্রধান সড়কে অবস্থিত নবকুমার সাহার দ্বিতল অট্টালিকা নির্বাচন অফিস-খোলা হয়। খুররম খান পন্নী ও শামসুল হক ছাড়া আরও অনেকে নির্বাচন প্রার্থী হলেন। গোটা পাকিস্তানের দৃষ্টি টাঙ্গাইলের প্রতি। এক দিকে প্রবল-প্রতাপশালী ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট জমিদার খুররম খান পন্নী, অপরদিকে অতি সাধারণ কর্মী শামসুল হক।
নির্বাচনের ফল গোটা পাকিস্তানকে বিস্মিত করে দিল। অসম্ভব সম্ভব হলো। ন্যায়ের সূর্যই (শামসুল হক) আকাশের উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে লাগল। শামসুর হকের এই বিজয়ে ক্ষমতাসীনদের মাথা হেট হয়ে গেল। কোন ক্রমেই তারা জনগণের ব্যালটের রায়কে মানতে পারলেন না। শামসুল হককে নামিয়ে দিতে উচ্চ পর্যায়ের ষড়যন্ত্র শুরু হল। নির্বাচনে অন্যতম স্বতন্ত্র প্রার্থী আমির আলী খান মোক্তার টেকনিক্যাল পয়েন্টে মামলা দায়ের করলেন। এ মামলায় নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়।
এখানে উল্লেক করা প্রয়োজন যে, নির্বাচনের সময় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বিশেষ জরুরী কাজে আসাম চলে যান।
নির্বাচনের পর শামসুল হক সেকান্দার আলীর কন্যা অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন। আফিয়া খাতুন চেয়েছিলেন স্বামী সন্তান নিয়ে সুখের নীড় রচনা করতে। আপন ভুবন রচনা করে আফিয়া খাতুন মগ্ন হতে চেয়েছিলেন- এ দেশের অন্য সকল মেয়ের যা আশা। শামসুল হক তো তা চান নি। রাজনীতি তাঁর রক্তে রক্তে মিশে গেছে। মানুষের দুঃখ দুর্দশা মোচনের জন্য তিনি নিজেকে সোপে দিয়েছেন। তিনি কি করে ছোট্ট পরিবারের ছোট, ঘরে আটকে থাকেন?
মাইঠান গ্রামের দবির উদ্দিন মিয়ার প্রথম সন্তান শামসুল হক ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট সময় থেকেই শামসুল হক অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ১৯৩৮ সালে সন্তোষের জাহ্নবী হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্টিক পাশ করেন। এরপর করটিয়া সা’দত কলেজ হতে প্রথম বিভাগে আই এ এবং ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসহ øাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এম এতে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক ডামাডোলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকোষ্ঠ তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। এখানেই তার ছাত্র জীবন শেষ হয়।
ছাত্র জীবন থেকেই শামসুল হক বক্তৃতায় অভ্যস্ত হন। তার বক্তৃতায় বিশেষ ভঙ্গিমা লক্ষ্যনীয় ছিল। তিনি ডান হাতটি উঁচু করে ধরে অনর্গল বলে যেতেন। মাথায় কোন কোন সময় টুপি থাকতো। হাতে যদি কখনো রুমাল থাকতো তা হলে তিনি তো অনবরত তুলতেন, আবার তা টেবিলে রাখতেন। হালকা লম্বা মুখের অধিকারী শামসুল হক ফর্সা ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে শামসুল হকের দুই কন্যা আছে।
শেষ জীবনে শামসুল হক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু কেন এই অবস্থা? মুসলীম লীগের জেলখানা পূর্ণ ছিল রাজবন্দী দিয়ে। শামসুল হককেও বার বার কারা প্রকোষ্ঠ অবস্থান করতে হয়েছে। জেলকানা থেকে বের হয়ে শামসুল হক বাসায় ফিরে এলেন। কোথায় আনন্দ, উল্লাস, আলিঙ্গন! না সেখানে বিরূপ ব্যবহার। স্ত্রীর ব্যবহারে শামসুল হক স্তম্ভিত হয়ে যান। এক পর্যায়ে শামসুল হক দোতলা থেকে লাফিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। এবারই দেশবরেণ্য নেতা শামসুল হকের একটি পা ভাঙ্গে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে দেখেছি একটি মোটা বড় খাতা আর চাঁদার বই নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে। প্রিয়তমার কাছ থেকে এরূপ ব্যবহার কোন দিনই শামসুল হক আশা করেননি। øেহের দু’টি কন্যাকেও বুকে আগলে ধরতে পারেনটি। পিতৃøেহে জ্বলে জ্বলে খাক হয়েচেন, কিন্তু তাঁকে দেখতেও দেয়া হয়নি। অসহ্য যন্ত্রণায় জ্বলেছেন।
জেলখানাগুলো রাজনৈতিক কর্মীদের মাথা ধোলাইর একটি উৎকৃষ্ট স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বৃটিশ আমল থেকেই এ ব্যবস্থা চালু হয়ে আসছে। উত্তরাধিকার সূত্রে মুসলীম লীগ বৃটিশদের কাছ থেকে কায়দাটি আয়ত্ব করে। জেলখানাতে শামসুল হকের উপর মানসিক এবং শারিরীক নির্যাতন ছাড়াও বিষাক্ত ঔষধ প্রয়োগ করা হয় বলেঐ সময় সর্বমহলে প্রচারিত হয়।
মওলানা ভাসানী ছিলেন আওয়ামী মুসলীম লীগের সভাপতি এবং শামসুল হক ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। এই সময় রাজনৈতিক গগনে আর এক জ্যোতিষ্কের আবির্ভাব ঘটে। অদ্ভুত সাংগঠনিক শক্তি এবং বক্তৃতার ফলে শেখ মুজিবুর রহমান সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন। কেউ কেউ বলেন, শেখ সাহেব শামসুল হকের প্রতিদ্বন্ধী হয়ে দাঁড়ান। এ জন্য শামসুল হককে প্রায়ই নাজেহাল হতে হয়।
পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে পাবনায় আওয়ামী মুসলীম লীগের এক জনসভায় শামসুল হক বক্তৃতা করছিলেন। তার সেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গির বক্তৃতা। মানুষ শুনছে; মন্ত্রমুগ্ধের মত, শুনছে মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক বিভিন্ন কার্যক্রমের কাহিনী। মঞ্চে উপবিষ্ট মুজিব ভাই (শেখ মুজিবুর রহমান) উঠে শামসুল হককে বক্তৃৃতা সংক্ষিপ্ত করার জন্য বার বার বলছেন। এইরূপ কয়েকবার বাধা প্রাপ্ত হওয়ার পর হক সাহেব তার বক্তৃতার যবনিকা টানলেন। সভা মঞ্চে এ নিয়ে কোন কথা হলো না। সভা শেষে সবার রওয়ানা হলেন জিলা আওয়ামী লীগ অফিসে। আমিও সাথে গেলাম। আমি তখন মরহুম এক এম আজিজুল হক সাহেবের সাপ্তাহিক “পাক হিতৈষী” পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। আওয়ামী লীগ অফিসে দেখলাম শামসুল হকের মূর্তি। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে সোজাসুজি আক্রমণ করলেনÑআমার বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগে আমাকে বসিয়ে দেয়ার উদ্দেম্য কি? আমার জনপ্রিয়তা দেখে তোমার ঈর্ষা হচ্ছে? তোমার সহ্য হচ্ছে না! শামসুল হককে নিবৃত্ত করার জন্য কেউ সাহসী হলেন না। সবাই চুপ, কেবল শামসুল হক বলে চলেছেন।
সে দিনের জনসভায় শামসুল হকের বক্তৃতায় তেমন কোন অসংলগ্নতা লক্ষ্য করা যায় নি। তবে খুব সতর্কতার সাথে তাঁর ভারসাম্য হারানোর কথা চিন্তা করে বক্তৃতা শুনলে একবার অসংলগ্নতার কথা মনে হবে।
মানসিক স্থৈর্য হারানোর কারণ ত্রিমুখী আক্রমণের ফল বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু এ নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কেউ কিছু বলতে পারেন না। শেষ জীবনে তিনি আল্লাহর পথে দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়ে ছিলেন। কেউ মনে করেন আধ্যাতিœক সাধনার ফলে শামসুল হক স্থির থাকতে পারেন নি। ঐশী জ্যোতি তাকে আলোড়িত করে দিয়েছে। তার লেখা বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম পুস্তকপাঠ করলে শামসুল হকের আধ্যাতিক চিন্তাধারা, মনমানসিকতা সম্পর্কে উপলদ্ধি করা যায়। ইদানীং অধ্যাপক আবদুল গফুরের সম্পাদনায় বইটি পুনঃ প্রকাশিত হয়েছে।
মৃত্যুর আগেই শামসুল হকের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল। ষাটের দশকের প্রথম কি দ্বিতীয় বছর। আমি তখন টাঙ্গাইলের এ.পি.পি. পাকিস্তান অবজার্বার ও দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদদাতা। শামসুল হকের নিকট সম্পর্কের এক ভাই আবদুর রশিদ আমাকে এস জানালেন, শামসুল হক সাহেব মারা গেছেন। খবর নিয়ে জানলাম শামসুল হকের কলেজ সা’দত কলেজ এ জন্য ছুটি দেয়া হয়েচে এবং শোকসভাও হয়েছে। আমার পাঠান সংবাদটি ইত্তেফাকে ছাপা হলো। তার শেষ জীবনের অবস্থা দেখে কেউ সংবাদটিকে মিথ্যা বলে ভাবত পারলেন না। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল শামসুল হকের মৃত্যু সংবাদটি মিথ্যা।
জীবনের অন্তিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে শামসুল হক প্রায় একাই গঠন করলেন খিলাফত পার্টি। আল্লাহর শাসন দুনিয়াতে কায়েম করাই ছিল তাঁর আশা। অর্থাভাবে জর্জরিত শামসুল হক মাথার টুপি পরে, একটা মোটা লম্বা খাতা আর খিলাফত পার্টির চাঁদার রসিদ নিয়ে গুলিস্তানের ফুটপাতে তাকে অনেক দিন দেখেছি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে আর পরিচিতজনদের নিকট চাঁদা বা ভিক্ষা সংগ্রহ করতে। কোন সময়ে তিনি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন পরিচিতজনের আশায়।
যে ধূমকেতুর আবির্ভাব বাংলা রাজনীতি আকাশ আশার আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল তাঁর শেষে জীবন ছিল বড়ই করুণ। লোকের উপহাস, ভিক্ষা, দয়ার উপর তাকে নির্ভর করতে হয়েছে। স্ত্রী,কন্যা, আতœীয়-স্বজন কেউ তাকে আশ্রয় দেন নি। বন্ধুবান্ধব এবং এক সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মীরা তার চিকিৎসার জন্য চেষ্টা করেছেন। জীবনমৃত্যু বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম শেষ জীবনে যা পেরেচেন শামসুল হক তার কিছুই পান নি। আজীবনই তিনি পেয়েছেন শুধু লাঞ্ছনা,অপমান।
শামসুল হকের অর্ন্তধান রহস্যজনক। কেউ তার সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারেন না। সবই অনুমান নির্ভর। এই মহান রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে এখনকার অনেকেই ভুলে গেছেন। কেউ তার সম্পর্কে জানেনও না। একটি প্রতিষ্ঠান তার জীবনী গ্রন্থ লেখার জন্য আমাকে অনুরোধ জানালে তথ্য সংগ্রহে বাধাপ্রাপ্ত হই। শুধু এ কারনেই আমার পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। এই মহান নেতাকে অনুসরণ করে উঠলেই নিজেদের ভাগ্য গড়েছেন। কিন্তু পিছনের পানে কেউ তাকান নি। তার স্মৃতি রক্ষার্থে কেউ এগিয়ে আসেন নি। বিরাট আলোড়ন তুলে যিনি এসেছিলেন তিনি হঠাৎ করে সকলের অলক্ষ্যে এমনভাবে হারিয়ে যাবেন তা কেউ ভাবেন নি।
টাংগাইলের অগ্নিপুরুষ শামসুল হক
মোঃ হজরত আলী সিকদার
শামসুল হক ১৯২০ সালে নাগরপুর পুরের মাইঠান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম দবির উদ্দিন মিয়া। তিনি তাঁর পিতা-মাতার প্রথম সন্তান। শামসুল হক ছেলেবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি কৃতিত্বের সাথে ১৯৩৮ সালে সন্তোষ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর করটিযার সা’দত কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই, এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৪৫ সালে বি,এ (অনার্স) পাস করেন। এম,এে ভর্তি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পরার ফলে আর পড়াশোনা করতে পারেননি।
চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি ভারতের রাজনৈতিক গগনে শামসুল হক একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে আবির্ভূত হন। মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুপ্রেরণায় এবং আবুল হাশিমের সহকর্মী হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন আরম্ভ হয়। তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক তৎপরতায় ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে সাড়া জাগিয়েছিলো।
এই সময় মরহুম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আসামে প্রজা আন্দোলন শুরু হয়।
শামসুল হক ‘৪৫ সালে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সংগঠনের জন্য ১৯৯, পুরানা মোগলটুলীতে একটি তিন তলা বাড়ি ভাড়া করে একজন সার্বজনীন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তাঁর কাজ শুরু করেন। এই সময় কয়েকজন কলেজ সহপাঠি তাঁর সংগে যুক্ত হয়, তাদের মধ্যে মরহুম তাজউদ্দিন ও আমি ছাড়া আরো কয়েকজনই ছিলেন। সমসাময়িককালে ঢাকার নওয়াব সাহেবদের সাথে মুসলিম লীগ নেতাদের কলহের উৎ-পত্তি হয়, যার পরিণামে মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিমের নেতৃত্বে ‘মুসলিম লীগ’ জনসাধারণের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যার ওপর ভিত্তি করে ভারতে মুসলিমানের নিজস্ব আবাসভূি হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওযার পর নেতারা পরস্পর আত্মকলহে মেতে ওঠেন। এতে সমাজের উচ্চ শ্রেণী থেকে যারা রাজনীতির ময়দানে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাদের মুখোশ জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়ে যায়। তারা সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রশ্নে ভিন্নমত পোষণ করেন এবং এই শ্রেণীর জনদরদী নেতাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। শামসুল হক এই সময় আসাম থেকে মওলানা ভাসানেিক বাংলাদেে নিয়ে আসেন। ভাসানী কাগমাররি সন্তোষে বসতি স্থাপন করেন। তখন থেকে হকের রাজনৈতিক সামাজিক জীবন শুরু হয় ভাসানীর ছায়াতলে। ভাসানী কিছু দিনের জন্য আসামের এক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং কাড়াবাসী হন। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি পুনরায় এখানকার রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক বৎসরের মধ্যেই মুসলিম লীগ জনসাধারণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই সময় শামসুল হকের সামাজিক কার্যকলাপের সাথে আমি সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে সংযুক্ত হই।
১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের একটি শূন্য আসনে উপ-নির্বাচনের জন্য করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নেিক মনোনয়ন দান করেন। সরকার তাকে সব রকম সাহায্য সহােগিতার জন্য এগিয়ে আসেন। হক এই আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। মওলানা ভাসানী এই সময়ে আসম যান, যাওয়ার আগে নির্বাচনের যাবতীয় ভার আমার ওপর ন্যস্ত করে যান। এর পরে শামসুল হক নির্বাচনে জয় লাভ করেন।
পন্নী সাহেব নির্বাচনে হেরে যাবার পর, প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নানারকম পন্থা অবলম্বন করেন। উক্ত নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে রাজী করান। আমি তখন করাচী চলে যাই সেখানে থেকে বি,এ,এল,এল,বি পাশ করে ওকালতি ব্যবসা শুরু করি। ইতিমধ্যে শামসুল হক নির্বাচনী মামলায় হেরে গেছেন। এই সময় টাঙ্গাইলের যে সমস্ত নেতাদের ওপর ভার ছিলো। হককে সাহায্য করার জন্য, তারা সবাই পন্নী সাহেবের সমর্থক হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে রয়েছেনÑ ডাঃ আলীম আল রাজী, আবদুল রহমান প্রমুখ। নির্বাচনে জয়লাভ করার পর শামসুল হক নানা কাকে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি ঢাকার সেকান্দার আলীর মেয়ে আফিয়া খাতুন (এম,এ) কে বিয়ে করেন। তারপর সপরিবারে করাচীতে ভ্রমণ করতে যান। তখন আমার ওখানে ওঠেছিলেন। ফেরার পথে নতুন করে রাজনৈতিক জীবন শুরু করার অভিপ্রায়ে মরহুম সোরোযাদীর আর্শিবাদ প্রাপ্ত হন। দেমে ফিরে আসার আগেই আকস্মিক বিপর্যয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। এই সময় তাঁর স্ত্রী দু’টি সন্তানসহ তার সঙ্গে সাময়িক ভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এতে হক মানসিক ভারস্যা হারিয়ে ফেলেন। পুরোপুরি বিচ্ছেদ হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তার স্ত্রী তাঁকে লাহোর হসপিটাল-এ ভর্তি করে আসেন। আমি তখন করাচী থেকে তাকে দেখতে যাই।
১৯৬০ সালে পারিবারিক বিপর্যয় এবং রাজনৈতিক সহকর্মীদের দুর্ব্যবহারে তিনি পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯৬২ সালে তাঁর একজন শুভাকাঙ্খী সহৃদয় তাজউদ্দিন সাহেব এক হোমিওপ্যাথিক যাক্তারের সাথে চুক্তি করে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শামসুল হক কোনো রকম ওষধ গ্রহণে বিরত থাকেন। তখন তাঁর ধারণা ছিলো অনেকটা িে রকম, ‘সবাই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের লিপ্ত, তিনি নিজে সব কিছুর ঊর্ধে এবং সব অন্যায়ভাবে চলছে। অবশ্য এই সময়ে তিনি কিছু সঠিক রাজনৈতিক বক্তব্যও রেখেছিলেন। তার মতে, ‘আইয়ুব খানের নির্বাচন অযৌক্তিক এবং শাসনতন্ত্র বাতিল করা উচিৎ’। তারপর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
রাজনৈতিক জীবনে মরহুম মওলানা ভাসানীর প্রভাব ছিলো অপরিসীম। তাঁর রাজনীতি ছিলো মূলত ঃ সাধারণ মানুষের জন্য। সাধারণ মানুষের মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের নিশ্চি করণই ছিলো তাঁর জীবনের ব্রত। কিন্তু পারিপাশ্বিকতার চাপে পড়ে, উপযুক্ত সহকর্মী না পেয়ে তার বাস্তবে রুপায়িত হ’তে পারেনি। কিন্তু তাঁকে নিয়ে নেতাদের যে উচ্চাশা ছিলো সোহরাওয়াদীর এই উক্তিটিতে তা স্পষ্ট। উপ-নির্বাচনে তার জয়লাভের সংবাদ শুনে তিনি একজনকে লিখেছিলেনÑ ঞযব ারপঃড়ৎু ড়ভ গৎ. ঝযধসংঁষ ঐধয়ঁব রহ ঃযব নু-বষবপঃরড়হ ড়ভ ঞধহমধরষ রং মৎবধঃ ভবধঃযবৎ ঃড় ড়ঁৎ ঢ়ড়ষরঃরপধষ মধঢ় ধহফ ুড়ঁ পধহ ৎধঃযবৎ বি পধহ াবৎু বিষষ ংঃধৎঃ ভৎড়স যবৎব.”
সমসাময়িক ‘লণ্ডন ডেইলী’র ভাষ্য ঃ “ওঃ রং হড়ঃ ড়হষু ধ ারপঃড়ৎু ড়ভ গৎ. ঝযধসংঁষ ঐধয়ঁব, নঁঃ রঃ রং ধ ভবধঃযবৎ ঃবহরহম ঃড় ঃযব ৎব-ধপঃরড়হধৎু মড়াবৎহসবহঃং ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ ড়াবৎ.”
শামসুল হকের দুই কন্যা ছিলো, কিন্তু তাদের খবর একমাত্র তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীই বলতে পারবেন, আর কেউ জানেন না। তাঁর সম্পর্কে দুএকটি জনশ্র“তি শোনা যায়। তিনি ঢাকার অদুরে কোন এক নদীতে নৌকা ভাড়া করে াকতেন। র্অ সংগ্রহ করতে মাঝে মধ্যে শহরে তার বন্ধু বান্ধবদের কাছে আসতেন। এক সময় তার অসুখ হয় এবং তাতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নৌকার মাঝিরা ভয় পেয়ে তাঁর লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। আকেটি কথা শোনা যায়, তিনি নাকি পীর ফকিরের মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ান। কারো কারো সঙ্গে নাকী দেখাও হয়েছে। আমি করাচী থেকে এসে তাঁর সম্বন্ধে এই সব তথ্য পেয়ে বাংলাদেশের অনেক মাজার মাজারে ঘুরেও তাঁর কোনো সন্ধ্যান জানতে পারিনি।
টাংগাইলে তাঁর স্মৃতিকে অম্লান রাখার জন্যে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো। তাঁর নামে টাংগাইলের এলেঙ্গাতে একটি কলেজ স্থাপন এবং টাঙ্গাইল জেলা সদরের তোরণটি তাঁরই নামে হয়েছে।
শামসুল হক টাঙ্গাইলের একজন অগ্নিপুরুষ। সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘তিনি একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে আবার চিরতরে হারিয়ে গেলেন। তাঁর মৃতু নেই। তিনি আমাদের এবং ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য গর্বের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে চিরদিন অম্লান ভাস্বর হয়ে থাকবেন।
আওয়ামী লীগের হারিয়ে যাওয়া নেতাঃ শামসুল হক
Ñমাহমুদ হাসান
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৪৯ সালের জুনে জন্ম হয় আওযামী লীগের (তখন নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ) এবং শামসুল হক হন দলের প্রথম জেনারেল সেক্রেটার।ি দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে ঢাকঢোল পিটিয়ে সাড়ম্বরে পার্টির অর্ধশতক উদযাপনের কোথাও আমি শামসুল হকের নাম শুনিনি বা দেখিনি। পার্টিতে কিছু লোক নিশ্চয় আছেন যারা তাকে চিনতেন বা তার কথা শুনেছেন। তবে এই নীরবতা কেন ? প্রয়াত নেতা কি বর্তানের আওয়ামী লীগ নেতাদের (সরকারি গদিতে যারা আসীন) কাছ থেকে কিছু কৃতজ্ঞতা আশা করতে পানের না?
এখানে আমি চেষ্টা করবো শামসুল হকের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের স্মৃতি কিছু ফিরিয়ে আনতে এবং তার স্বল্পকালীন রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে অন্যদের পরিচয় করাতে।
পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে করা হয় নতুন দলের সভাপতি। এবং তার ওপর কর্তৃত্ব দেয়া হয় দলের নির্বঅহী কমিটির সদস্যদের নাম ঠিক করে তা ঘোষণা করার। একাজের জন্য ১৯৪৯ সালের জুনে ঢাকার টিকাটুলির রোজ গার্ডেনসÑএ আনুষ্ঠানিক ভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগের শুরু হয় এবং সভাপতি ভাসানী সেখানে দলের নির্বাহী কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দুকার মোশতাক এবং সরকার বিরোধী উঠতি আরো অনেক নেতা। সভাপতি কর্তৃক যে নামগুলো ঘোষিত হতে যাচ্ছিল নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নামটি হবে জেনারেল সেক্রেটারির। সবাই তাই তাকিয়েছিল ভাসানীর মুখের দিকে কি নাম তিনি ঘোষনা করেন। সভায় উপস্থিত একজনেরও বেশি উচ্চাকাঙ্খী যুবক পদটির প্রতি আগ্রহান্বিত ছিলেন। ভাসানী এটা জানতেন। তাই চূড়ান্ত নামটি ঘোষনা করার আগে দুই একজনের নাম উল্লেখ করে সংগঠক হিসেবে তিনি তাদের প্রশংসা করেন অবশ্য তিনি পদটির জন্য যাকে বাছাই করেছেন সে সম্পর্কে তিনি ছিলেন দৃঢ়। এবং ভাসানীল কোনো সন্দেহ ছিল না নতুন পার্টি আওয়ামী মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে তিনি হবেন সবচেযে যোগ্য ব্যক্তি ভাসানী শামসুল হকের নাম ঘোষণা করবে সভায় কিছু গুঞ্জন ধ্বনি ওঠে। বৃদ্ধের ভীমরতি হয়েছে এমন দুটি একটা মন্তব্যও শোনা যায়। কিন্তু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার মতো এতো বলশালী সেগুলো ছিল না। ওই দিনে ভাসানীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলবেন তখন এমন কেউ ওই সভায় ছিলেন না। এভাবেই শামসুল হক আওয়ামী মুসলিম লীগের সবচেয়ে লোভনীয় পদটির অধিকারী হলেন। ওই সভায় দলের জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে ঘোষিত হয় শেখ মুজিব ও খন্দকার মোশতাকের নাম।
জেনারেল সেক্েরটারি হওযা ছিল শামসুল হকের দ্বিতয়ি বৃহৎ সাফল্য। প্রথম সাফল্য তিনি অর্জন করেন যখন তিনি পুর্ব পাকিস্তান আইন সভার এক আসনের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী করটিয়ার শক্তিশালী জমিদারকে পরাজিত করে জয়ী হন। ওই ব্যক্তিটিকে ভাসানী আগেই পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের খরচ ঠিক মতো দাখিল না করার অজুহাতে সরকার নির্বাচনটি বাতিল ঘোষণা করেন। এ জন্যই প্রয়োজন ছিল পরবর্তী নির্বাচনের। তার কৃতিত্ব অর্জনের জন্য শামসুল হক ওই সময় বোধ হয় দেশের সবচেয়ে প্রতিশ্র“তিশীল যুবক যাজনীতিক ছিলেন। সম্ভবত তখন তিনি ঢাকায় বিয়ে যোগ্য সবচেয়ে উপযুক্ত কুমারও ছিলেন। সুতরাং আশ্চর্যের কিছুই নেই যে তিনি বিয়েবন্ধ হলেন একজন সুশিক্ষিত, কেতাদুরস্ত এক কথায় সর্বগুণসম্পন্না এক মহিলার সঙ্গে। তার বিয়ের ভূমিকা তার জীবনে যার ভেতর ছিল তার রাজনৈতিক জীবন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দুই পক্ষের ব্যক্তি ত জীবনের খুটিনাটি বাদ দিয়ে জিনিসটির বিষয়ে আমি একটি উল্লেখ করতে পারি।
সম্ভবত ১৯৫২-র একুশে ফেব্র“য়ারি সংগ্রামকে কেন্দ্র করেই শামসুল হকের নাম সবচেয়ে সামনে আসে যদিও তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেননি। তার স্পষ্ট উচ্চারিত নেতিবাচক ভূমিকাতে আমার পরিচয় পাই তিনি কেমন মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন তার পার্টির লোক। তিনি ছিলেন তার দলের ও দলের জন্য। আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্য তিনি যা সবচেয়ে ভালো মনে করেছিলেন তাই তিনি করেছিলেন। একুশে ফেব্র“য়ারি ছাত্রদের শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভের বিরুদ্দে ব্যবস্থা অবলম্বনে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ২০ ফেব্র“য়ারি ১৪৪ ধারা ঘোষিত হবার পর ওই দিন সন্ধ্যায় নবাবপুর রোডের আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভা বসে। সভার আলোচনার বিষয় ছিল পরদিন ১৪৪ ধারা ভাঙা উচিত হবে কি না। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিরুদ্ধ ওই সায় সবচেয়ে সোচ্চার বক্তা ছিলেন শামসুল হক। বস্তুত তাকে কেন্দ্র করেই ছিলেন অন্যান্য বক্তা, যারা ছিলেন আইন অমান্য করে শোভাযাত্রা বের করার বিরুদ্ধে। বাহ্যত শামসুল হকের পক্ষে জোরালো কিছু যুক্তি ছিল। সেগুলো ছিল আওয়ামী লীগেরও যুক্তি। তিনি কাজ করছিলেন তার পার্টির হয়ে জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে যা করা তার কর্তব্য ছিল। যতগুলো সরলই ছিল সেগুলো হচ্ছে।
একুশে ফেব্র“য়ারির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার ও তারে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার কোনো সংগঠন নেই। তার ওপর দেশকে এ জন্য কেউ প্রস্তুত করেনি; সুতরাং সংগ্রাম যদি চলতে থাকে তাহলে জনগণের কাছ থেকে আমরা কোনো সাড়া পাবো না আর জনগণের সাড়া না পেলে কোনো আন্দোলনই টিকতে পারে না। এছাড়া বক্তারা বললেন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে আরো কিছু ঘটতে পারে। বিক্ষেভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আসতে পারে এবং মুসলি লীগ সরকার এটাই চায়। কেননা এই অজুহাতে নির্বাচন তারা পিছিয়ে দিতে পারে। আওযামী মুসলিম লীগ ওই সময় নির্বাচনের জন্য অধীর হয়ে ছিল। তারা বিশ্বাস করতো, নির্বাচন হলে তাতে তারা জয়লাভ করবে এবং প্রদেশে সরকারি ক্ষমতা হাতে পাবে। নিয়মতান্ত্রিক ব্যক্তি হিসেবে শামসুল হক তার পার্টির মত বিশ্বাস করতেন নির্বাচনের ভোটাভূটির মাধ্যমেই পরিবর্তন আসা উচিত। এবং এ পদ্ধতিতে বিঘœ সৃষ্টির তিনি পক্ষপাতি ছিলেন না। তার পার্টির প্রতি তিনি নিষ্ঠ ছিলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না এই প্রস্তাবটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় উপস্থিপিত হলে শামসুল হকের পক্ষ ১১Ñ৪ ভোটে জয়লাভ করেন। এর অর্থ আগামীকাল অর্থাৎ ২১ ফেব্র“য়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। ঢাকা ইউনিভার্সিটি রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন ওই সময় জিনিসটাকে উদ্ধার করলেন এই বলে যে দুটি ভিন্ন মত (১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না) আগামীকাল ঢাকা ইউনিভারর্সিটির আমতলায় সভায় ছাত্রদের সামনে উপস্থিত করতে হবে এবং এ বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত।
পরদিন ২১ ফেব্র“য়ারি আগের কথা মতো শামসুল হক এলেন আমতলায়। আমার মনে আছে তিনি পরেছিলেন ালো শেরোয়ানি ও তার মাথায় ছিল জিন্না টুপি। আমতলায় দাঁড়িয়ে যুক্তিসঙ্গত তিনি তার বক্তৃতা প্রদান করলেন। তার আবেদন ছিল ঐকান্তিক আগ্রহপূর্ণ। আমরা শ্রোতারা তার কথা মন দিয়ে শুনেছিলাম। কিন্তু তার পরও চিৎকার করেছিলাম না না বলে। এই না না ধ্বনি কিন্তু যতোটা না তার বিরুদ্ধে তারচেয়ে বেশি ছিল তিনি যে সিদ্ধান্তে পৌছতে চেয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে। বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন শামসুল হক। তিনি পরিষ্কার দেখতে পেলেন তিনি হেরে গেছেন। এ ঘটনাগুলো ঘটে ৪৭ বছর আগে। কিন্তু মানুষটার জন্য এখনো আমার দুঃখ হয়। আমার মনে হয়েছিল তার ভেতর সততা ও আন্তরিকতা ছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে তার পক্ষে আর এগুলো সম্ভব ছিল না। ওই দলের চরিত্র এমন ছিল যে একুশে ফেব্র“য়ারির সংগ্রামের পথে নেমে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সংগ্রামের যতো কাছে আসা সম্ভব তার পার্টিকে শামসুল হক সেখান পর্যন্ত এনেছিলেন। অবশ্য এ বিষয়ে শুধু আওয়ামী লীগকে দোষ দেয়া ঠিক হবে না। অন্য কোনো সংগঠনের অবদানও মহত্তর ছিল না।
একুশে ফেব্র“য়ারির পর খুব বেশি দিন যায়নি যখন থেকে পারিবারিক সমস্যার কারণে শামসুল হকের মানসিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু হয়। তার রাজনৈতিক জীবন তাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যর্থ হয়। যে পার্টির জন্য তিনি এতো কিছু করেছিলেন সেই পার্টি প্রতিদানে তার প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি যখন এমনটা তার প্রয়োজন ছিল। জনশ্র“তি আছে যে তার কোনো কোনো রাজনৈতিক সঙ্গী তার ভাগ্য ও অবস্থার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তার পারিবারিক সমস্যাকে আরো অবনতির দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করেন। কেননা এভাবে যদি তাকে সরানো যায় তাহলে তাদের ওপরে উঠার পথ সহজ হবে। এরপর শামসুল হক জেলে যান এবং সেখানে তার মানসিক অবস্থার আরো অবনতি হয়। পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায। এবং জেলের সীমানার মধ্যেও এমন কেউ ছিলেন না যিনি সহানুভূতিসুচক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলেন। শামসুল হক ছিলেন অত্যন্ত স্পর্শকাতর ব্যক্তি। বিষাদ এক চরিত্র এবং তার আবেগ ও অনুভূতির জন্য তাকে মূল্য দিতে হয়েছিল।
জেল থেকে ছাড়া পাবার পর দেখা গেল, শামসুল হক তার মানসিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ ভাবে হারিয়েছেন। তখন তাকে বোধ হয় আর সুস্থ বলা চলে না। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় তখন তাকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো। তিনি এমন অবস্থায় পড়েছিলেন যে জানাশোনা লোকের কাছ থেকে পয়সা চাইতে তিনি ইতস্তত করতেন না। দেশের এক সময়কার সবচেয়ে প্রতিশ্র“তিশীল রাজনীতিকের পরিণতি হলো। ওই সময় শামসুল হকের সঙ্গে বা তার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন এমন লোক নিশ্চয় এখন বাংলাদেশে আছেন তাদের মধ্যে থেকে কেউ কি এগিয়ে এসে শামসুল হক সম্পর্কে আরো কিছু আমাদের জানাতে পারেন না ? এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ কেন নীরব আমি বুঝতে পারি না। শামসুল হক ছিলেন তাদের প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি এবং প্রাদেশিক আইনসভায় তাদের প্রথ নির্বাচিত সদস্য যিনি মুসলিম লীগকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন।
মনে হয়, আওয়ামী লীগ ভুলে গেছে তাদের এই নেতাকেÑ আত্মপ্রচারে বিমুখ এই নেতাকে, যিনি পার্টির সঙ্গে নিজেকে এক করে দিয়েছিলেন। ঢাকডোল পেটানো আওয়ামী লীগের অর্ধশতাব্দীর উৎসবে শামসুল হকের নাম কোথাও উচ্চারিত হতে শুনিনি। আগের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। আওয়ামী লীগের উচ্চমহলে শামসুল হক কি অজানা ? আমাদের প্রধান মন্ত্রী যিনি সদাসর্বদা গর্বের সঙ্গে পার্টির কথা বলেন তিনি কি পার্টির সত্যিকার ইতিহাস জানেন না ? সে ইতিহাসে কি শামসুল হকের নাম থাকবে না ?
বাংলার বীর সন্তান ঃ শামসুল হক
আবু তোহা
বাংলার বীর সন্তান শামসুল হক আমাদের জাতয়ি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এক মহান ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তান আন্দোলনে এক মহান ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তান আন্দোলন থেকে শুরু ভাষা আন্দোলনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই বীর ােদ্দা যুদ্ধ করে ছিলেন। স্বাধীকার আদায়ের লক্ষ্যে।
শামসুল হক টাঙ্গাইলের এক দরিদ্র পরিবারে ১৯২৩ সালের ১ ফেব্র“য়ারী জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতেই তিনি রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। ৯৪৩ সালে আবুল হাশিম যখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, ঠিক সে সয় থেকে তিনি তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত হন এবং রাজনীতিতে সম্পর্কযুক্ত হন। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিস্ঠিত হলেও ১৯৩৭ সালের আগে পর্যন্ত মুসলিম লীগের নাম ঠিকানা গ্রাম বাংলার ছিলো না। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর শেরে বাংলা ফজলুল হক বাংলা প্রাদেশিক মুসলি লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে তিনি এই দলকে শক্তিশালী করতে প্রয়াস পান। কিন্তু আবুল হাশিমের সম্পাদক পদে নির্বাচিত হবার আগে পর্যন্ত এই দল গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে পড়েনি। আবুল হাশিম সম্পাদক পদে নির্বাচিত হলে বাংলার জমিদার, খান বাহাদুর, নবাবী নেতৃত্ব ভীত হয়ে পড়েন। আবুল হাশিম নির্বাচিত হয়েই ঘোষণা করেন, ‘তিনি মুসলিম লীগকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাত থেকে রক্ষা করবেন’। তিনি ঢাকার নবাব খাজা নাজিমুদ্দীন ও মওলানা আকরম খাকে বাংলার সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত করেন। এই সময় থেকেই লীগের সংগঠন দুদলে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি অংশে নেতৃত্বে থাকেন নবাব গোষ্ঠী। অপর অংশের নেতৃত্বে থাকেন আবুল হাশিম, সোহরাওযার্দী প্রমুখ। আবুল হাশিম গ্রাম বাংলার গরুণদেরকে মুসলিম লীগে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এই অবস্থায় আবুল হাশিমের সাথে শামসুল হকের যোগাযোগ এবং সে সুত্রে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ।
শেরে বাংলার মন্ত্রিসভা বাংলার মুসলমান কৃষকদের জন্য অনেক কল্যাণকর কাজ করলেও মুসলিম লীগের কারসাজিতে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। তাঁর পরে নাজিমুদ্দীনকে বসানো হয় প্রধান মন্ত্রিত্বে। তার সময়ে ১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষ হয় এবং তাতে বাংলার লাখ লাখ লোক মারা যায়। কলকাতার নর্দমাগুলোতে ানুষ ও কুকুরের মধ্যে এক সঙ্গে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়। ১৯৪৬ সালে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা গঠিত হয় যা পাকিস্তান অর্জন পর্যন্ত টিকে ছিলো। সোহরাওযার্দীর আমলেরৈ বাংলার প্রধান ঘটনা ১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্ট কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যাতে কলকাতায় হাজার হাজার মুসলিম নর-নারী, শিশু পুত্রের রক্তে রাজপথ লাল হয়ে যায়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো। পাকিস্তান আন্দোলনে শামসুল হক যুব সমাজকে সংগঠিত করার জন্য এক ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানেরই একটি উপনিবেশে পরিণত হলো। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার তকরা ৫৪% মানুষ পূর্ব বাংলায় বাস করে। তাদের ভাষা সাহিত্য, সং¯তৃতি বিকাশের একমাত্র মাধ্যম বাংলাভাষা। বাঙ্গালীদের সাং®কৃতিক বিকাশকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য পাঞ্চাবী গোষ্ঠী আমাদের ভাষার ওপর প্রথম চড়াও হয। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হবে মিঃ জিন্নাগর এ উক্তির ফলে বাংলা ভাষার দাবেিত বিক্ষেভ, বিদ্রোহ শুরু হলো। শামসুল হক এর নেতৃত্বপদে হাজির হলেন। তিনি ভাষার দাবীতে সংগ্রাম শুরু করলেনর। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ কায়েদে আযম রেসকোর্স ময়দানে উর্দুর পক্ষে ওকালতি করলে সে জনসভায়ই শামসুল হক উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করেন ‘নো’ ‘নো’ বলে। তিনি দাবী দাবী করেন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে হবে। ২৫ মার্চ কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মিঃ জিন্নাহ একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে তিনি ভাষার দাবীতে তখনও অটল ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে জিন্নাহগর যে আলোচনা হয় তাতেও তিনি ভাষার ন্যায্য দাবীকে তার কাছে তুলে ধরেন। কিন্তু জিন্নহ সাহেব তার কথায় অনড় ছিলেন। এভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পাকিস্তান নেতাদের অনমনীয়তার কারণে চলতে থাকে। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর বাংলার দুর্ভিক্ষাবস্থায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব বাংলায় সফরে এলে বাংলা ভাষার দাবী তোলা হয় তার কাছে। এ সময়ও শামসুল হক ছিলেন তেৃত্বের আসনে। ১৯৫২ সালে ২৬ জানুয়ারী পাস্তিান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দীন রমনায় লীগের এক জনসভায় জিন্নাহর কায় পুনরাবৃত্তি করে বলেন, টৎফঁ, টৎফঁ, ঝযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধহমব ড়ভ চধশরংঃধহ’ এ ঘোষণার সাথে সাথে বাংলার মানুষ গর্জে ওঠলো। ৩০ জানুয়ারী বিক্ষোভ চললো সারা শহরে। ৪ ফেব্র“য়ারী ঢাকা শহরে ধর্মঘট পালিত হলো এবং এ সময়েই সিদ্ধান্ত হয় যে, ২১ ফেব্র“য়ারী সারা বাংলায় হরতাল পালন করা হবে। ২১ ফেব্র“য়ারী ঘনিয়ে আসলে ২০ ফেব্র“য়ারীতে নূরুল আমিন সরকার আন্দোলনের ভয়ে সারা বাংলার ১৪৪ ধারা জারি করলেন। সাথে সাথে আওয়ামী লীগের অফিসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে আলোচনা হলো ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি না। সভায় ১১Ñ৪ ভোটে সিদ্ধান্ত হলো, লিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বার্থে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা যাবে না কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ ঘোষণায় কর্ণপাত না করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। শামসুল হক সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার কথা বললেও ২১ ফেব্র“য়ারী সকালে কলা ভবনে যে সভা অনুস্ঠিত হয় তাতে তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে তাঁর নিজের ......ব্যক্ত করেন। এভাবে ভাষা আন্দোলনের শেষ পর্যায়েও শামসুল হক ভাষার দাবীতে সংগ্রামকে অটুট রেখে ছিলেন। ভাষার দাবীতে ২১ ফেব্র“য়ারীতে বাংলার অত্র-জনতা পুশিলের গুলীতে যেভাবে আহত হলেন তাদেরকে চিকিৎসার জন্য এই শামসুল হকই সেদিন ছুটাছুটি করেছিলেন। গুলীর ভয়ে সেদিন অনেক ছাত্র নেতাই পা ঢাকা দিয়েছিলেন।
শামসুল হক বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দলের জনক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলিম লীগ সরকার দেশে পরিচালনায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। মুসলিম লীগকে নিজদের প্রসাদের চার দেয়ালে আবদ্ধ রা।ে লীগের সদস্যপদ দিতেও নেতৃবৃন্দ অদ্বীকার করে। প্রশাসনী কর্ম কান্ডে নবাবী গোষ্ঠীর একচেটিয়া আধিপত্য বিরাজ করেছিলো যা জনসাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়। এমন সময়ে টাঙ্গাইলে এক উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যার প্রার্থী ছিলেন শামসুল হক। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না আীনের একান্ত সহযোগী জমিদার খুররম খান পন্নী। এই নির্বাচনে শামসুল হক পদকহগীন থেকেও পন্নীকে পরাজিত করে বাংলায় যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেন। মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতার এই পরাজয় ছিলো স্বাভাবিক। টাঙ্গাইলের শামসুল হক জয়লাভ করলেও লীগ সরকার তাকে পরিষদে প্রবেশ করতে দেয় নাই। এমতাবস্থায় বাংলার যুব সম্প্রদায় অত্যন্ত ক্ষেপে ওঠে, তদূপরি মুসলিম লীগের সদস্য হওয়ার জন্য বাধাপ্রাপ্তি ইত্যাদি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শামসুল হক বাংলার বৃহত্তর জনগণের জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে সর্বপ্রথম একটি বিরোধী দল গঠন করেন মওলানা ভাসানী এর সভাপতি হন আর তিনি এর সাধারণ সম্পাদক হন। শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মুশতাক আগমদ যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যক্ত থাকার অভিযোগে সরকার তাকে গ্রেফতার করে কারাগারেই তার ওপর ভীষণ মানষিক নির্যাতন চালানো হয়। তদুপরি তাঁর পরিবাকেও ধ্বংস করে দেয়ার চক্রান্ত চলে। এমতাবস্থায় তিনি মুক্তি পেয়ে ানুষিক ভারসাম্যহীনতার কারণে পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন এভং প্রায় সময়ই অনাহারে থাকতেন। অবশেষে একদিন তার লাশ নদীর তীরে দেখা গেলো। আদতে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে কিনা, কিংবা তা করা তাকে হত্যা করেছে কিংবা কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে, এ প্রশ্ন আজও রহস্যবৃত।
জাতির দিক নির্দেশনায় শামসুল হক যে ভুমিকা রেখেছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। আমাদের উচিত তাঁর মৃত্যু রহস্য খুঁজে বের করে এই মহান যুগ মনীষীর মূল্যায়ন করা তার প্রতিভা ছিল অবিস্মরণীয়। বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম গ্রন্থের মধ্যে তাঁর প্রতিভা সমুজ্জ্বল করুন সক্ষ করা যায়।
কোথায় আছেন টাঙ্গাইলের শামসুল হক ???
তপন কুমার দে
১৯১৮ সালের পহেলা ফেব্র“য়ারী টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার এলাসিন গ্রামের এক পরিচিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বাঙ্গালীর গৌরব এদেশের কৃতীসন্তান জনাব শামসুল হক। এলাসিন গ্রামে ছিল তার মামার বাড়ী। মামার বাড়ীতেই তার জন্ম হয়। শামসুল হকের পৌত্রিক নিবাস। একই থানার টেউরিয়া গ্রাম। তার পিতার নাম দবির উদ্দন এবং মাতার নাম শরিফুন নেসা। শামসুল হকের পিতা ছিলেন একজন আদর্শ কৃষক। কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও শিশুকাল থেকেই তার লেখাপড়ার প্রতি প্রচন্ড মনোযোগ ছিল এবং অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি প্রথমে নিজ গ্রামে টেউরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুর করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়েল পাঠ শেষে এলাসিন স্বর্ণময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে কিছুদিন পড়ালেখার পর পোড়াবাড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এর পর সন্তোষ উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এখানে সম্পম শ্রেণীতে লেখাপড়ার সময় প্রথমে শ্রেণী ক্যাপ্টেন এবং পরের বছর স্কুল ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সালে তিনি সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর শামসুল হক বঙ্গের আলীগড়ে নামে খ্যাত করটিয়া সা’দত কলেজের একাদশ শ্রেণীর প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। এখানে লেখাপড়ার সময় তিনি সা’দত কলেজের প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ১৯৪০ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে আইএ পাশ করেন। ঐ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ অনার্স পাশ করেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকার কারণে তার ভাগ্যে আর এম এ পরীক্ষা দেয়া হয়নি। শামসুল হক স্কুল জীবন থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। করটিয়া কলেজের ভিপি হওয়ার পর তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলার নেতৃস্থানীয়দের সান্নিধ্যে আসেন। বিশেষ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও আব্দুল হাসিমের অত্যন্ত বিশ্বাস ও প্রিয় পাত্র হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন আন্দোলনে নেতুত্ব দেন। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের সম্মেলনে শামসুল হক যোগদান করেন। এই সময়ই আবুল হাশিম ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কয়েকজন যোগ্য নেতৃত্ব পড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হক। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের আগ থেকেই শামসুল হক পূর্ববঙ্গ জনসভা সমাবেশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যেতেন। তিনি ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই নির্বাচনেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তি রচিত হয়।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর সবচেয় মজার ব্যাপার ঘটে, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভ করে সে সমস্ত ব্যক্তিকে মুসলিম লীগ থেকে বিতারিত করা হয়। এর পিছনে মূল কারন ছিল মুসলিম লীগ সরকারের দুয়তিসন্ধি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালীকে চিরদিনের জন্য পশ্চিমাদের দাসত্বে বন্দী করে রাখা এবং শোষণ ও শাসনের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়া। মুসলীম লীগ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিম, শামসুল হককে বিতাড়িত করা হয়। অন্যদিকে যেসব নেতার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পিছনে কোন প্রকার অবদান ছিল না সেই নাজিমুদ্দিন ও মওলানা আকরাম খাঁকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়। মুসলিম লীগ থেকে এমনিভাবে সোহরাওয়ার্দী ও হাসিমপন্থীরা সরে আসেন এবং মুসলিম লীগের হীনস্বার্থের প্রতিবাদ করে নতুন রানৈতিক দল প্রতিষ্ঠার জন্য অগ্রসর হন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ একটি সম্মেলন আহবান করেন। এই সম্মেলনে ওয়ার্কাস ক্যাম্প নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর মূল লক্ষ ছিল মুসলিম লীগের অংশকে সংগঠিত করা এবং মুসলিম লীগের ভূল-ত্র“টি তুলে ধরা। ১৯৪৯ সালের ২৫শে এপ্রিল দক্ষিণ টাঙ্গাইলের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচন স্থির ১৮৮৭ সালের ১৮ই ........পাকিস্তানের সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার প্রথম.....মুসলিম লীগের প্রার্থী হন টাঙ্গাইলের...... খুররম খান পন্নী আর যুবনেতা.......ওয়ার্কাস ক্যাম্পের প্রার্থী হিসেবে.......অবতীর্ণ হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ........মুসলিম লীগ সরকারের সকল প্রকার......... শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে শামসুল হকের আহবানে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়েল ছাত্র সমাজ ও দেশের তরুণ সম্জ সংগঠিত হয়। ঢাকা, ময়মনসিংহ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান হতে অসংখ্য ছাত্র যুব দলে দলে টাঙ্গাইল এসে নির্বাচনী কাজে অংশ নেয়। শেখ মজিবুর রহমান তখন কারাগারে বন্দীকিন্তু...........প্রতিটি ভোটারের বাড়ী বাড়ি .........ধর্ম ও ইসলামের দোহাই দিয়ে মুসলিম লীগ সরকার বাঙ্গালীকে পঙ্গু করার জন্যে মেতে উঠেছে। খুররম খান পন্নরি পক্ষে খাজা ম........, নুরুল আমিনসহ পাঁচ-সাতজন মন্ত্রী সর্বক্ষনিক নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। পুলিশের আইজিকে সঙ্গে নিয়ে নাজিমুদ্দিন প্রশাসনের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেন মুসলিম লীগ প্রাথীকে বিজয়ী করার জন্যে। বহু গোঁড়া মোল্লা ভাড়া করে মুসলিম লীগ থেকে ধর্মের দোহাই দিয়ে অশিক্ষিত ভোটারদের বুঝানো হলো যে মুসলিম লীগকে ভোট না দিলে দেশহিন্দুস্থান হয়ে যাবে। শামসুল হককে ভোট দেয়ার অর্থ হলো বিধর্মীকে ভোট দেয়া, মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার অর্থই হলো ইসলামকে ধ্বংসকরা মুসলিম লীগই হচ্ছে মুসলমানদের মসজিদ। মুসলিম লীগ সরকারের সকল প্রকার উপপ্রচারে ভোটাররা বিভ্রান্ত না হয়ে তারা শামসুল হককে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী করে। নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় সমগ্র দেশে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে ন। এরপর মুসলিম লীগ সরকার আর কোন আসনে নির্বাচন দিতে সাহস পায়নি। অনেকগুলো আশন শুন্য থাকলেও পরাজয়ের ভয়ে ১৯৫৪ সাস পর্যন্ত সরকার নির্বাচন বন্ধ রাখে। ১৯৪৯ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের গদি যেমনি কেপে উঠে তেমনি বাঙ্গালীরা আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দপিনা লাভ করে। দক্ষিণ টাঙ্গাইলের নির্বাচনের বিজয় অর্জনের পরই শুরু হয় পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন বিকেল তিন ঘটিকা হতে ঢাকার রোজ গার্ডেনের দোতলায় এক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বৈঠকে প্রায় আড়াইশ থেকে তিনশ কর্মীর সমাবেশ হয়। বৈঠকে উপস্থিতিদের মধ্যে বিশিষ্ট নেতৃবর্গের মধ্যে ছিলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, কুষ্টিয়ার আবদুল মোতালেব মালেক, কুমিল্লার তোফাজ্জল আলী, ঢাকার আতাউর রহমান খান, ............. মোহাম্মদ খান, কামরুদ্দিন আহম্মেদ, ..........আব্দুল জব্বার খন্দকার, পাবনার এম.মনসুর আলী, মৌলানা আব্দুল রশিদ, নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী, রংপুরের খয়রাত হোসেন, টাঙ্গাইলের শামসুল হক, ফরিদপুরের শেখ মুজিবুর রহমান ও মোললা জালাল উদ্দিন, দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম ও রহিম উদ্দিন উকিল। আরেরা উপস্থিত ছিলেন আনোয়ারা খাতুন, আলী মোহাম্মদ খান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, শওকত আলী ফজলুল কাদের চৌধুলী শামসুদ্দিন আহমেদ, আলী আজাদ খান, মওলানা মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরী সহ আরো অনেকে। ঐদিনেই নারায়ণগঞ্জের ওসমান সাহেবের বাসায় আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নাম ঘোষণা করা হয়। ৪০ সদস্য বিশিষ্ট্য একটি কমিটির নাম প্রকাশ করা হয়। উক্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামি খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয় যুবনেতা শামসুল হককে এবং যুগ্ম সম্পাদক করা হয় খন্দকার মোশতাক আগমেদ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে নবগঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৪৯ সালের ২৪ শে জনু ৫টা ৩০ মিনিটে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সংগঠনের সর্বপ্রথম জনসভা করে। যদিও মুসলিম লীগ মরকার গুন্ডাদের দিয়ে সভা ভাঙ্গার চেষ্টা করে তবুও সাতে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ ঘটে। জনসভায় ভাসানী, শামসুল হকসক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য সমবেত জনতার মধ্যে মারাত্মক মুসলিম লীগ বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কর্মসূচী বা ম্যানিনেষ্টা তৈরী করেন জনাব শামসুল হক। অল্লদিনের মধ্যেই সারা প্রদেশব্যাপী আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার লোকের এক বিশাল ভূখা মিছিল ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে। ঐ বিশাল মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন দলীয় সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক ম্যামসুল হক এবং যগ্ম-সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। মিছিলে নেতৃত্বেদান করার অভিয়োগে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। আরো অনেক নেতার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়। দেশব্যাপী সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সকল প্রকার অত্যাচার-নিপীড়ন জুলেমের মুখেও বাংলার মানুষ মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলে। ভাসানী, মুজিব ও শামসুল হকের সাংগঠনিক তৎপরতায় দেশে নতুন যুগের সূচনা হলো। শামসুল হকের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ১৯৪৯ সালের উপ-নির্বাচন আর আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মহান ভাষা আন্দোলনেও তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্র“য়ারী পাকিস্তান গণপরিষদ অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলায় বক্তব্য দেয়ার দাবী জানান। এর কয়েকদিন পরে ১৯৪৮ সালের ২৮ শে ফেব্র“য়ারী হতে ৬ই মার্চ পর্যন্ত কলকাতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সুব সম্মেলনে শামসুল হক ও যোগদান করেন এবং সেখান হতে বীরেন্দ নাথের বক্তব্য সমর্থনে এবং নাজিমুদ্দিনের গণপরিষদের উক্তির প্রতিবাদে বিবৃতি প্রদান করেন। ১১ই মার্চের আয়োজিত ধর্মঘট সফল করার আহবান জানিয়ে শামসুল হকসহ কয়েকজন একটি বিবৃতি দেন। ১৯৪৮ সালের ১১ ই মার্চের ধর্মঘটের সময় শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৫ই মার্চ নাজিমুদ্দিন সরকার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৭ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে কারাগার হতে মুজিব ও শামসুল হক সমর্থন দেন। ঐ দিনই সণ্যায় মুজিব ও শামসুল হকসহ বন্দী নেতাদের মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ২৪ তারিখে সন্ধ্যায় জিন্নার সঙ্গে যে কর্ম পরিষদ বৈঠক করেন তার মধ্যেও শামসুল হক ছিলেন নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে।
১৯৫২ সালের ৩১ শে জানুয়ারী ঢাকা বার লাইব্রেরীতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে যে সর্বদলীয় ভাষা পরিষদ গঠিত হয় ঐ সভাতে শামুল হক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন এবং তিনি সর্বদলীয় ভাষা কমটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। ৪ঠা ফেব্র“য়ারী সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সভা হয়। এই সভাতে ২১ শে ফেব্র“য়ারী প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গহীত হয়। ১৯৫২ সালের ২০ শে ফেব্র“য়ারী সন্ধ্যায় ৯৪ নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে আবুল হাসিমের সভাপতিত্বে সভা হয়। সভায় অনেকেই ২১ শে ফেব্র“য়ারী ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে অভিমত পেশ করেন। জনাব শামসুল হক ২১ শে ফেব্র“য়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং ছাত্রদেরকে সংগ্রাম কমিটির বক্তব্য জানান। কিন্তু বতু যখন তিনি দেখলেন ছাত্রদের দাবী সবাই ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বা ভঙ্গবেই তখন তিনি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন।
২১ শে ফেব্র“য়ারী, গুলীবর্ষণের পর শামসুল হক উন্মাদের মত বিভিন্ন দিকে ছুটাছুটি করছেন। তিনি আহতদের তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। শামসুল হকের এদিনের ভুমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুলীবর্ষনের পরবর্তী কাজ কর্মেল বা কর্মসূচীল ব্যাপারে ২১ শে ফেব্র“য়ারী সন্ধ্যায় ফজলুল হকের কে এম দাস লেনের বাড়ীতে বৈঠকে বসেন শামসুল হক, আবুল হাসিম, কামরুদ্দিন আহম্মেদ কাজী গোলা মাহবুব। পরবর্তীতেও শামসুল হকের কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভাষা আন্দোলনের কর্মতৎপরতার কারণে সরকার শামসুল হককে ১৯৫২ সালের মার্চ মাসের ১৯ তারিখে গ্রেফতার করে। তার জীবনের উপর বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্র নেমে আসে এই বন্দী জীবনেই। এই সময়েই শামসল হককে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সরকার চক্রান্তে মেতে উঠে বলে অনেকের ধারণা। অনেকেই বলেন তাকে সরকার জেলখানায় বন্দী করে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে পাগল করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায় একদিকে অন্যদিকে তার স্ত্রীর মাধ্যমেও তাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হয়।
বাঙ্গালী জাতির এই কৃতী সন্তান বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়ে শেষ জীবন কোথায় কিভাবে আছেন বা না আছেন আজও তার কোন প্রকার সঠিক অনুসন্ধান পাওযা যাযনি। ১৯৫৩ সালের ১৩ই ফেব্র“য়ারী শামসুল হক অত্যন্ত মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় কারাগার হতে মুক্তি লাভ করেন। এরপর তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেন নি অসুস্থতার কারণে। রাজনীতি হতে বিচ্ছিন্ন হলেও জনাব শামসুল হক ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে আসেন। জনাব শামসুল হক যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষে অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ করে যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচনের প্রচারাভিযান চলা কালেও তিনি টাঙ্গাইল পার্কের এক বিশাল জনসভায় যুক্তফ্রন্ট-এর পক্ষে ভোট দেযার অনুরোধ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের বাঙ্গালীরা মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যে বাঙ্গালীরা মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যে জঙ্গী রায় প্রদান করে তার পিছনে শামসুল হকের বেশ ভাল অবদান ছিল। যুক্তফ্রন্ট বিজয়অর্জন করে মন্ত্রিসভা গঠন করে। কিন্তু পাক সরকারের ষড়যর্নেতর কারণে বেশী দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। যে সামান্য দিন ক্ষমতায় ছিল এ সময়ই শামসুল হককে চিকিৎসার জন্য যুক্তফ্রন্ট সরকার করাচী পাঠায়। দীর্ঘ তিন বছর চিকিৎসার পর করাচী মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসকগণ বলের তার কোন রোগ নেই। তিনি সম্পূর্ণ ভাল আছেন। কিন্তু তিনি মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত। চিকিৎসকগণ বলেন, হতাশা কাটিয়ে উঠার জন্য তাকে তার স্ত্রী, কন্যাসহ একত্রে বসবাস করতে হবে। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী শামসুল হকের রাজহনৈতিক সহকর্মী জনাব হযরত আলী তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তার স্ত্রী আর স্বামীর নিকট ফিরে যেতে রাজী হয়নি। তিনি জানলেন যে ইতিমধ্যে সে অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ১৯৫৭ সালের শেষ দিকে করাচী হতে আসার পর যখন স্ত্রীর সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সমালোচনা শুনেন তখন তিনি আরো মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এরপর হতে তাকে দেখা গেছে ছেড়া কাপড় পরে পাগলের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি সর্বদাই তার পরিচিত বন্ধুদের বলতেন তার স্ত্রী-কন্যাদের কাছে আনার ব্যবস্থা করে দিতে। একবার ১৯৫৮ সালের দিকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বললেন, মজিব তুই জানিস না আমার স্ত্রী, কন্যা কোায় ? তুই তাদেরকে এনে দে। কিন্তু তখন মুজিবের বা আর কারো কিছু করার ছিল না। কারণ তখন তার স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে বসেছেন। শামসুল হক তার চাচীকেও বলতেন তার স্ত্রী-কন্যাদের এনে দেয়ার জন্য। এমনি অবস্থায় দিনের পর দিন তার অসুস্থতা আরো বৃদ্ধি পায়। অসুস্থতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্রমশঃই তিন বাড়ীঘর ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। ১৯৬০ সালে একবার বাড়ী আসেন। এরপর আর তাকে দেখা যায়নি। ১৯৬৪ সালে শেষের দিকে একবার টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার লাউহাটির হাটে আসেন তার পর আর কোন স্থানে কোন দিন তাকে দেখা যায়নি। এর পর তিনি বেচে আছেন না মরে গেছেন এ সংবাদ কেউ জানে না। অনেকেই বলেন যমুনা নদীর চরে শামসুল হকের মতই একজন লোকের বিকৃত লাশ পড়ে ছিল। কিন্তু তা শামসুল হকের লাশ কি-না তার সঠিক কোন খোঁজ বা ঐ লাশের ভালভাবে দাফনের ব্যবস্থাও হয়নি। আবার অনেকেই বলেন, শামসুল হককে ১৯৭০ সালের দিকেও ঢাকা শহরের শাহবাগে দেখা গেছে। আবার কেউ কেউ বলেন, সিলেট শাহজালালের মাজারে পীর বা দরবেশ বেশে স্বাধীনতার পরেও তাকে দেখা গেছে। কিন্তু এ সমস্ত কথার কোন প্রকার সত্যতা আছে বলে অনুসন্ধান করা যায়নি। সর্বোপরি এটাই বলা যায়, শামসুল হক দেশবাসীর মাঝ হে এভাবে করুণ পরিণতিতে হারিয়ে যাবেন এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। জাতির যে মহান কৃতী সন্তান জাতিকে এতো কিছু দেয়ার জন্যে সর্বদা দিলেন সচেষ্ট সেই ব্যক্তির খোঁজ-খবর দেশবাসী রাখেনি। আজকের প্রজন্ জানে না শামসুল হক কে ছিলেন। কি তিনি করতে চেয়েছিলেন। সেই শামসুল হকের কি যে করুণ পরিণতি হলো ? তা মানুষের কাছে শুনে বা তার ভাতষ্পুত্র মোঃ হুমায়ুন কবীরের লেখা “স্বাধীকার আন্দোলন ও শামসুল হক” নামক গ্রন্থখানি পাঠ করলে শুধু অশ্র“ সম্বরণ করা ছাড়া আর মনে হয় কিছুই করার নেই। বাঙ্গালী জাতির এই মহান সন্তান সম্পর্কে সকল প্রকার জল্পনা-কল্পনার অবসান হতে পারে সঠিকভাবে অনুসন্ধান করে বা তদন্তের মাধ্যমে সত্য তুলে ধরলে। তাই এই মুহূর্তে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর নিকট অনুরোধ থাকবে শামসুল হক সম্পর্কে অনুসন্ধান বা তদন্ত কমিটি করে তার মাধ্যমে সঠিক তথ্য খুঁজে বের করে তা জাতির সামনে তুলে ধা।
ভাষা আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি শামছুল হক
মোঃ শহীদুল ইসলাম
যে সমস্ত বিপ্লবী নেতা বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের তাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে আন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে ইতিহাসের স্বরনীয় হয়ে আছেন শামসুল হক তাদের অন্যতম। তিনি এমন এক অনণ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন যার কর্মজীবন সংক্ষিপ্ত হলেও অবদান সুদুর প্রসারী। তিনি ১৯২৩ সালের ১লা ফেব্র“য়ারী টাঙ্গাইল জেলার এলাসিন গ্রামে মাতুনালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম মোঃ দবির উদ্দীন এবং মাতার নাম মরহুমা শরিফুন্নেসা। দবির উদ্দীন অল্প শিক্ষিত হলেও কবিত্বে ও নেতৃত্বে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। স্বীয় এলাকায় প্রভাবশালী মাতাব্বর ও জন সেবক হিসেবে তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন। ন্যায় বিচারক হিসাবে সমাজে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। তার পিতা মাতা উভয়েই বিশেষ ধার্মিক ও ন্যায় পরায়ন ছিলেন।
জনাব শামছুল হক তার পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে গৃহ শিক্ষকের নিকট থেকে অতি শৈশবে প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন। লেখা পড়ায় তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। শৈশব থেকেই তার মেধার বিকাশ ঘটতে থাকে। খেলাধুলা বতৃতা, কবিতা আবৃত্তি ও অভিনয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নকাল থেকেই তার মধ্যে এ সব গুণের প্রকাশ ঘটতে থাকে। তখন থেকেই তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী পরিলক্ষিত হয়। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত চিন্তাশীল।
হাই স্কুলে সাধারণ: নবম শ্রেণী থেকে স্কুল ক্যাপ্টেন নিয়োগ করা হয় কিন্তু শামছুল হক সপ্তম শ্রেণী হতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল ক্যাপ্টেন ছিলেন। কলেজে অধ্যায়নকালে তিনি ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন।
জনাব শামছুল হক তার নিজ গ্রামে টেউরিয়া প্রাথমকি বিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ পাশ করে কিছুদিন এলাসিন মাইনর স্কুলে পড়াশুনা করেন। তারপর কাবিলা পাড়া মাইনর স্কুলে ভর্তি হয়ে সেখানে থেকে বৃত্তিসহ মাইনর পাশকরেন। তারপরঃ সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৩৮ সনে মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ঐ বৎসরই তিনি করটিয়া সাদৎ কলেজে ভর্তি হন। তার আপ্রান চেষ্টায় ১৯৩৯ সালে সাদৎ কলেজে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। সাদৎ কলেজ থেকে তিনি ১৯৪০ সনে প্রথম বিভাগে আ্.এ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞান অনার্স পড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৪৩ সনে তিনি রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স সহ বি,এ ডিগ্রী লাভ করেন।
এ সময় তিনি দেশে বিরাজমান অস্থির রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জড়িত হয়ে পড়েন যার ফলে আর পউচ্চতর ডিগ্রী নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু নিজ চেষ্টায় তিনি রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও ধর্মীয় তত্ত্বের উপর গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেন।
তরুণ শামসুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার ফলে তার নাম নিজ এলাকা টাঙ্গাইল ও ঢাকা শহরে ছাত্র ও যুব সমাজে নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। সময় বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব আবুল হাশিম সাহেব বঙ্গীয় প্রাদেমিক মুসলীম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ মন্ত্রী সভা গঠিত হয়। তৎকালে মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক দলটিকে জনগণের মুসলিম লীগে পরিণত করার ক্ষেত্রে এই দুই মহান নেতার সর্বাধিক অবদান রয়েছে। জনাব শামসুল হক ছিলেন এই দুই নেতার অত্যন্ত প্রিয় পাত্র এবং অন্যতম প্রধান ও বিশ্বস্ত অবলম্বন। তাদের উদ্যোগে ১৯৪৫ সালে যখন মুসলিম লীগের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের জন্য ঢাকায় একটি আঞ্চলিক অফিস প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন এই দফতরই পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় জনাব শামসুল হককে।
জনাব শামসুল হক অত্যন্ত নিষ্ঠা,দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে তার এ দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্বপূর্ণ কাজে তার প্রধান সাহায্যকারী ছিলেন বর্তমানে ঢাকা সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট এবং তার ঘনিষ্ট বন্ধু জনাব হযরত আলী সিকদার।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জনগণের মুসলিম লীগ আবার কতিপয়ের পকেট মুসলীম লীগে পরিণত হয়। প্রকৃত সংগ্রামী মুসলিম লিডাররা তখন কালো তালিকা ভূক্ত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থারও অভাব ছিল না। মেরুদণ্ডহীন জীহজুরের দলের সমর্থনেই তখন দেশ শাসন চলছিল। শামছুল হক সহমুসলীম লীগের অনেক শক্তিশালী সংগঠক পর্যন্ত নব গঠিত মুসলীম লীগের কোন কর্মকর্তা হওয়া তো দূরের কথা সাধারণ সদস্য পর্যন্ত হতে পারেননি। আসাম প্রাদেশিক মুসলীম লীগের সাবেক সভাপতি ও তদানীন্তন পাকিস্তান আন্দোলনের সর্বাধিক বলিষ্ঠ ভূমিকা অবলম্বনকারী মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও পাক আন্দোলনকালে বঙ্গীয়ং প্রাদেশিক মুসলীম লীগের সর্বাধিক নিষ্ঠবান অক্লান্ত কর্মী অমিত তেজ শামছুল হক এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আজাদীর পর নবগঠিত মুসলীম লীগের পুন নির্বাচন দাবী করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের সকল প্রচেষ্ঠা বিফল হয়। তাই বাধ্য হয়েই তারা বিরোধীদল গঠনের কথা চিন্তা করেন।
এ অবস্থায় জনাব শামছুল হক সাবেক মুসলীম লীগের ঢাকাস্থ আঞ্চলিক অফিস ১৫০ নং মোগল টুলীতে নবগঠিত পকেটে মুসলীম লীগ বহির্ভূত প্রগতিশীল মুসলীম নেতৃবৃন্দ, যুব ও ছাত্র কর্মীদের মিলনস্থল হিসেবে কর্মী শিবির স্থাপন করেন।
বিরোধী দল গঠনের মনোভাব নিয়ে তিনি আতাউর রহমান খান প্রমুখদের নিয়ে ঢাকা জিলা বোর্ড নির্বাচনে লীগ বিরোধী প্রার্থী দাঁড় করান। কিন্তু সে নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেননি। তারপর আসে দক্ষিণ টাঙ্গাইলের উপ-নির্বাচন। এই উপ-নির্বাচনে শামছুল হক নিজেই প্রার্থী হয়ে মুসলীম লীগের বিরোধীতা করেন। এক পক্ষে মুসলীম লীগ মনোনীত প্রার্থী করটিয়ার জমিদার জনাব খররম খান পন্নী। জদিারীর বিপুল প্রভাব এবং আর্থিক সংগতি সহ মুসলীম লীগ দলীয় মন্ত্রী সভার সার্বিক শক্তি এবং তার সাথে আরও যোগদেন তৎকালীন মওলানা আলীম আলরাজী (পরে ডক্তর) ও জনাব আবদুর রহমান (পরে মন্ত্রী)। অপর পক্ষে আর্থিক সংগতিহীন নিু মধ্যবিত্ত পরিবারের জনাব শামছুল হক। তার না আছে অর্থের জোর আর না আছে সংগঠনের জোর। তখন তার সাথে থেকে নির্বাচন পরিচালনা করেন তার সহকর্মী জনাব খন্দকার মোশতাক আহাম্মদ (সাবেক রাষ্ট্রপতি), হযরত আলী সিকদার, বদিউজ্জামান খান, আঃ করিম খান, নূরুল হুদা, খোদা বকশ মিয়া, আলা উদ্দীন তালুকদার প্রমুখ যুব ছাত্র ও জননেতা।
অসাধারণ জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক নৈপুণ্যের দরুন শামছুল হক এ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে প্রতাপশালী জমিদারকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। তার এ বিজয়ের মধ্যেই নিহত াকে প্রম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলীম লীগের জন্ম তথা আওয়ামী লীগের ভিত্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়।
১৯৪৮ সালে কায়েদে আজম উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার সাথে সাথে শামছুল হক বজ্রকণ্ঠে তার প্রতি বাদ করেন এবং পরে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। তিনি উক্ত কমিটির একজন অন্যতম সদস্য হিসাবে নেতৃত্ব দেন। দক্ষিণ টাঙ্গাইলের উপ-নির্বাচনে জনাব শামছুল হকের বিজয়ে জনাব শামছুল হকের বিজয়ে প্রগতিশীল মুসলীমরাজনীতি বিদগণ উৎসাহিত হয়ে বিরোধী দল গঠনের উদ্দেশ্যে সালের সেপ্টেম্বর মাসে মওলানা রাগিব আহসানের পৌরহিত্যে ঢাকায় টিকাটুলির রো গার্ডেনে মুসলীমলীগ কর্মীদের একজন ভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ কনভেনশনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও জনাব শামছুল হককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগ গঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে থাকা অবস্থায় যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিক দল গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীমলীগ গঠন করেন এবং তিনি নিজেই তার সভাপতির পদ অলংকৃত করেন ও জনাব মাহমুদুল হক ওসমানী এই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচত হন।
জনাব শামছুল হকের নেতৃত্বে এই নবগঠিত প্রথম বিরোধী দল অতিদ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। কিন্তু এর পতাকাতলে সমবেত সুবিধাবাদীগণ জনাব শামছুল হকের ধর্মীয় প্রবনতা ও আদর্শ নিষ্ঠাকে সুনজনে দেখেননি। তাই রাতারাতি সংগোপনে তাকে দলের নেতৃত্ব থেকে অপসারণের প্র¯তৃতি চলতে থাকে। এ সময় বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের জোয়ার ক্রমশঃ দানা বেঁধে উঠতে থাকে।
বায়ান্নোর ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের বাংলা ভাষা বিরোধী আন্দোলনের পর ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ জানুয়ারি সাধারণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয় এবং ৩১ জানুয়ারি বার লাইব্রেরীতে সভার পর সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ৪ ফেব্র“য়ারি সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয় এবং ঢাকায় ছাত্রদের বিরাট মিছিল বের হয়। এভাবে আন্দোলন এগুতে থাকে এবং ২১শে ফেব্র“যারি এস্বেলী অধিবেশন চলার সময় ধর্মঘট ডাকা হয় এবং মিছিল বের করা হলে গুলি চালানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের মধ্যে গুলিতে প্রাণদেন ছালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, অহি উল্লাহ ও শফিউর রহমান এবং বহু লোক আহত হন। ২২ ফেব্র“য়ারি হরতাল পালিত হয় এবং শোভাযাত্রা ও গায়েবী জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ঐদিন পুনরায় হাই কোর্টের নিকট গুলি চালানো হয়। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শামছুল হক কারাবরণ করেন। তার সাথে আরও কারাবরণ করেন জনাব আবুল হাশিম, মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আলী চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ, অধ্যাপক মুনীর চৌুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে কারারুদ্ধ হওয়ার পর একটানা সুদীর্ঘ আড়াই বৎসর কাল তিনি কারাবরণ করেন। এই সময়ের মধ্যেই দ্বিমুখী ষড়যন্ত্রর ফলে তাকে নেতৃত্ব হতে অপসারণের কাজ সম্পন্ন হয়। তারপর মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় তিনি কারামুক্ত হন। তার এ অবস্থার জন্য তার দরদীদের মনে চরম ব্যথার উদ্রেক হলেও তার বিরোধীরা উল্লাসিত হন। তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও হয় না।
টাঙ্গাইল মাহফিলের তরফ থেকে তার চিকিৎসার জন্য তার নিজের দলের জনাব আঃ সালাম খান, প্রাদেশিক স্বাস্থ্য মন্ত্রীর শরনাপন্ন হলে বিষয়টিকে মোটেই গুরুত্ব দেযা হয়নি। পরে মন্ত্রী সভার পরিবর্তন হলে টাঙ্গাইল মাহফিলের সহযোগিতায় সরকারি সাহায্যে তাকে লাহোর মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। উক্ত হাসপাতালে কয়েক বৎসর যাবৎ তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পরও তার কোন মানসিক রোগ ধরা পড়ে না। পরে শহীদ সোহরাওয়াদী ও হজরত আলী সিকদার তাকে হাসপাতাল থেকে মুক্ত করে দেশে পাঠিয়ে দেন।
দেশে ফিরে তিনি আগের মতো ঘোরাঘুরি শুরু করেন এবং হুকমত রব্বানী প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় লিপ্ত আছে বলে প্রচার করতেন। এই অবস্থায় ১৯৬২ সনে হজরত আলী তার শেষ স্বাক্ষাত পান।
১৯৬২ সালের বর্ষায় তিনি শেষ বারের মতো বাড়ী থেকে চলে যান। এরপর আর তাকে বাড়ী আসতে দেখা যায়নি। তার আত্মীয় আঃ রশিদ মিয়ার প্যারাডাইস পাড়াস্থ বাস ভবন থেকেও এ সময় বিদায় নেন। তার এক ভাই আবু বকর ছিদ্দিক জানান বিদায়ের পর তার আর কোন খোঁজ খবর না নেয়ার জন্য তিনি সবাইকে অনুরোধ করে গেছেন। তিনি আরও বলে গেছেন, আমার আসার সময় হলে আমি আপনাআপনিই আবার ফিরে আসবো। তার উপ নির্বাচন পরিচালনা কালে একদিন গভীর জ্যোৎøা রাতে নৌকার ছইয়ের উপর বসে তিনি বলেন, আবুবকর সামনে এমন একদিন আসবে আমি তোমাদের মাঝখান থেকে হারিয়ে যাবো। লোকে আমাকে পাগল বলবে। আবার সময় হলে আমি ঠিকই ফিরে আসবো।
উপনির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুরোধে ও তার মুরুব্বীদের পরামর্শে তিনি ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা বেগম আফিয়া খাতুনকে বিবাহ করেন। আফিয়া খাতুন ইংরেজীতে অনার্সসহ এম.এ পাশ করার পর সবেমাত্র উক্ত কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেছিলেন। আফিয়া খাতুনের পিতার নাম সেকান্দার আলী মিয়া পেশায় তিনি স্কুল শিক্ষক। বাড়ী করিমপুর, বর্তমানে নরসিংদী জিলা।
তার দুই মেয়ে বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরত। বড় মেয়ের নাম উম্মে ষতুল ফাতেমা জহুরা (শাহীন) ও ছোট মেয়ের নাম উম্মে বতুল তাজমে তাহেরা (সায়েকা)। উভয়েই ডক্তটের ডিগ্রী প্রাপ্ত এবং বর্তমানে বিবাহিত জীবন যাপন করছেন। বড় মেয়ের স্বামী বাংলাদেশী এবং ছোট মেয়ের স্বামী আমেরিকান মুসলীম।
রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন কোন একক নেতৃত্বে সংগঠিত হয়নি। এর পেছনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের ভূমিকা ছিল। এই রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার পেছনে যাদের অগ্রণী ভূমিকা তাদের মধ্যে অন্যতম এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃৎ শামসুল হক।
উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম বিপ্লবী নায়ক, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক আজ নতুন প্রজন্মের কাছে একটি বিস্মৃত নাম। আমাদের নবলব্দ স্বাধীনতার ভিত নির্মাণে যাদের অকৃপণ দান ছিল, তাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতৃ-পুরুষ শামসুল হক। তিনি শুধু একজন রাজহনীতিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন উঁচুস্তরের চিন্তানায়ক, পন্ডিত ব্যক্তি ও একজন লেখ। তার রচিত “বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম” এক কালে দেশের বুদ্ধিজীবী মহলে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
বাংলাভাষা ও অন্যান্য দাবীতে সর্বপ্রথম যে রাজনৈতিক দলঠিত হয় তার নাম গণতান্ত্রিক যুবলীগ। আর এই যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। ১৯৪৭ সালে গণতান্তিক যুবলীগ বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবী জানায়। এ সময় তমদ্দুন মজলিশ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে প্রথম পুস্তিকা প্রকাশ করে।
পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়ার কারণে এবং মুসলিম লীগের বাংলা ভাষা বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদে নব-গঠিত ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ সারা বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন।
সাধারণ ধর্মঘট চলাকালে পিকেটিংরত অবস্থায় শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, গোলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখকে গ্রেফতার করা হয়।
সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, ছাত্রদের প্রিকেটিং এবং পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ঢাকা শহর বিক্ষোভ নগরীতে পরিণত হয়। ১২ মার্চ প্রতিবাদ সভা ও ১৩ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ১৪ মার্চ পূর্ব বাংলার বিপুল উ্দদীপনার সঙ্গে ধর্মঘট পালিত হয় এবং প্রধান মন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের বাসভবনের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ মিছিল করে ১১ মার্চের ধৃত নেতৃবৃন্দের মুক্তি ও বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী জানানো হয়।
১৫ মার্চ নাজিমুদ্দিন সাহেব সংগ্রাম পরিষদের সাথে বিনা শর্তে ৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ সময় শামসুল হক সহ আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা জেলে ছিলেন। অধ্যাপক আবুল কাশেম ও কামরুদ্দীন আহমদ জেলে গিয়ে ভাষা আন্দোলনের বৃন্দীদের চুক্তির শর্তগুলি দেখান এবং তাদের সম্মতি গ্রহণ করেন।
১৯ মার্চ কায়দে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আগমণ করেন। ২১ মার্চ বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে তিনি এক বিশাল নাগরিক সংবর্ধনায় ভাষণ দেন। পাকিস্তানের জাতির জনক তখন তার বিপুল জনপ্রিয়তা। সবার ধারণা ছিল তারা কায়দে আযমের নিকট সুবিচার পাবেন, তিনি জনতার দাবরি প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন। কিন্তু ঢাকা আগমণ করার পূর্বেই তাকে ভাষা আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দেওয়া হয়েছিল।
কায়দে আযম তার রেস কোর্সের ভাষণে ভাষা প্রসঙ্গে বলেন যে, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।” তাঁর এই ঘোষণর সাথে সাথেই শামসুল হক সর্বপ্রথম নো-নো বলে চিৎকার করে দঁড়িয়ে উঠেন এবং তার সাথে সাথে আরও কয়েকজন নো-নো বলে দাঁড়িয়ে উঠেন। সম্বর্ধনা সভা শেষে শামসুল হক ময়দানের এক পাশে একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে কায়দে আযমের এই ঘোষণার প্রতিবাদে বক্তৃতা শুরু করেন। এ সময় শত শত জনতা তার চার পাশে সমবেত হয়ে তার কথা শ্রবণ করেন।
কায়দে আযমের এই ঘোষণায় জনমনে দারুণ হতাশার সৃষ্টি করে। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে কায়দে আযম পুনরায় বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়া উচিৎ এটা আমার বিশ্বাস। তখনও সাথে সাথে নো-নো ধ্বনি উচ্চারিত হয়। তার ভাষণের প্রতিবাদ হওয়ায় তিনি এই সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। এর সমাধানের লক্ষ্যে তিনি রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে ঐ দিনই সন্ধ্যায় এক সাক্ষাতে মিলিত হন। বর্তমান প্রেসিডেন্টের বাসভবনে সাক্ষাতকার অনুষ্ঠিত হয়। এই সাক্ষাতকারের সময় কর্মপরিষদের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দীন আহমেদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মুহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহাম্মদ, অলি আহাদ নইমুদ্দিন আহ্মাদ, শামসুল আলম ও নজরুল ইসলাম।
এই সাক্ষাতকারের সময় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কায়দে আযমের নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। নানা উত্তেজনা সত্ত্বেও তাদের বিতর্ক প্রায় এক ঘণ্টা চলে।
(ভাষা আন্দোলন ঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মোস্তফা কামাল) আলোচনার এক পর্যায়ে অকুতোভয় বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ নেতা শামসুল হক কিছু বিতর্কের সুচনা করলে কায়দে আযম তাকে লক্ষ্য করে বলেন, “ুড়ঁ ধৎব ঃযব সধহ, যিড় ধষধিুং পৎবধঃবফ ঃৎড়ঁনষব ধঃ ষধযড়ৎব পড়হাবহঃরড়হ ধষংড়” বিতর্কের উত্তপ্ত পর্যায়ে জিন্নাহ সাহেব তিন তিন বার আসনে ছেড়ে আলোচনা কক্ষ পরিত্যাগ করতে উদ্যত ইন। বিতর্কের উত্তপ্ত ভাব কিছুটা প্রশমিত হলে শামসুল হক তার অনমনীয় শানিত তারুণ্য নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে ছাত্র ও তরুণদেরও বলার রয়েছে বলে যুক্তি প্রদর্শন করেন। তিনি কায়দে আযমকে লক্ষ্য করে বলেন “আপনার ডাকে দেশ স্বাধীন করার জন্য আমরা লেখাপড়াসহ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছি। সুতরাং দেশের ব্যাপারে, দেশের রাষ্ট্র ভাষার ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য রয়েছে। এভাবে কায়দে আযমের সাথে শামসুল হক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের দীর্ঘক্ষণ বিতর্ক চলে।
১৯৪৮ সালে নাজিমৃদ্দিনের সাথে সংগ্রাম পরিষদের ৭ দফা চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে ভাষা সংগ্রামীদের দাবী স্বকিার করে নেয়ার পর আন্দোলন অনেকটা শান্ত হয়ে আসে। ’৪৮ থেকে ’৫১ পর্যন্ত তেমন কোন উল্লেখযোগ্য আন্দোলন এদেশে গড়ে উঠেনি। ১১ মার্চ অনেকটা আনুষ্ঠানিক দিবসের মত পালিত হতে থাকে।
’৪৮ থেকে ৫১ এর ভেতর যে ঘটনাটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সেটি হচ্ছে টাঙ্গাইল উপনির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফল তৎকালীন পাকিস্তানের সমস্ত আনেদআলনে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। এদেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সবকিছুর মূল প্রথিত হয়ে আছে ১৯৪৯ সালের টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে শামসুল হকের বিজয়ের মেধ্যে। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে এদেশের নিপীড়িত মানুষ এক দিকে যেমন নিজেদের আত্মশক্তি সম্পর্কে সচেতন হতে পেরেছিল অন্যদিকে প্রতিপক্ষের দূর্বলতাও তাদের নিকট ধরা পড়েছিল। যে কোন বিচারে উপনির্বাচনে শামসুল হকের এ বিজয় ছিল এক ঐতিহাসিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। এই বিজয়কে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে এদেশে বিরোধী শক্তি সংগঠিত রূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং শামসুল হকই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন এবং তিনি নিজে এ দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেন। ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই দলের বিজয়কে কেন্দ্র করেই সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি আমাদের বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা।
প্রখ্যাত সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী বলেছেন, “৭১ এর ঝঃধহফরহম ঢ়ড়রহঃ হচ্ছে ’৪৯ এর উপনির্বাচন।”
১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে আসেন। ঐদিনই আওয়ামী মুসলিম লীগের উধ্যোগে ঢাকার সিরাজ উদ্দৌলা পার্কে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় শামসুল হক ও শেখ মুজিব সহ আরও অনেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীসহ অন্যান্য দাবীতে জোরালো বক্তব্য রাখেন। সভাশেষে প্রধান মন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে মিছিল নিয়ে রওনা হলে রাস্তায় পুলিশ ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। জোর করে মিছিল নিয়ে রওনা হলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিব সহ অনেকেই গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘ এক বৎসর কারাবাসের পর শামসুল হক মুক্তি লাভ করেন।
রাজনৈতিক কারণে শামছুল হকের সাথে তার স্ত্রীর সম্পর্ক বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে যখন তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ জেলখানায় বন্দী জীবন যাপন করছিলেন যখন প্রধান মন্ত্রী নুরুল আমিন চক্রান্তমূলকভাবে তার স্ত্রীকে সরকারি খরচে নিউজিল্যাণ্ডে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের সুযোগ দেন। আফিয়া খাতুন চক্রান্তের কথা চিন্তা না করে সেখানে চলে যান। নিউজিল্যাণ্ড থেকে ফেরার পর আবার তাকে সরকারী খরচে আমেরিকায় পাঠানো হয়।
এদিকে শামছুল হক ভারসাম্যহীন ও অসুস্থ্য অবস্থায় জেল খানা থেকে মুক্তি পান। এি অবস্থায় আফিয়া খাতুন আমেরিকায় বসে শামছুল হকের সাথে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করে জনৈক পাঞ্জাবী আনোয়ার হোসেন দীন এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। এই বিয়েও বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। পরে আফিয়া খাতুন শামছুল হকের দুই মেয়েসহ আমেরিকায় বসবাস করতে থাকেন। বর্তমানে তারা মাযের সাইে আছে।
শামছুল হক এখন জীবিত কি মৃত তা একমাত্র আলেমুল গায়েবই জানেন। কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন না। কেউ যমুনা নদীতে কেউ বুড়ী গংগা নদীতে নৌকায় তার মৃত্যুর কথা বলেন। অনেকের মতে তিনি দরবেশ হিসেবে ছদ্মবেশে আধ্যাত্মিক সাধনায় লিপ্ত আছেন। তাকে নাকি মাঝে মাঝে ঢাকা, চিটাগাং, সিলেট, মধুপুর, আজমীর, সিন্ধু, প্রভৃতি স্থানে মাজারের খাদের অথবা পাগলা দরবেশদের তালিম দিতে দেখা যায়। তিনি যে একজন আধ্যাত্মিক পুরুষ ছিলেন তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তার রচিত “বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম” প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ শে মার্চ। তার এ অমূল্য গ্রন্থখানা প্রকাশ করে তিনি তার অগাধ পাণ্ডিত্য, চিন্তার মোলিকত্ব, সাহিত্যিক প্রতিভা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। গ্রন্থখানিকে তিনি “গোটা বিশ্বের ক্যলাণকামী চিন্তানায়ক ও সংগ্রামী মানুষ যাঁরা” তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। এ থেকে তার সার্ব জনীনতা প্রকাশ পায়। ধর্মীয় আলোচনা শুনলেই যারা সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পান তারা হক সাহেবের এই গ্রন্থ থেকে শিক্ষ লাভ করতে পারেন। তার পরবর্তী বই “রব্বানিয়াৎ” আর প্রকাশিত হতে পারেনি।
এই মহান আধ্যাত্মিক পুরুষ ইসলাশী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে গেছেন তা অসামান্য এবং তার স্মৃতি অমর হয়ে থাকে। তদসত্বেও বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুগ যুগ আমাদের বিবেকে নাড়া বেদবেন। একুশের চেতনায় তাই শামছুল হক অমর ইতিহাস।
শামসুল হক
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক
** প্রিয় ব্যক্তিত্ব ঃ আলামা আজাদ সোবহানী, আবুল হাসিম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী।
** প্রিয় অভ্যাস ঃ সারা রাত জেগে নামাজ পড়া, ভীষণ অভিমানী, সত্য কথা বলা, সময় মেনে চলা।
** প্রিয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব ঃ হযরত মোহাম্মদ (দঃ)।
** প্রিয় পুস্তক ঃ ঞযব ঝঢ়রৎরঃ ড়ভ ওংষধস নু- স্যার সৈয়দ আমির আলী।
** প্রিয় বীরত্বপূর্ণ ত্তত্ব ঃ কার্ল মার্কস, আকরাম খাঁ, মুক্ত চিন্তা।
** প্রিয় খাবার ঃ দুধ।
** প্রিয় সখ ঃ জন সম্মুখে উপস্থিত বক্তৃতা করে মানুষকে সশিল সমাজ সচেতন করে তোলা।
** লক্ষ্য ঃ ইসলামী আদর্শে দেশে গন্ত্রায়ন এবং মজলুম ও শোষিতের মুক্তি অর্জন। নিয়মতান্ত্রিক গণ আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ গঠন। হটকারিতা পরিহার তাঁর স্বাভাবেরই একটি উজ্জ্বল অংশ ছিল।
** প্রিয় পোশাক ঃ শেরোয়ানী-পাজামা এবং জিন্নাহ ক্যাপ।
** ১৯৫৩-১৯৫৪ দ্বন্দ্ব ছিল মাওলানা ভাসানী - সোহরাওয়ার্দী। বলীর পাঠা হোল শামসুল হক। সুফ ভোগ করলেন - শেখ মুজিব।
** ১৯৭১-১৯৭৫ সাল দ্বন্দ্ব ছিলো মুশতাক-শেখ মুজিব। বলীর পাঠা হলেন কর্ণেল তাহের। সুফল ভোগ করলেন- মেজর জিয়া।
** শামসুল হকের ব্যক্তিগত ভুল ছিল ঃ-
১। করিম উকিলের মেয়ে রোকেয়াকে বিরয়ে না করা।
২। ৫৪ সালের নির্বাচন না করা।
৩। আফিয়া নামক উচ্চাভিলাসী মেয়েকে বিয়ে করা।
৪। শেখ মুজিবর এবং মওলানা ভাসানীকে বেশী বিশ্বাস করা।
** শামসুল হকের ২টি কন্যা ঃ
১) উম্মে বতুল তাজমা তাহেরা (সায়কা)
২) উম্মে বতুল ফাতিমা জহুরা (শাহীন)
** শামসুল হকের প্রকাশিত গ্রন্থ ঃ মোট ৩টি।
** শামসুল হকের অপ্রকাশিত গ্রন্থ ঃ মোট ১টি।
** শামসুল হকের প্রকৃত নরক বাস ছিল ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল। একজন মানুষও তাঁকে তখন একবিন্দু সাহায্য করেনি।
** ১৯৬৪ সালের ফেব্র“য়ারীর পর থেকে তাঁকে আর জনসম্মুখে দেখা যায়নি।
** ১৯৭৩ সালে বিন্দুবাসিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে শেখ মুজিব মরহুম শামসুল হক উচ্চারন করলে জনতার উত্তরে কিছুক্ষণ নীরব থেকে মুজিব বলেন। তিনি বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিতে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনেছেন মাত্র।
** ১৯৫৩ সালের ১৪,১৫,১৬ নভেম্বর কনভেনশনে ভাসানীকে সেন্ডেল তুলে অপমান করার অভিযোগে শামসুল হকের সদস্য পদ বাতিল ঘোষণা করা হয়।
** ১৯৫৪ সালে খঃ মুসতাক আহাম্মেদ ও জনাব শামসুল হকককে যুক্তফ্রন্ট থেকে নমিনেশন না দেয়া।
** ১৯৫৪ তে নমিনেশন না পাওয়া, পার্টি থেকে অনাস্থা, স্ত্রীর ডিভোর্স,দুই কন্যার সানিধ্য না পাওয়া, ভাই-পিতা কর্তৃক ভৎসনা, সহকর্মীদের ইত্যাদি নানা বিধ কারণে সত্যিই তিনি ১৯৫৪-৫৬ তে ভারসাম্যহীন হয়ে যান।
** ১৯৫৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর শামসুল হকের চিকিৎসার জন্য টাঙ্গাইল মাহফিলের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রী আব্দুস সালাম খানের কাছে স্মারক লিপি অগ্রাহ্য।
** পরে মন্ত্রীসভার পরিবর্তন হলে আবু হোসেন সরকার জনাব হককে লাহোর ও জুরিক মানুষিক হাসপাতালে প্রেরণ করলে চিকিৎসক গণ তাঁকে মানষিক রোগী বলতে নারাজ হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও এড্ হজরত আলী শিকদার তাঁকে দেশে নিয়ে আসেন।
** ১৯৫৬ সালে তিনি মুক্তভাবে দেশে বিচরন করেন এবং খেলাফতে রাব্বানা পার্টি নামে একটি পার্টির নামে রশিদ বই বের করে জনগণের নিকট চাঁদা তুলতে দেখা যায় এবং একই সালে তাকে বাজিতপুর হাটে লাঞ্ছিত হতে হয় এবং তাঁর রাব্বানিয়াত বই এর পান্ডুলিপি পোড়ানো হয়।
** ১৯৫২ সালের ৩১ শে জানুয়ারী সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং শামসুল হকের অগ্রণী ভূমিকা পালন।
** ২০শে ফেব্র“য়ারী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আমতলায় ছাত্রদের সিদ্ধান্ত জানানোর দায়িত্ব শামসুল হকের উপর অর্পন।
** ২১ ফেব্র“য়ারী ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
** ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি শেখ মুজিবের জেল থেকে মুক্তি এবং ২৭ ফেব্র“য়ারি জন সম্মুখে আগমন।
** ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি সোহরাওয়ার্দীর উর্দ্দুর পক্ষে উকালতি।
** ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি শামসুল হক কৃতিত্ব তাঁর প্রতিবাদ।
** ১৯৫২ সালের ৭ মার্চ শামসুল হকের নামে সচিত্র গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি।
** ১৯৫২ সালের ১৯ মার্চ শামসুল হকের গ্রেফতার বরণ।
** ১৯৫২ সালের ২৫ মার্চ তাঁর গ্রেফতারের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে।
** ১৯৫৩ সারে ১৩ ফেব্র“য়ারি জনাব শামসুলহক জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন দীর্ঘ ১১ মাস পর। উল্লেখ্য শেখ মুজিব জেল খাটেন ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত।
** জেল মুক্তির আগেই শামসুল হকের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে এবং জেল মুক্তির দিনই শেখ মুজিব কর্তৃক ডিভোর্স লেটার তাঁর হাতে পৌঁছে।
** জেল মুক্তির দুই মাস পরই ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল মুকুল সিনেমা হলে তথাকথিত ছোটাভোটির মাধ্যমে শামসুল হককে পাগল প্রমাণ সাপেক্ষ শেখ মুজিবকে লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয।
** ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আলোচনা সভায় কামরুদ্দিন ও শামসুল হকের প্রজ্ঞাদীপ্ত বিতর্ক। অন্যান্যদের মধ্যে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, মোহাম্মদ গোয়াহা, আশি আহাদ প্রমুখের অংশগ্রহণ।
** ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ বৈপবিক দৃষ্টিতে ইসলাম প্রকাশিত এবং তার ক্ষুধার লেখনির মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম হন।
** ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে ধানের আঁটি প্রতীক নিয়ে তিনি খুররম খাঁন পন্নীকে ১৮০০০ ভোটের ব্যবধানে জামানত বাজেয়াপ্ত সহ পরাজিত করে সমগ্র পাকিস্তানের রাজনীতির ‘লাইম লাইটে’ চলে আসেন এবং প্রথম বিরোধী দলীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, খন্দকার মুশতাক এবং এডঃ হজরত আলী সিকদার তার পক্ষে জনসভা করেন।
** উল্লেখ্য খুররম খানের স্ত্রী রাণী বিলকিস (বার্মিজ সুন্দরী) জনাব হকের পক্ষে নির্বাচন করেন।
** ড. আলীম আল রাজী পন্নীর পক্ষে নির্বাচন করেন।
** সরকার কর্তৃক নির্বাচন বানচাল ঘোষণা করা হলে তিনি পার্টি গঠণ করার চিন্তা মাথায় রেখে ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা বেগম আফিয়া খাতুনকে বিবাহ করেন।
** ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হয় “আওয়ামী মুসলিম লীগ” প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিÑ মওলানা আঃ হামিদ খাঁন ভাসানী।
প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকÑ জনাব শামসুল হকঃ
প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদকÑ খন্দকার মুশতাক আহমেদ (১)
প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদকÑ শেখ মুজিবর রহমান (২) জেলরত)
** লীগের প্রথম মেনিফোষ্টা রচনা করেন জনাব শামসুল হক।
** জনাব মোঃ সামসুল হকের জন্ম ঃ ১ লা ফেব্র“য়ারি ১৯২৩ সাল।
** জন্মস্থান ঃ মাতুলালয় পাঁচ এলাসি সাকৈজোজড়া।
** নিজগ্রাম ঃ মাইঠান টেউরিয়া।
** ছাত্র জীবন ঃ টেউরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এলাসিন (কাবিলাপাড়া) মাইনর স্কুল। প্রথম এলাসিন মাইনর স্কুল ও পরে কাবিলা পাড়া মাইনর স্কুল।
** সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়।
প্রবেশিকা পাশ ১৯৩৮ সাল (১৫ বৎসর)।
সা’দত কলেজের (প্রতিষ্ঠাতা) প্রথম ভি,পি, ১৯৩৯ সাল প্রথম বিভাগে আই,এ পাশ ১৯৪০ সাল।
** বি, এ অনার্স (রাষ্ট্র বিজ্ঞান) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৩ সাল লরকে লেংগে পাকিস্তান।
** ১৯৪৪-১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগ কর্মি শিবির ঢাকা অঞ্চলের প্রধান হিসেবে জনাব শামসুল হকের বিশাল দায়িত্ব পালন ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। প্রগতিশীল নেতা বিধায় পাকিস্তান হাসিলের পরপরই তিনি মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কৃত হন।
১৯৪৫ সালে টেউরিয়া স্কুল মাঠসহ টাঙ্গাইলের অন্যান্য এলাকায় শামসুল হক, মুজিব, অলি আহাদ গ্রেফতার হন।
১৯৪৮ সালৈর ১৫ মার্চ দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর “ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা চুক্তি”।
** খাজা নাজিমুদ্দিন বনাম শামসুল হক ও প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম স্বাক্ষরিত চুক্তি এবং তিন নেতা সহ অন্যান্যদের জেলমুক্তি লাভ ১৬ মার্চ।
** ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রতিবৎসর ১১ মার্চ “রাষ্ট্র ভাষা দিবস” হিসেবে পালিত হতে থাকে।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহ্ কর্তৃক উর্দ্দু রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা ক্ষং শামসুল হক, আঃ মতিন কর্তৃক ঘড় ঘড় প্রতিবাদ এবং পরে মিছিল।
** ২৪ মার্চও একই ঘটানা।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের তালিকা
সাল সভাপতি সাধারণ সম্পাদক
১৯৪৯ জনাব মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জনাব শামসুল হক
১৯৫৩ (ময়মনসিংহ) জনাব মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসীনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৫৩ জনাব মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসীনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৫৫ জনাব মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসীনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৫৭ জনাব মাওলানা আবদুল রশিদ তর্কাগীশ (ভারপ্রাপ্ত) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৬৪ জনাব মাওলানা আবদুল রশিদ তর্কাগীশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৬৬ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ
১৯৬৮ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ
১৯৭০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ
১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনাব জিল্লুর রহমান
১৯৭৪ জনাব এ,এইচ,এম কামরুজ্জামান জনাব জিল্লুর রহমান
১৯৭৬ জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ (ভারপ্রাপ্ত) বেগম সাজেদা চৌধুরী (ভারপ্রাপ্ত)
১৯৭৭ সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন (আহবায়িকা)
১৯৭৮ জনাব মালেক উকিল জনাব আব্দুর রাজ্জাক
১৯৮১ জননেত্রী শেখ হাসিনা জনাব আব্দুর রাজ্জাক
বেগম সাজেদা চৌধুরী (ভারপ্রাপ্ত) ’৮২
১৯৮৭ জননেত্রী শেখ হাসিনা বেগম সাজেদা চৌধুরী
১৯৯২ জননেত্রী শেখ হাসিনা জনাব জিল্লুর রহমান
১৯৯৭ জননেত্রী শেখ হাসিনা জনাব জিল্লুর রহমান
২০০৩ জননেত্রী শেখ হাসিনা জনাব আঃ জলিল
২০০৭ আলহাজ্ব জিল্লুর রহমান (ভারপ্রাপ্ত) সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত)