"স্বজ্ঞানে বংশ ভুলি যে করে ভুল
হয় সে জাতের কলঙ্ক না হয় বাতুল"
পরম করুনাময় আল্লার রহমতে আমাদের বংশের তালিকা তৈরি করতে পেরে আমি আনন্দিত৷ অনেকদিন থেকেই আমার আশা ছিল যে সময় পেলে আমি আমার বংশের একটা কষ্টিনামা বা ঠিকুজি তৈরি করব৷ আজ সে আশা পূর্ণ হয়েছে৷ এজন্য আল্লাহর দরগায় হাজার শুকুর গুজারি৷ তবে আকারে খুব ছোট হয়ে গেল বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন৷ তাদের আর একটা অভিযোগ অতীব সত্য এবং এটা জ্ঞানতঃ ভুল করিনি ইচ্ছা করেই বাদ দিয়েছি৷ সেটা বংশের মেয়েদের তালিকা৷ কারণ আমি জানি মেয়েরা বিয়ে হয়ে গেলে স্বামী বংশের পরিচয়েই পরিচিত হয় তখন জন্ম নেয়া বাপের বংশ পরিচয় থাকেনা৷ একটা উদাহরন তুলে ধরলে আমার বক্তব্যের যৌক্তিকতা পরিষ্কার হয়ে যাবে৷ ঘটনাক্রমে কোন মহিলাকে প্রথমেই জিজ্ঞাস করে বসি তার স্বামীর নাম, গ্রাম ও ঠিকানা৷ এক্ষেত্রে বাবার পরিচয় গৌন হয়ে দাঁড়ায়৷ তাছাড়া রেখাচিত্রে প্রকাশ বিরাট ঝামেলা ও ব্যয় সাপেক্ষ৷ আজকাল বৃথা কাজে শ'শ টাকা খরচ করি কিন্তু একটা দরকারী পজ্ঞিকা কিনি না৷ বার মাস ও তারিখ খুঁজতে গলদঘর্ম৷ আশারাখি পরবতর্ী সংস্করণে এর সংশোধন করব বাকি মাবুদ ভরসা৷
আমি হাদিসে দেখেছি, যে ব্যাক্তি নিজ বংশ ছাপিয়ে খানদানি বংশের টাইটেল লাগায় , এটা মস্ত বড় গুনার কাজ৷ ধনে জনে সহায় সম্পদে বড় হয়েছি বলে নিজ বংশ ভুলে যাওয়া বংশেরই কলঙ্ক৷ তাই দুটি ছত্র আমি লিখেছি ঃ "স্বজ্ঞানে বংশ ভুলি যে করে ভুল-হয় সে জাতের কলঙ্ক না হয় বাতুল৷ "
গজনীর বাদশা সুলতান মাহমুদ মহাকবি ফেরদৌসীকে তার বংশের ইতিহাস ফার্সি ছন্দাকারে ইতিহাস লেখার অনুরোধ করেছিলেন৷ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রতিটি ছত্রের জন্য একটা করে সোনার মোহর দেবেন৷ যখন শাহনামা গ্রন্থটি রচনা করে দিতে গেলেন তখন সভাকবিদের কুপরামর্শে তার ওয়াদা ভঙ্গ করে ষাট হাজার রুপার মোহর দিতে গেলেন৷ তা মহাকবি ফেরদৌসি প্রত্যাখ্যান করে রাতের অন্ধকারে সুলতান মাহমুদের নামাজের মসজিদে দু-ছত্র কবিতা লিখে গেলেন - তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল ঃ
"যদি তুমি নিম তলে ঘৃতমধু করোহ সিঞ্চন
তবুও জাতের খাছিলত যাবেনা কখন৷"
নিম বৃক্ষের তলদেশে ঘৃত মধু অমৃত সাধনা সিঞ্চন কর, তবুও জাতের তিতা স্বাভাব কখনও দূর হবেনা৷ ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদকে কৃতদাশ সবুত্তগীনের পুত্র বলে উল্লেখ করেছিলেন৷ আসলেও সবুত্তগীন কৃতদাশ ছিলেন৷ প্রতিভাবলে তার মালিকের কোন পরগনাদার হয়েছিলেন এবং এতেই সুলতান মাহমুদ গজনীর প্রতাপশালী সম্রাট হয়েছিলেন৷ তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন কবিতার ছত্রে আসলে নীচ বংশে জন্ম সুলতান মাহমুদের৷ তাই তিনি ওয়াাদা ভঙ্গ করলেন৷ উচু বংশে জন্ম হলে মন মেজাজ উচু হত৷ ওয়াদা ভঙ্গ করতেন না৷ যাক এমনও হাজারও উদাহারন আছে দেওয়া যায়৷ আসলে এ বই খানিতে আমাদের সাত প্রস্থান বা স্তবক/ স্তর চলছে৷ আমাদের স্তরের আমার কোন ভাই নাতির ঘরের পুতি এবং পুতির ঘরের নাতি দেখেছেন৷ যেমন ময়না মেম্বাররা আমাদের বংশ তালিকা অনুপাতে নাতি কিন্তু আমরা চাচাত ভাই হিসেবে অভিহিত করে থাকি৷ কারণ এটা উপরেরই সৃষ্টি৷ এ বইটি রচনা করতে অনেকেরই সক্রিয় সহযোগিতা পেয়েছি তাদের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় তছের হাজীর কথা৷ সে বংশের তালিকা হাতে লিখিয়ে রেখে দিয়েছিল৷ পরে আমি উদ্যোগ নিলে সেটা দিয়ে দেয়৷ সে আবার সংগ্রহ করেছিল আমাদের চাচাতো ভাই কুরপান সরকারের কাছ থেকে৷ স্নেহধন্য ভাতিজা রফিকুল আমাকে অনেকের সমন্ধে তত্ব ও তথ্য দিয়েছে৷ এজন্য কুরপান সরকার, তছের হাজীর সঙ্গে তার কাছেও আমি ঋণ স্বীকার করছি৷ আমি ঋণ স্বীকার করছি যারা আমাকে দিক নির্দেশনা দিয়ে সাহায্য করেছে তাদের কাছে৷ সর্বশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি আমার আদরের বড় ছেলে নূর কুতুবুল আলম পলাশের কাছে৷ রূপসী কম্পিউটার থেকে কম্পোজ করে পান্ডুলিপি তৈরি করে দিয়েছে কষ্ট স্বীকার করে৷ আমি তার কর্মময় দীর্ঘায়ু কামনা করি৷ এ বইটি তৈরিতে আরও একটি ব্যক্তি সাহায্য করেছে - আমাদের বংশের প্রবীন ব্যক্তি আদম ব্যাপারী৷ তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে খাট করবো না৷ সর্বশেষ এ বই পাঠ করে আমার বংশের লোকেরা যদি তাদের পূর্ব পূরুষদের জানতে পারে ও বংশের ইজ্জত রক্ষা করে চলে তবেই আমার শ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমি মনে করবো৷
আল্লাহ হাফেজ৷
হাল ঠিকানা ঃ
মোঃ নূরুল ইসলাম মাষ্টার
২১/১/ই, মুসলিম পাড়া, আকুর-টাকুর, টাংগাইল৷
রূপসী যাত্রা, হিংগানগর, টাংগাইল৷
হাজী বংশের ইতিহাস
পূর্ব ইতিহাস ঃ রূপসীযাত্রা গ্রামের হাজী বংশের ইতিহাস অতি পুরাণ৷ গ্রামের তিন চতুর্থাংশের মালিক মোকতার এ বংশের লোক৷ বর্তমান নিরীক্ষা তাই প্রমাণ করে৷ এখানে বাসরত ছয়টি বংশের মধ্যে এ বংশই বৃহত্তম৷ বংশগুলো হল গ্রামের উত্তর প্রান্তে শিকদার বংশ, তার দক্ষিণ পশ্চিমাংশে ফকির বংশ, এ বংশের গা ঘেঁষে সড়কের পূর্ব দিকে বেপারী বংশ, তার দক্ষিণে খাঁ এবং তারপর হাজী বংশ৷ খাঁ এবং হাজী বংশের উত্পত্তি এক ব্যক্তি থেকে, তা বংশ নামায় পৃথক দেখান হলেও জন্মস্থল এক জায়গা থেকে৷ বিশা ব্যাপারী, কলিম উদ্দিন, রহিমুদ্দিনের বংশ ছাড়াও আরও কিছু গোষ্ঠি আছে তা অতি নগণ্য৷ লোক প্রবাদে আছে " বহু সন্তান দারিদ্রের লক্ষণ৷ " এ ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নাই৷ মুরবি্বদের কাছে শোনা এ পরিবার পৃথক হওয়ার সময় আঠার ভাগ হয়েছিল৷ এ বংশ আগে একান্নভূক্ত পরিবার ছিল৷ পৃথক পূর্ব সময়ে ডেক, ডেকছি, কড়াইতে ডাল-ভাত পাক হত৷ বেগুন বা আলু জাতীয় ভর্তা ঢেঁকিতে পিষে করা হত৷ সকালে এক কোলা মুড়ি-গুড় নাস্তাা হিসাবে পরিবেশন করা হত৷ প্রায় শতাধিক পাত পড়ত দুপুরের খাবারের সময়৷ হঠাত্ করে কোন অপরিচিত লোক কিংবা আত্মীয় স্বজন দেখে মনে করতেন হয়ত কোন অনুষ্ঠানের ভোজন ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ আদতে এ বংশের লোকজন সবাই এক কাতারে মধ্যাহ্ন ভোজে আপ্যায়িত হতেন৷
গোত্র প্রধানের আদেশ নির্দেশ প্রতিপালন করতে হত৷ এর ব্যতিক্রম হলে ভর্ত্সনা বা শারীরিক শাস্তির জন্যও প্রস্তুত থাকতে হত৷ কখনও কোন বৌ ঝি বাপ- ভাইয়ের বাড়ি গেলে তাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যেতে হত৷ কাউকে আনতে গিয়ে ডুলি পাল্কি ফেরত এলে তার বাপ- ভাইয়েরা এনে রেখে না গেলে এ বংশের কেউ আনতে যেতেন না৷ তবে উত্সবাদিতে এর ব্যতিক্রম দেখা যেত৷ কোন ছেলে শষ্য কর্তন মৌসুমে শ্বশুরালয়ে যেতে নিষেধ ছিল৷ অবশ্য জরুরি সময়ে এর শিথিলতা দেখা গেছে৷
পারিবারিক ঝগড়া ফ্যাসাদ কিংবা মনোমালিন্য যখনই দেখা যেত পরিবার প্রধান এর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন৷ গোত্র প্রধানকে পরিবারের সন্মতিতেই হতে হত এবং প্রতিশ্রুতি দিতে হত প্রত্যেকেই বয়স বিচারে তাকে মানতে হবে ৷ সবার সন্মতিতে এ কার্যটি হত তাই ক্ষোভের কোন কারণ ঘটত না৷ পরিবার প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল অপরিসীম৷ প্রতিদিন প্রতি মুহুূর্তে সবার খবর তাকে রাখতে হত৷ তার চোখ রাখতে হত সবার উপর সমভাবে৷ ক্ষমতা প্রয়োগ সমভাবে চলত৷ বিশেষ করে গৃহাভ্যন্তরে নিজ স্ত্রীর উপর কঠোর থাকত৷ স্বামী গোত্র প্রধান, তার দাপট নারীদের উপর চলবে অন্যায় আচরণ হতে তাঁকে লাগাম টেনে রাখতে হত৷ তাকে সাবধান করে দেয়া হত যেন সে মেয়ে মহলে 'এক চোখে তেল আর এক চোখে লবণ' প্রয়োগ না করে৷ এ রকম হলে শারীরিক মানসিক দু'রকম শাস্তি দেয়া হত৷ মুরুবি্বদের কাছে প্রবাদ শুনেছি ঃ
'অবিচারে রাজ্য নষ্ট হয়'
নাও নষ্ট গুদুরা ঘাটে,
পুরুষ নষ্ট হাট বাজারে
নারী নষ্ট বাপের বাটে৷"
সর্বপেক্ষা জঘন্য শাষক সে ব্যাক্তি যে প্রবল প্রতিপক্ষের তোয়াজ করে৷ পরিবারত রাষ্ট্রের ছোট সংস্করণ মাত্র৷ রাষ্ট্র যদি ভালভাবে চালাতে চাও তবে নিজ পরিবার ভালভাবে চালাও৷ যে তার পরিবার সুন্দর ভাবে চালাতে পারে তাকে রাষ্ট্র চালাতে দিলেও ভালভাবে চালাতে পারবে৷ এদের মধ্যে একটা জিনিষ খুব প্রশংসনীয় ছিল৷ তা হল- কোন লোক যদি তার স্ত্রীর উপর হাত তুলতো তবে তার অব্যহতি ছিলনা ৷ তাকে শারীরিক শাস্তি পেতেই হত৷ আমি নিজ চোখে তা দেখেছি৷ আমার চাচী মনির উদ্দিন ব্যপারীর স্ত্রী আপন কিংবা চাচাত যাই হোক বৌঝি দারুণ ভালবাসতেন৷ আমার এক দিনের দেখা ঘটনা- চাচাত ভাই আদম বেপারী কি এক কারণে তার স্ত্রীকে মারধোর করেছেন৷ এ কথা আমার চাচীর কানে গিয়ে পৌঁছেছে৷ চাচী বুড়ো মানুষ৷ যুবক ছেলেদের তো দৌড়িয়ে ধরে মারতে পারেন না৷ কৌশল করে চাচী তালে আছেন আদম ভাইয়ের খোঁজে৷ ভাই আমার কু কর্মটি করে বাড়ি আসেন আর যান ৷ বাইরের কাজ কাম করেন চুপে৷ লোক চক্ষুর অন্তরালেই বেশি সময় কাটে৷ একদিন ভোর বেলায় দেখলাম চাচী খেড় নাড়ার কাড়াইল নিয়ে ভাইজানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ দরজা খূলে যেই বের হয়েছেন অমনি বংশদন্ড দিয়ে পিঠে দু'ঘা আচ্ছা করে বসালেন, ভাইজান আমার 'ওরে বাবারে, মারে' বলে দৌড়িয়ে বাঁচলেন৷
আমার দাদার আর এক কাহিনী শুনেছি ৷ আগে চাল ভাংগানের মেশিন ছিলনা৷ বৌঝিরাই চাল ভানতো ঢেঁকিতে৷ বৌঝি দের রাত ৩/৪ টার সময় ঘুম থেকে উঠে ধান ভেনে চাল করতে হত৷ এমনি একদিন আমার দাদী বৌঝিদের উঠিয়ে রাত ৩/৪ টার দিকে ঢেঁকিতে ধান দিয়ে নিজেও টুকিটাকি কাজ করছেন৷ সকাল পেরিয়ে ৯/১০ টা বেজে গেছে৷ তবুও দাদী তার বৌদের খাবারের কথা নেই৷ ধান ভান চাল কর৷ এই মনোভাব দাদী সাবের৷ এক বৌয়ের খুব ক্ষুধা পেয়েছে৷ ফাঁকে চুপকরে বৌ বুড়ির ঘরের কোলা থেকে কিছু মুড়ি আঁচলে নিয়ে আড়ালে চিবুচ্ছে৷ বুড়ি বৌকে ঢেঁকির পাড়ে না দেখে তার সন্দেহ হয়েছে৷ তাই তালাশ করতে করতে ধরে৷ আর কোথায় যাবা৷ দাদা জানের কাছে নালিশ৷ দাদা মিয়া আমার ঘটনা বুঝতে পেরেছেন৷ তাই বুড়িকে কাছে ডেকে এনে তাদেরকে সকালের নাস্তাপানি খেতে দিয়েছেন কিনা জিজ্ঞাস করলে বুড়ির জবাব নেই৷ আর কোথায় যাবা৷ হাতের লাঠি দিয়ে বুড়িকে গণ ধোলাই দিয়েছেন এই বলে যে, রাতভর ধান ভেনে সকাল ১০ টা বাজিয়ে দিয়েছ৷ তাদের ক্ষুধা লেগেছে৷ তারা চুরি করে খাবে না ত কি করবে? আক্কেল থাকা চাই যে ক্ষুধা লাগলে খেতে হয়৷ যাই হোক, এমনি অনেক ছোট খাটো ঘটনাই ঘটে গেছে এ পরিবারে৷ এখন সেই গোত্র শাসন নেই৷ সবাই বেশি বুঝে৷ কারও মাতাব্বরি কেউ রাখেনা৷ কারে মেরে কে খাবে, কারে দাবিয়ে কে উপরে উঠবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত সবাই৷ সে খিলাফতও নেই - সে খলিফা ওমরও (রাঃ) নেই৷ যার যার মত সেই৷ পরিণামে হচ্ছে কি ? আরও নিচে - আরও নিচে নেমে গেছি৷ কবিতায় পড়েছি ঃ
" যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
সহস্র শৗবাল দাম বাঁধি আসি তারে৷
যে জাতি জীবন হারা অচল অসার
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার৷"
কথায় বলে " শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড "৷ এই বোধ বংশের দু একজন ছাড়া বাকি আর কারও আছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না৷ চোখের সামনে দেখেও শিখছি না৷ ছেলে-মেয়েদের উপযুক্ত করে তুলছি না৷ ইদানিং একটা প্রবনতা বেশি দেখা যাচ্ছে৷ তা হলো বিদেশ গমন৷ এটা খুব একটা খারাপ বলছি না৷ কিন্তু সাথে যদি উচ্চ শিক্ষা কিংবা টেকনিক্যাল টেনিং তাকতো তবে আরও ভাল হত৷ পয়সা খরচা করে বিদেশ গিয়ে ভাল করতে পারত৷ কিন্তু সুবিধা করতে পারছে না৷ যে পয়সা খরচা করে বিদেশ যাচ্ছে দু থেকে তিন বত্সর লাগছে খরচার টাকা উঠাতে৷ মেয়াদ শেষে পাঁচ বছরে কিই বা আনতে পারে৷ অনেককে দেখেছি বিদেশ থেকে যা এনেছে তা দিয়ে দেশে একটা কিছু করছে৷ আবার অনেকের ছালাও গেছে আমও গেছে৷ লাভে মূলে সব হারিয়ে দিন হীন জীবন যাপন করছে৷ আবার বিদেশের বাড়িতে কারও হদিস্ ও মিলছে না৷ লা- পাতা গায়েব৷ চিঠি দিচ্ছে না৷ টাকা পাঠাচ্ছে না, ফোন করছে না৷ এমন কি দেশের লোকের কাছে খবরও দিচ্ছে না৷ বেঁচে আছে কি মরে গেছে তাও জানার উপায় নেই৷ দোয়া করি, আল্লাহ তাদেরকে মা বাব্বার বুকে ফিরিয়ে দিক, সহি সালামতে দেশে ফিরে আসুক৷
এ গোত্রের অনেকে ভিন্ন গ্রামেও বসতি গেড়েছে৷ অধিকাংশই ঘর জামাতা হিসেবে চলে গেছে৷ সেখানেই স্থায়ীভাবে বসত বাস্তবি করছে৷ গ্রামের বাড়ি ঘর জমি সম্পত্তি বিক্রি করে চির দিনের একেবারেই মত চলে গেছে আর বাকি জীবনে ফেরার সম্ভবনা নেই ৷ এদের মধ্যে নাম উল্লেখ করছি৷
আলহাজ আলিমুদ্দিন ঃ আলিমুদ্দিন হাজী ইনি নিজামুদ্দিন হাজীর আগ পক্ষের বড় ছেলে৷ প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব একটা ছিল না৷ সংসার এবং ব্যবসা বানিজ্যের জন্য যে শিক্ষার দরকার তা ছিল৷নদীমাতৃক দেশে ব্যবসা বানিজ্যের জন্য বেশ কয়েকটা বড় নৌকা ছিল৷ জমিতম্পত্তি যা ছিল তা এলাকায় বড় একজন জোতদারের ভূমিকায় বাস করতেন৷ ছিলিমপূরে মহাজনী কারবারের জন্য বিরাট গোলাঘর ছিল৷ তিনি আজীবন ছিলিমপূর জামে মস্জিদের খাদেম ছিলেন৷
মৌলানা আব্দুস ছামাদ ঃ ইনি মৌলানা নছিমুদ্দিন সাহেবের সুযোগ্য বড় সন্তান ছিলেন৷ তিনি একাধারে ইসলামী শিক্ষায় যেমন উন্নত ছিলেন তেমনি আধুনিক শিক্ষাও শিক্ষিত ছিলেন৷ তিনি সারা জীবন বিভিন্ন হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার পর ছিলিমপূর হাইস্কুলের একজন প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক হিসাবে এবং শেষ জীবনে প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন৷ এখান থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন এবং বাকি জীবন নিজ গৃহেই কাটান ৷ তিনি প্রায়
৮০ বত্সর বয়সে বেহেশত বাসী হন৷ তিনি ছিলেন ছিলিমপূর জামে মসজিদের আজীবন এমাম ৷ স্থানীয় ঈদগাঁ ময়দানের দুই ঈদের ইমামতি করতেন৷ আমি তাঁকে আরবি, উর্দু , ফারসি, ইংরেজী, বাংলা ও অংক শাস্ত্রে সুপন্ডিত হিসেবে পেয়েছি৷ আমার একটি ঘটনা খুব মনে পড়ে৷ আমরা দু জনে তখন স্বহস্তে প্রতিষ্ঠিত ছিলিমপূর হাইস্কুলের শিক্ষক৷ সকাল ৯ টার দিকে নদীতে উভয়েই গোছল করতে গিয়েছি৷ আমি তার আগে এক বুক পানিতে নেমে গোছল করছি৷ এমন সময় দু'গাদা বড় আকারের কোরআন হাদীসের মতো বান্ডিল ভেসে আসছে৷ আমি দেখা মাত্র মৌলানা আব্দুস ছামাদ সাহেবকে আহ্বাবান করলাম ও গুলো পড়ে দেখতে৷ তিনি সত্বর এসে প্রথম দর্শনেই এক প্রকার বিজয় উল্লাস করে বল্লেন যে ওটা বিখ্যাত কিতাব ফতোয়ায়ে আলমগীরি এবং দ্বিতীয় কেতাবের গাদা আইন-ই-আকবরী৷ এ সবই ফার্সিতে লিখিত৷ তিনি ওগুলো যথারীতি যত্ন করে বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন৷ আমি দেখেছি তিনি নবম ও দ্বশম শ্রেনীতে ইংরেজী , আংক ও আরবি আবলীলাক্রমে পড়াতে পাড়তেন৷ আগে পাটি গণিত দশম শ্রেনী পর্যন্ত অবশ্য পাঠ্য ছিল৷ আমি নিজেও এক সময় নবম ও দশম শ্রেনীতে তার কাছে পড়তাম ৷ তিনি ইসলামী শাস্ত্রে বহুত জ্ঞান রাখতেন৷ যে কোন ফতোয়া তিনি পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারতেন৷ কিন্তু বক্তা হিসেবে তুখোর ছিলেন না৷ তাঁর এলেম ছিল প্রচুর কিন্তু হেলেম ছিল অল্প৷ তাই ছয়টি বিষয়ে পন্ডিত হয়েও নাম কুড়াতে পারেন নি৷
আব্দুল বেপারী ঃ দীর্ঘদেহী সুপুরুষ ছিলেন৷ গায়ের রং ফর্সা৷ শীত কাল এলে তার সমস্ত গায়ের চাম রসুনের এড়িয়ে যেত৷ ধারালো ছুরি কাঁচি দিয়ে চেঁচে ফেলে দিতে হত৷ তিনি সৌখিন পাকি শিকারি ছিলেন৷ এ জন্য দোনালা বন্দুক ব্যবহার করতেন৷ কুটির শিল্পের কাজে নিপুন ছিলেন৷
নজর বেপারী ঃ হালকা পাতলা হলুদ বর্নের চেহারার অধিকারী ছিলেন৷ সুর করে কোরান পাঠ সবাইকে মুগ্দ করত৷ মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন৷ তার রসোত্তীর্ন কথা ও ঘটনা অনেকের কাছেই শোনা শোনা যায়৷ যেমন :-
১৷ বুঝলি না ফেলি
বুঝবি দিন গেলে৷
২৷ চুল ছিড়বার পারিনা টাইনা পরান মরি৷
৩৷ ফুটার বেটা ফুটা---বাড়িতে যাইয়া ফুটা৷
নয়ান বেপারী ঃ নিজামুদ্দিন হাজীর সর্ব কনিষ্ঠপুত্র এবং নয় পুত্র সন্তানের জনক৷ প্রথম জীবনে তিনি লেখা পড়ার সুযোগ পান নাই৷ এজন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করতেন৷ তিনি পাট, ধান, চাল ইত্যাদির ব্যবসা করতেন৷ ইজারদার হিসাবে তিনি সমাজে আত্মপ্রকাশ করেন৷ পরবর্তি সময়ে ব্যবসা এবং ইজারদার হিসাবে যথেষ্ট সফলতা অর্জণ করেন৷ তিনি বিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় কোনদিন মাড়াননি তথাপিও আপন বুদ্ধি বলে ব্যাপক জনগণের সঙ্গে মিশেছেন৷ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বাস্তব ব্যক্তি ছিলেন তিনি৷ শিক্ষিত অশিক্ষত ও বুদ্ধিজীবী যে কোন সমাজে কথা বলার ভঙ্গি ও কৌশল ভাল ভাবে আয়ত্ত্ব করা ছিল৷ বিশাল দেহধারী মানানসই সুপুরুষ ছিলেন৷ তার সময় সমস্ত রূপসীযাত্রা গ্রাম এক ছিল৷ তিনি এই একতার মূল চাবিকাঠি ছিলেন৷ হাজার বিপদে ও কঠিন সমস্যায় বীর পুরুষের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি তাকে৷ বাস্তবতার সাথে মিল রেখে তিনি কাজ করতেন বলেই সফলতা তাঁর হাতে ধরা দিত৷ ১০/২০ টা গ্রামের মানুষ তাঁর মাতাব্বরী ও নেতৃত্ব মানতেন৷ বয়সের শেষ প্রান্তে আসার আগেই তিনি হঠাত্ করেই ইন্তেকাল করেন৷
মোন্তাজ বেপারী ঃ আলীমুদ্দিন হাজীর বড় ছেলে৷ বড় ধনী ও এলাকায় বিশিষ্ট মাতাব্বর হিসাবে পরিচিত ছিলেন৷ বিশাল দেহধারী যে কোন মজলিসে গেলে মানত৷ বুদ্ধি বিবেচনায় তীক্ষতার পরিচয় দিতেন৷ জোতদারী এবং ব্যবসায়ে জন্য বিরাট নৌকা ছিল তিনি চারটা ৷ বাড়িতে মাদ্রাসা স্থাপন করে ছেলেমেয়েদের ধর্মিও শিক্ষার সু ব্যাবস্থা করেছিলেন৷
আমিরুদ্দিন সরকার ঃ তিনি ছিলেন সন্তোষ জাহ্নবী হাইস্কুলের বিট্রিশ সরকারের আমলের ছাত্র৷ অসুস্থ্যতা হেতু মেট্রিক পরীক্ষা দিতে পারেননি৷ তাই লেখাপড়া বাদ দিয়ে ব্যবসায়ে মন দেন৷ এলাকার বহু হিন্দু মুছলমান ছেলে তার কাছে লেখাপড়া করত৷
মফেজ মুন্সি ঃ- হালকা পাতলা দীর্ঘদেহী দুধে আলতা চেহারার অধিকারী ছিলেন৷ ইমানদার মোমিন মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করতেন৷
আছিম উদ্দিন সরকার ঃ তার হাতের লেখা ঝক ঝকে ও তকতকে ছিল৷ এতো সুন্দর লেখা আজও কোন শিক্ষত লোকের খুব কমই আছে৷ তিনি ব্রিটিশ আমলের সন্তেষ জাহ্নবী হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন৷
কছিমুদ্দিন বেপারী ঃ মনিরুদ্দিন বেপারির বড় ছেলে৷ বেপার বাণিজ্য করে অনেক অর্থের মালিক হয়েছিলেন৷ তিনি দরাজ কন্ঠের আধিকারী ছিলেন৷ শিক্ষত না হয়েও শিক্ষা বিস্তারের জন্য তাঁর অনেক অবদান আছে৷ তার মাতব্বুরি বুদ্ধি প্রশংসার দাবি রাখে৷ তিনি কখনও নিচু গলায় কথা বলতে পারতেন না৷ উপস্থিত বুদ্ধিতে অনেকেই তাঁর কাছে হার মানতেন৷ বড় নৌকার বেপারী ও ইজারদারী তার পেশা ছিল৷
হজরত বেপারী ঃ- তাকে আরজ বেপারী বলেই চিনত৷ মাছ ধরা বা মাছ মারার কাজে বিশেষ দক্ষ ছিলেন৷ বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের অধিকারী ঝিলেন৷ চোখের জ্যোতি এবং মুখের দাঁত আমৃতু্য অক্ষুন্ন ছিল৷
কাজিমুদ্দিন ঃ সে ছিল আছিমুদ্দিন সরকারের মেঝ ছেলে৷ তার পাঁচ ছেলে মেয়ে সমপরিমান ছিল৷ এখানে থাকতেই মেয়েদের বিয়ে সাদী দিয়েছিল৷ আমার এ চাচাতো ভাইটির স্বাভাব ছিলো স্ত্রৈন৷ স্ত্রী বুদ্ধি সম্পন্ন বৌয়ের একান্ত আঁচল প্রভাব ৷ তার কথা ছাড়া চলত না৷ মোটামুটি ভাইটি আমার ভালই চলতো৷ ভাবীর কথায় কি দূর্মতি ধরল শ্বুশুর বাড়ি দেলদুয়ার থানাধীন কুইচতারা গ্রামে চলে যাবে৷ শেষ পর্যন্ত জমি জমা ঘর দোর বিক্রি করে স্বপরিবারে চলে গেল৷ এতে ঘৃতাহুতি যুগিয়েছিল লেখা-পড়া জানা ছেলে আইন উদ্দিন৷ এই ছেলে ভাই ভাবীর একটু আদরের ছিল৷ তার অনুপ্রেরণাতে এ গ্রামের মাটি চিরতরে ত্যাগ করে চলে গেল৷ বেশ কয়েক বছর আগে তারা উভয়ে জান্নাতবাসী হয়েছে শুনেছি৷ বড় ছেলে বাহর সিলেট গিয়ে বাড়ি করার পর মারা যায়৷ অন্যান্যদের মধ্যে আইনউদ্দিন সোনালিয়া-করোটিয়া, যহুর মঙ্গোলহোড় শ্বশুরবাড়ি আস্থায়ী ভাবে বাস করছে৷ কাজিমুদ্দিন ভাই ও ভাবী তাদের সমস্ত সম্পত্তি চোট ছেলে সাইজুকে লিখে দিয়ে গেছে৷
জসম উদ্দিন বেপারী ঃ জশমভাই ছিল মনিরুদ্দিন বেপারীর ছেলে৷ পাকুল্লা বিয়ে করে সেখানেই শেষে অবস্থান করত৷ তার একছেলে নাম-আকালী৷ এক সময় আকালী পুত্রহীন আবস্থায় মারা গেলে বংশের শেষ চিহ্ন মুছে যায়৷
সোহরাব ঃ ভাই, মোফেজ উদ্দিন মুন্সীর ছোট ছেলে ৷ এস, এস, সি, পাশ করার পর তার ভাই আলফাজ মাস্টারের সহায়তায় দেলদুয়ারে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি পায় এবং বলজান রূপসী বিয়ে করে ৷ বর্তমানে সেখানেই পরিজন নিয়ে জীবন-যাপন করছে৷ তারও এ গ্রামে ফিরে আসা সুদূর পরাহত৷ এক ছেলে শিপুকে নিয়ে বেশ আরামেই দিন গুজরান করছে৷
দুখি বা জাফু বেপারীর উত্তরসূরিদের বর্তমান অবস্থান ঃ আগেই বলেছি গ্রামের অধিকাংশ স্থান জুড়েই হাজী বংশের অবস্থান৷ জালাল সরকারের বাড়ির দক্ষিণের কয়েকটি বাড়ি ছাড়া গ্রামের শেষ প্রান্ত দক্ষিণ স্থান জুড়ে এরা বাস করছে৷ কেউ অর্থবিত্তে উপরে উঠে গেছে৷ আবার কেউ দারিদ্রের শেষ সীমায় কায়ক্লশে দিন যাপন করে আসছে৷ বর্তমানে বাদশা সরকারের ছেলেরা ও ভাতিজারা মধ্যবিত্তের উচ্চ পর্যয়ে অবস্থান করছে৷ মনে হয় এদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চ পর্যয়ে উনি্নত হতে পারে৷ এরপর কছিম বেপারীর বড় ছেলে মাইন উদ্দিনের ছেলেরা কায়কারবারে প্রায় উচ্চ বিত্তের সীমায় ছুই ছুই করছে৷
এলাকার মায়মাতাব্বরির ক্ষেত্রে এ বংশের যথেষ্ট সুনাম অতীতেও ছিল বর্তমানেও আছে৷ কিন্তু তুলনামূলক ভাবে একটু নিষ্প্রভ৷ ছোট-বড় সামাজিক ক্ষেত্রে বিশিষ্ট আবস্থান রাখতে সক্ষম হয়েছে৷ উন্নয়ন ক্রিয়া কান্ডে এ বংশের তুলনা বিরল৷ ধমর্ীয় প্রতিষ্ঠান গড়া এবং রক্ষাকরার বেপারে এরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে৷ মোন্তাজ বেপারীর বাড়িতে ছিল ফোরকানিয়া মাদ্রাসা৷ এ মাদ্রাসায় ফজরের নামাজের পর-পরই শোনা যেতো ছেলেমেয়েদের কোরআন পাঠের সুমধুর আওয়াজ৷ মওলানা সাহেবের উচ্চ কন্ঠে শাসন ত্রাসন আর পাঠ নির্দেশ৷ এর ফলে দেখা যেত মেয়েরা তো বটেই এ বংশের ছেলেরাও নামাজ কালাম ও ইসলামের জ্ঞান আয়ত্ত্বে পারদশর্ী৷ হাজী বংশের চলাফেরা নামায - রোজা, যাকাত ও ইসলামি আকিদা অনুযায়ী জীবন যাপন করত৷ এ বংশের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন মৌলানা নছিম উদ্দিন৷ তিনি ভারত বিখ্যাত আলেম মৌলানা ইসমাইল হোসেন সিরাজির মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন৷ কোরআন হাদীস ফিকাহ্ , কেয়াছ প্রভৃতি ইসলামী শাস্ত্রে বিজ্ঞ পন্ডিত ছিলেন৷ তাঁর কন্ঠস্বর খুব মিষ্টি ছিল৷ তিনি যে মহিলাকে স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা দিয়েছিলেন তিনিও কোরআনে হাফেজ ছিলেন৷ তিনি তাঁর কোরআন পাঠ ও কন্ঠস্বর শ্রবণ করেই বিবাহ করেছিলেন৷
আছাব উদ্দিন মাষ্টার ঃ ইনি এনট্রান্স পরীক্ষার পর পরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে পাকুল্লার চরে চলে যান এবং সেখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন৷ এরপর স্থানীয় ছিলিমপূর বাজারে থান কাপড়ের ব্যবসায় অবতীর্ণ হন৷ ব্যবসা করে বিরাট অর্থ-বিত্তের মালিক হন৷ পরে নানাবিধ কারণে ব্যবসায়ে ভাটা পড়ে৷ পরিশেষে এ কারবার বাদ দিয়ে বেকার হয়ে পড়েন৷ তিনি ছিলিমপূর বাজারের ডাকসাইটে সচিব গিরি করেন৷ পাঁচ ছেলে দুই কন্যা সন্তানের জনক৷ আব্দুস ছামাদ লেবু কোরআনে হাফেজ৷ আবার তার দুই ছেলে হাফেজ হতে চলেছে৷ মেয়ে সাজনের এক ছেলেও কোরআনে হাফেজ ও চাকরিরত৷ পরিতাপের বিষয় আছাব মাষ্টারের বড় ছেলে শাজাহান ও ছোট তারা মিয়া মস্তিস্ক বিকৃতি রোগে ভুগছে৷ তারা ইতোপূর্বেই মারা গেছে৷ ফিরোজ বেশ কয়েক বছর সৌদি আরবে লাপাত্তা আছে ৷ সিদ্দিক হেসেন জামালপূর ফটোমেকানিজম ব্যবসায় রত৷ তার এক ছেলেও ঢাকাতে হাফিজি পড়ছে৷ আছাব মাষ্টারের ধর্ম ভীরু সত্রী শামসুর নাহার বার্ধক্যের শেষ কোঠায়৷ এ বয়সেও বাড়িতে একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করেন৷ আমি একবার কিছু অর্থের যোগান দিয়ে মাদ্রাসাটিকে টিনের ঘরে পরিণত করে দেই৷
সমেজ উদ্দিন সরকার ঃ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে জীবিকার তাগিদে ব্যবসায়ে অবতীর্ণ হন৷ এই নদী বহুল বাংলায় এক সময় বড় নৌকার মালিক ছিলেন৷ তাছাড়া হাটকোল ইজারাদার হিসেবে জীবিকা বেছে নেন৷ আচার আচরণ খুবই মধুর ছিল৷ তবে রেগে গেলে ভীষণ মূর্তি ধারণ করতেন৷ এক মাত্র ছেলে আব্দুর রাজ্জাকে রেখে পরিণত বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন৷
আব্দুর রাজ্জাক ঃ আপরিণত বয়সে মৃতু্য মূখে পতিত হন৷ তার দুই ছেলে হুমায়ন ও জুয়েল৷ দু জনেই বিবাহিত৷ এলাকায় একজন ভাল খেলোয়াড় ও সংস্কৃতি মনা ব্যাক্তিত্ব ছিলেন৷ ফুটবল খেলা, গ্রাম্য ঘাটু গান ও যাত্রা গানে তার এক সময় কোন জুটি ছিলনা৷ পকিস্তান জাতীয় খেলায় সুয়োগ পেয়েও বাবার নির্দেশে তা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ জীবনে বহু যাত্রা গানে অংশ নিয়ে এলাকায় কিংবদনী্তর পূরুষে পরিনত হয়েছিলেন৷ তার অকাল মৃত্যু বংশের জন্য তো বটেই এলাকার জন্য ক্ষতি টেনে আনে৷ জানিনা এ ক্ষতি কোনদিন পূর্ণ হবে কিনা৷
বাদশা সরকার ঃ বংশের মধ্যে বড় ধনী ছিলেন৷ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর সংসারের অসচ্ছলতা হেতু লেখাপড়ার ইতি টানেন৷ এক সময় গ্রাম্য পালা গানে অংশ নিয়ে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন৷ বয়সের শেষ প্রান্তেও তাকে দেখেছি হারমোনিয়ম বগলদাবা করে রাত-বিরেতে পাড়ায় পাড়ায় গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দান করতেন৷ তার কান্ঠস্বর মিহি ও মিষ্টি ছিল৷ তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো ঃ শূন্য হাতে ব্যবসা আরম্ভ করে কোটিপতি হয়েছিলেন৷ তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ে রেখে পরপারে চলে যান৷
হাজী রেফাজ উদ্দিন -ঝরু হাজী ঃ তিনি ব্যবসা করতেন ৷ তিনি দুই ছেলে রেখে পরিনত বয়সেই জান্নাতবাসী হন৷
এস, এম, মইন উদ্দিন (ময়না মেম্বার) ঃ বাদশা সরকারের বড় ছেলে বহুবিধ সদ্ গুণের অধিকারী৷ ফুটবল খেলা তার প্রিয় খেলা এবং দর্শক নন্দিত খেলা খেলেছেন৷ তিনি একটানা বেশ কয়েকবার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হয়ে জনগণের খেদমত করে ধন্যবাদ প্রাপ্ত হয়েছেন৷ স্থানীয় রূপসীযাত্রা, মামুদপূর ও ঘুনিকিশোর ( আর, এম, জি ) যুব সংঘের একাধিক বার মহাসচিবের পদে নির্বাচিত হয়েছেন৷ তার সময়ে ক্লাবটি প্রচুর নাম কুড়িয়েছিল৷ তার পৃষ্টপোষকতায় ফুটবল হা ডু ডু ফকিরি জলসা ও গ্রাম্য যাত্রা গানে এলাকা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল৷ তার গুণবতী স্ত্রীর সংসার ছেলে মেয়ে নিয়েই বর্তমানে তার অবসর জীবন কাটছে৷ ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন রশিক মানুষ ৷ মুখে মুখে ছড়া কাটাতে পরেন তিনি৷
জয়নুদ্দিন বাচ্চু ঃ বরুহা হোসনে আরা হাসান বালিকা উচ্চ বিদ্যলয়ের বি, এস, সি শিক্ষক৷ ছোটকালে তার দাদাবুজি তাকে জনু বলে ডাকতো৷ সেই থেকেই মনে হয় তার নাম জয়নুদ্দিন৷ তার ডাক নাম বাচ্চু৷ সব কাজেই তার নিয়ম নীতির স্বাক্ষর বহন করে৷ বাবু এবং টিটু নামে তার দুই ছেলে৷ তারা বিবাহিত৷ সংসারি ঝামেলা ছাড়া তার জীবনটা সুখি জীবনের উদাহরণ৷ এক সময় চমত্কার ফুটবল খেলতে পারতো৷ রসিকতায় তার জুড়ি মেলা ভার৷ খেলার জগত্ হতে আজও সরে দাঁড়ায় নি সে৷ বাবার সংকৃতির ছোঁয়া তারও গাঁয়ে পুরোপুরি লেগেছিল৷ তবে বর্তমানে ওগুলো ছেড়ে ছুড়ে নিষ্ঠাবান মুছলমান হিসাবে জীবন যাপন করছে৷ সে বাদশা সরকারের দ্বিতীয় গুণধর ছেলে৷
সামসুল হক সামসু ঃ বাদশা সরকারের কনিষ্ঠ ছেলে৷ এক সময় এলাকায় স্বর্ণ কন্ঠ দ্বিতীয় আব্দুল আলীম নামে গানের জগতে পরিচিত ছিল৷ অবশ্য এখন আর ঐ জগত্ থেকে দূরে৷ গ্রামে যাত্রা গান ও ফুটবল খেলার অঙ্গনে তার জুটি ছিলনা৷ বাদশা সরকার অবশ্য এসব খুব পছন্দ করতেন৷ এক ছেলে সূজন ও এক মেয়ের জনক৷ ঝামেলাহীন সংসারে স্ত্রীকে নিয়ে সুখেই আছে৷
মুনসুর রহমান ঃ পিতা নয়ান বেপারী , শিক্ষাগত যোগ্যতা ৮ম শ্রেনী পাশ, ছিলিমপূর বাজারের একটানা দেড় যুগ সেক্রেটারির কাজ করেছে৷ সে সময় ছিলিমপূর বাজারে বেশ কয়েকটা দোকানের মালিক ছিল৷ এখন সেগুলো চলে গেছে৷ ছোট একটি দোকান পরিচালনা করছে৷ নিজে অনেককে এই বাজারে কোটিপতি বানিয়েছে, কিন্তু নিজে কিছু করেনি৷ এক নম্বর মাতাব্বর হিসাবে এলাকায় আজও বিদ্যমান৷ সামান্য ভুল ত্রুটি বাদে তার বর্নাঢ্য জীবনের আজ শেষ প্রহর৷ মারফতী, মুর্শিদী গানে তার দক্ষতা ছিল প্রচুর৷ যৌবনের মধ্যভাগে হা ডু ডু খেলায় বিস্তর সুনাম ছিল৷ বহু পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছে৷ ফুটবল খেলায় গোল রক্ষকের ভূমিকায় অনেকদিন ভাল খেলা খেলেছে৷ দুই ছেলে বজলু ও হুরমুুুুুজকে নিয়ে সস্ত্রীক সংসার নির্বাহ করছে৷ মেয়েরা সবাই বিবাহিত৷ অবসর জীবনের ব্যত্যয় ঘটানোর প্রেক্ষিতে আজও ছিলিমপূর বাজারে যাতায়াত করে৷ শারীরিক অসুস্থতার জন্য আগের জৗলুস আর নেই৷ বর্তমানে দুরাগ্য হাপানী রোগে আক্রান্ত৷
হুরমুজ তালুকদার ঃ মুনসুর রহমানের তৃত্বীয় ছেলে৷ প্রথম ছেলে ছানারের অকাল মৃত্যু হওয়ায় হুরমুজকে সবাই মুনসুর রহমানের দ্বিতীয় ছেলে হিসাবে জানে৷ এক সময় তুখোড় ছাত্র নেতা হিসাবে এলাকায় সমধিক পরিচিতি ছিল৷ বর্তমানে তরিকাতে শিক্ষা নেওয়ার পর বেশ জন সমাজে প্রশংসা পাচ্ছে৷ উভয় ক্ষেত্রেই সম্ভাবনার আভাষ রেখে চলেছে৷ আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে নামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সাধারণ্যে প্রাধান্য পাবে৷
কুরপান সরকার ঃ পুঁথি পাঠ ও লোক কাহিনী বলতে ঐ সময়ে আর কেহ ছিলনা৷ আমরা বিস্ময় বোধ করতাম যখন ছোট বড় প্রায় ১৫/২০ টি পুঁথি অবলীলাক্রমে মুখস্থ বলতে পারত৷ আমি তার কাছে শুনেছি শোনাভান, কালুগাজী, চম্পাবতী, বেলেরাম, জঙ্গে কারবালা, আমির হামজা, গঞ্জেল আরশ প্রভৃতি৷ পুঁথি পাঠ পয়ার, ছন্দ, লয়, তৃপদী, চৌপদী যেখানে যে সুর হওয়া দরকার সেই সুরেই পাঠ করত৷ তার পাঠের ঢংই ছিল আলাদা৷ দরাজ কন্ঠ স্বর ছিল তার৷ প্রায় সব ঋতুতেই তার পুঠিপাঠ , গল্প, কাহিনীর আসর বসত পাড়ার সব বাড়িতে৷ নিজ গ্রাম তো বটেই ভিন গায়ের পুঁথি পাঠের দাওয়াত পেত৷ তার আর একটা নেশা ছিল তাশ খেলা৷ তাশের ২৯ খেলা ছিল তার নখদর্পনে৷
আলতাফ হোসেন মাষ্টার ঃ তিনি বি.কম. পাশ করার পর অদ্যাবধি আনুহোলা হাইস্কুলে শিক্ষকতা নিয়ে চলে যান৷ অবসর প্রাপ্ত হওয়ার খুব একটা দেরি নেই৷ আশৗশব সংস্কৃতিমনা৷ এক সময় প্রচুর নাম কুড়িয়েছিলেন৷ এখন এসব ছেড়ে ছুড়ে ধর্ম কর্ম ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত৷ দুই ছেলে এক মেয়ের জনক তিনি৷ ছিলিমপূর জামে মস্জিদের দীর্ঘ দিনের সচিব তিনি৷
কালু মিয়া ঃ বি. এ. পাশ করার পর কালিয়াকৈর কোন এক হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের দ্বায়িত্ব পালন করতেন৷ কিন্তু পরবর্তিতে সি.এন্ডবি.-র সরকারি চাকরি পেয়ে ঢাকাতেই অবসর নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই কাটান৷ তার তিন ছেলে- সাজ্জাত হোসেন বুলবুল, পারভেজ ও পাপন৷ বুলবুল ভার্সিটি পাড়ি দিয়ে বড় চাকরি করে৷ পারভেজ বড় ডাক্তার৷ ঢাকাতে জুতসই ডিস্পেনসারী খুলে স্বাধীন ব্যবসায় দিন গুজরান করছে৷ পাপনটাও এ পেশাতে জড়িত হয়ে দু পয়সা ভালই কামাচ্ছে৷ কালুর অবসর জীবনটা তার মার দুরাগ্য রোগ সেই সাথে তার স্ত্রীর অনুর ভগ্ন শরীর নিয়ে মানসিক শান্তিতে ব্যঘাত সৃষ্টি করেছে৷ কালূ এবং ফেরদৌস দু ভাই৷ দীর্ঘ দিন একত্র থাকার পর এখন পৃথক ভাবে বসবাস করছে৷ গরীবের দুঃখ বোঝার মতো একটি মন তার আছে৷ দানের হাত ভাল৷ এক সময় দক্ষিন টাংগাইলে সাড়া জাগানো ফুটবল খেলোয়ার ছিল৷ তাকে একটি সুখি পরিবারের কর্মকর্তা হিসাবে মনে করা হ