আটিয়া হতে টাঙ্গাইল
মোঃ নূরুল ইসলাম মাষ্টার
রূপসী প্রকাশনী
টাঙ্গাইল৷
প্রথম প্রকাশ ২০০৯ইং
অলংকরনঃ মোঃ শামসুজ্জামান (পাশা)
যোগাযোগঃ
মোঃ নূর কুতুবুল আলম (পলাশ)
রূপসী কম্পিউটার
৬৬ নং পৌর সুপার মার্কেট, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, টাঙ্গাইল৷
ফ্যাঙ্ ঃ ০৯২১-৬২১৫১, মোবাইলঃ ০১৯১২-০৯৮৮৫৫৷
ই-মেইলঃ rupushe@yahoo.com
উত্সর্গ সারা বাংলায় ছড়িয়ে থাকা বুজর্গানে দীন ওলিয়ে কামেল, সব তরিকার ভক্ত, আশেকান, পীর, মুর্শিদ, শিষ্য, দরবেশ, ফকির, আল্লাহ্ ও তার নবীর অনুরক্তদের ও আপামর জনগনের করকমলে৷
লেখকের আরও কিছু প্রকাশিত গ্রন্থ
* টুকটাক * রূপসী ললনা * বঙ্গ রত্ন শামছুল হক (১)
* হাজী বাড়ির ইতিহাস * কমল কাঞ্চন
প্রকাশক
আটিয়া দরগা কমিটির সকল মাননীয় কর্মকর্তা ও খাদেম বৃন্দ৷
সার্বিক সহযোগিতায়ঃ ............................................৷
মূল্য ১৫০.০০ (একশত পঞ্চাশ) টাকা মাত্র৷
আটিয়ার ইতিহাস
শাহান শাহ্ আদম কাশ্মীরী (র:)৷ সঙ্গত কারণেই আটিয়াকে জানার আগে এ তাপস কুল শিরোমনিকে জানা দরকার৷ গ্রন্থ খানির ভিতর এ বিষয়ে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য মাত্র৷
ভূমিকাঃ আটিয়া একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রাচীন জনপদ৷ এর গোড়ার ইতিহাস অনেক পুরান এবং অস্বচ্ছ৷ প্রামাণ্য দলিল ছাড়া তা জানারও উপায় নেই৷ রাজকীয় যত্ সামান্য দলিলপত্র, স্মৃতি চিহ্ন, ধ্বংসাবশেষ জনশ্রুতিতে যে আদি কথা জানা যায় তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য৷ ঐতিহাসিকগণের সংগৃহিত সরকারি কাগজপত্রে পাল, সেন, দেব ও সুলতানি আমলের ইতিহাসের ফাঁক ফোঁকরে এর পরিচয় সামান্যই মেলে৷ যদিও স্বল্প পরিসরে মেলে তথাপিও ঐতিহাসিক মূল্যবোধের দিক দিয়ে অত্যন্ত উঁচু মানের৷ আজ টাঙ্গাইল বাংলাদেশের সব দিক দিয়ে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী৷ কিন্তু এটা সত্য যে আটিয়ার জন্ম না হলে আধুনিক টাঙ্গাইলের জন্ম হতো কিনা সন্দেহ৷ যিনি ইতিহাসের মানদন্ডে একে অন্ধ গলি থেকে টেনে এনে জন সমাজে দাড়ঁ করিয়েছেন তিনি হলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ওলিয়ে কামেল, আলি বাবা হযরত আদম কাশ্মীরী (রাঃ)৷ তিনি কাশ্মীর থেকে আগত একজন বিশিষ্ট ইসলাম প্রচারক, সাধক, পীরে কামেল ও আউলিয়া দরবেশ ছিলেন৷ জনশ্রুতি আছে তিনি ছিলেন কাশ্মীর রাজ্যের বাদশাহ৷ রাজ্যপাট পরিত্যাগ করে এ দরবেশি রূপ ধারণ করে সুদূর আটিয়া পরগণায় এসে আস্তানা গাড়েন তা তিনিই ভাল জানেন৷ যতটুকু প্রমাণ মেলে তাতে ১৪৪২ হতে ১৪৮০ সালের মধ্যে তিনি আটিয়াতে শুভাগমন করেন৷ তার জন্ম তারিখ জানা না গেলেও তার মাজারে ঢোকার প্রধান গেইটের উপরে তার মৃতু্য তারিখ ৯১৩ হিজরীর ৭ জমাদিও সানি৷ আগে এ সন তারিখ ফার্সি লিপিতে শিপিবদ্ধ করা ছিল৷ এর পাঠোদ্ধার করে বাংলায় উত্কীর্ণ করা হয়েছে৷ পরে আদম কাশ্মীরী (র:) নামের আগে কেন শাহান শাহ্ লেখা হয় তা আটিয়া নিবাসী প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মরহুম মাইন উদ্দীন বি, এ, বিটি, তার লিখিত প্রবন্ধে প্রকাশ করেছেন৷ এটা সুনামধন্য করটিয়ার জমিদারদের দেওয়া নাম তবে মতভেদ আছে এতে৷ আগে লেখা হতো শাহে শাহান অর্থাত্ দুনিয়ার বাদশা৷ পরে লোক মুখে উচ্চারিত হতে হতে শাহান শাহ্ রূপ ধারন করেছে নামটি৷ বাবা কথাটির ব্যাখ্যাও তিনিই দিয়েছেন৷ আদম কাশ্মীরী (রঃ) করটিয়া জমিদার বংশের পূর্ব পুরুষদের পীর এবং আটিয়া পরগণার প্রতিষ্ঠাতা প্রশাসক৷ পরে এ মহান ব্যক্তির বদৌলতে জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা সাঈদ খান পন্নীকে তা দান করে যান৷ তিনি বলেছেন বাংলা দেশের মানুষ পীর মুশর্ীদদের খুব ইজ্জত করার জন্য বাবা কথাটি ব্যবহার করে থাকে৷ তাই তাঁর পূর্ণ নাম হল আলি বাবা হজরত শাহান শাহ আদম কাশ্মীরী (র:)৷ বাবা কথাটির আগে কেন আলি শব্দটি ব্যবহৃত হয় তার উল্লেখ তিনি করেননি৷ এবং তাঁর পান্ডুলিপিও আজ আর পাওয়ার উপায় নেই৷ তিনি জীবিত থাকা কালে এ সম্পর্কে বলেন টাঙ্গাইলের মাননীয় জেলা পরিষদ সচিব জনাব বাকের সাহেব আটিয়ার প্রাচীন ইতিহাস লেখার প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা একবার আহবান করেন এবং তাতে তাঁর গবেষণা ধমর্ী লেখাই প্রথম স্থান অধিকার করে এবং পুরস্কার প্রাপ্ত হন৷ তারপর অযত্নে অবহেলায় কোথায় প্রবন্ধটি হারিয়ে গেছে আজ আর তার হদিস মেলে না৷
আলি বাবা হজরত শাহান শাহ্ আদম কাশ্মীরী (র:) এর ন্যায়পরায়নতা, স্নেহ বত্সল আচরণ, সদাহাস্য মুখ মন্ডল, প্রশান্ত সৌম কান্ড মূর্তি সবের্াপরি দরবেশ তুল্য জীবন ধারন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে জন সাধারণ তো বটেই তদানীন্তন শাসক বর্গেরও সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ সেই সুবাদেই মনে হয় সুলতানি আমলে তিনি বিখ্যাত আতিয়া বা আটিয়া পরগনার জায়গীর লাভ করেন৷ অর্থ বিত্ত ও ক্ষমতার প্রতি তার কোন মোহ ছিলনা৷ ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে প্রজাকুলের হিত সাধনই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত৷ সেই সাথে শান্তির ধর্ম ইসলামের কার্যাবলী প্রচার করা৷ তাঁর সম্পর্কে অনেক লৌকিক ও অলৌকিক ঘটনাবলি এখনও শোনা যায়৷ মুসলমান ও হিন্দু উভয় সমপ্রদায়ের লোকজন তাঁকে সমান ভাবে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন৷ তাই বিভিন্ন সময়ে বাংলায় রাজশক্তির উত্থান পতন ঘটলেও লোকমান্য আলি বাবা হজরত শাহান শাহ আদম কাশ্মীরী (র:) পরগণাদারী ঠিকই থাকত৷ উপরের পরিবর্তন হলেও তাঁর পরিবর্তন হত না৷ শোনা যায় মুঘল সম্রাট মহামতি আকবর যখন দিল্লীর সিংহাসনে সমাসীন হন তখন কৌশলী, বুদ্ধিমান ও ক্ষমতাধর ইসলাম খাঁকে বাংলার সুবেদার করে সুদূর বাংলায় পাঠান৷ লোক মুখে তার গুণ কীর্তন শুনে তাঁকে অত্যন্ত সমাদর করেন এবং উপযুক্ত খেলাত প্রদান করেন৷ তখন হজরত শাহান শাহ আদম কাশ্মীরী (র:) ছিলেন অশতিপর বৃদ্ধ৷ ধর্ম মার্গে উচ্চাসন লাভের জন্য তাঁকে ইতিহাস বেত্তাগণ সিলেটের হজরত শাহ জালালের (রঃ) সমকক্ষ মনে করেন৷ এখনও দেশের বিভিন্ন স্থান হতে ধর্মপ্রাণ হিন্দু মুসলমান ও পর্যটকগণ আটিয়াতে প্রতিনিয়তই আগমন করে থাকেন৷ প্রতি বছর তাঁর মৃতু্যদিবস হিজরীর ৭ জমাদিউসানির পরবর্তী ৫ দিন মহা সমারোহে ওরস প্রতিপালিত হয়ে থাকে৷ বাংলাদেশের ধর্মীয় স্থান গুলির মধ্যে টাঙ্গাইলের আটিয়ার মাজার একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য ধর্মীও পীঠস্থান৷ এই মাজারের অদূরে তাঁর স্নেহছায়ায় পালিত সাঈদ খান পন্নী কতর্ৃক প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন মসজিদটির প্রতিকৃতি দশ টাকার নোটে উত্কীর্ণ করা আছে৷
ইতিহাসের পটভূমিকায় আটিয়ার প্রাচীন ইতিহাস জানতে চাইলে সূদুরে যেতে হবে৷ যেহেতু না প্রাচীন কালে বাংলার শতকরা আশি ভাগই যখন বিশাল যমুনা নদীর জল রাশির তল দেশে নিমজ্জিত ছিল তখনও আটিয়া নামক ভূখন্ডটি পানির উপরে মাথা উঁচু করে জনপথ হিসেবে বিদ্যমান ছিল৷ এই সময় গজনী রাজ্যের সুলতান ছিলেন সুলতান সবুত্তগীনের পুত্র সুলতান মাহ্মুদ৷ পিতার মৃতু্যর পর সিংহাসন আরোহন করেই তিনি সুলতান উপাধী ধারণ পূর্বক বঙ্গ ভারত জয়ের অভিলাষ পোষণ করেন৷ তাঁর ১৭ বার ভারত আক্রমন সফল হয়েছিল বটে কিন্তু বঙ্গ ভারতে স্থায়ী রাজ্য গঠন করতে সক্ষম হন নাই৷ তবে বিজয়ের যে সুবর্ণ পথ রচনা করে গেছেন তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তি সুলতানগণ নিশ্চিতভাবেই সফল হয়েছিলেন৷ এই কৃতিত্বের সর্বাগ্রে দাবিদার সিহাব উদ্দিন মোহাম্মদ ঘোরী৷ তিনি সিংহাসনে উপবেশন করেই রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান কল্পে রাজ্য বিস্তারে সবিশেষ মনোনিবেশ করেন৷ তাঁর পূর্বসূরি মহাবীর সুলতান মাহ্মুদের মতোই তিনিও বঙ্গ ভারত বিজয়ের একান্ত বাসনা পোষণ করেন৷ কঠোর পরিশ্রম ও অমিত বিক্রমের ফলোশ্রুতিতে উর্বর সমতল ভূমি ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম সুলতানি সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হন৷ এরপর দিল্লীর গদীতে সমাসীন হন মুহাম্মদ ঘোরীর বিশ্বস্ত কৃতদাস কুতুবুদ্দিন আইবক৷ তিনি শিহাব উদ্দিনের প্রতিনিধি হিসেবে আর্বিভূত হয়ে পরে দিল্লীর সুলতান রূপে আত্মপ্রকাশ করেন৷ কুতুবুদ্দিন তুর্কিস্তানের অধিবাসি ছিলেন৷ কাজী ফকরুদ্দিন কফি তাঁকে ক্রয় করে সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর কাছে বিক্রি করে দেন৷ স্বীয় সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতাগুনে কুতুবুদ্দিন অল্পদিনের মধ্যেই মহম্মদ ঘোরীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হন৷ মুহাম্মদ ঘোরী শিঘ্রই তাঁকে সেনা দরবারের বিশেষ পদে উনি্নত করেন৷ ভারত উপমহাদেশ অভিযানের সময় কুতুবুদ্দিন সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্থ সেনাপতি হিসেবে প্রভুর সহিত এদেশে আগমন করেন৷ তরাইনের ২য় যুদ্ধের পর কুতুবুদ্দিনের উপরই ভারতের বিজিত রাজ্য সমূহের শাসন ভার অর্পন করা হয়৷ তিনি মিরাট, দিল্লী, রনথম্বর, কনৌজ প্রভূতি রাজ্য জয় করে স্বীয় রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান৷ তারই অমীত বলশালী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলা বিহার ও উরিষ্যা জয় করেন৷ মহম্মদ ঘোরী সুলতান উপাধী ধারন করে দিল্লীর সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন৷ এই বছরই সেন বংশের সর্বশেষ রাজা লক্ষণ সেনকে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে অতর্কিতে আক্রমন করে বসেন৷ বৃদ্ধ রাজা রাজ প্রাসাদের পিছন দরজা দিয়ে পলায়নের সময় আহত ও নিহত হন৷ এই এখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ ঘোরী সৌভাগ্যের বরপুত্র ছিলেন৷ শোনা যায় তাঁর উভয় হস্ত জানু পর্যন্ত লম্বা ছিল৷ সেজন্য তাঁকে বলা হত আজানুলম্বিত বাহু৷ তাঁর রাজ্য সীমা আরাকান বার্মা (মিয়ারমার) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল৷ এই বখতিয়ার খলজির সময় হতেই বাংলাদেশ দিল্লীর শাসনাধীনে চলে যায় এবং এটা একটা প্রদেশ হিসেবে শাসিত হতে থাকে৷ সুতরাং বলাই বাহুল্য আটিয়া বাংলার একটি পরগণা হিসাবে আলাদা মর্যাদা ভোগ করতে থাকে৷
দিল্ল্লী কতর্ৃক নিযুক্ত সুবেদারগণ বাংলাদেশ শাসন করতে থাকেন অনেকদিন৷ কিন্তু মুশকিল হল অন্য জায়গায়৷ বাংলা হতে দিল্লী অনেক দূর৷ আর যোগাযোগ ব্যবস্থাও অত্যন্ত কষ্টকর৷ বাংলার শাসনকর্তা গণ এই সুযোগ গ্রহণ করে দিল্লীর শাসনকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীনভাবে দেশ শাসণ করেন৷ উল্লেখ করতে হয় দিল্লীর বাদশাহ সুলতান ইলতুতমিশ, বলবন শাহ্ ও গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন আমলে বাংলাদেশে বার বার বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং শাসনের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে৷ গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলার বিদ্রোহী শাসনকর্তা বাহাদুর শাহ্কে পরাজিত করে সোনারগাঁ (আটিয়া), সাতগাঁও ও লক্ষনাবতি এই তিন অংশে বিভক্ত করে তিনজন শাসন কর্তার মাধ্যমে শাসন মজবুত করেন৷ এরপর কিছুদিন অতিবাহিত হলে আবার দিল্লীর শাসন ভাটা পড়ে৷ এরফলে পুনরায় বাংলায় বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠে৷ এমনি এক মুহূর্তে ১৩৩৮ সালে সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ্ বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনভাবে শাসণ কার্য চালাতে থাকেন৷ তাঁর পথ অনুসরণ করে সাতগাঁয়ের শাসণকর্তা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ দিল্লীর নাগ পাশ ছিন্ন করে বাংলায় স্বাধীনতার ডাক দেন৷ তাঁর শাসণ স্বাধীনভাবেই চলে৷ এরপর ১৩৪২সালে ইলিয়াস শাহ্ নামে এক রাজ কর্মচারী আলাউদ্দিন হুসেন শাহকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন৷ তিনি ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে ফকর উদ্দিন মোবারক শাহকে পরাজিত করে সোনার গাঁও নিজ শাসনাধীনে আনেন৷ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই কাশ্মীর হতে স্বয়ং আলী বাবা হজরত শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) আটিয়ার ইতিহাস খ্যাত মাটিতে শুভাগমন করেন৷ ১৩৫৮ সালে ইলিয়াস শাহের মৃতু্যর পর তাঁর পুত্র সেকান্দার শাহ বাংলার মসনদ লাভ করেন৷ এর পর থেকে টানা দুশত বছর মুঘলেরা শত চেষ্টা করেও বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করতে পারেননি৷ এ দু'শত বছরে ক্ষমতার হাত বদল নতুন রাজ শক্তির উত্থান, পুরাতন রাজ শক্তির কোন কোনটার পতন এবং সেই সঙ্গে বাংলা ভেঙ্গে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের জন্ম নেয়৷ ওদিকে দিল্লীতেও ক্ষমতা বদলের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে৷ এরপর আফগানস্তানের ফারগানা রাজ্যের রাজা মহা শক্তিধর সম্রাট বাবর কাবুল রাজ্যের অনেকাংশ দখল করে দেশ শাসণ করতে থাকেন৷ বাবরকে পাঞ্জাবের শাসণকর্তা দৌলতখাঁ লোদী এবং মেবারের রাজা রানা সংগ্রাম সিং তাদের শত্রু দিল্লীর বাদশাহ্ ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে দিল্লী আক্রমণের আহবান জানান৷ তারা উভয়েই আশা করেছিল যে, ইব্রাহিম লোদি দিল্লীর মসনদ থেকে বিতারিত হলে দৌলতখাঁ লোদি দিল্লীর সিংহাসনে বসবেন এবং রাজা সংগ্রাম সিংও শত্রুমুক্ত হয়ে এক সময় রাজ্য বিস্তার করতে করতে শেষে দিল্লীশ্বর হয়ে বসবেন৷ কিন্তু তাদের সে আশায় গুড়ে বালি৷ তারা বাবর সম্পর্কে আরও আশা করেছিল যে, তিনি হলেন তৈমুর লংগের বংশধর৷ তিনিও তৈমুরের মত দিল্লী লুটপাট শেষে ইব্রাহিম লোদীকে হত্যা করে আবার ফারগানা রাজ্যে ফিরে যাবেন৷ কিন্তু বাবর ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া৷ তিনি দৌলতখাঁ লোদি ও রাজা সংগ্রাম সিংহের আমন্ত্রনে সাড়া দিয়ে তরাইনের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত ও হত্যা করে স্থায়ীভাবে দিল্লীতে সিংহাসন গেড়ে বসেন৷ শুধু তাই নয় ঐ দুই অপশক্তিকে পযর্ুদস্ত করে তার রাজ্য শাসণ নির্বিঘ্ন করেন৷ এ সময় হতেই পাঁচশত বছর মুঘল শাসকগণ ভারত শাসণ করেন৷ এ সময় আটিয়া পরগণা বহাল ছিল৷ ওদিকে বাংলায় বারো ভঁূইয়াদের শ্রেষ্ঠ ভূস্বামী মহাবীর ঈসাখাঁর আর্বিভাব ঘটে৷ বর্তমান কুমিল্লা জেলার সরাইল পরগণার জমিদার ছিলেন তিনি৷ তিনি দোর্দান্ত প্রতাপশালী ও কৌশলী ছিলেন৷ তাঁর সুশিক্ষিত একদল সেনাবাহিনী ছিল৷ দেহে ছিল তাঁর অপূর্ব শক্তি ও যুদ্ধ কৌশলে পারঙ্গম৷ তাঁর বুদ্ধিমত্তা ছিল বাস্তবমূখী৷ তাঁর মত তীক্ষ্ণ ধীশক্তি সম্পন্ন ভূস্বামী বাংলায় আর দ্বিতীয় আর কেউ ছিলেন না৷ তিনি তাঁর পার্শবর্তী সোনার গাঁ, খিদিরপুর, কাতরাভূ প্রভৃতি পরগণা দখল করে সম্পূর্ন দিল্লীর প্রভাব মুক্ত সোনারগাঁয় রাজধানী স্থাপিত করেন৷ এ সময় দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বাদশা হুমায়ুন৷ তাঁর নিযুক্ত বাংলার সুবেদারগণ নানা বিলাসিতা ও পরগনা শাসণে অযোগ্য ছিলেন৷ এই সুযোগে বিভিন্ন পরগণাদারগণ বিদ্রোহ করে বসেন৷ শুধু তাই নয় বিভিন্ন প্রকার কর দেয়া বন্ধ করে দিয়ে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ পরগণা শাসণ করতে থাকেন৷ এদের মধ্যে ভূইয়া শ্রেষ্ঠ পরগনাদার ছিলেন বীরবাহু ঈশা খাঁ৷ শুধু তাই নয় মুঘল শাসণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে তাদের নিযুক্ত অনেকগুলি পরগণা দখল করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন৷ তাঁর এ সমস্ত কথা বাদশা হুমায়নের কানে গেলেও তিনি তার প্রতিকার করতে ব্যর্থ হন৷ তিনি একদিন হঠাত্ গোছলখানার সিঁড়িতে পিছলে গুরুতর আহত হন এবং কয়েকদিন অজ্ঞান থাকার পর মৃতু্যবরণ করেন৷ তাঁর মৃতু্যর পর তাঁর পুত্র মহামতি আকবর দিল্লীর সম্রাট নিযুক্ত হন৷ তাঁর সুযোগ্য মামা বৈরাম খাঁ তাঁর প্রধান মন্ত্রী নিযুক্ত হন৷ তিনি সার্বিকভাবে ভাগিনা আকবরকে সাহায্য করে রাজ্যকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন৷ প্রতাপশালী পরগণাদার ঈশা খাঁর বিদ্রোহের কথা তাঁর কানে পেঁৗছাল৷ বাদশাহ আকবর ঈঁশা খাঁকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য যুদ্ধ বিশারদ বুদ্ধিমান সেনাপতি মানসিংহকে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলার মুলুকে পাঠালেন৷ তিনি ঈশাখানের পরগণায় ঝটিকা আক্রমন চালালেন৷ ঈশাখাঁ কম কিসে ? তিনি আগেই এ ব্যাপারে প্রস্তুত ছিলেন৷ তিনি সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী নিয়ে মানসিংকে প্রবল বাঁধা প্রদান করেন৷ যুদ্ধের প্রথমদিকে উভয় পক্ষের প্রচুর রক্তপাত ঘটল৷ এতদৃষ্টে মান সিংহ ঈশাখাঁকে উভয় পক্ষের সেনাপ্রধানের এক তরবারি যুদ্ধের আহবান জানালেন৷ বীর শ্রেষ্ঠ ঈশা খাঁ এ আহবান সাদরে গ্রহণ করে রাজী হয়ে গেলেন৷ এক পক্ষে মুগল সেনাপতি মান সিংহ অপর পক্ষে তেজদীপ্ত ঈশাখাঁ৷ চলল খোলা তরবারি যুদ্ধ৷ আঘাত প্রত্যাঘাতে আগুনের ফুলকি ছুটল৷ এক পর্যায়ে হঠাত্ দেখা গেল ঈশা খার এক প্রচন্ড আঘাতে মানসিংহের তরবারি ভেঙ্গে খান খান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল৷ মানসিংহ হত বিহ্বল মূর্তিবত্ ভীষণ পরিণতির জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন৷ না ঈশা খাঁ মান সিংহকে হত্যা করলেন না৷ পরিবর্তে তিনি তাঁর কোষবদ্ধ অপর তরবারি এগিয়ে আবার যুদ্ধের আহ্বান জানালেন৷ রাজা মান সিং ঈশা খাঁর এ মহানুভবতার পরিচয় পেয়ে সবিশেষ চমত্কৃত হলেন এবং আর যুদ্ধ নয় বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেন৷ ঈশা খাঁ সহাস্যে সে আহ্বানে সাড়া দিলেন৷ শুধু তাই নয় হৃষ্ট চিত্তে উভয়ে কোলাকুলি করলেন৷ রাজা মান সিংহ পরাজিত হয়ে অধঃবদনে দিল্লী ফিরে গিয়ে ঈশা খাঁর বীরত্ব, মহানুভবতা, শাসন কাজে দক্ষতা, প্রজা বাত্সল্য প্রভৃতি গুণের কথা সম্্রাট আকবরের কাছে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলেন৷ সম্্রাট আকবর বাড়াবাড়ির পথ পরিহার করে স্বাধীন পরগণাদার হিসাবে ঈশা খাঁ কে মেনে নিলেন এবং খেলাত দেবার জন্য দিল্লীতে ডেকে পাঠালেন৷ ঈশা খাঁ প্রথমত: সন্দেহ পোষন করলেও পরে যখন নিশ্চিত হলেন তখন দিল্লীর দরবারে সম্্রাট আকবরের সংগে সাক্ষাত্ করলেন৷ তিনি ঈশা খাঁ কে অত্যন্ত সম্মান জানায়ে রাজদরবারে আসন দিলেন এবং পরিষদবর্গ ডেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে মসনদ-ঈ-আলা খেতাবে ভুষিত করলেন৷ দিল্লী হতে ফিরে এসে ঈশা খাঁ পূর্বাঞ্চলীয় এ রাজ্য সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করতে লাগলেন৷ এ সময় আটিয়া পরগণাও তাঁর শাসনাধীনে চলে যায়৷ তাঁর ২২টি পরগনার সঙ্গে আলি বাবা হজরত শাহান শাহ আদম কাশ্মীরীর (র:) আটিয়া ও কাগমারী এ দুটি যোগ হওয়ায় মোট ২৪ টি পরগনার হয়৷ শেষোক্ত পরগণা দু'টি তে বাবা কাশ্মীরী (রঃ) অনুকূলে প্রাপ্ত হন৷ ঈশা খাঁ ২৪ টি পরগনায় ২৪ জন শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন৷ আটিয়া ও কাগমারী পরগণা দু'টি ঈশা খাঁর শাসনাধীনে অনেক পরে অন্তর্ভুক্ত হয়৷ তাই অনেকে এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন৷ তারা বলেন ঃ ঈশা খাঁর পরগণা ২২ টি ছিল কাগমারী ও আটিয়া এ দুটি পরগণা ময়মনসিংহ পরগণার দক্ষিনে বড়বাজু পরগণার অধীন ছিল৷ নাম না থাকলেও স্থান দুটি যে অন্য পরিসরে থাক আর নাই থাক বর্তমানে তাতে কোন মতান্তর নেই৷ এ দুটির সীমানা নির্দেশ করা ছিল৷ উত্তরে জয়েনশাহী ও মধুপুর পাহাড়, পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ, সোহাগপুর, দক্ষিণে ও পশ্চিমে ভাওয়ালের গড় এবং পূর্বে নিজ পরগণা সোনার গাঁও৷ ইতিহাসে এ দুটি স্থানের নাম উল্লেখ না থাকার কারণ অবশ্যই থাকতে পারে৷ এক সময় স্থান দুটি বিশাল দেহী যমুনা নদীর বক্ষে বিলীন ছিল৷ শুধু এ দুটি স্থানই নয় বাংলাদেশের সিংহভাগ এলাকাই ছিল নদীর গর্ভে৷ শত সহস্র বছর ধরে উজানের ছোট বড় অনেক নদীর ভাটি বাহিত পলি ও বালি দ্বারা এ অংশ গঠিত হয়৷ পরে লোক বসতি গড়ে ওঠে৷ ঐতিহাসিক এবং ভূ-তাত্তি্বকবিদগণ গবেষণা করে দেখছেন কুড়িগ্রাম রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, জামালপপুর, টাঙ্গাইলের মাটি প্রায় এক এবং স্থানভেদে সামান্য পার্থক্য বিদ্যমান৷ শ্রেণী বিন্যাসে এ মাটি ভূষা, দোঁয়াস, বেঁলে-দোয়াস, সাদা, লালচে, এঁটেল প্রভৃতি৷
এ সময় আটিয়া এবং কাগমারী পরগণাদ্বয় বনদসু্য, জলদসু্য, ঠগ সহ নানা প্রকার সমাজ বিরোধী লোকের আবির্ভাব ঘটে৷ তারা নিরীহ লোকদের খুন, ভয়, ভীতি প্রদর্শন করে সর্বস্ব্যলুট করে নিত৷ উঠন্ত বয়সের যুবকদের ধরে নিয়ে ভয় ভীতি আর ছেড়ে দেবার লোভ দেখিয়ে নিজেদের দল ভারী করত৷ মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে আটকে রেখে ব্যভিচার করত৷ দসু্য তষ্কর সমাজ বিরোধীদের এ অত্যাচার এমন পর্যায়ে পৌছে গেল যে, স্বয়ং মসনদ-ঈ-আলা ঈশা খাঁ পর্যন্ত ভীত শঙ্কিত হয়ে পড়লেন৷ দরদী শাসক ঈশা খাঁ কালবিলম্ব না করে জ্ঞানী গুণীদের নিয়ে মন্ত্রনালয়ে বসে গেলেন৷ বিভিন্ন আলাপ আলোচনার পর সাব্যস্থ হল যে, এ অশুভ শক্তিকে অচিরেই কঠোর হস্তে দমন করতে হবে৷ এজন্য একটি সুশিক্ষিত ও শক্তিশালী নৌ বাহিনী গঠন করলেন৷ অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ন নৌপথে টহল বসিয়ে দিলেন৷ স্থলভাগে আরও কার্যকরী সশস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করলেন৷ ঘোষণা করে দিলেন যে, যারা এই দসু্য তষ্করদের ধরিয়ে দিতে পারবে বা গোপনে তাদের আস্তানার সন্ধান দিতে পারবে তাদেরকে উপযুক্ত পুরষ্কারে পুরস্কৃত করা হবে অথবা রাজ কর্মচারী হিসাবে চাকুরী দেওয়া হবে৷ এতে ফল ফলল ভালোই৷ আইন শৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটল৷ কোথাও হতে ছিটে ফোঁটা দুঃসংবাদ এলেও তা অতি সামান্য৷ তাই দমন করার জন্যে বন, জঙ্গল, চর ও গভীর জল সীমায় সারাশী আক্রমন চালানো হল৷ তাতে অপ্রীতিকর খবর আসা একদম বন্ধ হয়ে গেল৷ মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁ সস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন৷
এরপর তিনি তাঁর রাজ্যের শাসনে মনোযোগ দিলেন৷ তার ২৪টি পরগণাতে দ্রুততর রাজকার্য পরিদর্শন করে বেড়াতে লাগলেন৷ তার রাজ্যের উত্তর পশ্চিম এলাকা রাজধানী হতে বেশ দূরে ও যোগাযোগ দুষ্কর৷ তাই এ প্রান্তরে মমেনশাহীর জঙ্গলবাড়ীতে অস্থায়ী দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করলেন৷ এখানে অবস্থান করে রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটালেন তবে নতুন পরগণা আটিয়া এবং কাগমারীর সুশাসনের ব্যবস্থা আগে করা দরকার মনে করলেন৷ এজন্যে এ নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তাবোধ করতে লাগলেন৷ প্রশাসক হিসেবে এ সময় উপযুক্ত লোকের দারুণ অভাব ছিল৷ কারণ যারে তারে প্রশাসক নিযুক্ত করা যায় না৷ অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে প্রশাসনে বসিয়ে দিলে যদি তার দুর্বলাতার সুযোগে বিদ্রোহ করে বসে৷ এক্ষেত্রে দেখা গেছেও তাই৷ প্রভুর হাতে লালিত পালিত হয়ে এক সময় প্রভূকেই হয় হত্যা না হয় বিতাড়িত করে নিজেই রাজা বা সম্রাট হয়েছেন৷ ইতিহাসে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে৷ এমন ব্যাকুল চিন্তায় যখন তিনি অস্থির তখন এক শুভ সকালে এক শুভ সংবাদ তাঁর কাছে এসে পেঁৗছে গেল৷ খবরটি তাঁর খুব মনঃপুত হল৷ তা হল এই আটিয়াতে একজন নূরানী চেহারার সৌমদর্শন কাশ্মীরদেশীয় দরবেশ অনাড়ম্বর এক আস্তানা গেড়ে বসেছেন৷ সঙ্গে অনেক ভক্ত বালল্লক তিনি সব সময় আল্লাহর ধ্যান খেয়ালে কাটান৷ আশে পাশের দশ-বিশটা গ্রামের মানুষ তাঁকে কামেল বলে মনে করেন৷ সর্বদাই তাঁর দরবারে তাঁর দোয়া অর্াির্শবাদের আশায় ভিড় জমায়৷ তার কাছে হিন্দু মুসলমান জাত পাত নির্বিশেষে সমানভাবে আদৃত৷ কেউই তার নেক দোয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না৷ ঈশা খাঁকে আরও বলা হল যে, এই মহান ব্যক্তিকে যদি পরগনা দু'টির শাসন কাজের ভার অর্পণ করা হয় তবে ভাল ভাবেই শাসন কার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন৷ তীক্ষ্ণ রাজনীতিজ্ঞ ঈশা খাঁ এই উত্তম সুযোগ হাত ছাড়া করতে পারলেন না৷ কাল বিলম্ব না করে একজন বিচক্ষন দূত পাঠালেন আদম কাশ্মীর (রাঃ) দরবারে৷ দূত এসে পেঁৗছলেন সেই মহামানবের কাছে৷ তিনি দেখলেন ছোট্ট একটি খড়ের দোচালা ঘরের ভিতর জায়নামাজ বিছিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল বহু লোক, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই৷ সবাই ভক্তি গদগদ ভাব নিয়ে বাবার দর্শন প্রতীক্ষায় সাগ্রহে বসে আছে৷ তিনি আরও দেখলেন, কাঙ্খিত ব্যক্তির চেহারা মোবারকের উপর বেহেস্তের নূরানী আভা খেলা করছে৷ পক্ক কেশ লম্বিত দাঁড়ি, সুন্নতি বাবড়ী, সৌম শান্ত গৌরকান্তি সত্তর বছরের বুড়ো৷ দেখে মনে হয় সর্বাঙ্গে আজও তারুণ্যের তেজ বিরাজমান৷ জান্নাতি রশ্মির ছটা তাঁর চোখে মুখে৷ যখন অনুরাগী ভক্ত সমাজে কথা বলেন প্রতিটি মুখ মিশ্রিত বাণী মধুমাখা অথচ আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান৷ সমবেত ধর্মপ্রাণ মানুষ আলী বাবার দর্শন লাভে মুগ্ধ৷ বাণী শ্রবণে ভক্তিভাবে বিগলিত ও নিবিষ্ট চিত্ত৷
যথাযোগ্য মর্যাদায় নিবেদন পূর্বক দূত আরজি পেশ করলেন মস্নদ-ই-আলা ঈশা খাঁর কথা ৷ কথা শুনে ক্ষানিকক্ষণ নিরব হয়ে গেলেন আলী বাবা হজরত শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) কিছুক্ষণ এভাবে ধ্যানস্থ থাকার পর মিষ্টি করে উত্চ্চারণ করলেন আলহামদুলিল্লাহ৷ তিনি চক্ষু উন্মিলন করলেন৷ ভালভাবে দূতকে নিরীক্ষণ করে বুঝতে পারলেন দূত বুদ্ধিমান বিচক্ষণ বটে৷ তাই বললেনঃ এলাকায় আছে অজ্ঞ, অশিক্ষিত, হত-দরিদ্র মানুষ৷ এরা ধর্ম জ্ঞানহীন, নীতিবোধ বিবর্জিত মানুষ৷ তিনি বহুত দিন ধরে এদের মধ্যে জ্ঞানের আলো বিস্তারের জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ তাতে আশা অনূরূপ ফল না পেলেও মোটামুটি মানুষ পদবাচ্য হয়ে চলবার মত শক্তি অর্জন করেছে৷ তিনি আরও বলে চললেনঃ বয়সের দিক দিয়ে বার্ধ্যকের কোঠায় সমুপস্থিত৷ কখন পরোলকের ডাক এসে যায় সেই মাবুদ আল্লাই জানে৷ তবুও আশা ছাড়িনি৷ তিনি এখানে বৃহত্তর পরিসরে কিছু করতে গেলে মস্নদ-ঈ-আলা ঈশা খাঁর মদদ অবশ্যই থাকা দরকার৷ তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বল্লেনঃ সদরের আদেশ নির্দেশ ও প্রয়োজনে সাহায্য সহযোগিতা না পেলে তিনি যে জ্ঞানালোক প্রজ্বলিত করে চারদিক উদ্ভাসিত করে রেখেছেন তা একদিন নির্বাপিতও হতে পারে৷ এমতাবস্থায় মসনদ-ঈ-আলা ঈশা খাঁ প্রজা সাধারণের সার্বিক মঙ্গলের জন্য মনোনিবেশ করলে তিনি নিবিষ্ট চিত্তে তা গ্রহণ করবো ইন্শাআল্লাহ৷ বাকী আল্ল্লাহ মর্জি৷
আদম কাশ্মীর (রঃ) কথা দূত প্রবর এতোক্ষণ মন্ত্রমূগ্ধের মত শুনছিলেন৷ স্বম্বিত ফিরে পেয়ে দূত বিলম্ব করা ঠিক হবে না মনে করলেন৷ তাই অত্যন্ত আনন্দ বিগলিত চিত্তে বাবা কাশ্মীরীকে তাজিমের সাথে সঙ্গে ভক্ত বৃন্দ নিয়ে রাজধানী সোনারগাঁয় সদরে আলা ঈশা খাঁর দরবারে হাজির হওয়ার আরজি পেশ করলেন৷ বুদ্ধিমান দূত আরও জানাতে ভূল করলেন না যে, মসনদ-ঈ-আলা ঈশা খাঁরও তাই ইচ্ছে৷ বাবা কাশ্মিরী (র:) খুশি খোশালিতে রাজী হয়ে গেলেন৷ এবার দিনক্ষণ ঠিক করে তারা উভয়েই আল্লার নাম স্মরণ করে রাস্তা চলতে আরম্ভ করলেন৷ শত নদ নদী ঝোপ জঙ্গল জনপথ পেরিয়ে রাজধানী সোনার গাঁয়ে ঈশা খার দরবারে এসে পেঁৗছে গেলেন৷ পূর্বেই তাঁর আবির্ভাবের জন্যে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল৷ তাঁকে পূর্ণ রাজকীয় মর্যাদায় অভ্যর্থনা করে বিশ্রামের যাবতীয় ব্যবস্থা প্রদান পূর্বক দূত মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর নিকট শুভ সংবাদ প্রেরণ করলেন৷ মসনদদার ঈশা খাঁ দূতের নিকট সম্মানীয় মেহমান বাবা কাশ্মীরির বর্ণনা শুনলেন৷ তাঁর কাছে সবই অপূর্ব মনে হল৷ তারপর পূর্ণ বিশ্রামান্তে একদিন তিনি তার রাজ দরবারে পরম আদরে শুভ্র কেশ সৌম্য দর্শন আল্লাওয়ালা ব্যক্তিকে অতি তাজিমের সঙ্গে কাছে বসালেন৷ কুশল বিনিময়ের পর আসল আলাপে লিপ্ত হলেন৷ প্রাজ্ঞ সুবাদার ঈশা খাঁ আটিয়া ও কাগমারীর কথা সবিনয়ে জানতে চাইলেন৷ তিনি তাঁর পরগণাদ্বয়ের শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে বলতে গিয়ে বললেনঃ প্রজা পুত্র আর পরগনদার পিতা৷ পিতৃতুল্য মানসিকতা নিয়ে রাজ্য শাসন করতে হয়৷ প্রজার মঙ্গল রাজার মঙ্গল-একথা তিনি সদা সর্বদাই মনে রাখেন৷ তাদের কাছ থেকে যত্- সামান্য নজরানা যা পান তা দ্বারা বিলাস ব্যাসনে দিন গুজরান করা মাহাপাপ বলে মনে করেন৷ এ করলে আল্লাহ বেজার হবেন৷ তার উপর খাড়া গজব নাজিল হবে৷ তাকে পরকালে জাহান্নমের কঠিন আগুনে জ্বলতে হবে৷ তাকে রক্ষক করে পাঠিয়েছেন৷ ভক্ষক করে নয়৷ তার দুঃশাসনের জন্য প্রজাদের যারপর নেই ক্ষতি হতে পারে৷ অতীতে তিনি কোনদিন নাফরমানি কাজ করেননি৷ এখনতো বৃদ্ধ বয়স৷ এখন আর এ প্রশ্নই উঠতে পারে না৷ এ সময় একমাত্র কাজ হল 'আল্লাহ' 'আল্লাহ' করা আর তাঁর উপর ন্যাস্ত কাজ গুলো সুচারুরূপে সমাধা করা৷ এটাই আমার জন্য আমি শ্রেয়: মনে করি৷ মসনদদার ঈশা খাঁ বাইশ পরগনার সার্বভৌম ক্ষমাতার অধিকারী৷ তিনি এ পর্যন্ত এমন সুন্দর কথা কোন পরগনাদারের মুখ থেকে শোনেননি৷ তাই বাবা কাশ্মীরীর মুখে শুনে মনে মনে অত্যন্ত প্রীত হলেন৷ বললেনঃ খাজনা ট্যাঙ্ আদায় করতে তহশিলদার নায়েব গোমস্তা পাইক পেয়াদা বরকনদাজ এদের কিভাবে প্রতিপালন করেন৷ উত্তরে বাবা আদম কাশ্মিরী জানালেনঃ আমি সত্ ও কর্তব্যনিষ্ঠদেরই নিয়োগ করে থাকি৷ তারা যথাযথভাবে ন্যায় নিষ্ঠার সাথে তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব প্রতিপালন করে থাকেন৷ আমি তাদের এসব কাজ তদারকি করে থাকি৷ শুধু এ পর্যন্তই নয় তাদের ঘরদোর থাকা খাওয়া প্রতিরক্ষা এটাও আমাকেই করতে হয়৷ আর এটা করতে আমাকে মোটেই বেগ পেতে হয় না৷ তারা সবাই আমার প্রতি অত্যন্ত অনুগত৷ অন্যায়ভাবে প্রজাদের কাছ থেকে একটা পয়সাও লওয়া হয় না৷ বরং অনাহারে উক্ত পরিবার পরিজন নিয়ে দিন যাপন করলে তাদেরকে অর্থ সাহায্য করে বা আমার গোচরিভূত করে৷ তাদের আদায়কৃত রাজস্বের এক চতুর্থাংশ তাদেরকে নিয়মিত পরিশোধ করে থাকি৷ যে অর্থ বাকি থাকে তদ্বারা পরগণার প্রজাদের কল্যাণের জন্য ব্যয় নির্বাহ করা হয়৷ এটা তার কখনো ভুল হয় না৷ আমার এ কাজ নিজের অবশ্য কর্তব্য কাজের মধ্যে আমি মনে করি৷ বিচক্ষণ সুবেদার শাসক মেহমানের কথা যতই শোনেন ততই চমত্কৃত হন৷ তিনি এরূপ উপযুক্ত পরগনাদারই চান৷ এমন চরিত্রবান, কর্তব্য পরায়ণ প্রজাবত্সল পরগনাদারই তো মনে প্রাণে কামনা করেন৷ তাঁর পরম সৌভাগ্য যে নতুন দু'টি পরগণা আটিয়া ও কাগমারীর জন্য এমন একজন মহত্ প্রাণ প্রশাসক পেতে যাচ্ছেন৷ এই প্রশাসক যদি তাকে খাজনা, ট্যাঙ্ না দিয়েও বরং তার কাছে উল্টা আরও কিছু প্রজাসাধারনের জন্য বরাদ্দ চান তবে তাও দিতে প্রস্তুত৷ তবুও এ প্রশাসক তার চাই-ই৷ শান্ত শিষ্ট প্রবীণ জ্ঞান বৃদ্ধ আল্লাহ ভক্ত ব্যক্তিটি আরও বলতে চেয়েছেন- তিনি চিরকুমার৷ সংসার বিরাগী৷ দুনিয়ার ভোগ বিলাস তাঁকে মোটেই মহাবিষ্ট করে নাই৷ সে বয়সও তাঁর অনেক আগেই কেটে গেছে৷ তিনি আল্লাহ ও নবী (সঃ) এর প্রেমে ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর ছেড়ে সুদূর আটিয়া চলে এসেছেন৷ শুধু আল্লাহকে রাজি খুশীই তাঁর ধ্যান ধারণা এবং খেয়াল৷ তাঁর মনের কামনা ছিল, বাকি জিন্দেগী আল্লাহর এবাদত বন্দেগীতে কাটিয়ে দিবেন৷ কিন্তু এখানে এসে যা দেখলেন তা কহব্য নয়৷ জীব জানোয়ারের জীবন আর শয়তানের ওয়াছ ওয়াছা মানুষকে অমানুষ করে জাহান্নামী করে ফেলেছে৷ তারা আল্লাহর নবীর (সা:) দ্বীনকে বেমালুম ভুলে গেছ্ দে;ুনিয়াকে আকড়িয়ে ধরেছে আখেরাত ভুলে গেছে৷ তিনি আটিয়ার ফরমা বরদারের যে দায়িত্বটুকু বেছে নিয়েছেন তা অজ্ঞ গোমরা মানুষদেরকে সত্যিকার মানুষ করার উপযুক্ত৷ এতে যে পরিমান কর প্রজাদের কাছে থেকে পাচ্ছেন তা দিয়ে মাদ্রাসা, মক্তব, টোল,মসজিদ, মন্দির প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করছেন৷ এবং সেই সাথে গরিব, কাঙ্গাল, আতুর মিসকিন এদের সেবায় ব্যয় করা হচ্ছে৷ এ বড় মহত্ কাজ৷ মসনদ-ই- আলা ঈশা খাঁ বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) কে সাধারণ মানুষ মনে করলেন না৷ পরগনাদারের ছদ্মাবরনে একজন ওলিয়ে কামেল, পীর দরবেশ মনে করলেন৷ তিনি মনে মনে সংকল্প করলেন এই দরবেশকুল শিরমনিকে যে ভাবেই হোক তাঁর অধীনস্ত আটিয়া ও কাগমারী পরগণা চালাতে দেবেন৷ এ পরগণাদ্বয়ের শাসন কার্য পরিচালনার জন্য যেমন উপযুক্ত মানুষ দরকার তেমন লোকই পাওয়া গেছে৷ আল্হামদুলিল্লা৷ তিনি সুশাসন ও সাধারণ প্রজাদের মঙ্গলের জন্য যা কিছুু অনুরোধ করবেন তিনি নির্বাহকে তা প্রতি পালন করবেন৷ এরপর তিনি আদম কাশ্মীরী (রঃ) যাই বলেন তাতেই সানন্দে রাজী খুশী হয়ে যান৷ প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটি তাঁর শাসনাধীন পরগণাটির নাম বহাল রাখলেন এবং কাগমারীরও তাই রইল৷ উল্লেখ্য আতিয়া বা আটিয়া অর্থ দান বা উপহার৷ এ কথাটিও ঈশা খাঁ মেনে নিলেন এবং এ পরগণা দান হিসাবে আদম কাশ্মীরী (রঃ) কে দান করে দিলেন৷ আগে আটিয়াকে আতিয়া বলা হতো৷ ইংরেজ আমলে এ নামের পরিবর্তন ঘটে৷ ইংরেজিতে "ত" অক্ষর নেই আছে "ট"৷ এর প্রতি বর্ণ ইংরেজী "টি" অক্ষর৷ ইংরেজির আটিয়া উচ্চারণের সময় আতিয়াকে আটিয়া বলত আর তাতেই আতিয়া আটিয়া হয়ে গেল৷ কাগমারী সমন্ধে ইতিহাস কিছু বললেন না, আর বাবা আদম কাশ্মীরীও কিছু ব্যাখ্যা করেননি৷ তবে তার অনেক পরে জনশ্রুতি প্রকাশ পেল৷ এর সত্যতা সন্মদ্ধে অনেকেই সন্ধিহান এবং একে গাল গল্প হিসেবে মনে করেন৷ গল্পটি হল ঃ- বাবা আদম কাশ্মীরীর (রাঃ) ভাগ্নে এবং শিষ্যও বটে৷ একবার মামা এবং ভাগ্নে এক রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন৷ তারা দেখতে পেলেন রাস্তার ধারে এক বুড়ি তার মৃত বকরি নিয়ে কান্না কাটি করছে৷ তাদের দেখে বুড়ি আরও হাউমাউ করে জোরে কাঁদতে লাগলো৷ বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) তাকে কিছু টাকা দান করে সান্ত্বনা দিয়ে চলে যাচ্ছেন৷ হঠাত্ পিছন ফিরে দেখলেন তার ভাগ্নে শাহ্জামান (রাঃ) মৃত বকরীর পাশে দাঁড়িয়ে কি যেন বলছেন৷ আর হাত ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গে বকরিটি উঠে ঘাস খেতে লাগলো৷ এতে বাবা কাশ্মীরী (রঃ) ভারী বেজার হলেন- এই ভেবে যে ভাগিনা খোদার উপর খোদগারী করল৷ আর নিজের দিককে মানুষের কাছে ছোট করল৷ তাই তিনি ভাগ্নেকে বললেনঃ এখন থেকে আমার সহবতে তুমি আর থাকতে পারবে না, অন্যত্র চলে যাও৷ প্রয়োজনে তোমাকে ডাকব৷ তাই হবে৷ কোথায় যাব মামা৷ তখন বাবা ধনুক হাতে নিয়ে উত্তর দিকে দাঁড়ালেন এবং তীর ছুঁড়ে মারলেন৷ বললেনঃ উত্তর দিকে চলে যাও৷ যেখানে এ তীর মাটিতে পতিত দেখবে সেখানেই ধ্যান খেয়ালে বসে যাবে৷ যথাদেশ বলে শাহ্জামান (রঃ) চললেন উত্তর দিকে৷ বেশ কিছুদূরে (টাঙ্গাইলের কাছে দক্ষিণে) এক জায়গায় তীরটি একটি মস্ত দেও বা দৈত্যের বক্ষ ভেদ করে মাটিতে পতিত আছে৷ কাগ নামক সেই দৈত্যটি মারা গেছে৷ সেই থেকে স্থানের নাম হল কাগমারা৷ পরে লোকমুখে উচ্চারিত হতে হতে কাগমারি নামে রূপান্তরিত হল৷
সে যাই হোক-আসল কথা হলঃ সুবেদার ঈশা খাঁ তাঁর পরগণার সীমা নির্দেশ করে বললেনঃ এতোদিন আটিয়া পরগণার সীমানা যাই থাকুক এখন থেকে এর সীমানা হলঃ উত্তরে বড় বাজু, পুখুরিয়া পরগণা ও আলাপশাহী পরগণা, পূর্বে চন্দ্রাতপ, সুজারপুর ও সুলতানপুর পরগণা৷ পশ্চিমে যমুনা নদী, সিন্দির পরগণা এবং দক্ষিণে সোনারগাঁও, নারায়নগঞ্জ৷ এর ভিতরে নদী সিকস্তি স্থলভাগকে আটিয়া পরগণা নামে অভিহিত হবে৷ বিজ্ঞ ঈশা খাঁ এ নব গঠিত আটিয়া পরগণা প্রথম আনুষ্ঠানিক শাসক নিযুক্ত করলেন দরবেশ শিরোমনি অলিয়ে কামেল আলী বাবা শাহানশাহ হজরত আদম কাশ্মীরী (রঃ)-কে৷ এর রাজস্ব দ্বারা তিনি বরাবর যা করতেন এখনও দ্বীধাহীন চিত্তে তাই করতে পারবেন৷ এতে কারও কিছু বলার থাকবে না৷ এটা মসনদ-ই-আলা ঈশা খার আদেশ৷ আটিয়া পরগণার সুকঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আটিয়া ফিরেই এর সার্বিক উন্নয়নে মন প্রাণ ঢেলে দিলেন৷ সুবেদার ঈশা খাঁও এতে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হলেন৷ এ সময় আটিয়া পরগণার মুসলিম সমাজে নানা বিজাতীয় আচার আচরণ এবং ধর্মীও অনুষ্ঠানাদির ভীষন সংমিশ্রণ ঘটেছিল৷ তাইতো দেখতে পাওয়া যায় বাঙ্গালী হিন্দুদের শিব পূজা, দূর্গা পূজা, মনসা পূজা, ধর্ম ঠাকুরের পূজা, ওলা ডুবির পূজা প্রভৃতি অনুষ্ঠান মুসলিম সমাজকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল৷ তখনকার দিনে প্রায়ই দেখা যেত কুসংষ্কার আচ্ছন্ন মুসলিম সমাজ চাঁদা তুলে আসর বসাত মনসা ভাষাণ যাত্রা, কৃষ্ণ যাত্রা, ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখ কাক পক্ষীকে চাল ভাজার ছাতু খাওয়ানো, ঘরের প্রধান দরজার উপরে পাকা তাল বেঁধে রাখা, মাটির শরায় নানা দেবীর মূর্তি এঁকে ঘরে ঝুলিয়ে রাখা প্রভৃতির রেওয়াজ ছিল৷ পৌষ মাসের শেষ দিন ধুমধাম করে পিঠা পায়েস, দৈ, চিড়া, মুড়ি খাওয়া, পহেলা বৈশাখের ভাল মন্দ পাক করে খাওয়া, হিন্দুদের জামাই ষষ্ঠীতে জামাইদেরকে মজা করে খাওয়ানো এগুলোর প্রচলন ছিল৷ এমনকি ধুতি পড়ে মঠের পাশ দিয়ে গমনাগমন করে মাথা নত করে প্রনাম করা পুণ্যের কাজ বলে মনে করত৷ মুসলমান সমাজে আরও কিছু অনৈসলামিক আচার আচরণ ইসলাম ধর্মের অঙ্গিভূত মনে করা হতো৷ যেমন সত্য পীরের শিরনি, খোয়াজ খিজিরের শিরনি, বাস্তু ভিটার শিরনি, বালা মসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দুধ কলা, আতপ চালের ভোগ দেওয়া, প্রভৃতি অনুষ্ঠান মুসলমান লোকের ঘরে প্রায়ই পরিলক্ষিত হত৷ বদর পীর, পাঁচ পীর, বালু গাজী পীরধর্মের সর্দার, এ সমস্ত কাল্পনিক পীর ফকিরদের অনুষ্ঠান মুসলমান সমাজকে অন্ধভাবে গ্রাস করে ছিল৷ শুধু যে আটিয়া পরগণাতে কুসংস্কার দেখা যেত তাই নয় গোটা বাংলা মূলুক জুড়েই এ দুরবস্থা বিরাজিত ছিল৷ বাঙ্গালীর যে কোন অনুষ্ঠানেই হিন্দু মুসলিম চিনবার উপায় ছিল না৷ তবুও বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের প্রতি একটা আকর্ষণ নিবু নিবু বাতির মত জ্বলছিল৷ ধর্ম সম্পর্কে অস্বচ্ছতার সামান্য ধুলি বালির যা আস্তরণ জমে ছিল তা সহজ ধোলাইতেই দূরিভূত হতো৷ তারা ইসলামের নিয়ম নীতি শরা- শরিয়তের অধঃপতন দেখে বেদনা অনুভব করাহতো৷ এজন্য দেখা যায় বাইরের দেশ থেকে পরিপূর্ণ ঈমানদার মমিন মুসলমান এদেশে ধর্ম প্রচার বা সংস্কারের জন্য এলে এদেশের মুসলমানগণ মন প্রাণ উজার করে দিয়ে তার পিছনে অষ্টপ্রহর লেগে থাকতো৷ আর সংস্কারের নির্দেশ দিলে জান কোরবান করে যথাযথ প্রতিপালন করতে তত্পর হতো৷ কারণ এটাই তত্কালীন মুসলমান সমাজের প্রবণতা ছিল৷ তাই ইসলামের সঠিক দিক নির্দেশনা না থাকায় ভুগছিল গোটা জাতি৷ বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে এহেন দুখঃজনক ও কুসংস্কার আচ্ছন্ন পরিবেশে নিমজ্জিত থাকার কথা শুনতে পেয়ে মধ্যপ্রচ্যের ধর্মপ্রাণ মুসলমান মানুষ দারুণ বেদনা বোধ করতেন৷ তাই এদের অধঃপতন ঠেকাতে ৩৬০ জন মতান্তরে আরও বেশি সংখ্যক ধর্ম সংস্কারক, অলীয়ে কামেল, শিষ্য স্বজন সহ বাংলা ভারতে হিজরত করেন৷ এরা কেউ কেউ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে পেঁৗছিলেন৷ বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছ থেকে এরা যথেষ্ট ইজ্জত, হুরমত, আতিথেয়তা পেতেন৷ এদের এমন মন মানসিকতার পরিচয় জেনে সুদূর দূর্গম পথ পেরিয়ে ৫৮ বত্সরের তাপসকুল শিরোমনি, বুজুর্গানের দ্বীন সাথে পিতৃহীন এতিম ১২ বত্সরের ভাগ্নে হজরত শাহ্ জামান (রঃ) কে নিয়ে হাজির হলেন পূর্ব বাংলার মাটিতে৷ ভাবতে অবাক লাগে যে, কোথায় আটিয়া আর কোথায় কাশ্মীর অবস্থিত৷ জনশ্রুতি আছে, তিনি প্রথম দিল্লীর পীরে কামেল বুজুর্গানে দ্বীন হজরত সলিম শাহ্ (রঃ) আস্তানায় পদার্পণ করেন৷ সেখানে কঠোর সাধনায় সিদ্ধি লাভের পর ধর্ম প্রচার ও সংস্কারের জন্য বাবা সলিম শাহ্ আটিয়া মূলুকে পাঠালেন৷ হাতে দিলেন এক মুষ্ঠি মাটি- এই মাটির গন্ধ আর বর্ণ বাংলার যে প্রান্তে পাবে সেখানেই আস্তানা গেড়ে সাধনায় বসে যাবে৷ বাবা কাশ্মীরী (রঃ) ইস্তেখারা করলেন-পেয়ে গেলেন পথ৷ আটিয়া থেকে তার নাকে আটিয়ার মাটির গন্ধ পেতে লাগলেন৷ ছুটলেন শিষ্য বাল্যক নিয়ে আটিয়ার দিকে৷ পেয়ে গেলেন কাঙ্খিত স্থান৷ মিলে গেল পীর প্রদত্ত মাটির গন্ধ ও বর্ণ, রং-বসে পড়লেন আস্তানা গেড়ে৷ চলল ধর্ম প্রচার, সংস্কার, ও কঠোর সাধনা৷
এ সময় বাংলাদেশ ছিল সত্যিই এক শান্তির নীড়৷ পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা আর সহজ সরল মানুষের কল-কাকলীতে ভরা৷ বিদেশীদের হাতছানি দিয়ে ডাকতো তাঁর বুকে৷ তাইতো আফ্রিকাবাসী বিশ্ব পর্যটক মরক্কো রাজ্যের নাগরিক ইবনে বতুতা, চীনের হিউয়েং সাঙ, ইটালির মার্কপোলো আরও হাজার ভ্রমণকারী এ বাংলায় আগমন করেছেন৷ লিখে গেছেন এদেশের সুখ শান্তির কথা৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিবরণ, লিখে গেছেন মানুষের সরল সহজ কথা৷ এতো স্বল্প মূল্যে জিনিষ পাওয়া যেত এ বাংলায় তা ভাবলে অবাক হতে হয়৷ ইবনে বতুতা এতোটুকু মহাবিষ্ট হয়েছিলেন যে, একটানা ৩০ বছর বাংলায় অবস্থান করে আবার স্বদেশে ফিরে গিয়েছিলেন৷ তিনি বাংলার সেন, পাল, দেব, চৌহান, সুলতান, মুসলমান রাজা বাদশা, দিল্লীর সম্রাট, চীনের বিরল কাহিনী প্রভৃতি লিখে অমর করে রেখে গেছেন৷ তার থেকে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস অনেকাংশে জানতে পারা যায়৷ নিকট মধ্যপ্রাচ্য, প্রাচ্য সহ আরব বিশ্ব থেকে এসেছেন সিলেটের মহাত্মা শাহ্ জালাল (রঃ), শাহ্ পরান (রঃ), রাজশাহীর শাহ্ মখদুম (রঃ), চিটাগাং এর বায়েজিদ বোস্তামী, সুন্দরবনের কালু গাজী (রঃ), বাগেরহাটের খান জাহান আলী, আটিয়ার শাহানশাহ্ বাবা হজরত আদম কাশ্মীরী (রঃ), কাগমারীর হজরত শাহজামান (রঃ), মীরের বেতকার শাহ জামাল (রঃ), সিংহরাগীর হজরত দেওয়ান শাহ্ হুসেন আল কাদরী হুসাইন (রঃ) প্রমূখ৷ ভারতের আজমীরের খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রঃ), নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রঃ), আসামের জলেশ্বরের নাসিরুদ্দিন বোখদাদী (রঃ) সহ বহু কামেল পীর মুর্শিদ এদেশে এসে আমাদেরকে ধন্য ও কৃতজ্ঞ করেছেন৷ ধর্ম প্রচার, ধর্ম সংস্কার, রাজ্য বিস্তার, নতুন রাজ্য স্থাপন, পর্যটন যে যে উদ্দেশ্যেই একবার এদেশে পা বাড়িয়েছেন তারা এদেশের সুখ শান্তি সরল সহজ মানুষ, আরামপ্রদ আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সহজলভ্য জিনিষপত্র পেয়ে ফিরে যাবার নামটি করেননি কোনদিন৷ থেকে গেছেন চিরদিনের জন্য এই বাংলা ভারতে৷ রাজা-বাদশা, সম্রাট-সুবেদার, সেনাপতি-জমিদার, ভূস্বামী, ভাগ্যান্বেষী, ভাগ্যাহত, বিপর্যস্ত মানুষইকি কম এসেছেন ! ইতিহাসের নিরিখে বিচার করলে দেখা যায় প্রধানত তিনটি কারণে এই বিদেশীরা এদেশে এসেছেন৷ তাহলো- প্রথমতঃ সুখ সমৃদ্ধি, নিরুপদ্রব জীবন যাপন, দ্বিতীয়তঃ আফগান মুগলদের উত্থান পতন, অনেকেই আত্মগোপন, আত্মরক্ষা, তৃতীয়তঃ ধর্ম প্রচার ও ধর্ম সংষ্কারের উদ্দেশ্যে ৷ এদের মধ্যে করটিয়ার জমিদারদের আদি পুরুষ, মুঘল সেনাপতি বায়েজিদ খান পন্নী মুঘল পাঠানদের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য শেষোক্ত কারণে এসেছিলেন ধর্ম প্রচার ও সংস্কারের জন্য৷ আলী বাবা হজরত শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) অবশ্য তিনি এসেছিলেন নিজ দেশ ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে যাবার জন্য কিনা জানিনা৷ আর তা জানারও কোন উপায় নেই৷ বেহেশতী সুরত, গৌর কান্তি দেহ, চির কুমার ফিরেই বা কি করবেন ? দরবেশ, সংসার ত্যাগী, অলিয়ে কামেলদের স্বদেশ আর বিদেশ উভয়ই সমান৷ এরা স্বদেশ বিদেশ, আপন পর কোন পার্থক্য করেন না৷ তাদের চোখে মানুষ মানুষই৷ আল্লাহ্র আর এক নাম "রব"৷ প্রতিপালক- সব সৃষ্ট জীবকেই প্রতিপালন করেন তিনি৷ মানুষের খেদমত করাই শ্রেষ্ঠ এবাদত্ বন্দেগী৷
আলী বাবা হজরত শাহান শাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) সবেমাত্র পৌঢ়ত্ব পেরিয়ে বার্ধ্যক্যে পা রেখেছেন৷ দেহ যৌষ্ঠ ঝলমলে, নূর চমকায় দেহে, মনে অসীম ঈমানী জোশ বল বিক্রমে ভরা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, হৈম কান্তি সুডেল দেহ বল্লরী, সুশ্রী সদা হাস্য মুখমন্ডল৷এক সময় ধর্মাভাবে বাংলার জনপদে তসরিফ আনলেন৷ তিনি শুভাগমন করে বেছে নিলেন যমুনা ধলেশ্বরী অতি প্রাচীন জায়গা আটিয়াকে৷ এসব জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা ও পাশে চর ও চর ঘেঁষা অঞ্চলের প্রতি৷ গৌড়ের সুলতান, রাজমহল বা সোনারগাঁয়ের শাসকদের শাসন সুনজর কাড়তে চায় নাই মোটেই৷ রাজ্য বিস্তার এসব এলাকায় খাজনার চেয়ে বাজনাই বেশি হবে ভেবে শুরুতেই থেমে গেছেন তারা৷ অনুন্নত ঝাড়জঙ্গল, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কারে নিমজ্জিত অধিবাসীদের জীবন৷ ধর্মীয়, সামাজিক মূল্যবোধ নেই বললেই চলে এদের৷ রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা নেই৷ যখন যে ক্ষমতায় আসে তাকেই সালাম৷ গেলেও খবর রাখে না আসলেও মাথা ব্যাথা নেই৷ এসব জটিল কুটিল নবাব বাদশাদের খবরাখবর ওরা রাখে না৷ কাজেই নিসঙ্কো চিত্তে সংস্কার মূলক কাজ করার পক্ষে এসব এলাকা বিঘ্ন শংকুল ছিল৷ তবে জরুরীও ছিল বটে৷ কেননা খারাবি এদের রক্তে মাংসে মিশে গিয়েছিল৷ তাদের পূর্ব পুরুষরাও এভাবেই জীবন অতিবাহিত করেছে৷ বর্তমানেতো চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু আশার কথা একবার এ অশিক্ষিত অজ্ঞ অথচ সরলমনা জনগণের মনের ওপর ভাল কিছু ছাপ দিয়ে প্রভাব বিস্তার করলেই হলো৷ নিজের জানের বিনিময়ে পীর দরবেশ ওলিয়ে কামেলদের কথা মেনে রেখে চলবে৷ সেই সূত্রে এদেরকে মনের মনি কোঠায় স্থান দিয়ে সদায় ভক্তিভাবে গদ্ গদ্ থাকবে৷ আর খোদা নাখাস্তা তাদের মন একবার বিগড়ে গেলে কশ্মিনকালেও ফেরাতে পারবে না কেউ৷
এর অনেক পরের কথা৷ এ সময় ধলেশ্বরী যমুনা নদী সিকস্তি চরগুলি প্রায় কায়েমীভাব ধারণ করেছে৷ লোক জনের বাড়ি ঘর সবুজ গাছ পালায় ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় হয়ে উঠেছে৷ গ্রাম হিসেবে সুন্দর রূপ ধারণ করেছে চরা ভূমির বাঁকে বাঁকে৷ ছোট একটা বাজারকে কেন্দ্র করে কোলাহল মূখর হয়ে উঠেছে এখনকার ঘনবসতিপূর্ণ একটা চর৷ সেই বাজারের পাশে নতুন গজিয়ে ওঠা একটা বট গাছের ছায়ায় ছোট একটা ছনের দোচালা ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেছেন বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ)৷ আওলিয়া সর্দার আলি বাবার অপূর্ব মিষ্টি মধুর কথা, ইসলামি আচার আচরণের সানি্নধ্যে এলে সহজেই মন কেড়ে নেয়৷ চেহারা এবং কথা যেন সোনায় সোহাগা৷ চেহারা দেখলে চোখ জুড়ায় আর কথা শুনলে মন প্রান মোহিত হয়৷ গুরুগম্ভীর ভাব ও ইসলামী আচরণের ভিতর প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব তা দেখে এলাকার মানুষ একে একে সবাই হুজুরের কাছে বায়াত পড়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে লাগল৷ এর ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর নাম কাম ছড়িয়ে পড়ল৷ তিনি ইসলামী জ্ঞানে শিক্ষিত ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে অনেক উচু মার্গের সিদ্ধ পুরুষ৷ তিনি ইসলামের আলো চারদিকে বিস্তারের জন্য খুলে বসলেন একটি মক্তব৷ এই মক্তবেই শিক্ষা দিতে লাগলেন মানুষ হওয়ার আদর্শ ৷ এলাকার অজ্ঞ অশিক্ষিত ব্যক্তি বর্গসহ ছোট শিশু ছেলে মেয়েরা এক বেলা করে হুজুরের কাছে পড়তে যান প্রতিদিন৷ শেষে শাহান শাহ বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) এমন হয়ে গেলেন যে ভিন দেশী লোক কিনা চিনবারই উপায় রইল না৷ এ গণ্ড এলাকার কৃষ্টি ঐতিহ্য সবাই স্থানীয় লোকজনের মত রপ্ত করে ফেললেন তিনি৷ এবার তিনি সকলের মনের মানুষ ও সুখ দুঃখের সাথী হয়ে গেলেন৷ এবার তাঁর উদ্দেশ্য হাসিলের পালা৷ তাঁর স্বপ্ন কি ভাবে এই অজ পাড়াগায়ের মানুষ গুলোকে কুসংস্কার মুক্ত করে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যায়৷ সেই সঙ্গে পরগণার শাসন ভার মাথায় নিয়ে সারা পরগণার চষে বেড়ান প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য৷ নায়েব পিয়াদারা খাজনা ট্যাঙ্ আদায় করার জন্য কারো ওপর জুলুম করে কিনা, কি হালে আছে তা নিয়মিত খোঁজ রাখেন৷ সব কাজ করার পর রাতে যেটুকু সময় পান তা আল্লাহর ধ্যান খেয়ালে কাটান৷ এমন করেই প্রজার হিত সাধনায় সময় কেটে যায় বছরের পর বছর৷ কঠোর পরিশ্রম আর ত্যাগে এখন মোটামোটি প্রজাকূল সুখি, ধর্মীয় ভাবে জীবন চালনায় অভ্যান্ত হয়ে গেছে, ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত ও মার্জিত হচ্ছে৷ ক্ষেতে খামারে হাল চাষ করে যে শষ্য পায় তা দিয়ে সারা বছর ভাল ভাবেই কাটে৷ এলাকায় এলাকায় আরও মক্তব খুলে শিক্ষার আলো ছড়াতে লাগলেন৷ এবাদত্ বন্দেগী করার জন্য মস্জিদ গড়ে দিলেন৷ পানির কষ্ট দূর করার জন্য ইদারা কুপ ও পুকুর খনন করে দিলেন৷ আটিয়াতে এখনও প্রাচীন পুকুর পাগাড় জলাশয় যত আছে বাইরের আর দশ বিশটা এলাকায় তা নেই৷ মাজারের সামনের ইঁদারা, সুখ দশার জলাশয়, ইছামতির জলাশয় প্রভৃতি আরও অনেক জলাশয়ের নজির আটিয়ার যত্র-তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ আজ তাঁর সাধনা সফল হতে চলেছে৷ আগের চেয়ে আটিয়া পরগণা এখন অনেক সভ্য ও কুসংস্কার মুক্ত৷ চারদিকে শান্তির সুবাতাস বইছে৷ তবুও তিনি নিজেকে মনে করছেন তাঁর আরও তত্পর হওয়া দরকার৷ নইলে তাঁর উপর ন্যাস্ত দায়িত্ব অবহেলার জন্যে সদরে আলা ঈশা খাঁর কাছে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন তার বরখেলাপ হবে৷ যদিও ঈশা খাঁ পরগনা সুশাসনে বাবা আদম কাশ্মিরীর উপর অত্যন্ত খুশি৷ তথাপিও আল্লার কাছে অজানা অপরাধের জন্যে কি কৈফিয়ত দেবেন ভেবে শঙ্কিত হন তিনি৷
হঠাত্ই ঈশা খাঁ জান্নাতবাশী হলেন৷ সব যেন ঘুর্নিঝড়ে বিধস্ত হয়ে গেল৷ এখন শাসক হলেন তাঁর পুত্রদ্বয় মুসা খাঁ ও ওসমান খাঁ৷ ভাল মতই শাসন চলছে৷ তাদের পিতার রাজ্য৷ কিন্তু দিল্লীতে শক্তি বিপুল পরিমানে বেড়ে গেছে মুঘলদের৷ মহামতি আকবর পূর্ণ যুবক৷ তার মন্ত্রনাদাতা ও পরিচালক মামা বৈরাম খাঁকে অবসর দিয়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা রাজ্যে সর্বত্র৷ যেখানে তাঁর আদেশের ব্যাতিক্রম দেখছেন সেখানেই সেনাবাহিনী পাঠিয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন৷ সম্রাট আকবর ঈশা খাঁর ধৃষ্টার কথা ভুলেন নাই৷ তার সেনাপতি মানসিংহকে পরাজিত করে অপমানের মালা গলায় পরিয়ে দিল্লিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর কাছে৷ দিল্লির খাজনা বন্ধ করে দিয়ে স্বাধীন ভাবে পরগনা পরিচালনা করছেন৷ কিন্তু তিনি এখন বেঁচে নেই৷ সম্রাট আকবর ঈশা খাঁর অপমানের বদলা নেবেন৷ তাই তিনি তার দুই পুত্রের বিরুদ্ধে বিশাল দক্ষ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে যুদ্ধে মুছা খাঁ ও ওসমান খাঁ কে পরাজিত নিহত করে গোটা সোনারগাঁও রাজ্যই দখল করে নিলেন৷ এখন মুঘল শাসন বাংলায় পোক্ত করা দরকার৷ তাই সোঁনার গাঁ দখলের দাবিদার ইসলাম খানকে বাংলার সুবেদার করে পাঠালেন৷ তিনি মুঙ্গের, কলকাতা, গৌড় সহ সমস্ত এলাকা শাসন ক্ষমতার কেন্দুবিন্দু করলেন ঢাকাকে৷ ঢাকা থেকে ঈশা খাঁর ২৪ পরগনার শাসনকর্তাদেরে মুঘলদের বশ্যতা স্বীকারের আদেশ জারী করলেন৷ তিনি উল্লেখযোগ্য কাজ করলেন গৌড় হতে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর৷ এখন এখান থেকে সমগ্র বাংলা মুলুক শাসন করা সহজ হল৷
ইসলাম খাঁ সুদক্ষ শাসক ও বীর যোদ্ধা৷ তিনি ঈশা খাঁর কাতরাভূ, কদমরসুল দূর্গ জয় করে মন দিলেন বাংলার বারো ভূইয়াদের দিকে৷ ইসলাম খাঁ প্রত্যেকের কাছে ফরমান পাঠালেন মুঘল বশ্যতা স্বীকার করতে৷ যারা স্বীকার করলেন তাদের জমিদারী ঠিক রইল৷ আর যারা অস্বীকার করলেন সৈন্য পাঠিয়ে তাদের জমিদারী দখল করে অন্য শাসক নিযুক্ত করছেন৷ আগেই তিনি আটিয়া পরগণায় হাত দিলেন না৷ কারণ অবশ্যই আছে৷ সোনার গাঁ পতনের পর আটিয়ার পরগণদার বাবা কাশ্মীরী (রঃ) খাজনা ট্যাঙ্ বন্ধ না করে ঢাকায় ইসলাম খাঁর খাজাঞ্চী খানায় পাঠাতে লাগলেন৷ এতদ শ্রবণে ইসলাম খাঁ খুবই সন্তুষ্ট হলেন৷ শুধু তাই নয় তিনি আটিয়া পরগণার শাসনকর্তা আদম কাশ্মীরী (রঃ) বহাল রেখে সময়ে ঢাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পত্র পাঠালেন৷ অলি বাবা শাহানশাহ (রঃ) উপর ইসলাম খাঁ খুশি হলেন এই জেনে যে তিনি একজন সুফি দরবেশ কাশ্মীরী সম্বান্ত অধিবাসী৷ শান শওকত নেই, বিলাসিতা বিষবত মনে করেন৷ সংসারের প্রতি নির্লোভ, চিরকুমার বার্ধক্যের কোঠায় পা বাড়িয়েছেন৷ পরগণা শাসনে তার এতটুকুও শৈথিল্য নেই৷ তিনি আগের মতই নিজের খোরাকীর জন্য সামান্য কিছু অর্থ রাখেন আর কিছূ পরগণা পরিচালনার জন্য বরাদ্দ দিয়ে বাকি সবই ইসলাম খানের সদরে পাঠাতে থাকেন৷
বাবা আদম কাশ্মীরী (রাঃ) আটিয়া পরগণাকে শিল্প বানিজ্যে সমৃদ্ধশালী ও অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল করার জন্য মন দিলেন৷ স্থানীয় কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য শিল্পীদের উত্সাহ, আর্থিক সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে লাগলেন৷ এদের মধ্যে কুমার বা পাল সমপ্রদায়ের মাটির তৈজসপত্র, বাঁশ বেতের শিল্পীদের কুটির শিল্প, তুলট কাগজ, বাজি বারুদ, তাঁত শিল্প প্রভৃতি উল্লেখ্যযোগ্য৷ কাঠ শিল্পিদের স্থায়ী এলাকা বরাদ্দ করে দিলেন৷ ঘানি শিল্পিরা গ্রাম পেলেন হিঙ্গানগর৷ ***
তুলট কাগজের জন্যে আটিয়া তখনও বিখ্যাত ছিল৷ এখনকার মত তখন উন্নত ধরনের কাগজ সহজলভ্য ছিল না৷ আর মুদ্রণ শিল্প ও কাগজ তৈরির যন্ত্রও আবিষকৃত হয়নি৷ সুতরাং হাতে তৈরি তুলট কাগজের প্রচলন ছিল৷ এতে লেখালেখি চলত৷ এর প্রস্তুত প্রনালী ছিল চমত্কার৷ পুরান কাপড়, শিমুল তুলা, পুরানো কাঁথা প্রভৃতি প্রক্রিয়াজাত করে প্রথমত মন্ড তৈরি তারপর ভাতের মাড় সংমিশ্রন করে কাঠের শক্ত তক্তা ও পাথরচাপা ইত্যাকার সংগে আরও কিছু কাজ করে রৌদ্র অথবা চুলার আগুনে শুকিয়ে কাগজ তৈরি করা হত৷ এদেরকে কাগজিয়া বলা হত৷ এখনও এদের বংশধর আটিয়াতে আছেন৷ তবে সে পেশার তাদের বাপ দাদারা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশা গ্রহণ করে ছিলেন৷
বাজি বারুদ তৈরিতে আটিয়া সদর বহুত বিখ্যাত ছিল৷ এ মূলুকে যত অনুষ্ঠানাদি যেমন বিবাহ, খাতনা, মহরম উত্সব, শিশুদের অন্য প্রশুন, পুঁজা-পার্বণ, নবাব জমিদারদের শুভ পুন্যাহ অনুষ্ঠানে প্রচুর বাজি পোড়ানো হত৷ চরকি বাজি, ঢিল বোমা, বোম ছিতারা, পটকা আরও কত রকমের বোমা আর বাজি বারুদ বানাতে পারতো শিল্পিরা৷ শোনা যায় তারা এমন ধরনের বোমা তৈরি করতে পারতো যা ফাটালে মানুষ আট দশ মাইল দূর পর্যন্ত শব্দ শুনতে পেতো৷ বোম ছেতারা আকাশে ছুড়লে এক আলো হতে পাঁচ, আবার পাঁচ আলো হতে আরও পাঁচ আলো এমনি করে পাঁচিশ আলো বিচ্ছুরিত হতো৷ এটা আকাশ মূখো শক্ত ভারী লোহার চোঙ্গা তেঁতে তাতে ঐ আতশবাজি রেখে দিতে হত৷ আর তাতে আগুন দিলে আকাশে গিয়ে আলো দিত ও পটকা ফুটতো৷ এ শিল্পিদেরও বংশধর আটিয়ায় এখনও দেখা যায়৷ এদেরকে বলা হয় বারুজিয়া৷ আটিয়া সদর ব্যবসা বানিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র ছিল৷ নৌপথের চমত্কার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল৷ বড় বন্দরের মত আটিয়া বন্দর নামকরা ছিল৷ লৌহজং নদী দিয়ে ইষ্টিমার, লঞ্চ, জং বড় নৌকা মালামাল নিত ও আনতো এ বন্দরে৷ ধনাঢ্য মহাজন বনিক সমপ্রদায় প্রয়োজনীয় জিনিষ এখানে এনে গুদামজাত করতো আর পাইকারদের কাছে বিক্রি করতো৷ মোট কথা আটিয়া সদর পরগণা ব্যবসা বানিজ্যের প্রাণকেন্দ্র মশহুর প্রাণকেন্দ্র ছিল৷ এখানে প্রতিদিন জমজমাট বাজার বসত৷ নানা রকম দোকানে রকমারি জিনিষ বিকি কিনি হত৷ তরি-তরকারি, দুধ, মাছ, চাল, ডাল, কাপড়, চোপড় ও আনুসঙ্গিক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ আমদানি রপ্তানি হত প্রচুর৷ প্রবাদ আছে সাইদ খান পন্নী বালক বয়সে মায়ের গাভীর দুধ বিক্রি করতেন৷ গোয়ালাদের গরু বাছুর চড়াতেন৷ সাঈদ খাঁন একদিন দুধ বিক্রি করতে নিলে পথিমধ্যে তার পাত্রের সব দুধ দরবেশ বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) এক চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন৷ একথা সাঈদ খাঁন মায়ের কাছে ব্যাক্ত করলে তার মা কোন ব্যাক্তি তার ছেলের হাত হতে দুধ খেয়েছে দেখতে পরের দিন ছেলের পিছনে তফাতে থেকে চলতে লাগলেন৷ মা দেখলেন এক বৃদ্ধ (যিনি বাবা কাশ্মিরি রঃ) সাঈদ খাঁনের হাত হতে পূর্বদিনের মত পাত্র ছিনিয়ে নিয়ে সবটুকু দুধ আবার খেয়ে ফেললেন৷ সাঈদ খাঁন প্রতিবাদ করলে তাকে লাঠি দিয়ে পেটাতে আরম্ভ করলেন৷ এই দৃশ্য দেখে মা এসে ছেলেকে রক্ষা করার জন্যে দরবেশের চারদিকে বেড়া বেড়ি করতে লাগলেন৷ তাতে সাঈদের গায়ে ইতিমধ্যেই সাতটা আঘাত পড়ে গেছে৷ আর অবশিষ্ট সাতটা আঘাত আংশিকভাবে সাঈদের গা স্পর্শ করেছে মাত্র৷ তখন বাবা কাশ্মিরী দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন যে, তার অধঃস্থনেরা সাত পুরষ প্রবল প্রতাপের সঙ্গে জমিদারী করতে পারবে৷ আর সাত পুরষ নিবু নিবু ভাবে জমিদারির কাজ চালাতে পারবে৷
আটিয়াতে তত্কালে একটি উন্নত ধরনের ব্যবসায়ী কেন্দ্র ছিল মাটি খূড়লেই তার প্রমাণ মেলে৷ সেকালে মানুষে মাটির তৈজসপত্র প্রচুর ব্যবহার করতো৷ চাড়া,
খাপড়া এমনকি আস্ত পাত্রও এখানে পাওয়া যায়৷ এছাড়া পুতির মালা, মুগা, দানা, চিনা মাটির ভাঙ্গা টুকরা, পুতুল, পোড়া মাটির খেলনা নানা প্রকার ইট পাথরের টুকরা আজও মাটির গভীরে খুড়লে হঠাত্ই দেখতে পাওয়া যায়৷
বাবা আদম কাশ্মিরী (রঃ) আটিয়াকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন৷ তিনি নিজে ছিলেন শিক্ষা-দিক্ষায় উন্নত পন্ডিত ব্যাক্তি৷ ইসলামী জ্ঞানে তিনি তত্কালে এ তল্লাটে বিখ্যাত ছিলেন৷ জ্ঞান বিস্তারে তাঁর প্রচুর আগ্রহ ছিল৷ তাই তিনি বড় পন্ডিতদের মত শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত হলেন৷ এজন্যে দূর দূরান্ত হতে ছাত্র শিক্ষক এখানে এসে ভিড় জমাতেন৷ তারা আসতেন জ্ঞান পিপাশা নিবারনের জন্যে৷ বাবা কাশ্মীরী ও তার নিয়োজিত পন্ডিতেরা প্রাণপাত পরিশ্রম করে সভ্যতার উজ্বল প্রদীপ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন৷ একথার সারবস্তা খুঁজে পাওয়া যায় যখন দেখা যায় মুসলিম পরিবারের এখানকার মানুষ কেউ সৌয়দ, কেউ মিয়া, কেউ খন্দকার, কেউ শেখ, কেউ মির্জা, কেউ পাঠান, হাফেজ, কারী, মওলানা, মুন্সি প্রচুর ছিল এবং এখনও আছে৷ মুরুব্বীদের কাছে শুনেছি দু-একঘর পাঠান বংশিয় লোকেরা বাস করতেন৷ খাঁ সাহেবদেরতো ভূরি ভূরি প্রমাণ মেলে৷ এরা নাকি খূব উঁচু দরের খাঁন বংশিয় লোক৷ খন্দকার, ফারায়েজি, হাজামত, খৌরকার, চর্মকার, স্বর্নকার, বাঁশ-বেতের শিল্পীরা বাস করতো এখানে৷ এদের মধ্যে আজও উঁচু দরের সরাফতি আচার-আচরণ দেখা যায়৷ বলতে গেলে আটিয়াতে নানা বংশের আশরাফ-আত্রাবের লোক বাস করতেন৷ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ধনী ব্যাক্তিরা প্রায় সবাই আটিয়ার মাটি ছেড়ে শহরে সভ্যতায় ঠাঁই জমিয়েছেন৷ কেউবা একবারেই এ স্থান ত্যাগ করে চলে গেছেন, আর ফিরবেন না৷
এবার আলী বাবা হজরত আদম কাশ্মীরী (রঃ) তাঁর এতিম ভাগনে এবং তার কাছে রক্ষিত বায়েজিদ খানের ছেলে সাঈদ খাঁন এদেরকে মানুষ করার দিকে মন দিলেন৷ পাঠান বালক সাঈদ খাঁ এবং ভাগ্নে শাহ্ জামান (রঃ) বাবা কাশ্মীরী (রঃ) বিশেষ তত্বাবধানে শিক্ষা প্রাপ্ত হতে লাগলেন৷ ১২ বছরের শাহজামান (রঃ) এখন ৩০ বছরের পূর্ণ যুবক৷ সাঈদ খাঁনও তাই৷ উভয়েই সম বয়স্ক৷ শিক্ষার সাথে সাথে উভয়ের চরিত্রের ভিন্ন গুন ফুটে উঠতে লাগলো৷ শাহ্জামান (রঃ) শিক্ষার সঙ্গে কোরআন, হাদিস, ফেকাহ্, কেয়াস ইজমা ও সেইসঙ্গে মামার মত আধ্যাত্ম জ্ঞানেরও অনুশীলন রীতিমত করতে লাগলেন৷ সাথে নামাজ-কালাম, জিকির-আস্কার নিত্য সঙ্গী৷ অপরপক্ষে সাঈদ খাঁন সকল শিক্ষার চাইতে যুদ্ধ বিদ্যা চর্চা করতে বেশি পছন্দ করতে লাগলেন৷ আলী বাবা হজরত আদম কাশ্মীরী (রঃ) দু'শিষ্যের বিপরীতমূখী আচরণে আশ্চর্য হলেন না৷ তিনি বুঝলেন এ হল রক্তের তাছির৷ শাহ্ জামানের শরীরে রয়েছে অলিয়ে কামেলের রক্ত৷ আর সাঈদ খাঁনের শরীরে রয়েছে সৈনিকের রক্ত৷ বাবা শাহ্ জামান (রঃ) কাগমারির প্রশাসণ শিক্ষা বিস্তার তাঁর আদেশ প্রতিপালন করার জন্যে নিয়োজিত আছেন৷ বাবা কাশ্মীরী (রঃ) কাজ উপলক্ষে প্রায়ই কাগমারী যেতেন৷ আবার শাহ্ জামান (রঃ) জরুরী কাজে আটিয়া আসতেন৷ সমস্যা থাকলে মামা সমাধান করে দিতেন৷ ভাগ্নে রিষ্ট চিত্তে কাগমারী ফিরে যেতেন৷ তাতে মামা এত খুশি হতেন যে, নফল নামাজ আদায় পরম করুনাময়ের কাছে শাহ্ জামানের জন্যে দোওয়া করতেন৷ তিনি এই বলে দোয়া করতেন যে, এতিম ভাগ্নে তিনি যেন মানুষের মত মানুষ করেন৷ আল্লাহ তার দোয়া পুরোপুরি কবুল করেছিলেন৷ ফলে পরিণত বয়সে পুরো দস্তুর তাঁর মতই চরিত্রবান ও ধর্মভীরু সুশাসক হয়েছিলেন৷
সোনার গাঁয়ের শাসনকর্তা ঈশা খাঁ ইতোপূর্বে আটিয়া পরগণার পর কাগমারী পরগণা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ শাসন ক্ষমতা যুক্ত ভাবে আটিয়ার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরীর উপর৷ তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে কাগমারী পরগণা দেখাশোনা ও শিক্ষা দিক্ষা বিস্তারের জন্যে স্নেহধন্য ভাগ্নে শাহ্ জামান (রঃ) কে নিয়োজিত করেছিলেন৷ আটিয়ার কিছু কিছু কাজ সাঈদ খানকে দিয়ে চালাতে লাগলেন৷ এ সময় বাবা কাশ্মীরী (রঃ) নবতিপর বৃদ্ধ৷ বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছিলেন৷ আটিয়া ও কাগমারী পরগণার শাসন কাজ আর তাঁর ভাল লাগছিল না৷ তিনি মনে মনে স্থির করে ছিলেন অন্যের উপর পরগণার দ্বায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে একান্তে আল্লার ধ্যান খেয়ালে সময় কাটিয়ে দিবেন৷ আটিয়া এবং কাগমারি অনেক আগেই মোঘলদের অধীনে চলে গিয়েছিল৷ বাবা কাশ্মীরী মুঘলদের হয়েই নিশ্চিন্তে নিবিঘ্নে পরগণা চালিয়ে আসছিলেন৷ এখন কোন ঝামেলা আটিয়াতে সাঈদ খাঁন আর কাগমারীতে শাহ্জামান ভালোই চালাচ্ছেন৷ সবই ঠিক কেবল তিনিই বৃদ্ধ এবং শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দেবার সুযোগে দিনক্ষন গুনছিলেন৷ ইচ্ছা করলেই তো আর শাসনকাজ অন্যের উপর ছেড়ে দেওয়া যায় না৷ এটা মুঘল প্রতিনিধি ঢাকার সুবেদার ইসলাম খানের কাজ৷ তিনি শাসনক্ষমতা অন্যের উপর দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাবেন সময় সুয়োগে৷ সে সুযোগও ইনশাআল্লাহ্ এসে গেল সামনে৷ ঢাকার সুবেদার ইসলাম খাঁন তার অধিনস্থ সমস্ত পরগণা পুর্নবিন্যাস করার সিদ্ধান্ত নিলেন৷ একের পর এক পরগণাদারদের ঢাকায় ডেকে যাচাই বাছাই করে একসময় আটিয়া পরগণার শাসক আলি বাবা হজরত বাবা শাহানশাহ্ এর নিকট দূত পাঠালেন তিনি৷ আলি বাবাও চাচ্ছিলেন এটাই৷ দূতের পত্র পাঠ ক্ষণকাল গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন৷ সিদ্ধান্ত নিলেন এ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করবেন না৷ দূতকে বললেনঃ তিনি প্রস্তুত৷ অতি সত্তরই ঢাকার পথে রওনা দেবেন মাননীয় সুবেদার ইসলাম খাঁনের সঙ্গে দেখা করার জন্যে৷ দূত চলে গেলেন ঢাকায়৷
তারপর শুভক্ষন দেখে আল্লার নাম ভরসা করে রওনা দিলেন সুবেদার ইসলাম খাঁনের দরবারের উদ্দেশ্যে৷ সঙ্গে নিলেন তার আশ্রিত পাঠান যুবক সেনাপতি বায়েজিদ খানের পুত্র সাঈদ খাঁন এবং স্নেহধন্য ভাগ্নে শাহ্ জামানকে৷ এক সময় সহি সালামতে পেঁৗছে গেলেন ঢাকায়৷ সালাম-কালাম, কুশল বিনিময়ের পর সুবেদার বিশ্রামের আদেশ দিলেন পাইক পিয়াদাদের৷ সেদিন এই পর্যন্তই৷
পরদিন বিজ্ঞ ইসলাম খাঁ রাজকীয় মেহমানকে দেখলেন বয়সের ভারে যদিও নু্যব্জ্য প্রায় তথাপিও তিনি এখনও গায়ে গতরে শক্ত সামর্থ৷ মেহেদীমাখা চাঁপ দাড়ি বাবড়ি, শরীরে কাঁচা হলুদের মত রং, সৌম শান্ত এবং আত্মপ্রত্যয়ী বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে যথা নিয়মে সালাম ঠুকে আস্তে আস্তে প্রবেশ করলেন সুবেদার ইসলাম খাঁনের দরবার কক্ষে৷ বৃদ্ধের দু'পাশে সদ্য ফোঁটা গোলাপের মত টলমলে সুদর্শন চেহারার যুবকদ্বয়৷ তাদের হাতে মান্যবর সুবেদারের জন্যে আকর্ষনীয় নজরানা৷ অতিথিদের দেখা মাত্রই সুবেদার ইসলাম খাঁ নিজ আসন হতে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে সংরক্ষিত আসনে বসার অনুরোধ করলেন৷ ইসলাম খাঁ উপস্থিত সভাসদ ও আমন্ত্রিত অতিথীদের উদ্দেশ্য করে বলল্লেন মাননীয় সভাসদ বৃন্দ ইনিই হচ্ছেন আমাদের আজকের পরম শ্রদ্ধেও রাজঅতিথি আটিয়া পরগণার মহান শাসক আলি বাবা হজরত শাহানশাহ আদম কাশ্মিরী (রঃ) সবাই দাঁড়িয়ে রাজকীয কায়দায় অভিবাদন জানালেন তাঁদেরকে এবং বৃদ্ধের অতুলনীয় নূরানী চহারা মোবারকের দিকে তাকিয়ে রইলেন বিস্ময়ে৷ তিনি বলে চললেন আটিয়ার রিপোর্টে এমন একটা ব্যাতিক্রম দেখছি যার অকুন্ঠ প্রশংসা না করে পারা যায় না৷ ইসলামের অভূ্যদ্বয়ের পর একমাত্র চার খলিফার আমল বাদ দিলে শুধু বিলাসিতার রাজত্ব ব্যাতিত আর কিছুই নজরে পড়ে না৷ কিন্তু সেই বিলাসিতার বন্যার উর্দ্ধে থেকে শ্রদ্ধেও আদম কাশ্মীরী (রঃ) খাঁটি ও কর্তব্যপরায়ন৷ মুসলমান শাসক হিসাবে পরগণা শাসনের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন৷ একথা বলার পর সুবেদার ইসলাম খাঁ একটু থামলেন৷ উপস্থিত সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত বাবা আদম কাশ্মীরির (রঃ) ফরির দরবেশি জীবন পদ্ধতির কথা শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হলেন৷ তারপর ইসলাম খাঁ বললেন দিল্লীর বাদশাহ নামদার মহামতি সম্রাট আকবর খান যে সমস্ত মুঘল সম্রাজ্য সুখ সমৃদ্ধি ও আনন্দ কোলাহলে ভরে উঠুক৷ প্রত্যেক শাসক নিজ নিজ পরগনার প্রজা পালনে কল্যাণকর ভূমিকা রাখুক৷ উল্লেখিত অলোক সামান্য ব্যাক্তিটির মধ্যে এ সমস্ত বিরল গুনরাজি তো আছেই অধিকন্তু তিনি একজন সাক্ষাত ওলিয়ে কামেল আল্লাওয়ালা ব্যাক্তি৷ এমন প্রজা নিবেদিত প্রাণ শাসকই সবার কাম্য৷ আটিয়া পরগনার শাসক আলি বাবা হজরত শাহান শাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) আমাদের অনুকরনীয় আদর্শ৷ আমরা তাঁর সুস্বাস্থ্য ও কর্মময় দীর্ঘজীবন কামনা করি৷ তাঁর এ নাতিদীর্ঘ ভাষনের পর সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পড়লেন৷ অল্পক্ষনের মধ্যে সবাইকে বিদায় দিয়ে বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) কে নিয়ে পর্দার অন্তরালে চলে গেলেন৷ সেখানে হালকা নাস্তা পানি গ্রহণ করার পর এখানেই নাস্তার টেবিলে আবার একান্তে আলাপ শুরু করলেন৷ ইসলাম খাঁ প্রশ্নাতুর নেত্রে বল্ললেন বলুন আপনার আর্জি৷ আমি প্রস্তুত৷
বাবা কাশ্মীরী (রঃ) যথাযোগ্য মর্যাদা জানিয়ে বলতে শুরু করলেন৷ মহামান্য সুবেদার৷ আটিয়া পরগনার সুশাসনের জন্য যে দৈহিক ও মানসিক উপযুক্ততার দরকার তার সামান্যই বর্তমান আছে আমার মধ্যে৷ আমি নবতিপর বৃদ্ধ৷ এখন দুনিয়ার কোন ঝামেলাই আমার মন চায় না৷ আমার মন চায় সর্বদাই আল্লাহর ধ্যানে খেয়ালে দিন গুজরান করি৷ চাওয়া ও পাওয়ারতো জীবনে আর কিছূই বাকি নেই৷ তাই আমি আপনার আটিয়া পরগণা শাসনের গুরু দ্বায়িত্ব থেকে অবসর চাচ্ছি৷ অনুগ্রহ করে অব্যাহতি দিলে আমি আপনার মঙ্গলময় দীর্ঘ জীবন কামনা করতাম৷ ইসলাম খাঁ অত্যন্ত প্রীত হলেন৷ বৃদ্ধের আবেদনময়ী অথচ আন্তরিক আর্জিতে যারপর নেই অভিভূত হলেন৷ কাল বিলম্ব না করে ইসলাম খাঁ বল্ললেন আপনার দরখাস্ত মঞ্জুর করা হলো৷ এখন অনুগ্রহ করে বলুন আটিয়া পরগণা শাসনের জন্যে আপনার মনোনীত ব্যাক্তি কে ? আপনি যার নাম প্রস্তাব করবেন আমি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকেই ঐ কাজে নিযুক্ত করবো৷ আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি আপনার পছন্দের ব্যাক্তি আপনার গুনাবলী না পেয়েই যায় না৷ তাই আমি আপনার ঈস্পিত ব্যাক্তিকে এখনই আপনার স্থলাভিষিক্ত করবো৷ বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) অত্যন্ত বিগলিত চিত্তে অঙ্গুলী নির্দেশ করে দেখিয়ে দিলেন সঙ্গে আনা অত্যন্ত বলিষ্ঠ তেজদ্বীপ্ত চাদুনী পাঠান যুবক সাঈদ খাঁকে৷ মুখে বল্লেন একে আশৈশব শাসন কাজের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে চলেছি আমি৷ এ যুবক হচ্ছেন মুঘলদের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি বায়েজিদ খাঁর পুত্র সাঈদ খাঁ৷ তারপর এই পাঠান পুত্রের গোড়ার ইতিহাস তুলে বললেন এক সময় বাংলায় মুঘল পাঠান পাল্টা পাল্টি যুদ্ধ শুরু হয়৷ হত্যা, লুন্ঠন, রক্তপাত কহতব্য ছিল না৷ তা সত্তেও মুঘল শাসন বাংলার জনপদে শক্তই ছিল৷ কিন্তু সুবেদার মুজাফর খাঁ পাঠানদের ঝটিকা আক্রমনে নিহত হন৷ তখন মুঘলদের উপর নির্মম জুলুম নেমে আসে৷ যেখানে মুঘলদের সন্ধান পায় সেখানেই মরন আক্রমন করে মুঘলদের ধ্বংস না করে ছাড়ে না৷ কিন্তু পাঠানরা সবচেয়ে বড় বাধা পেলেন মুঘল সেনাপতি বায়েজিদ খানের কাছ থেকে৷ তিনি চোরাগুপ্তা আক্রমন চালিয়ে পাঠান সেনা ও শাসকদের খতম করে চল্লেলেন৷ এতে তারা ভয়ানকভাবে পর্যদস্তু হয়ে পড়লো৷ তারা এই বায়োজিদ সেনাপতিকে ধরা বা নিহত করার জন্যে স্থানে স্থানে সংঘবদ্ধ চিরুনী অভিযান চালালেন৷ এতে বায়েজিদ এর সবগুলো সৈন্য হয় নিহত না হয় আত্মরক্ষার জন্য যে যেদিকে পারলো পালাতে লাগলো৷ এবার তাদের প্রধান সেনাপতি বায়োজিদ খাঁকে খতম করা হবে৷ কোথায় সে ? ধর তাঁকে৷ একথা সেনাপতি বায়েজিদের কানে পেঁৗছে গেলে তিনি আত্মরক্ষার জন্য পথ খুঁজতে লাগলেন৷ পশ্চিম এবং উত্তর দিক পাঠান সৈন্য দ্বারা লৌহ প্রাচীর নির্মিত৷ সুতরাং দিল্লিতে ফেরা আপাতত অসম্ভব৷ দক্ষিন দিক নদীনালা সমুদ্র৷ ওদিকেও যাওয়া নিরাপদ নয়৷ তাই পূর্বদিক খোলা আর উচুভূমি এবং নিরাপদও বটে৷ তিনি ছিলেন অশ্ব রোহী দলের সেনাপতি৷ তাই শক্তিশালী এক তেজী ঘোড়া বেছে নিয়ে পিঠে উঠে জোরছে চাবুক কষলেন৷ পূর্বদিকে ঘন্টার পর ঘন্টা কতক্ষন যে মুঘল রাজধানী গৌড় হতে চলে এসেছেন তা তার খেয়াল নেই৷ একসময় হঠাত্ দেখতে পেলেন, সাগর সদৃশ বিরাট প্রশস্ত নদী৷ সেই কাক ডাকা ভোরে ঘোড়ায় সোয়ার হয়েছেন৷ এখন দিন গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেল৷ ঘোড়া হতে নেমে পড়লেন৷ যে করেই হোক নদী পার হতে হবে৷ সন্ধান করতে লাগলেন লোকজন আর নদী পারাপারের নৌকা৷ কিন্তু দুটোর একটাও চোখে পড়ছে না৷ তবে বেশ দূরে লোকালয়ের সন্ধান দেখা যাচ্ছে৷ ছুটালেন ঘোড়া পাড় ধরে সেই দিকে৷ অল্পক্ষণ পরেই সেখানে একটা বাড়িতে এসে এক মধ্য বয়সী দাঁড়িওয়ালা গেরস্তকে দেখে নদীর নাম এবং কিভাবে এটা পার হওয়া যায় জিজ্ঞাস করলেন তাকে৷ লোকটি বলল নদীর নাম যমুনা, প্রশস্ত প্রায় ১০/১২ মাইল৷ পাড় হতেও ১০/১২ কাহন লাগবে৷ কাহন এখন টাকাই বুঝায়৷ পাড়াপাড় হতে নৌকা ছাড়া উপায় নেই৷ বায়েজিদ খাঁন পালিয়ে আসার সময় ব্যাগভর্তি বেশ কিছু স্বর্ণ মূদ্রা সঙ্গে করে এনেছিলেন৷ তিনি বুদ্ধিমান তাই খালি হাতে আসেন নাই৷ তিনি গেরোস্ত লোকটিকে বলেন পাড়ের জন্য ১০ কাহন এবং পুরষ্কার হিসাবে আস্ত একটা স্বর্ন মুদ্রা পাবে, চল৷ আর যায় কোথায়! মাসে মেলে না ১০ কাহন, আর স্বর্ণ মূদ্রা ! আধা বয়সী লোকটি ডাকাডাকি হাকাহাকি শুরু করে দিল.................... কই রে মাইঝা বাহে, শিঘ্রই আয়৷ কেড়ায়া পাইছি৷ ওপাড় যাতি হবি, চলি আয়৷ কইরে টেপির মা, হুকা, কলকি তামাক দিয়ে যা৷ ডাক শুনে তিন তাগড়া জোয়ান ছেলে এসে নৌকায় ঘোড়ার পায়ের তলায় খড় বিছিয়ে বায়েজিদকে নায়ে উঠিয়ে বদর বদর বলে ঝপাঝপ দাড় ফেলে দিল নদী পাড়ি৷ বায়েজিদ এতোক্ষনে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন৷ এখন শত্রুর নাগালের বাইরে এসে গেছেন৷ শুকুর গুজারী করলেন আল্লার দরবারে৷ অনেকক্ষন পর এসে ভোর বেলায় পূর্ব পাড়ে নৌকা ভিড়লো৷ মাঝি মাল্লাদের পাওনা পরিশোধ করে ঘোড়া নিয়ে নেমে পড়লেন পাড়ে৷ আর তাদের সাবধান করে দিলেন যে, কেউ যদি জিজ্ঞাস করে তবে জানিনা বলে এড়িয়ে যাবে কেমন৷ তারা স্বীকারউক্তি দিয়ে আবার ওপাড়ে চলে গেল৷ কিন্তু বায়েজিদ এখন যাবে কোথায় ? তবে তিনি মুঘল সুবেদার মুজাফর খাঁ তুর বর্তির কাছে শুনেছিলেন যে, যমুনা নদীর ওপাড়ে মস্নদ ই আলা সুবাদার ঈশা খানের রাজত্ব৷ ঈশা খাঁ শক্তিশালী মুঘল কতর্ৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সুবাদার৷ সুতরাং তার রাজ্যে শত্রুরা তার পশ্চাদধাবন অসম্ভব৷ তাই তিনি হৃষ্ট চিত্তে আরও পূর্ব দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে একটা নির্জন সুবিধামত আশ্রয় পেয়ে গেলেন৷ ভাগ্য ভাল এক মুসলমান বৃদ্ধের বাড়ি এটা৷ বাড়ির সামনে খড়ের দোচালা ঘর৷ বাইরে ছোট বাঁশের মাচি আর ভিতরেও আধা ঘরে মাচি৷ পরিষ্কার ছিমছাম মাচির উপর খেজুর পাতার চাটাই বিছানো৷ বায়েজিদ এটাকেই থাকার উপযুক্ত স্থান মনে করলেন৷ সূর্য এখনও উঠেনি৷ ফজরের নামাজ আদায় করার জন্যে বৃদ্ধ এই মাত্র ওজু সারা করে বিদেশী মেহমানের আগমন দেখে বদনা রেখে উঠে দাঁড়ালেন৷ বায়েজিদ ভূমিকা না করে বৃদ্ধের কাছে বিশ্রামের জায়গা কামনা করলেন৷ বৃদ্ধ রাজি হলেন বটে কিন্তু এতবড় মেহমানকে থাকতে দেবেন কেমন করে ? বায়েজিদ বৃদ্ধের মনোভাব বুঝতে পেরে বল্লেন ঐ ঘরের বাঁশের মাচির উপর বিশ্রাম নিতে তাঁর কোন অসুবিধা হবে না৷ বৃদ্ধের মেয়ে আমিনা মেহমানের আগমন বার্তা টের পেয়ে ত্বরায় ডালভাত যা পাড়লো পাক করে বাবাকে দিয়ে মেহমানের সামনে পাঠিয়ে দিল৷ মেহমান তাই-ই অভূক্ত পেটে খেয়ে অবসন্ন হয়ে শীঘ্রই মাটির উপর গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন৷ সারাদিন এবং সারারাত বায়েজিদ খাঁন এবং আশ্রয়দাতা বৃদ্ধের মধ্যে আর কোন কথাই হল না৷
পরের দিন পরিচয়ের পালা৷ বাড়ির মালিকের নাম আব্দুল করিম৷ এ নাম আলি বাবা হজরত শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরীর দেয়া৷ আগে তিনি হিন্দু কায়স্থ ছিলেন৷ বছর তিনেক আগে আলী বাবা কাশ্মীরীর হাত ধরে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়া শীতল কোলে আশ্রয় নিয়েছেন৷ এই বলে বাবা কাশ্মীরীর উদ্দেশ্যে ছালাম জানিয়ে নিলেন৷ তার এ অপরাধের জন্যে তার আত্মীয় স্বজন সবাই ক্রুদ্ধ হয়েছেন৷ সহদর ভাইয়েরা বড় দুই ছেলে ও বিবাহিত দুই মেয়ে জাতিচু্যত বলে বৃদ্ধকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে৷ তাইতো গ্রাম ছেড়ে বাইরে ছোটখাটো করে কুড়ে ঘর তৈরি করে ছোট মেয়ে আমিনাকে নিয়ে একাকিত্বে নির্জনে বাস করছেন৷ মেয়ে আমার জানের জান৷ কিছূতেই আমাকে ছাড়তে পারলো না৷ সেও মুসলমান হয়ে আমার সঙ্গে বাস করছে এখানে৷ এ বলে বৃদ্ধ চোখের পানি ফেলে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন৷ এই কান্না অবস্থায় বল্লেন কেউ আমার ছায়াও পর্যন্ত মাড়ায় না৷ তারা বলে ধর্মচু্যত হয়েছি বলে আমি এবং মা আমিনা উভয়েই মৃত৷ তিনি তাদের কাছে অস্পৃশ অসুচি তাই এই নির্জনতা বাপ বেটিতে বেছে নিয়েছেন৷ মেয়েটা বিবাহের যোগ্যা৷ তাকে ছাড়া তিনি একদন্ড থাকতে পারেন না৷ কিন্তু বিবাহের কোন পাত্র পাওয়া যায় না৷ পাত্র খুঁজতে গেলে মুসলমান বর পক্ষ বলে হিন্দুর মেয়ে, আর হিন্দুরা বলে তার মেয়েকে নেবেই না৷ সে যাই হোক সত্ বংশীয় কোন মুসলামান ছেলে পেলে ভিটে মাটি যা আছে তা বিক্রি করে কন্যাদায় হতে রেহাই পেতেন৷ পীর বাবা হজরত শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) বলেন ..............তার চিন্তার কোন কারণ নেই৷ আল্লাহ রহমানির রাহিম৷ তার মেয়ের জন্যে তিনি সু-পাত্রই যোগাড় করে দেবেন৷ তিনি আরও বল্লেনঃ তুমি বাড়ি গিয়ে আল্লাহ আল্লাহ কর৷ তাইতো নামাজ পড়ি৷ দোয়া খায়ের পাঠ করি৷ আর মোনাজাত করি তিনি যেন তাঁর মেয়ের জন্যে একজন সত্ পাত্র জুটিয়ে দেন৷ এই বলে বৃদ্ধ আবার চোখের পানি মুছতে লাগলেন৷
অনেকক্ষন দু-জনেই চুপচাপ৷ কারোও মুখে কোন কথা নেই৷ সৈনিক হলেও বায়েজিতের দয়ার্দ দিল একটু বেদনা আপ্লুত হল৷ মনে মনে বলতে লাগলেন কি করে এই অসহায় পরপোকারী বৃদ্ধকে সাহায্য করা যায়৷ আর কি করেই বা তার বিবাহযোগ্যা মেয়েকে পাত্রস্থ করা যায়৷ কিন্তু তিনি তো বিদেশী৷ এখানে সবই অজানা৷ অচেনা৷ তাকেও কেউ চেনে না৷ কে কার কথা শুনবে ? আবার ভাবলেন, সোনার মোহর এনেছেন এক ব্যাগ ভর্তি৷ তিনি আরাম আয়েশে খেতে পড়তে পারবেন, কোনদিন ফুরাবে না৷ মধ্যপ্রাচ্য এমনকি ভারতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বহু ভাগ্যান্বেসী লোক বাংলায় এসেছেন--- এক সময় ধনে মানে সৌভাগ্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহন করেছেন৷ সুখ শান্তি প্রাচুর্যের বাংলা তাদের কাউকে এখন দিয়েছেন সাত পুরষ বসে খেলেও কোনদিন ফুরাবে না৷ তাঁরতো দিল্লী যাওয়ার পথই এখন নিষ্কটক নয়৷ পথিমধ্যে সংহার মুর্তির হাজার বাধা৷ এ মুহুর্তে জীবন বিপন্ন করে দেশে ফিরতেও তিনি নারাজ৷ মুঘলদের বাংলার রাজধানী গৌড়ের খবর তিনি নিজেই জানেন৷ দিল্লীর খবর ইচ্ছা থাকলেও পাওয়ার উপায় নেই৷ বায়েজিদ খাঁন ভাবছেন তো ভাবছেনই৷ তিনি সঙ্গে করে যে মোহর এনেছেন তার মূল্য বাংলার মুদ্রা মানের তুলনায় অনেকগুন বেশি৷ এখানে একটা মোহর ভাংগালে পাওয়া যায় ষোল টাকা, এক টাকা ভাংগালে পাওয়া যায় চৌষট্টি পয়সা, আর এক পয়সা ভাংগালে পাওযা যায় আশিটি কড়ি৷ এক পয়সা সের দুধ, দুই আনা বা আট পয়সায় পাওয়া যায় একমন চাল৷ একটা মুরগীর দাম ৪ পয়সা৷ একটা গরুর দাম ১ টাকা৷ কি সস্তা বাংলার জিনিষ৷ তার সঙ্গে আনা স্বর্ণ মূদ্রা৷ তিনি দশ বারোটি কড়িও খরচ করে খেলে রাজার হালে দিন যাবে৷ এ বাংলা প্রাচুর্যে ভরা৷ তাইতো যুগে যুগে সম্পদে পরিপূর্ণ এই দেশ বিদেশীদের হাতছানি দিয়ে ডেকেছে৷ এখানে এসেছেন বিশ্ব বিজয়ী আলেকজান্ডার, পাঠান, মুঘল বাদশারা ও ভূ পর্যটক বৃন্দ৷ তারা বাংলার অপার শান্তি প্রাচুর্য দর্শনে বিস্ময়ে অবিভূত হয়েছেন৷ এসব কথা পর্যটকরা নিজ হাতে লিখে গেছেন৷ অল্প পরিশ্রমে অনেক কিছুই মেলে এখানে৷ জনগণ সরল সহজ, ধর্মভীরু৷ আবহাওয়া মনোরম ও স্বাস্থ্যপ্রদ৷ বায়েজিদের চিন্তা জগত্-এ কল্প নদীর বান ডেকেছে৷ এ চিন্তা স্রোত কতক্ষন যে বইবে কেউ তা জানে না৷ বুড়ো আব্দুল করিমের সকরুন জীবন কাহিনী যারপর নেই তাকে অবিভূত করেছে৷ তাঁকে এহেন নিষ্ঠুর দন্য দশা থেকে উদ্ধার করতেই হবে৷ কিন্তু কিসে ? বায়েজিদের চিন্তা রাজ্যে ঘুর্নিঝড় বইছে৷ হতাশ যেন তার চিন্তা জগত্-এ অলংঘনীয় বাধা আসে৷ বৃদ্ধ নিজ মুখেই বলেছেন তার বিবাহ যোগ্যা এক কন্যা সন্তান আছে৷ বিবাহের পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না৷ তাকেও অনেকদিন গাঁ ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে এই দেশে৷ থাকারও জায়গা নেই৷ বিদেশ বিভূই-এ কে তাকে জায়গা দেবে ? এমনিতে কারো বাড়িতে তার মত একজন সেনাপতি থাকতেও পারে না৷ আলহামদুলিল্লাহ্ ! বুড়োর এই মেয়েকেই তিনি বিয়ে করে এখানেই থেকে যাবেন৷ তা চিরদিনই হোক বা কয়েক বছরই হোক৷ কোন কথা নেই৷ তবুও তো থাকার একটা ঠাঁই হলো৷ ইতকার চিন্তায় পুরো একটা দিন তার কেটে গেল৷ পরের দিন হঠাত্ এক ফাঁকে বুড়োর মেয়েকে এক ঝলক দেখলেন৷ সত্যিই আমিনা সুন্দরী৷ নব যৌবনা৷ তিনি তাঁকে দেখে চমত্কৃত হলেন৷ তিনি মনে করেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের মেয়েরাই খুব সুন্দরী হয়৷ এ দেশীও মেয়েরা তত সুন্দরী নয়৷ কিন্তু এ মেয়ে দেখে তাঁর সে ধারনা সম্পূর্ন পাল্টে গেল৷ বাঙ্গালী ঘরের মেয়ে এত সুন্দরী হয় ! এ রূপে কার না চিত্ত দাহ হয়৷ রূপ যৌবন সব মিলিয়ে নিবিড় প্রশান্তি বিরাজ করছে তার সর্বাঙ্গে৷ এ রূপের সায়রে যে একবার অবগাহন করবে সে সত্যিই ধন্য হবে, পাবে অপরিমেয় সুখ শান্তি৷ এ মেয়ে অন্য কারো হতে পারে না৷ এ মেয়ে হবে তারই এবং একান্তই তার৷ বায়েজিদ দৃঢ় সংকল্প চিত্ত হলেন৷ এই মেয়েকে তিনি বিয়ে করবেনই৷ আর এখানেই হোক তার জীবনের প্রতিষ্ঠা৷ এক শুভক্ষনে বায়েজিদ বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হলেন গ্রাম বাংলার মেয়ে আমিনার সঙ্গে৷ অল্পদিনে মেয়ের আচার আচরণ, আদর আপ্যায়ন, বুদ্ধিমত্তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার৷ সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হলেন মেয়েটির স্বামী নিবেদিত প্রান দেখে৷ তিনি শুনেছিলেন গ্রাম বাংলার রমনীকুল পতিপরায়না৷ বাস্তবে তিনি আজ স্বচক্ষে তাই দেখলেন৷ বায়েজিদ বুড়োর কুড়ে ঘরগুলি পাল্টিয়ে টিনের সুন্দর চারিটি ঘর চার ভিটায় তুলে দিলেন৷ বাড়ির পরিবেশ করলেন ছিমছাম৷ দেখলে মনে হয় একজন উন্নত পরিবারের বাসস্থান৷ কিছু ভদ্র পরিবারের লোকেরাও ইতোমধ্যে তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘর দোড় তৈরি করে বসবাস করতে লাগলেন৷ বুড়ো শ্বশুর আব্দুল করিমের সংসার যেন আনন্দের বন্যায় ভাসছে৷ আল্লাহর করুনায় দশ মাস দশ দিন পর আমেনার কোল জুড়ে এলো এক টুকরো ফুটফুটে শিশু পুত্র৷ বুড়ো নিজেই নাতি ভাইয়ের নাম রাখলেন সাঈদ৷ বুড়ো শ্বশুর সব সময় মেতে থাকেন তার স্নেহধন্য নাতি ভাইকে নিয়ে৷ বায়েজিদ এ সংসারকে একটা শান্তির নীড় রচনা করেছেন ভেবে নিজেকে ধন্য মনে করেন৷ এভাবে দিন যায় মাস যায় বছর পেরিয়ে আরও কয়েক বত্সর চলে গেল৷
একদিন বাংলার রাজনীতির সর্বনাশা খেলা এ সংসারে আঘাত হানলো৷ বায়েজিদ একদিন জানতে পারলেন বাংলা মুলুক আফগান শাসনমুক্ত৷ সম্মিলিত মুঘল বাহিনী পাঠানদের সম্পূর্ন পরাজিত ও বাংলার বুক থেকে বিতাড়িত করেছেন৷ মুঘল রাজত্ব নিঃকন্টক করেছেন৷ গ্রাম গঞ্জ সর্বত্রই এখন শত্রুমুক্ত৷ দিল্লী ও বাংলা গমনাগমন শঙ্কা মুক্ত৷ দিল্লীর শাসন বাংলার বুকে সু প্রতিষ্ঠিত৷ শুষ্ক প্রায় নদীতে বান ডাকলো৷ মনটা বায়েজিদের আনন্দদোলায় দোল খেতে লাগলো৷ তিনি ভাবলেন তার নিরুদ্দেশ থাকা ও বাংলার নিভৃত কুঞ্জে আত্মগোপনের পালা বুঝি শেষ হয়ে এলো৷ তার দিল্লী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে৷ কিন্তু চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই বৃদ্ধ শ্বশুর আব্দুল করিম হঠাত্ একদিন জান্নাতবাসী হলেন৷ তার চিন্তা স্রোতে খানিকটা বাধা পড়লো৷ কিন্তু তাকে এ বাধা অতিক্রম করতেই হবে৷ অবশ্যই তাকে অভিষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে হবে৷ তিনি হলেন একজন ক্ষত্রিয়৷ ক্ষাত্র ধর্ম খচ্চর ধর্ম৷ কিছুতেই মন মানতে চায় না৷ ভিতর থেকে প্রবলভাবে মাথা চারা দিয়ে উঠে পথ পাবার জন্য৷ তাকে ব্যাকুল করে তুলল দিল্লী যাবার নেশায়৷ এবার পূর্বের চেয়ে আরও সুন্দর খবর এলো৷ আফগান পাঠানদের যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে ইতোত বিক্ষিপ্ত বাংলার আনাচে কানাচে মুঘল সৈন্য যারা আত্মগোপন করে আছেন তাদের আর ভয় নেই৷ সম্মিলিত মুঘল বাহিনীর সঙ্গে নির্ভয়ে দিল্লী যেতে পারেন৷ এজন্যে এই বাহিনী প্রধান মির্জা আজিম কোকা ফরমান জারী করলেন৷ বায়েজিদ ভয়ানকভাবে মরিয়া হয়ে উঠলেন৷ তিনি ভাবনায় পাগল হয়ে গেলেন৷ সে ভাবনা একদিকে স্ত্রী-পুত্রের অচ্ছেদ্য বন্ধন, অপরদিকে দেশে ফিরে যাবার প্রবল আকর্ষন৷ একসময় বিস্মিল্লা বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি৷ আল্লাহ যদি তাকে সহি সালামতে রাখেন তবে অবশ্যই স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে আবার মিলিত হবেন৷ সুতরাং বিলম্ব করা তার জন্যে ঠিক হবে না৷ তাঁকে ফেরার জন্যে মিলিত হতে হবে সেনা প্রধান মির্জা কোকার সঙ্গে৷ দিল্লীতে ফিরে বাদশাহ্ নামদার মহামতি আকবরের সঙ্গে সাক্ষাত করবেন৷ তাঁর এটাই এখন উত্তম সুযোগ৷ এই সুযোগ এই মুহুর্তে হারালে একজন সেনাপতি হয়েও সারা জীবন সুবেদারের অধীনে সামান্য চাকুরী করতে হবে৷ কিন্তু সেটা তার পক্ষে অসম্ভব৷ তাই তিনি বিদায়ের বন্দোবস্তো করলেন৷ অল্প দিনের মধ্যেই একদিন সোনার টুকরা শিশু পুত্রকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে অশ্রু সিক্ত নয়নে উপস্থিত হলেন আলী বাবা হজরত শাহানশাহ্ বাবা আদম কাশ্মীরীর দরবারে৷ বায়েজিদ এ সংকটজনক মুহুর্তে স্ত্রী এবং পাঠান শিশুকে আশ্রয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করলেন বাবা কাশ্মীরী৷ তবে শর্ত যত শীঘ্র পারেন দিল্লী গিয়ে কার্য শেষে স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে যেতে হবে৷ বায়েজিত এতে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন৷ তবে তিনিও ওয়াদাবদ্ধ হলেন স্ত্রী পুত্র অবশ্যই নিয়ে যাবেন কার্য সিদ্ধি হলে৷ বায়েজিত নিশ্চিন্ত হয়ে স্ত্রী পুত্রকে একান্তে ডেকে তাদেরকে ডেকে অঝোরে কাঁদলেন৷ তিনি পতি প্রাণা স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়ে বললেন তিনি বাদশার দরবারে পেঁৗছেই ভাল একটা চাকুরী নিয়ে পরে এসে তাদের দিল্লী নিয়ে যাবেন৷ তাতে ভুল হবার কথা নয়৷ বাকি মাবুদ ভরসা৷
এদিকে বায়েজিদের স্ত্রী আমিনার বুকফাটা আহাজারি বাবা জান্নাতবাসী হলেন কিছুদিন আগে৷ মাতো অনেকদিন আগেই দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে পরপারে চলে গেলেন৷ ৷ ভরসা ছিল একমাত্র স্বামী৷ সেও তাঁর শিশুপুত্র সাঈদকে রেখে দিল্লীর উদ্দেশ্যে চলে গেলেন৷ বাবা ধর্মান্তরিত হওয়ার অপরাধে তাদের মুখ দর্শন করে না আত্মীয় স্বজনেরা৷ সংসারে আপন বলতে তার আর কেউ নেই৷ আশ্রয়দাতা বাবা শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরী অতিশয় বৃদ্ধ৷
লেখক পরিচিতি ঃ জনাব নূরুল ইসলাম মাষ্টার একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক৷ তিনি অনেকদিন ধরেই লিখেন৷ তাঁর প্রিয় বিষয় ইতিহাস৷ তাছাড়া কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক এগুলোতেও চমত্কার হাত আছে৷ ইতিমধ্যেই তার বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে৷ পত্র পত্রিকাতেও লেখেন তিনি৷ তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে আকাশ, কমল কলি, টুকটাক, রূপসী ললনা, বঙ্গরত্ন শামসুল হক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য৷ এ সমস্ত গ্রস্থরাজি পাঠক সমাজে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে৷ তিনি অবসরজীবন লেখা লেখি করেই কাটান৷ তার লেখার মধ্যে মননশীলতার ছাপ আছে৷ এ লেখা গুলোতে তিনি বিভিন্ন রসের চমত্কার সমন্বয় বর্তমান পরিলক্ষিত হয়৷
নিজ ধর্মের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস থাকলেও তাতে গোড়ামি নেই৷ সুফি ও বাতিল মতবাদ তার কাছে প্রিয়৷ তিনি মনে করেন-
নানা বর্নের গাভী রে ভাই, একই বর্নের দুধ
সারা দুনিয়া ঘুইরা দেখলাম, একই মায়ের পুত৷
বা
সিন্ধু রূপ পুকুড় রে ভাই, ঘাটে ঘাটে বিচার
সব ঘাটেতে একই পানি নেইকো জাত বিচার৷
বা
ডালে ডালে ঘুরে বেড়াই ভাঙ্গল নারে ভুল
হাজার ডালে গাছের শোভা, রস টানে এক মূল৷
এলাকার শিক্ষা বিস্তারে তাঁর বিরাট অবদান আছে৷ ছিলিমপুর এম, এ, করিম উচ্চ বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য ও প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক, আটিয়া শাহানশাহী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, পাকুল্যা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উত্সাহ দাতা ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ছিলিমপুর বাজার হাফেজিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, সুবর্নতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের খন্ডকালীন অবৈতনিক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক৷ নিজ গ্রামে ফোরকানিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, ছিলিমপুর বাজার জামে মস্জিদকে টিনের ঘরের পরিবর্তে পাকা করণ ও এর সামনে পুকুর খনন তাঁর প্রত্যক্ষ মদদে প্রতিষ্ঠিত৷
তাঁর রচিত শামসুল হক বিস্মরনের অপর নাম, ছোটদের ভাসানী, ছোটদের বঙ্গবন্ধু, ছোটদের জিয়া প্রভৃতি শিঘ্রই প্রকাশিত হবে বলে পান্ডুলিপি তৈরি আছে৷
মোঃ নূরুল ইসলাম মাষ্টার
রূপসী প্রকাশনী
টাঙ্গাইল৷
প্রথম প্রকাশ ২০০৯ইং
অলংকরনঃ মোঃ শামসুজ্জামান (পাশা)
যোগাযোগঃ
মোঃ নূর কুতুবুল আলম (পলাশ)
রূপসী কম্পিউটার
৬৬ নং পৌর সুপার মার্কেট, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, টাঙ্গাইল৷
ফ্যাঙ্ ঃ ০৯২১-৬২১৫১, মোবাইলঃ ০১৯১২-০৯৮৮৫৫৷
ই-মেইলঃ rupushe@yahoo.com
উত্সর্গ সারা বাংলায় ছড়িয়ে থাকা বুজর্গানে দীন ওলিয়ে কামেল, সব তরিকার ভক্ত, আশেকান, পীর, মুর্শিদ, শিষ্য, দরবেশ, ফকির, আল্লাহ্ ও তার নবীর অনুরক্তদের ও আপামর জনগনের করকমলে৷
লেখকের আরও কিছু প্রকাশিত গ্রন্থ
* টুকটাক * রূপসী ললনা * বঙ্গ রত্ন শামছুল হক (১)
* হাজী বাড়ির ইতিহাস * কমল কাঞ্চন
প্রকাশক
আটিয়া দরগা কমিটির সকল মাননীয় কর্মকর্তা ও খাদেম বৃন্দ৷
সার্বিক সহযোগিতায়ঃ ............................................৷
মূল্য ১৫০.০০ (একশত পঞ্চাশ) টাকা মাত্র৷
ATIA HOTE TANGAIL
PRICE: 150.00
U. S. A. 2$
আটিয়ার ইতিহাস
শাহান শাহ্ আদম কাশ্মীরী (র:)৷ সঙ্গত কারণেই আটিয়াকে জানার আগে এ তাপস কুল শিরোমনিকে জানা দরকার৷ গ্রন্থ খানির ভিতর এ বিষয়ে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য মাত্র৷
ভূমিকাঃ আটিয়া একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রাচীন জনপদ৷ এর গোড়ার ইতিহাস অনেক পুরান এবং অস্বচ্ছ৷ প্রামাণ্য দলিল ছাড়া তা জানারও উপায় নেই৷ রাজকীয় যত্ সামান্য দলিলপত্র, স্মৃতি চিহ্ন, ধ্বংসাবশেষ জনশ্রুতিতে যে আদি কথা জানা যায় তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য৷ ঐতিহাসিকগণের সংগৃহিত সরকারি কাগজপত্রে পাল, সেন, দেব ও সুলতানি আমলের ইতিহাসের ফাঁক ফোঁকরে এর পরিচয় সামান্যই মেলে৷ যদিও স্বল্প পরিসরে মেলে তথাপিও ঐতিহাসিক মূল্যবোধের দিক দিয়ে অত্যন্ত উঁচু মানের৷ আজ টাঙ্গাইল বাংলাদেশের সব দিক দিয়ে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী৷ কিন্তু এটা সত্য যে আটিয়ার জন্ম না হলে আধুনিক টাঙ্গাইলের জন্ম হতো কিনা সন্দেহ৷ যিনি ইতিহাসের মানদন্ডে একে অন্ধ গলি থেকে টেনে এনে জন সমাজে দাড়ঁ করিয়েছেন তিনি হলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ওলিয়ে কামেল, আলি বাবা হযরত আদম কাশ্মীরী (রাঃ)৷ তিনি কাশ্মীর থেকে আগত একজন বিশিষ্ট ইসলাম প্রচারক, সাধক, পীরে কামেল ও আউলিয়া দরবেশ ছিলেন৷ জনশ্রুতি আছে তিনি ছিলেন কাশ্মীর রাজ্যের বাদশাহ৷ রাজ্যপাট পরিত্যাগ করে এ দরবেশি রূপ ধারণ করে সুদূর আটিয়া পরগণায় এসে আস্তানা গাড়েন তা তিনিই ভাল জানেন৷ যতটুকু প্রমাণ মেলে তাতে ১৪৪২ হতে ১৪৮০ সালের মধ্যে তিনি আটিয়াতে শুভাগমন করেন৷ তার জন্ম তারিখ জানা না গেলেও তার মাজারে ঢোকার প্রধান গেইটের উপরে তার মৃতু্য তারিখ ৯১৩ হিজরীর ৭ জমাদিও সানি৷ আগে এ সন তারিখ ফার্সি লিপিতে শিপিবদ্ধ করা ছিল৷ এর পাঠোদ্ধার করে বাংলায় উত্কীর্ণ করা হয়েছে৷ পরে আদম কাশ্মীরী (র:) নামের আগে কেন শাহান শাহ্ লেখা হয় তা আটিয়া নিবাসী প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মরহুম মাইন উদ্দীন বি, এ, বিটি, তার লিখিত প্রবন্ধে প্রকাশ করেছেন৷ এটা সুনামধন্য করটিয়ার জমিদারদের দেওয়া নাম তবে মতভেদ আছে এতে৷ আগে লেখা হতো শাহে শাহান অর্থাত্ দুনিয়ার বাদশা৷ পরে লোক মুখে উচ্চারিত হতে হতে শাহান শাহ্ রূপ ধারন করেছে নামটি৷ বাবা কথাটির ব্যাখ্যাও তিনিই দিয়েছেন৷ আদম কাশ্মীরী (রঃ) করটিয়া জমিদার বংশের পূর্ব পুরুষদের পীর এবং আটিয়া পরগণার প্রতিষ্ঠাতা প্রশাসক৷ পরে এ মহান ব্যক্তির বদৌলতে জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা সাঈদ খান পন্নীকে তা দান করে যান৷ তিনি বলেছেন বাংলা দেশের মানুষ পীর মুশর্ীদদের খুব ইজ্জত করার জন্য বাবা কথাটি ব্যবহার করে থাকে৷ তাই তাঁর পূর্ণ নাম হল আলি বাবা হজরত শাহান শাহ আদম কাশ্মীরী (র:)৷ বাবা কথাটির আগে কেন আলি শব্দটি ব্যবহৃত হয় তার উল্লেখ তিনি করেননি৷ এবং তাঁর পান্ডুলিপিও আজ আর পাওয়ার উপায় নেই৷ তিনি জীবিত থাকা কালে এ সম্পর্কে বলেন টাঙ্গাইলের মাননীয় জেলা পরিষদ সচিব জনাব বাকের সাহেব আটিয়ার প্রাচীন ইতিহাস লেখার প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা একবার আহবান করেন এবং তাতে তাঁর গবেষণা ধমর্ী লেখাই প্রথম স্থান অধিকার করে এবং পুরস্কার প্রাপ্ত হন৷ তারপর অযত্নে অবহেলায় কোথায় প্রবন্ধটি হারিয়ে গেছে আজ আর তার হদিস মেলে না৷
আলি বাবা হজরত শাহান শাহ্ আদম কাশ্মীরী (র:) এর ন্যায়পরায়নতা, স্নেহ বত্সল আচরণ, সদাহাস্য মুখ মন্ডল, প্রশান্ত সৌম কান্ড মূর্তি সবের্াপরি দরবেশ তুল্য জীবন ধারন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে জন সাধারণ তো বটেই তদানীন্তন শাসক বর্গেরও সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ সেই সুবাদেই মনে হয় সুলতানি আমলে তিনি বিখ্যাত আতিয়া বা আটিয়া পরগনার জায়গীর লাভ করেন৷ অর্থ বিত্ত ও ক্ষমতার প্রতি তার কোন মোহ ছিলনা৷ ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে প্রজাকুলের হিত সাধনই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত৷ সেই সাথে শান্তির ধর্ম ইসলামের কার্যাবলী প্রচার করা৷ তাঁর সম্পর্কে অনেক লৌকিক ও অলৌকিক ঘটনাবলি এখনও শোনা যায়৷ মুসলমান ও হিন্দু উভয় সমপ্রদায়ের লোকজন তাঁকে সমান ভাবে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন৷ তাই বিভিন্ন সময়ে বাংলায় রাজশক্তির উত্থান পতন ঘটলেও লোকমান্য আলি বাবা হজরত শাহান শাহ আদম কাশ্মীরী (র:) পরগণাদারী ঠিকই থাকত৷ উপরের পরিবর্তন হলেও তাঁর পরিবর্তন হত না৷ শোনা যায় মুঘল সম্রাট মহামতি আকবর যখন দিল্লীর সিংহাসনে সমাসীন হন তখন কৌশলী, বুদ্ধিমান ও ক্ষমতাধর ইসলাম খাঁকে বাংলার সুবেদার করে সুদূর বাংলায় পাঠান৷ লোক মুখে তার গুণ কীর্তন শুনে তাঁকে অত্যন্ত সমাদর করেন এবং উপযুক্ত খেলাত প্রদান করেন৷ তখন হজরত শাহান শাহ আদম কাশ্মীরী (র:) ছিলেন অশতিপর বৃদ্ধ৷ ধর্ম মার্গে উচ্চাসন লাভের জন্য তাঁকে ইতিহাস বেত্তাগণ সিলেটের হজরত শাহ জালালের (রঃ) সমকক্ষ মনে করেন৷ এখনও দেশের বিভিন্ন স্থান হতে ধর্মপ্রাণ হিন্দু মুসলমান ও পর্যটকগণ আটিয়াতে প্রতিনিয়তই আগমন করে থাকেন৷ প্রতি বছর তাঁর মৃতু্যদিবস হিজরীর ৭ জমাদিউসানির পরবর্তী ৫ দিন মহা সমারোহে ওরস প্রতিপালিত হয়ে থাকে৷ বাংলাদেশের ধর্মীয় স্থান গুলির মধ্যে টাঙ্গাইলের আটিয়ার মাজার একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য ধর্মীও পীঠস্থান৷ এই মাজারের অদূরে তাঁর স্নেহছায়ায় পালিত সাঈদ খান পন্নী কতর্ৃক প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন মসজিদটির প্রতিকৃতি দশ টাকার নোটে উত্কীর্ণ করা আছে৷
ইতিহাসের পটভূমিকায় আটিয়ার প্রাচীন ইতিহাস জানতে চাইলে সূদুরে যেতে হবে৷ যেহেতু না প্রাচীন কালে বাংলার শতকরা আশি ভাগই যখন বিশাল যমুনা নদীর জল রাশির তল দেশে নিমজ্জিত ছিল তখনও আটিয়া নামক ভূখন্ডটি পানির উপরে মাথা উঁচু করে জনপথ হিসেবে বিদ্যমান ছিল৷ এই সময় গজনী রাজ্যের সুলতান ছিলেন সুলতান সবুত্তগীনের পুত্র সুলতান মাহ্মুদ৷ পিতার মৃতু্যর পর সিংহাসন আরোহন করেই তিনি সুলতান উপাধী ধারণ পূর্বক বঙ্গ ভারত জয়ের অভিলাষ পোষণ করেন৷ তাঁর ১৭ বার ভারত আক্রমন সফল হয়েছিল বটে কিন্তু বঙ্গ ভারতে স্থায়ী রাজ্য গঠন করতে সক্ষম হন নাই৷ তবে বিজয়ের যে সুবর্ণ পথ রচনা করে গেছেন তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তি সুলতানগণ নিশ্চিতভাবেই সফল হয়েছিলেন৷ এই কৃতিত্বের সর্বাগ্রে দাবিদার সিহাব উদ্দিন মোহাম্মদ ঘোরী৷ তিনি সিংহাসনে উপবেশন করেই রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান কল্পে রাজ্য বিস্তারে সবিশেষ মনোনিবেশ করেন৷ তাঁর পূর্বসূরি মহাবীর সুলতান মাহ্মুদের মতোই তিনিও বঙ্গ ভারত বিজয়ের একান্ত বাসনা পোষণ করেন৷ কঠোর পরিশ্রম ও অমিত বিক্রমের ফলোশ্রুতিতে উর্বর সমতল ভূমি ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম সুলতানি সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হন৷ এরপর দিল্লীর গদীতে সমাসীন হন মুহাম্মদ ঘোরীর বিশ্বস্ত কৃতদাস কুতুবুদ্দিন আইবক৷ তিনি শিহাব উদ্দিনের প্রতিনিধি হিসেবে আর্বিভূত হয়ে পরে দিল্লীর সুলতান রূপে আত্মপ্রকাশ করেন৷ কুতুবুদ্দিন তুর্কিস্তানের অধিবাসি ছিলেন৷ কাজী ফকরুদ্দিন কফি তাঁকে ক্রয় করে সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর কাছে বিক্রি করে দেন৷ স্বীয় সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতাগুনে কুতুবুদ্দিন অল্পদিনের মধ্যেই মহম্মদ ঘোরীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হন৷ মুহাম্মদ ঘোরী শিঘ্রই তাঁকে সেনা দরবারের বিশেষ পদে উনি্নত করেন৷ ভারত উপমহাদেশ অভিযানের সময় কুতুবুদ্দিন সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্থ সেনাপতি হিসেবে প্রভুর সহিত এদেশে আগমন করেন৷ তরাইনের ২য় যুদ্ধের পর কুতুবুদ্দিনের উপরই ভারতের বিজিত রাজ্য সমূহের শাসন ভার অর্পন করা হয়৷ তিনি মিরাট, দিল্লী, রনথম্বর, কনৌজ প্রভূতি রাজ্য জয় করে স্বীয় রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান৷ তারই অমীত বলশালী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলা বিহার ও উরিষ্যা জয় করেন৷ মহম্মদ ঘোরী সুলতান উপাধী ধারন করে দিল্লীর সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন৷ এই বছরই সেন বংশের সর্বশেষ রাজা লক্ষণ সেনকে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে অতর্কিতে আক্রমন করে বসেন৷ বৃদ্ধ রাজা রাজ প্রাসাদের পিছন দরজা দিয়ে পলায়নের সময় আহত ও নিহত হন৷ এই এখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ ঘোরী সৌভাগ্যের বরপুত্র ছিলেন৷ শোনা যায় তাঁর উভয় হস্ত জানু পর্যন্ত লম্বা ছিল৷ সেজন্য তাঁকে বলা হত আজানুলম্বিত বাহু৷ তাঁর রাজ্য সীমা আরাকান বার্মা (মিয়ারমার) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল৷ এই বখতিয়ার খলজির সময় হতেই বাংলাদেশ দিল্লীর শাসনাধীনে চলে যায় এবং এটা একটা প্রদেশ হিসেবে শাসিত হতে থাকে৷ সুতরাং বলাই বাহুল্য আটিয়া বাংলার একটি পরগণা হিসাবে আলাদা মর্যাদা ভোগ করতে থাকে৷
দিল্ল্লী কতর্ৃক নিযুক্ত সুবেদারগণ বাংলাদেশ শাসন করতে থাকেন অনেকদিন৷ কিন্তু মুশকিল হল অন্য জায়গায়৷ বাংলা হতে দিল্লী অনেক দূর৷ আর যোগাযোগ ব্যবস্থাও অত্যন্ত কষ্টকর৷ বাংলার শাসনকর্তা গণ এই সুযোগ গ্রহণ করে দিল্লীর শাসনকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীনভাবে দেশ শাসণ করেন৷ উল্লেখ করতে হয় দিল্লীর বাদশাহ সুলতান ইলতুতমিশ, বলবন শাহ্ ও গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন আমলে বাংলাদেশে বার বার বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং শাসনের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে৷ গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলার বিদ্রোহী শাসনকর্তা বাহাদুর শাহ্কে পরাজিত করে সোনারগাঁ (আটিয়া), সাতগাঁও ও লক্ষনাবতি এই তিন অংশে বিভক্ত করে তিনজন শাসন কর্তার মাধ্যমে শাসন মজবুত করেন৷ এরপর কিছুদিন অতিবাহিত হলে আবার দিল্লীর শাসন ভাটা পড়ে৷ এরফলে পুনরায় বাংলায় বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠে৷ এমনি এক মুহূর্তে ১৩৩৮ সালে সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ্ বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনভাবে শাসণ কার্য চালাতে থাকেন৷ তাঁর পথ অনুসরণ করে সাতগাঁয়ের শাসণকর্তা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ দিল্লীর নাগ পাশ ছিন্ন করে বাংলায় স্বাধীনতার ডাক দেন৷ তাঁর শাসণ স্বাধীনভাবেই চলে৷ এরপর ১৩৪২সালে ইলিয়াস শাহ্ নামে এক রাজ কর্মচারী আলাউদ্দিন হুসেন শাহকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন৷ তিনি ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে ফকর উদ্দিন মোবারক শাহকে পরাজিত করে সোনার গাঁও নিজ শাসনাধীনে আনেন৷ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই কাশ্মীর হতে স্বয়ং আলী বাবা হজরত শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) আটিয়ার ইতিহাস খ্যাত মাটিতে শুভাগমন করেন৷ ১৩৫৮ সালে ইলিয়াস শাহের মৃতু্যর পর তাঁর পুত্র সেকান্দার শাহ বাংলার মসনদ লাভ করেন৷ এর পর থেকে টানা দুশত বছর মুঘলেরা শত চেষ্টা করেও বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করতে পারেননি৷ এ দু'শত বছরে ক্ষমতার হাত বদল নতুন রাজ শক্তির উত্থান, পুরাতন রাজ শক্তির কোন কোনটার পতন এবং সেই সঙ্গে বাংলা ভেঙ্গে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের জন্ম নেয়৷ ওদিকে দিল্লীতেও ক্ষমতা বদলের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে৷ এরপর আফগানস্তানের ফারগানা রাজ্যের রাজা মহা শক্তিধর সম্রাট বাবর কাবুল রাজ্যের অনেকাংশ দখল করে দেশ শাসণ করতে থাকেন৷ বাবরকে পাঞ্জাবের শাসণকর্তা দৌলতখাঁ লোদী এবং মেবারের রাজা রানা সংগ্রাম সিং তাদের শত্রু দিল্লীর বাদশাহ্ ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে দিল্লী আক্রমণের আহবান জানান৷ তারা উভয়েই আশা করেছিল যে, ইব্রাহিম লোদি দিল্লীর মসনদ থেকে বিতারিত হলে দৌলতখাঁ লোদি দিল্লীর সিংহাসনে বসবেন এবং রাজা সংগ্রাম সিংও শত্রুমুক্ত হয়ে এক সময় রাজ্য বিস্তার করতে করতে শেষে দিল্লীশ্বর হয়ে বসবেন৷ কিন্তু তাদের সে আশায় গুড়ে বালি৷ তারা বাবর সম্পর্কে আরও আশা করেছিল যে, তিনি হলেন তৈমুর লংগের বংশধর৷ তিনিও তৈমুরের মত দিল্লী লুটপাট শেষে ইব্রাহিম লোদীকে হত্যা করে আবার ফারগানা রাজ্যে ফিরে যাবেন৷ কিন্তু বাবর ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া৷ তিনি দৌলতখাঁ লোদি ও রাজা সংগ্রাম সিংহের আমন্ত্রনে সাড়া দিয়ে তরাইনের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত ও হত্যা করে স্থায়ীভাবে দিল্লীতে সিংহাসন গেড়ে বসেন৷ শুধু তাই নয় ঐ দুই অপশক্তিকে পযর্ুদস্ত করে তার রাজ্য শাসণ নির্বিঘ্ন করেন৷ এ সময় হতেই পাঁচশত বছর মুঘল শাসকগণ ভারত শাসণ করেন৷ এ সময় আটিয়া পরগণা বহাল ছিল৷ ওদিকে বাংলায় বারো ভঁূইয়াদের শ্রেষ্ঠ ভূস্বামী মহাবীর ঈসাখাঁর আর্বিভাব ঘটে৷ বর্তমান কুমিল্লা জেলার সরাইল পরগণার জমিদার ছিলেন তিনি৷ তিনি দোর্দান্ত প্রতাপশালী ও কৌশলী ছিলেন৷ তাঁর সুশিক্ষিত একদল সেনাবাহিনী ছিল৷ দেহে ছিল তাঁর অপূর্ব শক্তি ও যুদ্ধ কৌশলে পারঙ্গম৷ তাঁর বুদ্ধিমত্তা ছিল বাস্তবমূখী৷ তাঁর মত তীক্ষ্ণ ধীশক্তি সম্পন্ন ভূস্বামী বাংলায় আর দ্বিতীয় আর কেউ ছিলেন না৷ তিনি তাঁর পার্শবর্তী সোনার গাঁ, খিদিরপুর, কাতরাভূ প্রভৃতি পরগণা দখল করে সম্পূর্ন দিল্লীর প্রভাব মুক্ত সোনারগাঁয় রাজধানী স্থাপিত করেন৷ এ সময় দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বাদশা হুমায়ুন৷ তাঁর নিযুক্ত বাংলার সুবেদারগণ নানা বিলাসিতা ও পরগনা শাসণে অযোগ্য ছিলেন৷ এই সুযোগে বিভিন্ন পরগণাদারগণ বিদ্রোহ করে বসেন৷ শুধু তাই নয় বিভিন্ন প্রকার কর দেয়া বন্ধ করে দিয়ে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ পরগণা শাসণ করতে থাকেন৷ এদের মধ্যে ভূইয়া শ্রেষ্ঠ পরগনাদার ছিলেন বীরবাহু ঈশা খাঁ৷ শুধু তাই নয় মুঘল শাসণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে তাদের নিযুক্ত অনেকগুলি পরগণা দখল করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন৷ তাঁর এ সমস্ত কথা বাদশা হুমায়নের কানে গেলেও তিনি তার প্রতিকার করতে ব্যর্থ হন৷ তিনি একদিন হঠাত্ গোছলখানার সিঁড়িতে পিছলে গুরুতর আহত হন এবং কয়েকদিন অজ্ঞান থাকার পর মৃতু্যবরণ করেন৷ তাঁর মৃতু্যর পর তাঁর পুত্র মহামতি আকবর দিল্লীর সম্রাট নিযুক্ত হন৷ তাঁর সুযোগ্য মামা বৈরাম খাঁ তাঁর প্রধান মন্ত্রী নিযুক্ত হন৷ তিনি সার্বিকভাবে ভাগিনা আকবরকে সাহায্য করে রাজ্যকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন৷ প্রতাপশালী পরগণাদার ঈশা খাঁর বিদ্রোহের কথা তাঁর কানে পেঁৗছাল৷ বাদশাহ আকবর ঈঁশা খাঁকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য যুদ্ধ বিশারদ বুদ্ধিমান সেনাপতি মানসিংহকে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলার মুলুকে পাঠালেন৷ তিনি ঈশাখানের পরগণায় ঝটিকা আক্রমন চালালেন৷ ঈশাখাঁ কম কিসে ? তিনি আগেই এ ব্যাপারে প্রস্তুত ছিলেন৷ তিনি সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী নিয়ে মানসিংকে প্রবল বাঁধা প্রদান করেন৷ যুদ্ধের প্রথমদিকে উভয় পক্ষের প্রচুর রক্তপাত ঘটল৷ এতদৃষ্টে মান সিংহ ঈশাখাঁকে উভয় পক্ষের সেনাপ্রধানের এক তরবারি যুদ্ধের আহবান জানালেন৷ বীর শ্রেষ্ঠ ঈশা খাঁ এ আহবান সাদরে গ্রহণ করে রাজী হয়ে গেলেন৷ এক পক্ষে মুগল সেনাপতি মান সিংহ অপর পক্ষে তেজদীপ্ত ঈশাখাঁ৷ চলল খোলা তরবারি যুদ্ধ৷ আঘাত প্রত্যাঘাতে আগুনের ফুলকি ছুটল৷ এক পর্যায়ে হঠাত্ দেখা গেল ঈশা খার এক প্রচন্ড আঘাতে মানসিংহের তরবারি ভেঙ্গে খান খান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল৷ মানসিংহ হত বিহ্বল মূর্তিবত্ ভীষণ পরিণতির জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন৷ না ঈশা খাঁ মান সিংহকে হত্যা করলেন না৷ পরিবর্তে তিনি তাঁর কোষবদ্ধ অপর তরবারি এগিয়ে আবার যুদ্ধের আহ্বান জানালেন৷ রাজা মান সিং ঈশা খাঁর এ মহানুভবতার পরিচয় পেয়ে সবিশেষ চমত্কৃত হলেন এবং আর যুদ্ধ নয় বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেন৷ ঈশা খাঁ সহাস্যে সে আহ্বানে সাড়া দিলেন৷ শুধু তাই নয় হৃষ্ট চিত্তে উভয়ে কোলাকুলি করলেন৷ রাজা মান সিংহ পরাজিত হয়ে অধঃবদনে দিল্লী ফিরে গিয়ে ঈশা খাঁর বীরত্ব, মহানুভবতা, শাসন কাজে দক্ষতা, প্রজা বাত্সল্য প্রভৃতি গুণের কথা সম্্রাট আকবরের কাছে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলেন৷ সম্্রাট আকবর বাড়াবাড়ির পথ পরিহার করে স্বাধীন পরগণাদার হিসাবে ঈশা খাঁ কে মেনে নিলেন এবং খেলাত দেবার জন্য দিল্লীতে ডেকে পাঠালেন৷ ঈশা খাঁ প্রথমত: সন্দেহ পোষন করলেও পরে যখন নিশ্চিত হলেন তখন দিল্লীর দরবারে সম্্রাট আকবরের সংগে সাক্ষাত্ করলেন৷ তিনি ঈশা খাঁ কে অত্যন্ত সম্মান জানায়ে রাজদরবারে আসন দিলেন এবং পরিষদবর্গ ডেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে মসনদ-ঈ-আলা খেতাবে ভুষিত করলেন৷ দিল্লী হতে ফিরে এসে ঈশা খাঁ পূর্বাঞ্চলীয় এ রাজ্য সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করতে লাগলেন৷ এ সময় আটিয়া পরগণাও তাঁর শাসনাধীনে চলে যায়৷ তাঁর ২২টি পরগনার সঙ্গে আলি বাবা হজরত শাহান শাহ আদম কাশ্মীরীর (র:) আটিয়া ও কাগমারী এ দুটি যোগ হওয়ায় মোট ২৪ টি পরগনার হয়৷ শেষোক্ত পরগণা দু'টি তে বাবা কাশ্মীরী (রঃ) অনুকূলে প্রাপ্ত হন৷ ঈশা খাঁ ২৪ টি পরগনায় ২৪ জন শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন৷ আটিয়া ও কাগমারী পরগণা দু'টি ঈশা খাঁর শাসনাধীনে অনেক পরে অন্তর্ভুক্ত হয়৷ তাই অনেকে এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন৷ তারা বলেন ঃ ঈশা খাঁর পরগণা ২২ টি ছিল কাগমারী ও আটিয়া এ দুটি পরগণা ময়মনসিংহ পরগণার দক্ষিনে বড়বাজু পরগণার অধীন ছিল৷ নাম না থাকলেও স্থান দুটি যে অন্য পরিসরে থাক আর নাই থাক বর্তমানে তাতে কোন মতান্তর নেই৷ এ দুটির সীমানা নির্দেশ করা ছিল৷ উত্তরে জয়েনশাহী ও মধুপুর পাহাড়, পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ, সোহাগপুর, দক্ষিণে ও পশ্চিমে ভাওয়ালের গড় এবং পূর্বে নিজ পরগণা সোনার গাঁও৷ ইতিহাসে এ দুটি স্থানের নাম উল্লেখ না থাকার কারণ অবশ্যই থাকতে পারে৷ এক সময় স্থান দুটি বিশাল দেহী যমুনা নদীর বক্ষে বিলীন ছিল৷ শুধু এ দুটি স্থানই নয় বাংলাদেশের সিংহভাগ এলাকাই ছিল নদীর গর্ভে৷ শত সহস্র বছর ধরে উজানের ছোট বড় অনেক নদীর ভাটি বাহিত পলি ও বালি দ্বারা এ অংশ গঠিত হয়৷ পরে লোক বসতি গড়ে ওঠে৷ ঐতিহাসিক এবং ভূ-তাত্তি্বকবিদগণ গবেষণা করে দেখছেন কুড়িগ্রাম রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, জামালপপুর, টাঙ্গাইলের মাটি প্রায় এক এবং স্থানভেদে সামান্য পার্থক্য বিদ্যমান৷ শ্রেণী বিন্যাসে এ মাটি ভূষা, দোঁয়াস, বেঁলে-দোয়াস, সাদা, লালচে, এঁটেল প্রভৃতি৷
এ সময় আটিয়া এবং কাগমারী পরগণাদ্বয় বনদসু্য, জলদসু্য, ঠগ সহ নানা প্রকার সমাজ বিরোধী লোকের আবির্ভাব ঘটে৷ তারা নিরীহ লোকদের খুন, ভয়, ভীতি প্রদর্শন করে সর্বস্ব্যলুট করে নিত৷ উঠন্ত বয়সের যুবকদের ধরে নিয়ে ভয় ভীতি আর ছেড়ে দেবার লোভ দেখিয়ে নিজেদের দল ভারী করত৷ মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে আটকে রেখে ব্যভিচার করত৷ দসু্য তষ্কর সমাজ বিরোধীদের এ অত্যাচার এমন পর্যায়ে পৌছে গেল যে, স্বয়ং মসনদ-ঈ-আলা ঈশা খাঁ পর্যন্ত ভীত শঙ্কিত হয়ে পড়লেন৷ দরদী শাসক ঈশা খাঁ কালবিলম্ব না করে জ্ঞানী গুণীদের নিয়ে মন্ত্রনালয়ে বসে গেলেন৷ বিভিন্ন আলাপ আলোচনার পর সাব্যস্থ হল যে, এ অশুভ শক্তিকে অচিরেই কঠোর হস্তে দমন করতে হবে৷ এজন্য একটি সুশিক্ষিত ও শক্তিশালী নৌ বাহিনী গঠন করলেন৷ অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ন নৌপথে টহল বসিয়ে দিলেন৷ স্থলভাগে আরও কার্যকরী সশস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করলেন৷ ঘোষণা করে দিলেন যে, যারা এই দসু্য তষ্করদের ধরিয়ে দিতে পারবে বা গোপনে তাদের আস্তানার সন্ধান দিতে পারবে তাদেরকে উপযুক্ত পুরষ্কারে পুরস্কৃত করা হবে অথবা রাজ কর্মচারী হিসাবে চাকুরী দেওয়া হবে৷ এতে ফল ফলল ভালোই৷ আইন শৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটল৷ কোথাও হতে ছিটে ফোঁটা দুঃসংবাদ এলেও তা অতি সামান্য৷ তাই দমন করার জন্যে বন, জঙ্গল, চর ও গভীর জল সীমায় সারাশী আক্রমন চালানো হল৷ তাতে অপ্রীতিকর খবর আসা একদম বন্ধ হয়ে গেল৷ মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁ সস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন৷
এরপর তিনি তাঁর রাজ্যের শাসনে মনোযোগ দিলেন৷ তার ২৪টি পরগণাতে দ্রুততর রাজকার্য পরিদর্শন করে বেড়াতে লাগলেন৷ তার রাজ্যের উত্তর পশ্চিম এলাকা রাজধানী হতে বেশ দূরে ও যোগাযোগ দুষ্কর৷ তাই এ প্রান্তরে মমেনশাহীর জঙ্গলবাড়ীতে অস্থায়ী দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করলেন৷ এখানে অবস্থান করে রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটালেন তবে নতুন পরগণা আটিয়া এবং কাগমারীর সুশাসনের ব্যবস্থা আগে করা দরকার মনে করলেন৷ এজন্যে এ নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তাবোধ করতে লাগলেন৷ প্রশাসক হিসেবে এ সময় উপযুক্ত লোকের দারুণ অভাব ছিল৷ কারণ যারে তারে প্রশাসক নিযুক্ত করা যায় না৷ অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে প্রশাসনে বসিয়ে দিলে যদি তার দুর্বলাতার সুযোগে বিদ্রোহ করে বসে৷ এক্ষেত্রে দেখা গেছেও তাই৷ প্রভুর হাতে লালিত পালিত হয়ে এক সময় প্রভূকেই হয় হত্যা না হয় বিতাড়িত করে নিজেই রাজা বা সম্রাট হয়েছেন৷ ইতিহাসে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে৷ এমন ব্যাকুল চিন্তায় যখন তিনি অস্থির তখন এক শুভ সকালে এক শুভ সংবাদ তাঁর কাছে এসে পেঁৗছে গেল৷ খবরটি তাঁর খুব মনঃপুত হল৷ তা হল এই আটিয়াতে একজন নূরানী চেহারার সৌমদর্শন কাশ্মীরদেশীয় দরবেশ অনাড়ম্বর এক আস্তানা গেড়ে বসেছেন৷ সঙ্গে অনেক ভক্ত বালল্লক তিনি সব সময় আল্লাহর ধ্যান খেয়ালে কাটান৷ আশে পাশের দশ-বিশটা গ্রামের মানুষ তাঁকে কামেল বলে মনে করেন৷ সর্বদাই তাঁর দরবারে তাঁর দোয়া অর্াির্শবাদের আশায় ভিড় জমায়৷ তার কাছে হিন্দু মুসলমান জাত পাত নির্বিশেষে সমানভাবে আদৃত৷ কেউই তার নেক দোয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না৷ ঈশা খাঁকে আরও বলা হল যে, এই মহান ব্যক্তিকে যদি পরগনা দু'টির শাসন কাজের ভার অর্পণ করা হয় তবে ভাল ভাবেই শাসন কার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন৷ তীক্ষ্ণ রাজনীতিজ্ঞ ঈশা খাঁ এই উত্তম সুযোগ হাত ছাড়া করতে পারলেন না৷ কাল বিলম্ব না করে একজন বিচক্ষন দূত পাঠালেন আদম কাশ্মীর (রাঃ) দরবারে৷ দূত এসে পেঁৗছলেন সেই মহামানবের কাছে৷ তিনি দেখলেন ছোট্ট একটি খড়ের দোচালা ঘরের ভিতর জায়নামাজ বিছিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল বহু লোক, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই৷ সবাই ভক্তি গদগদ ভাব নিয়ে বাবার দর্শন প্রতীক্ষায় সাগ্রহে বসে আছে৷ তিনি আরও দেখলেন, কাঙ্খিত ব্যক্তির চেহারা মোবারকের উপর বেহেস্তের নূরানী আভা খেলা করছে৷ পক্ক কেশ লম্বিত দাঁড়ি, সুন্নতি বাবড়ী, সৌম শান্ত গৌরকান্তি সত্তর বছরের বুড়ো৷ দেখে মনে হয় সর্বাঙ্গে আজও তারুণ্যের তেজ বিরাজমান৷ জান্নাতি রশ্মির ছটা তাঁর চোখে মুখে৷ যখন অনুরাগী ভক্ত সমাজে কথা বলেন প্রতিটি মুখ মিশ্রিত বাণী মধুমাখা অথচ আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান৷ সমবেত ধর্মপ্রাণ মানুষ আলী বাবার দর্শন লাভে মুগ্ধ৷ বাণী শ্রবণে ভক্তিভাবে বিগলিত ও নিবিষ্ট চিত্ত৷
যথাযোগ্য মর্যাদায় নিবেদন পূর্বক দূত আরজি পেশ করলেন মস্নদ-ই-আলা ঈশা খাঁর কথা ৷ কথা শুনে ক্ষানিকক্ষণ নিরব হয়ে গেলেন আলী বাবা হজরত শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) কিছুক্ষণ এভাবে ধ্যানস্থ থাকার পর মিষ্টি করে উত্চ্চারণ করলেন আলহামদুলিল্লাহ৷ তিনি চক্ষু উন্মিলন করলেন৷ ভালভাবে দূতকে নিরীক্ষণ করে বুঝতে পারলেন দূত বুদ্ধিমান বিচক্ষণ বটে৷ তাই বললেনঃ এলাকায় আছে অজ্ঞ, অশিক্ষিত, হত-দরিদ্র মানুষ৷ এরা ধর্ম জ্ঞানহীন, নীতিবোধ বিবর্জিত মানুষ৷ তিনি বহুত দিন ধরে এদের মধ্যে জ্ঞানের আলো বিস্তারের জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ তাতে আশা অনূরূপ ফল না পেলেও মোটামুটি মানুষ পদবাচ্য হয়ে চলবার মত শক্তি অর্জন করেছে৷ তিনি আরও বলে চললেনঃ বয়সের দিক দিয়ে বার্ধ্যকের কোঠায় সমুপস্থিত৷ কখন পরোলকের ডাক এসে যায় সেই মাবুদ আল্লাই জানে৷ তবুও আশা ছাড়িনি৷ তিনি এখানে বৃহত্তর পরিসরে কিছু করতে গেলে মস্নদ-ঈ-আলা ঈশা খাঁর মদদ অবশ্যই থাকা দরকার৷ তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বল্লেনঃ সদরের আদেশ নির্দেশ ও প্রয়োজনে সাহায্য সহযোগিতা না পেলে তিনি যে জ্ঞানালোক প্রজ্বলিত করে চারদিক উদ্ভাসিত করে রেখেছেন তা একদিন নির্বাপিতও হতে পারে৷ এমতাবস্থায় মসনদ-ঈ-আলা ঈশা খাঁ প্রজা সাধারণের সার্বিক মঙ্গলের জন্য মনোনিবেশ করলে তিনি নিবিষ্ট চিত্তে তা গ্রহণ করবো ইন্শাআল্লাহ৷ বাকী আল্ল্লাহ মর্জি৷
আদম কাশ্মীর (রঃ) কথা দূত প্রবর এতোক্ষণ মন্ত্রমূগ্ধের মত শুনছিলেন৷ স্বম্বিত ফিরে পেয়ে দূত বিলম্ব করা ঠিক হবে না মনে করলেন৷ তাই অত্যন্ত আনন্দ বিগলিত চিত্তে বাবা কাশ্মীরীকে তাজিমের সাথে সঙ্গে ভক্ত বৃন্দ নিয়ে রাজধানী সোনারগাঁয় সদরে আলা ঈশা খাঁর দরবারে হাজির হওয়ার আরজি পেশ করলেন৷ বুদ্ধিমান দূত আরও জানাতে ভূল করলেন না যে, মসনদ-ঈ-আলা ঈশা খাঁরও তাই ইচ্ছে৷ বাবা কাশ্মিরী (র:) খুশি খোশালিতে রাজী হয়ে গেলেন৷ এবার দিনক্ষণ ঠিক করে তারা উভয়েই আল্লার নাম স্মরণ করে রাস্তা চলতে আরম্ভ করলেন৷ শত নদ নদী ঝোপ জঙ্গল জনপথ পেরিয়ে রাজধানী সোনার গাঁয়ে ঈশা খার দরবারে এসে পেঁৗছে গেলেন৷ পূর্বেই তাঁর আবির্ভাবের জন্যে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল৷ তাঁকে পূর্ণ রাজকীয় মর্যাদায় অভ্যর্থনা করে বিশ্রামের যাবতীয় ব্যবস্থা প্রদান পূর্বক দূত মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর নিকট শুভ সংবাদ প্রেরণ করলেন৷ মসনদদার ঈশা খাঁ দূতের নিকট সম্মানীয় মেহমান বাবা কাশ্মীরির বর্ণনা শুনলেন৷ তাঁর কাছে সবই অপূর্ব মনে হল৷ তারপর পূর্ণ বিশ্রামান্তে একদিন তিনি তার রাজ দরবারে পরম আদরে শুভ্র কেশ সৌম্য দর্শন আল্লাওয়ালা ব্যক্তিকে অতি তাজিমের সঙ্গে কাছে বসালেন৷ কুশল বিনিময়ের পর আসল আলাপে লিপ্ত হলেন৷ প্রাজ্ঞ সুবাদার ঈশা খাঁ আটিয়া ও কাগমারীর কথা সবিনয়ে জানতে চাইলেন৷ তিনি তাঁর পরগণাদ্বয়ের শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে বলতে গিয়ে বললেনঃ প্রজা পুত্র আর পরগনদার পিতা৷ পিতৃতুল্য মানসিকতা নিয়ে রাজ্য শাসন করতে হয়৷ প্রজার মঙ্গল রাজার মঙ্গল-একথা তিনি সদা সর্বদাই মনে রাখেন৷ তাদের কাছ থেকে যত্- সামান্য নজরানা যা পান তা দ্বারা বিলাস ব্যাসনে দিন গুজরান করা মাহাপাপ বলে মনে করেন৷ এ করলে আল্লাহ বেজার হবেন৷ তার উপর খাড়া গজব নাজিল হবে৷ তাকে পরকালে জাহান্নমের কঠিন আগুনে জ্বলতে হবে৷ তাকে রক্ষক করে পাঠিয়েছেন৷ ভক্ষক করে নয়৷ তার দুঃশাসনের জন্য প্রজাদের যারপর নেই ক্ষতি হতে পারে৷ অতীতে তিনি কোনদিন নাফরমানি কাজ করেননি৷ এখনতো বৃদ্ধ বয়স৷ এখন আর এ প্রশ্নই উঠতে পারে না৷ এ সময় একমাত্র কাজ হল 'আল্লাহ' 'আল্লাহ' করা আর তাঁর উপর ন্যাস্ত কাজ গুলো সুচারুরূপে সমাধা করা৷ এটাই আমার জন্য আমি শ্রেয়: মনে করি৷ মসনদদার ঈশা খাঁ বাইশ পরগনার সার্বভৌম ক্ষমাতার অধিকারী৷ তিনি এ পর্যন্ত এমন সুন্দর কথা কোন পরগনাদারের মুখ থেকে শোনেননি৷ তাই বাবা কাশ্মীরীর মুখে শুনে মনে মনে অত্যন্ত প্রীত হলেন৷ বললেনঃ খাজনা ট্যাঙ্ আদায় করতে তহশিলদার নায়েব গোমস্তা পাইক পেয়াদা বরকনদাজ এদের কিভাবে প্রতিপালন করেন৷ উত্তরে বাবা আদম কাশ্মিরী জানালেনঃ আমি সত্ ও কর্তব্যনিষ্ঠদেরই নিয়োগ করে থাকি৷ তারা যথাযথভাবে ন্যায় নিষ্ঠার সাথে তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব প্রতিপালন করে থাকেন৷ আমি তাদের এসব কাজ তদারকি করে থাকি৷ শুধু এ পর্যন্তই নয় তাদের ঘরদোর থাকা খাওয়া প্রতিরক্ষা এটাও আমাকেই করতে হয়৷ আর এটা করতে আমাকে মোটেই বেগ পেতে হয় না৷ তারা সবাই আমার প্রতি অত্যন্ত অনুগত৷ অন্যায়ভাবে প্রজাদের কাছ থেকে একটা পয়সাও লওয়া হয় না৷ বরং অনাহারে উক্ত পরিবার পরিজন নিয়ে দিন যাপন করলে তাদেরকে অর্থ সাহায্য করে বা আমার গোচরিভূত করে৷ তাদের আদায়কৃত রাজস্বের এক চতুর্থাংশ তাদেরকে নিয়মিত পরিশোধ করে থাকি৷ যে অর্থ বাকি থাকে তদ্বারা পরগণার প্রজাদের কল্যাণের জন্য ব্যয় নির্বাহ করা হয়৷ এটা তার কখনো ভুল হয় না৷ আমার এ কাজ নিজের অবশ্য কর্তব্য কাজের মধ্যে আমি মনে করি৷ বিচক্ষণ সুবেদার শাসক মেহমানের কথা যতই শোনেন ততই চমত্কৃত হন৷ তিনি এরূপ উপযুক্ত পরগনাদারই চান৷ এমন চরিত্রবান, কর্তব্য পরায়ণ প্রজাবত্সল পরগনাদারই তো মনে প্রাণে কামনা করেন৷ তাঁর পরম সৌভাগ্য যে নতুন দু'টি পরগণা আটিয়া ও কাগমারীর জন্য এমন একজন মহত্ প্রাণ প্রশাসক পেতে যাচ্ছেন৷ এই প্রশাসক যদি তাকে খাজনা, ট্যাঙ্ না দিয়েও বরং তার কাছে উল্টা আরও কিছু প্রজাসাধারনের জন্য বরাদ্দ চান তবে তাও দিতে প্রস্তুত৷ তবুও এ প্রশাসক তার চাই-ই৷ শান্ত শিষ্ট প্রবীণ জ্ঞান বৃদ্ধ আল্লাহ ভক্ত ব্যক্তিটি আরও বলতে চেয়েছেন- তিনি চিরকুমার৷ সংসার বিরাগী৷ দুনিয়ার ভোগ বিলাস তাঁকে মোটেই মহাবিষ্ট করে নাই৷ সে বয়সও তাঁর অনেক আগেই কেটে গেছে৷ তিনি আল্লাহ ও নবী (সঃ) এর প্রেমে ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর ছেড়ে সুদূর আটিয়া চলে এসেছেন৷ শুধু আল্লাহকে রাজি খুশীই তাঁর ধ্যান ধারণা এবং খেয়াল৷ তাঁর মনের কামনা ছিল, বাকি জিন্দেগী আল্লাহর এবাদত বন্দেগীতে কাটিয়ে দিবেন৷ কিন্তু এখানে এসে যা দেখলেন তা কহব্য নয়৷ জীব জানোয়ারের জীবন আর শয়তানের ওয়াছ ওয়াছা মানুষকে অমানুষ করে জাহান্নামী করে ফেলেছে৷ তারা আল্লাহর নবীর (সা:) দ্বীনকে বেমালুম ভুলে গেছ্ দে;ুনিয়াকে আকড়িয়ে ধরেছে আখেরাত ভুলে গেছে৷ তিনি আটিয়ার ফরমা বরদারের যে দায়িত্বটুকু বেছে নিয়েছেন তা অজ্ঞ গোমরা মানুষদেরকে সত্যিকার মানুষ করার উপযুক্ত৷ এতে যে পরিমান কর প্রজাদের কাছে থেকে পাচ্ছেন তা দিয়ে মাদ্রাসা, মক্তব, টোল,মসজিদ, মন্দির প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করছেন৷ এবং সেই সাথে গরিব, কাঙ্গাল, আতুর মিসকিন এদের সেবায় ব্যয় করা হচ্ছে৷ এ বড় মহত্ কাজ৷ মসনদ-ই- আলা ঈশা খাঁ বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) কে সাধারণ মানুষ মনে করলেন না৷ পরগনাদারের ছদ্মাবরনে একজন ওলিয়ে কামেল, পীর দরবেশ মনে করলেন৷ তিনি মনে মনে সংকল্প করলেন এই দরবেশকুল শিরমনিকে যে ভাবেই হোক তাঁর অধীনস্ত আটিয়া ও কাগমারী পরগণা চালাতে দেবেন৷ এ পরগণাদ্বয়ের শাসন কার্য পরিচালনার জন্য যেমন উপযুক্ত মানুষ দরকার তেমন লোকই পাওয়া গেছে৷ আল্হামদুলিল্লা৷ তিনি সুশাসন ও সাধারণ প্রজাদের মঙ্গলের জন্য যা কিছুু অনুরোধ করবেন তিনি নির্বাহকে তা প্রতি পালন করবেন৷ এরপর তিনি আদম কাশ্মীরী (রঃ) যাই বলেন তাতেই সানন্দে রাজী খুশী হয়ে যান৷ প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটি তাঁর শাসনাধীন পরগণাটির নাম বহাল রাখলেন এবং কাগমারীরও তাই রইল৷ উল্লেখ্য আতিয়া বা আটিয়া অর্থ দান বা উপহার৷ এ কথাটিও ঈশা খাঁ মেনে নিলেন এবং এ পরগণা দান হিসাবে আদম কাশ্মীরী (রঃ) কে দান করে দিলেন৷ আগে আটিয়াকে আতিয়া বলা হতো৷ ইংরেজ আমলে এ নামের পরিবর্তন ঘটে৷ ইংরেজিতে "ত" অক্ষর নেই আছে "ট"৷ এর প্রতি বর্ণ ইংরেজী "টি" অক্ষর৷ ইংরেজির আটিয়া উচ্চারণের সময় আতিয়াকে আটিয়া বলত আর তাতেই আতিয়া আটিয়া হয়ে গেল৷ কাগমারী সমন্ধে ইতিহাস কিছু বললেন না, আর বাবা আদম কাশ্মীরীও কিছু ব্যাখ্যা করেননি৷ তবে তার অনেক পরে জনশ্রুতি প্রকাশ পেল৷ এর সত্যতা সন্মদ্ধে অনেকেই সন্ধিহান এবং একে গাল গল্প হিসেবে মনে করেন৷ গল্পটি হল ঃ- বাবা আদম কাশ্মীরীর (রাঃ) ভাগ্নে এবং শিষ্যও বটে৷ একবার মামা এবং ভাগ্নে এক রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন৷ তারা দেখতে পেলেন রাস্তার ধারে এক বুড়ি তার মৃত বকরি নিয়ে কান্না কাটি করছে৷ তাদের দেখে বুড়ি আরও হাউমাউ করে জোরে কাঁদতে লাগলো৷ বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) তাকে কিছু টাকা দান করে সান্ত্বনা দিয়ে চলে যাচ্ছেন৷ হঠাত্ পিছন ফিরে দেখলেন তার ভাগ্নে শাহ্জামান (রাঃ) মৃত বকরীর পাশে দাঁড়িয়ে কি যেন বলছেন৷ আর হাত ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গে বকরিটি উঠে ঘাস খেতে লাগলো৷ এতে বাবা কাশ্মীরী (রঃ) ভারী বেজার হলেন- এই ভেবে যে ভাগিনা খোদার উপর খোদগারী করল৷ আর নিজের দিককে মানুষের কাছে ছোট করল৷ তাই তিনি ভাগ্নেকে বললেনঃ এখন থেকে আমার সহবতে তুমি আর থাকতে পারবে না, অন্যত্র চলে যাও৷ প্রয়োজনে তোমাকে ডাকব৷ তাই হবে৷ কোথায় যাব মামা৷ তখন বাবা ধনুক হাতে নিয়ে উত্তর দিকে দাঁড়ালেন এবং তীর ছুঁড়ে মারলেন৷ বললেনঃ উত্তর দিকে চলে যাও৷ যেখানে এ তীর মাটিতে পতিত দেখবে সেখানেই ধ্যান খেয়ালে বসে যাবে৷ যথাদেশ বলে শাহ্জামান (রঃ) চললেন উত্তর দিকে৷ বেশ কিছুদূরে (টাঙ্গাইলের কাছে দক্ষিণে) এক জায়গায় তীরটি একটি মস্ত দেও বা দৈত্যের বক্ষ ভেদ করে মাটিতে পতিত আছে৷ কাগ নামক সেই দৈত্যটি মারা গেছে৷ সেই থেকে স্থানের নাম হল কাগমারা৷ পরে লোকমুখে উচ্চারিত হতে হতে কাগমারি নামে রূপান্তরিত হল৷
সে যাই হোক-আসল কথা হলঃ সুবেদার ঈশা খাঁ তাঁর পরগণার সীমা নির্দেশ করে বললেনঃ এতোদিন আটিয়া পরগণার সীমানা যাই থাকুক এখন থেকে এর সীমানা হলঃ উত্তরে বড় বাজু, পুখুরিয়া পরগণা ও আলাপশাহী পরগণা, পূর্বে চন্দ্রাতপ, সুজারপুর ও সুলতানপুর পরগণা৷ পশ্চিমে যমুনা নদী, সিন্দির পরগণা এবং দক্ষিণে সোনারগাঁও, নারায়নগঞ্জ৷ এর ভিতরে নদী সিকস্তি স্থলভাগকে আটিয়া পরগণা নামে অভিহিত হবে৷ বিজ্ঞ ঈশা খাঁ এ নব গঠিত আটিয়া পরগণা প্রথম আনুষ্ঠানিক শাসক নিযুক্ত করলেন দরবেশ শিরোমনি অলিয়ে কামেল আলী বাবা শাহানশাহ হজরত আদম কাশ্মীরী (রঃ)-কে৷ এর রাজস্ব দ্বারা তিনি বরাবর যা করতেন এখনও দ্বীধাহীন চিত্তে তাই করতে পারবেন৷ এতে কারও কিছু বলার থাকবে না৷ এটা মসনদ-ই-আলা ঈশা খার আদেশ৷ আটিয়া পরগণার সুকঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আটিয়া ফিরেই এর সার্বিক উন্নয়নে মন প্রাণ ঢেলে দিলেন৷ সুবেদার ঈশা খাঁও এতে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হলেন৷ এ সময় আটিয়া পরগণার মুসলিম সমাজে নানা বিজাতীয় আচার আচরণ এবং ধর্মীও অনুষ্ঠানাদির ভীষন সংমিশ্রণ ঘটেছিল৷ তাইতো দেখতে পাওয়া যায় বাঙ্গালী হিন্দুদের শিব পূজা, দূর্গা পূজা, মনসা পূজা, ধর্ম ঠাকুরের পূজা, ওলা ডুবির পূজা প্রভৃতি অনুষ্ঠান মুসলিম সমাজকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল৷ তখনকার দিনে প্রায়ই দেখা যেত কুসংষ্কার আচ্ছন্ন মুসলিম সমাজ চাঁদা তুলে আসর বসাত মনসা ভাষাণ যাত্রা, কৃষ্ণ যাত্রা, ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখ কাক পক্ষীকে চাল ভাজার ছাতু খাওয়ানো, ঘরের প্রধান দরজার উপরে পাকা তাল বেঁধে রাখা, মাটির শরায় নানা দেবীর মূর্তি এঁকে ঘরে ঝুলিয়ে রাখা প্রভৃতির রেওয়াজ ছিল৷ পৌষ মাসের শেষ দিন ধুমধাম করে পিঠা পায়েস, দৈ, চিড়া, মুড়ি খাওয়া, পহেলা বৈশাখের ভাল মন্দ পাক করে খাওয়া, হিন্দুদের জামাই ষষ্ঠীতে জামাইদেরকে মজা করে খাওয়ানো এগুলোর প্রচলন ছিল৷ এমনকি ধুতি পড়ে মঠের পাশ দিয়ে গমনাগমন করে মাথা নত করে প্রনাম করা পুণ্যের কাজ বলে মনে করত৷ মুসলমান সমাজে আরও কিছু অনৈসলামিক আচার আচরণ ইসলাম ধর্মের অঙ্গিভূত মনে করা হতো৷ যেমন সত্য পীরের শিরনি, খোয়াজ খিজিরের শিরনি, বাস্তু ভিটার শিরনি, বালা মসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দুধ কলা, আতপ চালের ভোগ দেওয়া, প্রভৃতি অনুষ্ঠান মুসলমান লোকের ঘরে প্রায়ই পরিলক্ষিত হত৷ বদর পীর, পাঁচ পীর, বালু গাজী পীরধর্মের সর্দার, এ সমস্ত কাল্পনিক পীর ফকিরদের অনুষ্ঠান মুসলমান সমাজকে অন্ধভাবে গ্রাস করে ছিল৷ শুধু যে আটিয়া পরগণাতে কুসংস্কার দেখা যেত তাই নয় গোটা বাংলা মূলুক জুড়েই এ দুরবস্থা বিরাজিত ছিল৷ বাঙ্গালীর যে কোন অনুষ্ঠানেই হিন্দু মুসলিম চিনবার উপায় ছিল না৷ তবুও বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের প্রতি একটা আকর্ষণ নিবু নিবু বাতির মত জ্বলছিল৷ ধর্ম সম্পর্কে অস্বচ্ছতার সামান্য ধুলি বালির যা আস্তরণ জমে ছিল তা সহজ ধোলাইতেই দূরিভূত হতো৷ তারা ইসলামের নিয়ম নীতি শরা- শরিয়তের অধঃপতন দেখে বেদনা অনুভব করাহতো৷ এজন্য দেখা যায় বাইরের দেশ থেকে পরিপূর্ণ ঈমানদার মমিন মুসলমান এদেশে ধর্ম প্রচার বা সংস্কারের জন্য এলে এদেশের মুসলমানগণ মন প্রাণ উজার করে দিয়ে তার পিছনে অষ্টপ্রহর লেগে থাকতো৷ আর সংস্কারের নির্দেশ দিলে জান কোরবান করে যথাযথ প্রতিপালন করতে তত্পর হতো৷ কারণ এটাই তত্কালীন মুসলমান সমাজের প্রবণতা ছিল৷ তাই ইসলামের সঠিক দিক নির্দেশনা না থাকায় ভুগছিল গোটা জাতি৷ বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে এহেন দুখঃজনক ও কুসংস্কার আচ্ছন্ন পরিবেশে নিমজ্জিত থাকার কথা শুনতে পেয়ে মধ্যপ্রচ্যের ধর্মপ্রাণ মুসলমান মানুষ দারুণ বেদনা বোধ করতেন৷ তাই এদের অধঃপতন ঠেকাতে ৩৬০ জন মতান্তরে আরও বেশি সংখ্যক ধর্ম সংস্কারক, অলীয়ে কামেল, শিষ্য স্বজন সহ বাংলা ভারতে হিজরত করেন৷ এরা কেউ কেউ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে পেঁৗছিলেন৷ বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছ থেকে এরা যথেষ্ট ইজ্জত, হুরমত, আতিথেয়তা পেতেন৷ এদের এমন মন মানসিকতার পরিচয় জেনে সুদূর দূর্গম পথ পেরিয়ে ৫৮ বত্সরের তাপসকুল শিরোমনি, বুজুর্গানের দ্বীন সাথে পিতৃহীন এতিম ১২ বত্সরের ভাগ্নে হজরত শাহ্ জামান (রঃ) কে নিয়ে হাজির হলেন পূর্ব বাংলার মাটিতে৷ ভাবতে অবাক লাগে যে, কোথায় আটিয়া আর কোথায় কাশ্মীর অবস্থিত৷ জনশ্রুতি আছে, তিনি প্রথম দিল্লীর পীরে কামেল বুজুর্গানে দ্বীন হজরত সলিম শাহ্ (রঃ) আস্তানায় পদার্পণ করেন৷ সেখানে কঠোর সাধনায় সিদ্ধি লাভের পর ধর্ম প্রচার ও সংস্কারের জন্য বাবা সলিম শাহ্ আটিয়া মূলুকে পাঠালেন৷ হাতে দিলেন এক মুষ্ঠি মাটি- এই মাটির গন্ধ আর বর্ণ বাংলার যে প্রান্তে পাবে সেখানেই আস্তানা গেড়ে সাধনায় বসে যাবে৷ বাবা কাশ্মীরী (রঃ) ইস্তেখারা করলেন-পেয়ে গেলেন পথ৷ আটিয়া থেকে তার নাকে আটিয়ার মাটির গন্ধ পেতে লাগলেন৷ ছুটলেন শিষ্য বাল্যক নিয়ে আটিয়ার দিকে৷ পেয়ে গেলেন কাঙ্খিত স্থান৷ মিলে গেল পীর প্রদত্ত মাটির গন্ধ ও বর্ণ, রং-বসে পড়লেন আস্তানা গেড়ে৷ চলল ধর্ম প্রচার, সংস্কার, ও কঠোর সাধনা৷
এ সময় বাংলাদেশ ছিল সত্যিই এক শান্তির নীড়৷ পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা আর সহজ সরল মানুষের কল-কাকলীতে ভরা৷ বিদেশীদের হাতছানি দিয়ে ডাকতো তাঁর বুকে৷ তাইতো আফ্রিকাবাসী বিশ্ব পর্যটক মরক্কো রাজ্যের নাগরিক ইবনে বতুতা, চীনের হিউয়েং সাঙ, ইটালির মার্কপোলো আরও হাজার ভ্রমণকারী এ বাংলায় আগমন করেছেন৷ লিখে গেছেন এদেশের সুখ শান্তির কথা৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিবরণ, লিখে গেছেন মানুষের সরল সহজ কথা৷ এতো স্বল্প মূল্যে জিনিষ পাওয়া যেত এ বাংলায় তা ভাবলে অবাক হতে হয়৷ ইবনে বতুতা এতোটুকু মহাবিষ্ট হয়েছিলেন যে, একটানা ৩০ বছর বাংলায় অবস্থান করে আবার স্বদেশে ফিরে গিয়েছিলেন৷ তিনি বাংলার সেন, পাল, দেব, চৌহান, সুলতান, মুসলমান রাজা বাদশা, দিল্লীর সম্রাট, চীনের বিরল কাহিনী প্রভৃতি লিখে অমর করে রেখে গেছেন৷ তার থেকে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস অনেকাংশে জানতে পারা যায়৷ নিকট মধ্যপ্রাচ্য, প্রাচ্য সহ আরব বিশ্ব থেকে এসেছেন সিলেটের মহাত্মা শাহ্ জালাল (রঃ), শাহ্ পরান (রঃ), রাজশাহীর শাহ্ মখদুম (রঃ), চিটাগাং এর বায়েজিদ বোস্তামী, সুন্দরবনের কালু গাজী (রঃ), বাগেরহাটের খান জাহান আলী, আটিয়ার শাহানশাহ্ বাবা হজরত আদম কাশ্মীরী (রঃ), কাগমারীর হজরত শাহজামান (রঃ), মীরের বেতকার শাহ জামাল (রঃ), সিংহরাগীর হজরত দেওয়ান শাহ্ হুসেন আল কাদরী হুসাইন (রঃ) প্রমূখ৷ ভারতের আজমীরের খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রঃ), নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রঃ), আসামের জলেশ্বরের নাসিরুদ্দিন বোখদাদী (রঃ) সহ বহু কামেল পীর মুর্শিদ এদেশে এসে আমাদেরকে ধন্য ও কৃতজ্ঞ করেছেন৷ ধর্ম প্রচার, ধর্ম সংস্কার, রাজ্য বিস্তার, নতুন রাজ্য স্থাপন, পর্যটন যে যে উদ্দেশ্যেই একবার এদেশে পা বাড়িয়েছেন তারা এদেশের সুখ শান্তি সরল সহজ মানুষ, আরামপ্রদ আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সহজলভ্য জিনিষপত্র পেয়ে ফিরে যাবার নামটি করেননি কোনদিন৷ থেকে গেছেন চিরদিনের জন্য এই বাংলা ভারতে৷ রাজা-বাদশা, সম্রাট-সুবেদার, সেনাপতি-জমিদার, ভূস্বামী, ভাগ্যান্বেষী, ভাগ্যাহত, বিপর্যস্ত মানুষইকি কম এসেছেন ! ইতিহাসের নিরিখে বিচার করলে দেখা যায় প্রধানত তিনটি কারণে এই বিদেশীরা এদেশে এসেছেন৷ তাহলো- প্রথমতঃ সুখ সমৃদ্ধি, নিরুপদ্রব জীবন যাপন, দ্বিতীয়তঃ আফগান মুগলদের উত্থান পতন, অনেকেই আত্মগোপন, আত্মরক্ষা, তৃতীয়তঃ ধর্ম প্রচার ও ধর্ম সংষ্কারের উদ্দেশ্যে ৷ এদের মধ্যে করটিয়ার জমিদারদের আদি পুরুষ, মুঘল সেনাপতি বায়েজিদ খান পন্নী মুঘল পাঠানদের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য শেষোক্ত কারণে এসেছিলেন ধর্ম প্রচার ও সংস্কারের জন্য৷ আলী বাবা হজরত শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) অবশ্য তিনি এসেছিলেন নিজ দেশ ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে যাবার জন্য কিনা জানিনা৷ আর তা জানারও কোন উপায় নেই৷ বেহেশতী সুরত, গৌর কান্তি দেহ, চির কুমার ফিরেই বা কি করবেন ? দরবেশ, সংসার ত্যাগী, অলিয়ে কামেলদের স্বদেশ আর বিদেশ উভয়ই সমান৷ এরা স্বদেশ বিদেশ, আপন পর কোন পার্থক্য করেন না৷ তাদের চোখে মানুষ মানুষই৷ আল্লাহ্র আর এক নাম "রব"৷ প্রতিপালক- সব সৃষ্ট জীবকেই প্রতিপালন করেন তিনি৷ মানুষের খেদমত করাই শ্রেষ্ঠ এবাদত্ বন্দেগী৷
আলী বাবা হজরত শাহান শাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) সবেমাত্র পৌঢ়ত্ব পেরিয়ে বার্ধ্যক্যে পা রেখেছেন৷ দেহ যৌষ্ঠ ঝলমলে, নূর চমকায় দেহে, মনে অসীম ঈমানী জোশ বল বিক্রমে ভরা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, হৈম কান্তি সুডেল দেহ বল্লরী, সুশ্রী সদা হাস্য মুখমন্ডল৷এক সময় ধর্মাভাবে বাংলার জনপদে তসরিফ আনলেন৷ তিনি শুভাগমন করে বেছে নিলেন যমুনা ধলেশ্বরী অতি প্রাচীন জায়গা আটিয়াকে৷ এসব জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা ও পাশে চর ও চর ঘেঁষা অঞ্চলের প্রতি৷ গৌড়ের সুলতান, রাজমহল বা সোনারগাঁয়ের শাসকদের শাসন সুনজর কাড়তে চায় নাই মোটেই৷ রাজ্য বিস্তার এসব এলাকায় খাজনার চেয়ে বাজনাই বেশি হবে ভেবে শুরুতেই থেমে গেছেন তারা৷ অনুন্নত ঝাড়জঙ্গল, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কারে নিমজ্জিত অধিবাসীদের জীবন৷ ধর্মীয়, সামাজিক মূল্যবোধ নেই বললেই চলে এদের৷ রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা নেই৷ যখন যে ক্ষমতায় আসে তাকেই সালাম৷ গেলেও খবর রাখে না আসলেও মাথা ব্যাথা নেই৷ এসব জটিল কুটিল নবাব বাদশাদের খবরাখবর ওরা রাখে না৷ কাজেই নিসঙ্কো চিত্তে সংস্কার মূলক কাজ করার পক্ষে এসব এলাকা বিঘ্ন শংকুল ছিল৷ তবে জরুরীও ছিল বটে৷ কেননা খারাবি এদের রক্তে মাংসে মিশে গিয়েছিল৷ তাদের পূর্ব পুরুষরাও এভাবেই জীবন অতিবাহিত করেছে৷ বর্তমানেতো চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু আশার কথা একবার এ অশিক্ষিত অজ্ঞ অথচ সরলমনা জনগণের মনের ওপর ভাল কিছু ছাপ দিয়ে প্রভাব বিস্তার করলেই হলো৷ নিজের জানের বিনিময়ে পীর দরবেশ ওলিয়ে কামেলদের কথা মেনে রেখে চলবে৷ সেই সূত্রে এদেরকে মনের মনি কোঠায় স্থান দিয়ে সদায় ভক্তিভাবে গদ্ গদ্ থাকবে৷ আর খোদা নাখাস্তা তাদের মন একবার বিগড়ে গেলে কশ্মিনকালেও ফেরাতে পারবে না কেউ৷
এর অনেক পরের কথা৷ এ সময় ধলেশ্বরী যমুনা নদী সিকস্তি চরগুলি প্রায় কায়েমীভাব ধারণ করেছে৷ লোক জনের বাড়ি ঘর সবুজ গাছ পালায় ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় হয়ে উঠেছে৷ গ্রাম হিসেবে সুন্দর রূপ ধারণ করেছে চরা ভূমির বাঁকে বাঁকে৷ ছোট একটা বাজারকে কেন্দ্র করে কোলাহল মূখর হয়ে উঠেছে এখনকার ঘনবসতিপূর্ণ একটা চর৷ সেই বাজারের পাশে নতুন গজিয়ে ওঠা একটা বট গাছের ছায়ায় ছোট একটা ছনের দোচালা ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেছেন বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ)৷ আওলিয়া সর্দার আলি বাবার অপূর্ব মিষ্টি মধুর কথা, ইসলামি আচার আচরণের সানি্নধ্যে এলে সহজেই মন কেড়ে নেয়৷ চেহারা এবং কথা যেন সোনায় সোহাগা৷ চেহারা দেখলে চোখ জুড়ায় আর কথা শুনলে মন প্রান মোহিত হয়৷ গুরুগম্ভীর ভাব ও ইসলামী আচরণের ভিতর প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব তা দেখে এলাকার মানুষ একে একে সবাই হুজুরের কাছে বায়াত পড়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে লাগল৷ এর ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর নাম কাম ছড়িয়ে পড়ল৷ তিনি ইসলামী জ্ঞানে শিক্ষিত ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে অনেক উচু মার্গের সিদ্ধ পুরুষ৷ তিনি ইসলামের আলো চারদিকে বিস্তারের জন্য খুলে বসলেন একটি মক্তব৷ এই মক্তবেই শিক্ষা দিতে লাগলেন মানুষ হওয়ার আদর্শ ৷ এলাকার অজ্ঞ অশিক্ষিত ব্যক্তি বর্গসহ ছোট শিশু ছেলে মেয়েরা এক বেলা করে হুজুরের কাছে পড়তে যান প্রতিদিন৷ শেষে শাহান শাহ বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) এমন হয়ে গেলেন যে ভিন দেশী লোক কিনা চিনবারই উপায় রইল না৷ এ গণ্ড এলাকার কৃষ্টি ঐতিহ্য সবাই স্থানীয় লোকজনের মত রপ্ত করে ফেললেন তিনি৷ এবার তিনি সকলের মনের মানুষ ও সুখ দুঃখের সাথী হয়ে গেলেন৷ এবার তাঁর উদ্দেশ্য হাসিলের পালা৷ তাঁর স্বপ্ন কি ভাবে এই অজ পাড়াগায়ের মানুষ গুলোকে কুসংস্কার মুক্ত করে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যায়৷ সেই সঙ্গে পরগণার শাসন ভার মাথায় নিয়ে সারা পরগণার চষে বেড়ান প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য৷ নায়েব পিয়াদারা খাজনা ট্যাঙ্ আদায় করার জন্য কারো ওপর জুলুম করে কিনা, কি হালে আছে তা নিয়মিত খোঁজ রাখেন৷ সব কাজ করার পর রাতে যেটুকু সময় পান তা আল্লাহর ধ্যান খেয়ালে কাটান৷ এমন করেই প্রজার হিত সাধনায় সময় কেটে যায় বছরের পর বছর৷ কঠোর পরিশ্রম আর ত্যাগে এখন মোটামোটি প্রজাকূল সুখি, ধর্মীয় ভাবে জীবন চালনায় অভ্যান্ত হয়ে গেছে, ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত ও মার্জিত হচ্ছে৷ ক্ষেতে খামারে হাল চাষ করে যে শষ্য পায় তা দিয়ে সারা বছর ভাল ভাবেই কাটে৷ এলাকায় এলাকায় আরও মক্তব খুলে শিক্ষার আলো ছড়াতে লাগলেন৷ এবাদত্ বন্দেগী করার জন্য মস্জিদ গড়ে দিলেন৷ পানির কষ্ট দূর করার জন্য ইদারা কুপ ও পুকুর খনন করে দিলেন৷ আটিয়াতে এখনও প্রাচীন পুকুর পাগাড় জলাশয় যত আছে বাইরের আর দশ বিশটা এলাকায় তা নেই৷ মাজারের সামনের ইঁদারা, সুখ দশার জলাশয়, ইছামতির জলাশয় প্রভৃতি আরও অনেক জলাশয়ের নজির আটিয়ার যত্র-তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ আজ তাঁর সাধনা সফল হতে চলেছে৷ আগের চেয়ে আটিয়া পরগণা এখন অনেক সভ্য ও কুসংস্কার মুক্ত৷ চারদিকে শান্তির সুবাতাস বইছে৷ তবুও তিনি নিজেকে মনে করছেন তাঁর আরও তত্পর হওয়া দরকার৷ নইলে তাঁর উপর ন্যাস্ত দায়িত্ব অবহেলার জন্যে সদরে আলা ঈশা খাঁর কাছে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন তার বরখেলাপ হবে৷ যদিও ঈশা খাঁ পরগনা সুশাসনে বাবা আদম কাশ্মিরীর উপর অত্যন্ত খুশি৷ তথাপিও আল্লার কাছে অজানা অপরাধের জন্যে কি কৈফিয়ত দেবেন ভেবে শঙ্কিত হন তিনি৷
হঠাত্ই ঈশা খাঁ জান্নাতবাশী হলেন৷ সব যেন ঘুর্নিঝড়ে বিধস্ত হয়ে গেল৷ এখন শাসক হলেন তাঁর পুত্রদ্বয় মুসা খাঁ ও ওসমান খাঁ৷ ভাল মতই শাসন চলছে৷ তাদের পিতার রাজ্য৷ কিন্তু দিল্লীতে শক্তি বিপুল পরিমানে বেড়ে গেছে মুঘলদের৷ মহামতি আকবর পূর্ণ যুবক৷ তার মন্ত্রনাদাতা ও পরিচালক মামা বৈরাম খাঁকে অবসর দিয়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা রাজ্যে সর্বত্র৷ যেখানে তাঁর আদেশের ব্যাতিক্রম দেখছেন সেখানেই সেনাবাহিনী পাঠিয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন৷ সম্রাট আকবর ঈশা খাঁর ধৃষ্টার কথা ভুলেন নাই৷ তার সেনাপতি মানসিংহকে পরাজিত করে অপমানের মালা গলায় পরিয়ে দিল্লিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর কাছে৷ দিল্লির খাজনা বন্ধ করে দিয়ে স্বাধীন ভাবে পরগনা পরিচালনা করছেন৷ কিন্তু তিনি এখন বেঁচে নেই৷ সম্রাট আকবর ঈশা খাঁর অপমানের বদলা নেবেন৷ তাই তিনি তার দুই পুত্রের বিরুদ্ধে বিশাল দক্ষ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে যুদ্ধে মুছা খাঁ ও ওসমান খাঁ কে পরাজিত নিহত করে গোটা সোনারগাঁও রাজ্যই দখল করে নিলেন৷ এখন মুঘল শাসন বাংলায় পোক্ত করা দরকার৷ তাই সোঁনার গাঁ দখলের দাবিদার ইসলাম খানকে বাংলার সুবেদার করে পাঠালেন৷ তিনি মুঙ্গের, কলকাতা, গৌড় সহ সমস্ত এলাকা শাসন ক্ষমতার কেন্দুবিন্দু করলেন ঢাকাকে৷ ঢাকা থেকে ঈশা খাঁর ২৪ পরগনার শাসনকর্তাদেরে মুঘলদের বশ্যতা স্বীকারের আদেশ জারী করলেন৷ তিনি উল্লেখযোগ্য কাজ করলেন গৌড় হতে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর৷ এখন এখান থেকে সমগ্র বাংলা মুলুক শাসন করা সহজ হল৷
ইসলাম খাঁ সুদক্ষ শাসক ও বীর যোদ্ধা৷ তিনি ঈশা খাঁর কাতরাভূ, কদমরসুল দূর্গ জয় করে মন দিলেন বাংলার বারো ভূইয়াদের দিকে৷ ইসলাম খাঁ প্রত্যেকের কাছে ফরমান পাঠালেন মুঘল বশ্যতা স্বীকার করতে৷ যারা স্বীকার করলেন তাদের জমিদারী ঠিক রইল৷ আর যারা অস্বীকার করলেন সৈন্য পাঠিয়ে তাদের জমিদারী দখল করে অন্য শাসক নিযুক্ত করছেন৷ আগেই তিনি আটিয়া পরগণায় হাত দিলেন না৷ কারণ অবশ্যই আছে৷ সোনার গাঁ পতনের পর আটিয়ার পরগণদার বাবা কাশ্মীরী (রঃ) খাজনা ট্যাঙ্ বন্ধ না করে ঢাকায় ইসলাম খাঁর খাজাঞ্চী খানায় পাঠাতে লাগলেন৷ এতদ শ্রবণে ইসলাম খাঁ খুবই সন্তুষ্ট হলেন৷ শুধু তাই নয় তিনি আটিয়া পরগণার শাসনকর্তা আদম কাশ্মীরী (রঃ) বহাল রেখে সময়ে ঢাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পত্র পাঠালেন৷ অলি বাবা শাহানশাহ (রঃ) উপর ইসলাম খাঁ খুশি হলেন এই জেনে যে তিনি একজন সুফি দরবেশ কাশ্মীরী সম্বান্ত অধিবাসী৷ শান শওকত নেই, বিলাসিতা বিষবত মনে করেন৷ সংসারের প্রতি নির্লোভ, চিরকুমার বার্ধক্যের কোঠায় পা বাড়িয়েছেন৷ পরগণা শাসনে তার এতটুকুও শৈথিল্য নেই৷ তিনি আগের মতই নিজের খোরাকীর জন্য সামান্য কিছু অর্থ রাখেন আর কিছূ পরগণা পরিচালনার জন্য বরাদ্দ দিয়ে বাকি সবই ইসলাম খানের সদরে পাঠাতে থাকেন৷
বাবা আদম কাশ্মীরী (রাঃ) আটিয়া পরগণাকে শিল্প বানিজ্যে সমৃদ্ধশালী ও অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল করার জন্য মন দিলেন৷ স্থানীয় কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য শিল্পীদের উত্সাহ, আর্থিক সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে লাগলেন৷ এদের মধ্যে কুমার বা পাল সমপ্রদায়ের মাটির তৈজসপত্র, বাঁশ বেতের শিল্পীদের কুটির শিল্প, তুলট কাগজ, বাজি বারুদ, তাঁত শিল্প প্রভৃতি উল্লেখ্যযোগ্য৷ কাঠ শিল্পিদের স্থায়ী এলাকা বরাদ্দ করে দিলেন৷ ঘানি শিল্পিরা গ্রাম পেলেন হিঙ্গানগর৷ ***
তুলট কাগজের জন্যে আটিয়া তখনও বিখ্যাত ছিল৷ এখনকার মত তখন উন্নত ধরনের কাগজ সহজলভ্য ছিল না৷ আর মুদ্রণ শিল্প ও কাগজ তৈরির যন্ত্রও আবিষকৃত হয়নি৷ সুতরাং হাতে তৈরি তুলট কাগজের প্রচলন ছিল৷ এতে লেখালেখি চলত৷ এর প্রস্তুত প্রনালী ছিল চমত্কার৷ পুরান কাপড়, শিমুল তুলা, পুরানো কাঁথা প্রভৃতি প্রক্রিয়াজাত করে প্রথমত মন্ড তৈরি তারপর ভাতের মাড় সংমিশ্রন করে কাঠের শক্ত তক্তা ও পাথরচাপা ইত্যাকার সংগে আরও কিছু কাজ করে রৌদ্র অথবা চুলার আগুনে শুকিয়ে কাগজ তৈরি করা হত৷ এদেরকে কাগজিয়া বলা হত৷ এখনও এদের বংশধর আটিয়াতে আছেন৷ তবে সে পেশার তাদের বাপ দাদারা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশা গ্রহণ করে ছিলেন৷
বাজি বারুদ তৈরিতে আটিয়া সদর বহুত বিখ্যাত ছিল৷ এ মূলুকে যত অনুষ্ঠানাদি যেমন বিবাহ, খাতনা, মহরম উত্সব, শিশুদের অন্য প্রশুন, পুঁজা-পার্বণ, নবাব জমিদারদের শুভ পুন্যাহ অনুষ্ঠানে প্রচুর বাজি পোড়ানো হত৷ চরকি বাজি, ঢিল বোমা, বোম ছিতারা, পটকা আরও কত রকমের বোমা আর বাজি বারুদ বানাতে পারতো শিল্পিরা৷ শোনা যায় তারা এমন ধরনের বোমা তৈরি করতে পারতো যা ফাটালে মানুষ আট দশ মাইল দূর পর্যন্ত শব্দ শুনতে পেতো৷ বোম ছেতারা আকাশে ছুড়লে এক আলো হতে পাঁচ, আবার পাঁচ আলো হতে আরও পাঁচ আলো এমনি করে পাঁচিশ আলো বিচ্ছুরিত হতো৷ এটা আকাশ মূখো শক্ত ভারী লোহার চোঙ্গা তেঁতে তাতে ঐ আতশবাজি রেখে দিতে হত৷ আর তাতে আগুন দিলে আকাশে গিয়ে আলো দিত ও পটকা ফুটতো৷ এ শিল্পিদেরও বংশধর আটিয়ায় এখনও দেখা যায়৷ এদেরকে বলা হয় বারুজিয়া৷ আটিয়া সদর ব্যবসা বানিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র ছিল৷ নৌপথের চমত্কার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল৷ বড় বন্দরের মত আটিয়া বন্দর নামকরা ছিল৷ লৌহজং নদী দিয়ে ইষ্টিমার, লঞ্চ, জং বড় নৌকা মালামাল নিত ও আনতো এ বন্দরে৷ ধনাঢ্য মহাজন বনিক সমপ্রদায় প্রয়োজনীয় জিনিষ এখানে এনে গুদামজাত করতো আর পাইকারদের কাছে বিক্রি করতো৷ মোট কথা আটিয়া সদর পরগণা ব্যবসা বানিজ্যের প্রাণকেন্দ্র মশহুর প্রাণকেন্দ্র ছিল৷ এখানে প্রতিদিন জমজমাট বাজার বসত৷ নানা রকম দোকানে রকমারি জিনিষ বিকি কিনি হত৷ তরি-তরকারি, দুধ, মাছ, চাল, ডাল, কাপড়, চোপড় ও আনুসঙ্গিক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ আমদানি রপ্তানি হত প্রচুর৷ প্রবাদ আছে সাইদ খান পন্নী বালক বয়সে মায়ের গাভীর দুধ বিক্রি করতেন৷ গোয়ালাদের গরু বাছুর চড়াতেন৷ সাঈদ খাঁন একদিন দুধ বিক্রি করতে নিলে পথিমধ্যে তার পাত্রের সব দুধ দরবেশ বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) এক চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন৷ একথা সাঈদ খাঁন মায়ের কাছে ব্যাক্ত করলে তার মা কোন ব্যাক্তি তার ছেলের হাত হতে দুধ খেয়েছে দেখতে পরের দিন ছেলের পিছনে তফাতে থেকে চলতে লাগলেন৷ মা দেখলেন এক বৃদ্ধ (যিনি বাবা কাশ্মিরি রঃ) সাঈদ খাঁনের হাত হতে পূর্বদিনের মত পাত্র ছিনিয়ে নিয়ে সবটুকু দুধ আবার খেয়ে ফেললেন৷ সাঈদ খাঁন প্রতিবাদ করলে তাকে লাঠি দিয়ে পেটাতে আরম্ভ করলেন৷ এই দৃশ্য দেখে মা এসে ছেলেকে রক্ষা করার জন্যে দরবেশের চারদিকে বেড়া বেড়ি করতে লাগলেন৷ তাতে সাঈদের গায়ে ইতিমধ্যেই সাতটা আঘাত পড়ে গেছে৷ আর অবশিষ্ট সাতটা আঘাত আংশিকভাবে সাঈদের গা স্পর্শ করেছে মাত্র৷ তখন বাবা কাশ্মিরী দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন যে, তার অধঃস্থনেরা সাত পুরষ প্রবল প্রতাপের সঙ্গে জমিদারী করতে পারবে৷ আর সাত পুরষ নিবু নিবু ভাবে জমিদারির কাজ চালাতে পারবে৷
আটিয়াতে তত্কালে একটি উন্নত ধরনের ব্যবসায়ী কেন্দ্র ছিল মাটি খূড়লেই তার প্রমাণ মেলে৷ সেকালে মানুষে মাটির তৈজসপত্র প্রচুর ব্যবহার করতো৷ চাড়া,
খাপড়া এমনকি আস্ত পাত্রও এখানে পাওয়া যায়৷ এছাড়া পুতির মালা, মুগা, দানা, চিনা মাটির ভাঙ্গা টুকরা, পুতুল, পোড়া মাটির খেলনা নানা প্রকার ইট পাথরের টুকরা আজও মাটির গভীরে খুড়লে হঠাত্ই দেখতে পাওয়া যায়৷
বাবা আদম কাশ্মিরী (রঃ) আটিয়াকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন৷ তিনি নিজে ছিলেন শিক্ষা-দিক্ষায় উন্নত পন্ডিত ব্যাক্তি৷ ইসলামী জ্ঞানে তিনি তত্কালে এ তল্লাটে বিখ্যাত ছিলেন৷ জ্ঞান বিস্তারে তাঁর প্রচুর আগ্রহ ছিল৷ তাই তিনি বড় পন্ডিতদের মত শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত হলেন৷ এজন্যে দূর দূরান্ত হতে ছাত্র শিক্ষক এখানে এসে ভিড় জমাতেন৷ তারা আসতেন জ্ঞান পিপাশা নিবারনের জন্যে৷ বাবা কাশ্মীরী ও তার নিয়োজিত পন্ডিতেরা প্রাণপাত পরিশ্রম করে সভ্যতার উজ্বল প্রদীপ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন৷ একথার সারবস্তা খুঁজে পাওয়া যায় যখন দেখা যায় মুসলিম পরিবারের এখানকার মানুষ কেউ সৌয়দ, কেউ মিয়া, কেউ খন্দকার, কেউ শেখ, কেউ মির্জা, কেউ পাঠান, হাফেজ, কারী, মওলানা, মুন্সি প্রচুর ছিল এবং এখনও আছে৷ মুরুব্বীদের কাছে শুনেছি দু-একঘর পাঠান বংশিয় লোকেরা বাস করতেন৷ খাঁ সাহেবদেরতো ভূরি ভূরি প্রমাণ মেলে৷ এরা নাকি খূব উঁচু দরের খাঁন বংশিয় লোক৷ খন্দকার, ফারায়েজি, হাজামত, খৌরকার, চর্মকার, স্বর্নকার, বাঁশ-বেতের শিল্পীরা বাস করতো এখানে৷ এদের মধ্যে আজও উঁচু দরের সরাফতি আচার-আচরণ দেখা যায়৷ বলতে গেলে আটিয়াতে নানা বংশের আশরাফ-আত্রাবের লোক বাস করতেন৷ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ধনী ব্যাক্তিরা প্রায় সবাই আটিয়ার মাটি ছেড়ে শহরে সভ্যতায় ঠাঁই জমিয়েছেন৷ কেউবা একবারেই এ স্থান ত্যাগ করে চলে গেছেন, আর ফিরবেন না৷
এবার আলী বাবা হজরত আদম কাশ্মীরী (রঃ) তাঁর এতিম ভাগনে এবং তার কাছে রক্ষিত বায়েজিদ খানের ছেলে সাঈদ খাঁন এদেরকে মানুষ করার দিকে মন দিলেন৷ পাঠান বালক সাঈদ খাঁ এবং ভাগ্নে শাহ্ জামান (রঃ) বাবা কাশ্মীরী (রঃ) বিশেষ তত্বাবধানে শিক্ষা প্রাপ্ত হতে লাগলেন৷ ১২ বছরের শাহজামান (রঃ) এখন ৩০ বছরের পূর্ণ যুবক৷ সাঈদ খাঁনও তাই৷ উভয়েই সম বয়স্ক৷ শিক্ষার সাথে সাথে উভয়ের চরিত্রের ভিন্ন গুন ফুটে উঠতে লাগলো৷ শাহ্জামান (রঃ) শিক্ষার সঙ্গে কোরআন, হাদিস, ফেকাহ্, কেয়াস ইজমা ও সেইসঙ্গে মামার মত আধ্যাত্ম জ্ঞানেরও অনুশীলন রীতিমত করতে লাগলেন৷ সাথে নামাজ-কালাম, জিকির-আস্কার নিত্য সঙ্গী৷ অপরপক্ষে সাঈদ খাঁন সকল শিক্ষার চাইতে যুদ্ধ বিদ্যা চর্চা করতে বেশি পছন্দ করতে লাগলেন৷ আলী বাবা হজরত আদম কাশ্মীরী (রঃ) দু'শিষ্যের বিপরীতমূখী আচরণে আশ্চর্য হলেন না৷ তিনি বুঝলেন এ হল রক্তের তাছির৷ শাহ্ জামানের শরীরে রয়েছে অলিয়ে কামেলের রক্ত৷ আর সাঈদ খাঁনের শরীরে রয়েছে সৈনিকের রক্ত৷ বাবা শাহ্ জামান (রঃ) কাগমারির প্রশাসণ শিক্ষা বিস্তার তাঁর আদেশ প্রতিপালন করার জন্যে নিয়োজিত আছেন৷ বাবা কাশ্মীরী (রঃ) কাজ উপলক্ষে প্রায়ই কাগমারী যেতেন৷ আবার শাহ্ জামান (রঃ) জরুরী কাজে আটিয়া আসতেন৷ সমস্যা থাকলে মামা সমাধান করে দিতেন৷ ভাগ্নে রিষ্ট চিত্তে কাগমারী ফিরে যেতেন৷ তাতে মামা এত খুশি হতেন যে, নফল নামাজ আদায় পরম করুনাময়ের কাছে শাহ্ জামানের জন্যে দোওয়া করতেন৷ তিনি এই বলে দোয়া করতেন যে, এতিম ভাগ্নে তিনি যেন মানুষের মত মানুষ করেন৷ আল্লাহ তার দোয়া পুরোপুরি কবুল করেছিলেন৷ ফলে পরিণত বয়সে পুরো দস্তুর তাঁর মতই চরিত্রবান ও ধর্মভীরু সুশাসক হয়েছিলেন৷
সোনার গাঁয়ের শাসনকর্তা ঈশা খাঁ ইতোপূর্বে আটিয়া পরগণার পর কাগমারী পরগণা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ শাসন ক্ষমতা যুক্ত ভাবে আটিয়ার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরীর উপর৷ তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে কাগমারী পরগণা দেখাশোনা ও শিক্ষা দিক্ষা বিস্তারের জন্যে স্নেহধন্য ভাগ্নে শাহ্ জামান (রঃ) কে নিয়োজিত করেছিলেন৷ আটিয়ার কিছু কিছু কাজ সাঈদ খানকে দিয়ে চালাতে লাগলেন৷ এ সময় বাবা কাশ্মীরী (রঃ) নবতিপর বৃদ্ধ৷ বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছিলেন৷ আটিয়া ও কাগমারী পরগণার শাসন কাজ আর তাঁর ভাল লাগছিল না৷ তিনি মনে মনে স্থির করে ছিলেন অন্যের উপর পরগণার দ্বায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে একান্তে আল্লার ধ্যান খেয়ালে সময় কাটিয়ে দিবেন৷ আটিয়া এবং কাগমারি অনেক আগেই মোঘলদের অধীনে চলে গিয়েছিল৷ বাবা কাশ্মীরী মুঘলদের হয়েই নিশ্চিন্তে নিবিঘ্নে পরগণা চালিয়ে আসছিলেন৷ এখন কোন ঝামেলা আটিয়াতে সাঈদ খাঁন আর কাগমারীতে শাহ্জামান ভালোই চালাচ্ছেন৷ সবই ঠিক কেবল তিনিই বৃদ্ধ এবং শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দেবার সুযোগে দিনক্ষন গুনছিলেন৷ ইচ্ছা করলেই তো আর শাসনকাজ অন্যের উপর ছেড়ে দেওয়া যায় না৷ এটা মুঘল প্রতিনিধি ঢাকার সুবেদার ইসলাম খানের কাজ৷ তিনি শাসনক্ষমতা অন্যের উপর দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাবেন সময় সুয়োগে৷ সে সুযোগও ইনশাআল্লাহ্ এসে গেল সামনে৷ ঢাকার সুবেদার ইসলাম খাঁন তার অধিনস্থ সমস্ত পরগণা পুর্নবিন্যাস করার সিদ্ধান্ত নিলেন৷ একের পর এক পরগণাদারদের ঢাকায় ডেকে যাচাই বাছাই করে একসময় আটিয়া পরগণার শাসক আলি বাবা হজরত বাবা শাহানশাহ্ এর নিকট দূত পাঠালেন তিনি৷ আলি বাবাও চাচ্ছিলেন এটাই৷ দূতের পত্র পাঠ ক্ষণকাল গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন৷ সিদ্ধান্ত নিলেন এ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করবেন না৷ দূতকে বললেনঃ তিনি প্রস্তুত৷ অতি সত্তরই ঢাকার পথে রওনা দেবেন মাননীয় সুবেদার ইসলাম খাঁনের সঙ্গে দেখা করার জন্যে৷ দূত চলে গেলেন ঢাকায়৷
তারপর শুভক্ষন দেখে আল্লার নাম ভরসা করে রওনা দিলেন সুবেদার ইসলাম খাঁনের দরবারের উদ্দেশ্যে৷ সঙ্গে নিলেন তার আশ্রিত পাঠান যুবক সেনাপতি বায়েজিদ খানের পুত্র সাঈদ খাঁন এবং স্নেহধন্য ভাগ্নে শাহ্ জামানকে৷ এক সময় সহি সালামতে পেঁৗছে গেলেন ঢাকায়৷ সালাম-কালাম, কুশল বিনিময়ের পর সুবেদার বিশ্রামের আদেশ দিলেন পাইক পিয়াদাদের৷ সেদিন এই পর্যন্তই৷
পরদিন বিজ্ঞ ইসলাম খাঁ রাজকীয় মেহমানকে দেখলেন বয়সের ভারে যদিও নু্যব্জ্য প্রায় তথাপিও তিনি এখনও গায়ে গতরে শক্ত সামর্থ৷ মেহেদীমাখা চাঁপ দাড়ি বাবড়ি, শরীরে কাঁচা হলুদের মত রং, সৌম শান্ত এবং আত্মপ্রত্যয়ী বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে যথা নিয়মে সালাম ঠুকে আস্তে আস্তে প্রবেশ করলেন সুবেদার ইসলাম খাঁনের দরবার কক্ষে৷ বৃদ্ধের দু'পাশে সদ্য ফোঁটা গোলাপের মত টলমলে সুদর্শন চেহারার যুবকদ্বয়৷ তাদের হাতে মান্যবর সুবেদারের জন্যে আকর্ষনীয় নজরানা৷ অতিথিদের দেখা মাত্রই সুবেদার ইসলাম খাঁ নিজ আসন হতে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে সংরক্ষিত আসনে বসার অনুরোধ করলেন৷ ইসলাম খাঁ উপস্থিত সভাসদ ও আমন্ত্রিত অতিথীদের উদ্দেশ্য করে বলল্লেন মাননীয় সভাসদ বৃন্দ ইনিই হচ্ছেন আমাদের আজকের পরম শ্রদ্ধেও রাজঅতিথি আটিয়া পরগণার মহান শাসক আলি বাবা হজরত শাহানশাহ আদম কাশ্মিরী (রঃ) সবাই দাঁড়িয়ে রাজকীয কায়দায় অভিবাদন জানালেন তাঁদেরকে এবং বৃদ্ধের অতুলনীয় নূরানী চহারা মোবারকের দিকে তাকিয়ে রইলেন বিস্ময়ে৷ তিনি বলে চললেন আটিয়ার রিপোর্টে এমন একটা ব্যাতিক্রম দেখছি যার অকুন্ঠ প্রশংসা না করে পারা যায় না৷ ইসলামের অভূ্যদ্বয়ের পর একমাত্র চার খলিফার আমল বাদ দিলে শুধু বিলাসিতার রাজত্ব ব্যাতিত আর কিছুই নজরে পড়ে না৷ কিন্তু সেই বিলাসিতার বন্যার উর্দ্ধে থেকে শ্রদ্ধেও আদম কাশ্মীরী (রঃ) খাঁটি ও কর্তব্যপরায়ন৷ মুসলমান শাসক হিসাবে পরগণা শাসনের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন৷ একথা বলার পর সুবেদার ইসলাম খাঁ একটু থামলেন৷ উপস্থিত সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত বাবা আদম কাশ্মীরির (রঃ) ফরির দরবেশি জীবন পদ্ধতির কথা শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হলেন৷ তারপর ইসলাম খাঁ বললেন দিল্লীর বাদশাহ নামদার মহামতি সম্রাট আকবর খান যে সমস্ত মুঘল সম্রাজ্য সুখ সমৃদ্ধি ও আনন্দ কোলাহলে ভরে উঠুক৷ প্রত্যেক শাসক নিজ নিজ পরগনার প্রজা পালনে কল্যাণকর ভূমিকা রাখুক৷ উল্লেখিত অলোক সামান্য ব্যাক্তিটির মধ্যে এ সমস্ত বিরল গুনরাজি তো আছেই অধিকন্তু তিনি একজন সাক্ষাত ওলিয়ে কামেল আল্লাওয়ালা ব্যাক্তি৷ এমন প্রজা নিবেদিত প্রাণ শাসকই সবার কাম্য৷ আটিয়া পরগনার শাসক আলি বাবা হজরত শাহান শাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) আমাদের অনুকরনীয় আদর্শ৷ আমরা তাঁর সুস্বাস্থ্য ও কর্মময় দীর্ঘজীবন কামনা করি৷ তাঁর এ নাতিদীর্ঘ ভাষনের পর সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পড়লেন৷ অল্পক্ষনের মধ্যে সবাইকে বিদায় দিয়ে বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) কে নিয়ে পর্দার অন্তরালে চলে গেলেন৷ সেখানে হালকা নাস্তা পানি গ্রহণ করার পর এখানেই নাস্তার টেবিলে আবার একান্তে আলাপ শুরু করলেন৷ ইসলাম খাঁ প্রশ্নাতুর নেত্রে বল্ললেন বলুন আপনার আর্জি৷ আমি প্রস্তুত৷
বাবা কাশ্মীরী (রঃ) যথাযোগ্য মর্যাদা জানিয়ে বলতে শুরু করলেন৷ মহামান্য সুবেদার৷ আটিয়া পরগনার সুশাসনের জন্য যে দৈহিক ও মানসিক উপযুক্ততার দরকার তার সামান্যই বর্তমান আছে আমার মধ্যে৷ আমি নবতিপর বৃদ্ধ৷ এখন দুনিয়ার কোন ঝামেলাই আমার মন চায় না৷ আমার মন চায় সর্বদাই আল্লাহর ধ্যানে খেয়ালে দিন গুজরান করি৷ চাওয়া ও পাওয়ারতো জীবনে আর কিছূই বাকি নেই৷ তাই আমি আপনার আটিয়া পরগণা শাসনের গুরু দ্বায়িত্ব থেকে অবসর চাচ্ছি৷ অনুগ্রহ করে অব্যাহতি দিলে আমি আপনার মঙ্গলময় দীর্ঘ জীবন কামনা করতাম৷ ইসলাম খাঁ অত্যন্ত প্রীত হলেন৷ বৃদ্ধের আবেদনময়ী অথচ আন্তরিক আর্জিতে যারপর নেই অভিভূত হলেন৷ কাল বিলম্ব না করে ইসলাম খাঁ বল্ললেন আপনার দরখাস্ত মঞ্জুর করা হলো৷ এখন অনুগ্রহ করে বলুন আটিয়া পরগণা শাসনের জন্যে আপনার মনোনীত ব্যাক্তি কে ? আপনি যার নাম প্রস্তাব করবেন আমি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকেই ঐ কাজে নিযুক্ত করবো৷ আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি আপনার পছন্দের ব্যাক্তি আপনার গুনাবলী না পেয়েই যায় না৷ তাই আমি আপনার ঈস্পিত ব্যাক্তিকে এখনই আপনার স্থলাভিষিক্ত করবো৷ বাবা আদম কাশ্মীরী (রঃ) অত্যন্ত বিগলিত চিত্তে অঙ্গুলী নির্দেশ করে দেখিয়ে দিলেন সঙ্গে আনা অত্যন্ত বলিষ্ঠ তেজদ্বীপ্ত চাদুনী পাঠান যুবক সাঈদ খাঁকে৷ মুখে বল্লেন একে আশৈশব শাসন কাজের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে চলেছি আমি৷ এ যুবক হচ্ছেন মুঘলদের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি বায়েজিদ খাঁর পুত্র সাঈদ খাঁ৷ তারপর এই পাঠান পুত্রের গোড়ার ইতিহাস তুলে বললেন এক সময় বাংলায় মুঘল পাঠান পাল্টা পাল্টি যুদ্ধ শুরু হয়৷ হত্যা, লুন্ঠন, রক্তপাত কহতব্য ছিল না৷ তা সত্তেও মুঘল শাসন বাংলার জনপদে শক্তই ছিল৷ কিন্তু সুবেদার মুজাফর খাঁ পাঠানদের ঝটিকা আক্রমনে নিহত হন৷ তখন মুঘলদের উপর নির্মম জুলুম নেমে আসে৷ যেখানে মুঘলদের সন্ধান পায় সেখানেই মরন আক্রমন করে মুঘলদের ধ্বংস না করে ছাড়ে না৷ কিন্তু পাঠানরা সবচেয়ে বড় বাধা পেলেন মুঘল সেনাপতি বায়েজিদ খানের কাছ থেকে৷ তিনি চোরাগুপ্তা আক্রমন চালিয়ে পাঠান সেনা ও শাসকদের খতম করে চল্লেলেন৷ এতে তারা ভয়ানকভাবে পর্যদস্তু হয়ে পড়লো৷ তারা এই বায়োজিদ সেনাপতিকে ধরা বা নিহত করার জন্যে স্থানে স্থানে সংঘবদ্ধ চিরুনী অভিযান চালালেন৷ এতে বায়েজিদ এর সবগুলো সৈন্য হয় নিহত না হয় আত্মরক্ষার জন্য যে যেদিকে পারলো পালাতে লাগলো৷ এবার তাদের প্রধান সেনাপতি বায়োজিদ খাঁকে খতম করা হবে৷ কোথায় সে ? ধর তাঁকে৷ একথা সেনাপতি বায়েজিদের কানে পেঁৗছে গেলে তিনি আত্মরক্ষার জন্য পথ খুঁজতে লাগলেন৷ পশ্চিম এবং উত্তর দিক পাঠান সৈন্য দ্বারা লৌহ প্রাচীর নির্মিত৷ সুতরাং দিল্লিতে ফেরা আপাতত অসম্ভব৷ দক্ষিন দিক নদীনালা সমুদ্র৷ ওদিকেও যাওয়া নিরাপদ নয়৷ তাই পূর্বদিক খোলা আর উচুভূমি এবং নিরাপদও বটে৷ তিনি ছিলেন অশ্ব রোহী দলের সেনাপতি৷ তাই শক্তিশালী এক তেজী ঘোড়া বেছে নিয়ে পিঠে উঠে জোরছে চাবুক কষলেন৷ পূর্বদিকে ঘন্টার পর ঘন্টা কতক্ষন যে মুঘল রাজধানী গৌড় হতে চলে এসেছেন তা তার খেয়াল নেই৷ একসময় হঠাত্ দেখতে পেলেন, সাগর সদৃশ বিরাট প্রশস্ত নদী৷ সেই কাক ডাকা ভোরে ঘোড়ায় সোয়ার হয়েছেন৷ এখন দিন গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেল৷ ঘোড়া হতে নেমে পড়লেন৷ যে করেই হোক নদী পার হতে হবে৷ সন্ধান করতে লাগলেন লোকজন আর নদী পারাপারের নৌকা৷ কিন্তু দুটোর একটাও চোখে পড়ছে না৷ তবে বেশ দূরে লোকালয়ের সন্ধান দেখা যাচ্ছে৷ ছুটালেন ঘোড়া পাড় ধরে সেই দিকে৷ অল্পক্ষণ পরেই সেখানে একটা বাড়িতে এসে এক মধ্য বয়সী দাঁড়িওয়ালা গেরস্তকে দেখে নদীর নাম এবং কিভাবে এটা পার হওয়া যায় জিজ্ঞাস করলেন তাকে৷ লোকটি বলল নদীর নাম যমুনা, প্রশস্ত প্রায় ১০/১২ মাইল৷ পাড় হতেও ১০/১২ কাহন লাগবে৷ কাহন এখন টাকাই বুঝায়৷ পাড়াপাড় হতে নৌকা ছাড়া উপায় নেই৷ বায়েজিদ খাঁন পালিয়ে আসার সময় ব্যাগভর্তি বেশ কিছু স্বর্ণ মূদ্রা সঙ্গে করে এনেছিলেন৷ তিনি বুদ্ধিমান তাই খালি হাতে আসেন নাই৷ তিনি গেরোস্ত লোকটিকে বলেন পাড়ের জন্য ১০ কাহন এবং পুরষ্কার হিসাবে আস্ত একটা স্বর্ন মুদ্রা পাবে, চল৷ আর যায় কোথায়! মাসে মেলে না ১০ কাহন, আর স্বর্ণ মূদ্রা ! আধা বয়সী লোকটি ডাকাডাকি হাকাহাকি শুরু করে দিল.................... কই রে মাইঝা বাহে, শিঘ্রই আয়৷ কেড়ায়া পাইছি৷ ওপাড় যাতি হবি, চলি আয়৷ কইরে টেপির মা, হুকা, কলকি তামাক দিয়ে যা৷ ডাক শুনে তিন তাগড়া জোয়ান ছেলে এসে নৌকায় ঘোড়ার পায়ের তলায় খড় বিছিয়ে বায়েজিদকে নায়ে উঠিয়ে বদর বদর বলে ঝপাঝপ দাড় ফেলে দিল নদী পাড়ি৷ বায়েজিদ এতোক্ষনে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন৷ এখন শত্রুর নাগালের বাইরে এসে গেছেন৷ শুকুর গুজারী করলেন আল্লার দরবারে৷ অনেকক্ষন পর এসে ভোর বেলায় পূর্ব পাড়ে নৌকা ভিড়লো৷ মাঝি মাল্লাদের পাওনা পরিশোধ করে ঘোড়া নিয়ে নেমে পড়লেন পাড়ে৷ আর তাদের সাবধান করে দিলেন যে, কেউ যদি জিজ্ঞাস করে তবে জানিনা বলে এড়িয়ে যাবে কেমন৷ তারা স্বীকারউক্তি দিয়ে আবার ওপাড়ে চলে গেল৷ কিন্তু বায়েজিদ এখন যাবে কোথায় ? তবে তিনি মুঘল সুবেদার মুজাফর খাঁ তুর বর্তির কাছে শুনেছিলেন যে, যমুনা নদীর ওপাড়ে মস্নদ ই আলা সুবাদার ঈশা খানের রাজত্ব৷ ঈশা খাঁ শক্তিশালী মুঘল কতর্ৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সুবাদার৷ সুতরাং তার রাজ্যে শত্রুরা তার পশ্চাদধাবন অসম্ভব৷ তাই তিনি হৃষ্ট চিত্তে আরও পূর্ব দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে একটা নির্জন সুবিধামত আশ্রয় পেয়ে গেলেন৷ ভাগ্য ভাল এক মুসলমান বৃদ্ধের বাড়ি এটা৷ বাড়ির সামনে খড়ের দোচালা ঘর৷ বাইরে ছোট বাঁশের মাচি আর ভিতরেও আধা ঘরে মাচি৷ পরিষ্কার ছিমছাম মাচির উপর খেজুর পাতার চাটাই বিছানো৷ বায়েজিদ এটাকেই থাকার উপযুক্ত স্থান মনে করলেন৷ সূর্য এখনও উঠেনি৷ ফজরের নামাজ আদায় করার জন্যে বৃদ্ধ এই মাত্র ওজু সারা করে বিদেশী মেহমানের আগমন দেখে বদনা রেখে উঠে দাঁড়ালেন৷ বায়েজিদ ভূমিকা না করে বৃদ্ধের কাছে বিশ্রামের জায়গা কামনা করলেন৷ বৃদ্ধ রাজি হলেন বটে কিন্তু এতবড় মেহমানকে থাকতে দেবেন কেমন করে ? বায়েজিদ বৃদ্ধের মনোভাব বুঝতে পেরে বল্লেন ঐ ঘরের বাঁশের মাচির উপর বিশ্রাম নিতে তাঁর কোন অসুবিধা হবে না৷ বৃদ্ধের মেয়ে আমিনা মেহমানের আগমন বার্তা টের পেয়ে ত্বরায় ডালভাত যা পাড়লো পাক করে বাবাকে দিয়ে মেহমানের সামনে পাঠিয়ে দিল৷ মেহমান তাই-ই অভূক্ত পেটে খেয়ে অবসন্ন হয়ে শীঘ্রই মাটির উপর গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন৷ সারাদিন এবং সারারাত বায়েজিদ খাঁন এবং আশ্রয়দাতা বৃদ্ধের মধ্যে আর কোন কথাই হল না৷
পরের দিন পরিচয়ের পালা৷ বাড়ির মালিকের নাম আব্দুল করিম৷ এ নাম আলি বাবা হজরত শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরীর দেয়া৷ আগে তিনি হিন্দু কায়স্থ ছিলেন৷ বছর তিনেক আগে আলী বাবা কাশ্মীরীর হাত ধরে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়া শীতল কোলে আশ্রয় নিয়েছেন৷ এই বলে বাবা কাশ্মীরীর উদ্দেশ্যে ছালাম জানিয়ে নিলেন৷ তার এ অপরাধের জন্যে তার আত্মীয় স্বজন সবাই ক্রুদ্ধ হয়েছেন৷ সহদর ভাইয়েরা বড় দুই ছেলে ও বিবাহিত দুই মেয়ে জাতিচু্যত বলে বৃদ্ধকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে৷ তাইতো গ্রাম ছেড়ে বাইরে ছোটখাটো করে কুড়ে ঘর তৈরি করে ছোট মেয়ে আমিনাকে নিয়ে একাকিত্বে নির্জনে বাস করছেন৷ মেয়ে আমার জানের জান৷ কিছূতেই আমাকে ছাড়তে পারলো না৷ সেও মুসলমান হয়ে আমার সঙ্গে বাস করছে এখানে৷ এ বলে বৃদ্ধ চোখের পানি ফেলে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন৷ এই কান্না অবস্থায় বল্লেন কেউ আমার ছায়াও পর্যন্ত মাড়ায় না৷ তারা বলে ধর্মচু্যত হয়েছি বলে আমি এবং মা আমিনা উভয়েই মৃত৷ তিনি তাদের কাছে অস্পৃশ অসুচি তাই এই নির্জনতা বাপ বেটিতে বেছে নিয়েছেন৷ মেয়েটা বিবাহের যোগ্যা৷ তাকে ছাড়া তিনি একদন্ড থাকতে পারেন না৷ কিন্তু বিবাহের কোন পাত্র পাওয়া যায় না৷ পাত্র খুঁজতে গেলে মুসলমান বর পক্ষ বলে হিন্দুর মেয়ে, আর হিন্দুরা বলে তার মেয়েকে নেবেই না৷ সে যাই হোক সত্ বংশীয় কোন মুসলামান ছেলে পেলে ভিটে মাটি যা আছে তা বিক্রি করে কন্যাদায় হতে রেহাই পেতেন৷ পীর বাবা হজরত শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরী (রঃ) বলেন ..............তার চিন্তার কোন কারণ নেই৷ আল্লাহ রহমানির রাহিম৷ তার মেয়ের জন্যে তিনি সু-পাত্রই যোগাড় করে দেবেন৷ তিনি আরও বল্লেনঃ তুমি বাড়ি গিয়ে আল্লাহ আল্লাহ কর৷ তাইতো নামাজ পড়ি৷ দোয়া খায়ের পাঠ করি৷ আর মোনাজাত করি তিনি যেন তাঁর মেয়ের জন্যে একজন সত্ পাত্র জুটিয়ে দেন৷ এই বলে বৃদ্ধ আবার চোখের পানি মুছতে লাগলেন৷
অনেকক্ষন দু-জনেই চুপচাপ৷ কারোও মুখে কোন কথা নেই৷ সৈনিক হলেও বায়েজিতের দয়ার্দ দিল একটু বেদনা আপ্লুত হল৷ মনে মনে বলতে লাগলেন কি করে এই অসহায় পরপোকারী বৃদ্ধকে সাহায্য করা যায়৷ আর কি করেই বা তার বিবাহযোগ্যা মেয়েকে পাত্রস্থ করা যায়৷ কিন্তু তিনি তো বিদেশী৷ এখানে সবই অজানা৷ অচেনা৷ তাকেও কেউ চেনে না৷ কে কার কথা শুনবে ? আবার ভাবলেন, সোনার মোহর এনেছেন এক ব্যাগ ভর্তি৷ তিনি আরাম আয়েশে খেতে পড়তে পারবেন, কোনদিন ফুরাবে না৷ মধ্যপ্রাচ্য এমনকি ভারতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বহু ভাগ্যান্বেসী লোক বাংলায় এসেছেন--- এক সময় ধনে মানে সৌভাগ্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহন করেছেন৷ সুখ শান্তি প্রাচুর্যের বাংলা তাদের কাউকে এখন দিয়েছেন সাত পুরষ বসে খেলেও কোনদিন ফুরাবে না৷ তাঁরতো দিল্লী যাওয়ার পথই এখন নিষ্কটক নয়৷ পথিমধ্যে সংহার মুর্তির হাজার বাধা৷ এ মুহুর্তে জীবন বিপন্ন করে দেশে ফিরতেও তিনি নারাজ৷ মুঘলদের বাংলার রাজধানী গৌড়ের খবর তিনি নিজেই জানেন৷ দিল্লীর খবর ইচ্ছা থাকলেও পাওয়ার উপায় নেই৷ বায়েজিদ খাঁন ভাবছেন তো ভাবছেনই৷ তিনি সঙ্গে করে যে মোহর এনেছেন তার মূল্য বাংলার মুদ্রা মানের তুলনায় অনেকগুন বেশি৷ এখানে একটা মোহর ভাংগালে পাওয়া যায় ষোল টাকা, এক টাকা ভাংগালে পাওয়া যায় চৌষট্টি পয়সা, আর এক পয়সা ভাংগালে পাওযা যায় আশিটি কড়ি৷ এক পয়সা সের দুধ, দুই আনা বা আট পয়সায় পাওয়া যায় একমন চাল৷ একটা মুরগীর দাম ৪ পয়সা৷ একটা গরুর দাম ১ টাকা৷ কি সস্তা বাংলার জিনিষ৷ তার সঙ্গে আনা স্বর্ণ মূদ্রা৷ তিনি দশ বারোটি কড়িও খরচ করে খেলে রাজার হালে দিন যাবে৷ এ বাংলা প্রাচুর্যে ভরা৷ তাইতো যুগে যুগে সম্পদে পরিপূর্ণ এই দেশ বিদেশীদের হাতছানি দিয়ে ডেকেছে৷ এখানে এসেছেন বিশ্ব বিজয়ী আলেকজান্ডার, পাঠান, মুঘল বাদশারা ও ভূ পর্যটক বৃন্দ৷ তারা বাংলার অপার শান্তি প্রাচুর্য দর্শনে বিস্ময়ে অবিভূত হয়েছেন৷ এসব কথা পর্যটকরা নিজ হাতে লিখে গেছেন৷ অল্প পরিশ্রমে অনেক কিছুই মেলে এখানে৷ জনগণ সরল সহজ, ধর্মভীরু৷ আবহাওয়া মনোরম ও স্বাস্থ্যপ্রদ৷ বায়েজিদের চিন্তা জগত্-এ কল্প নদীর বান ডেকেছে৷ এ চিন্তা স্রোত কতক্ষন যে বইবে কেউ তা জানে না৷ বুড়ো আব্দুল করিমের সকরুন জীবন কাহিনী যারপর নেই তাকে অবিভূত করেছে৷ তাঁকে এহেন নিষ্ঠুর দন্য দশা থেকে উদ্ধার করতেই হবে৷ কিন্তু কিসে ? বায়েজিদের চিন্তা রাজ্যে ঘুর্নিঝড় বইছে৷ হতাশ যেন তার চিন্তা জগত্-এ অলংঘনীয় বাধা আসে৷ বৃদ্ধ নিজ মুখেই বলেছেন তার বিবাহ যোগ্যা এক কন্যা সন্তান আছে৷ বিবাহের পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না৷ তাকেও অনেকদিন গাঁ ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে এই দেশে৷ থাকারও জায়গা নেই৷ বিদেশ বিভূই-এ কে তাকে জায়গা দেবে ? এমনিতে কারো বাড়িতে তার মত একজন সেনাপতি থাকতেও পারে না৷ আলহামদুলিল্লাহ্ ! বুড়োর এই মেয়েকেই তিনি বিয়ে করে এখানেই থেকে যাবেন৷ তা চিরদিনই হোক বা কয়েক বছরই হোক৷ কোন কথা নেই৷ তবুও তো থাকার একটা ঠাঁই হলো৷ ইতকার চিন্তায় পুরো একটা দিন তার কেটে গেল৷ পরের দিন হঠাত্ এক ফাঁকে বুড়োর মেয়েকে এক ঝলক দেখলেন৷ সত্যিই আমিনা সুন্দরী৷ নব যৌবনা৷ তিনি তাঁকে দেখে চমত্কৃত হলেন৷ তিনি মনে করেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের মেয়েরাই খুব সুন্দরী হয়৷ এ দেশীও মেয়েরা তত সুন্দরী নয়৷ কিন্তু এ মেয়ে দেখে তাঁর সে ধারনা সম্পূর্ন পাল্টে গেল৷ বাঙ্গালী ঘরের মেয়ে এত সুন্দরী হয় ! এ রূপে কার না চিত্ত দাহ হয়৷ রূপ যৌবন সব মিলিয়ে নিবিড় প্রশান্তি বিরাজ করছে তার সর্বাঙ্গে৷ এ রূপের সায়রে যে একবার অবগাহন করবে সে সত্যিই ধন্য হবে, পাবে অপরিমেয় সুখ শান্তি৷ এ মেয়ে অন্য কারো হতে পারে না৷ এ মেয়ে হবে তারই এবং একান্তই তার৷ বায়েজিদ দৃঢ় সংকল্প চিত্ত হলেন৷ এই মেয়েকে তিনি বিয়ে করবেনই৷ আর এখানেই হোক তার জীবনের প্রতিষ্ঠা৷ এক শুভক্ষনে বায়েজিদ বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হলেন গ্রাম বাংলার মেয়ে আমিনার সঙ্গে৷ অল্পদিনে মেয়ের আচার আচরণ, আদর আপ্যায়ন, বুদ্ধিমত্তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার৷ সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হলেন মেয়েটির স্বামী নিবেদিত প্রান দেখে৷ তিনি শুনেছিলেন গ্রাম বাংলার রমনীকুল পতিপরায়না৷ বাস্তবে তিনি আজ স্বচক্ষে তাই দেখলেন৷ বায়েজিদ বুড়োর কুড়ে ঘরগুলি পাল্টিয়ে টিনের সুন্দর চারিটি ঘর চার ভিটায় তুলে দিলেন৷ বাড়ির পরিবেশ করলেন ছিমছাম৷ দেখলে মনে হয় একজন উন্নত পরিবারের বাসস্থান৷ কিছু ভদ্র পরিবারের লোকেরাও ইতোমধ্যে তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘর দোড় তৈরি করে বসবাস করতে লাগলেন৷ বুড়ো শ্বশুর আব্দুল করিমের সংসার যেন আনন্দের বন্যায় ভাসছে৷ আল্লাহর করুনায় দশ মাস দশ দিন পর আমেনার কোল জুড়ে এলো এক টুকরো ফুটফুটে শিশু পুত্র৷ বুড়ো নিজেই নাতি ভাইয়ের নাম রাখলেন সাঈদ৷ বুড়ো শ্বশুর সব সময় মেতে থাকেন তার স্নেহধন্য নাতি ভাইকে নিয়ে৷ বায়েজিদ এ সংসারকে একটা শান্তির নীড় রচনা করেছেন ভেবে নিজেকে ধন্য মনে করেন৷ এভাবে দিন যায় মাস যায় বছর পেরিয়ে আরও কয়েক বত্সর চলে গেল৷
একদিন বাংলার রাজনীতির সর্বনাশা খেলা এ সংসারে আঘাত হানলো৷ বায়েজিদ একদিন জানতে পারলেন বাংলা মুলুক আফগান শাসনমুক্ত৷ সম্মিলিত মুঘল বাহিনী পাঠানদের সম্পূর্ন পরাজিত ও বাংলার বুক থেকে বিতাড়িত করেছেন৷ মুঘল রাজত্ব নিঃকন্টক করেছেন৷ গ্রাম গঞ্জ সর্বত্রই এখন শত্রুমুক্ত৷ দিল্লী ও বাংলা গমনাগমন শঙ্কা মুক্ত৷ দিল্লীর শাসন বাংলার বুকে সু প্রতিষ্ঠিত৷ শুষ্ক প্রায় নদীতে বান ডাকলো৷ মনটা বায়েজিদের আনন্দদোলায় দোল খেতে লাগলো৷ তিনি ভাবলেন তার নিরুদ্দেশ থাকা ও বাংলার নিভৃত কুঞ্জে আত্মগোপনের পালা বুঝি শেষ হয়ে এলো৷ তার দিল্লী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে৷ কিন্তু চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই বৃদ্ধ শ্বশুর আব্দুল করিম হঠাত্ একদিন জান্নাতবাসী হলেন৷ তার চিন্তা স্রোতে খানিকটা বাধা পড়লো৷ কিন্তু তাকে এ বাধা অতিক্রম করতেই হবে৷ অবশ্যই তাকে অভিষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে হবে৷ তিনি হলেন একজন ক্ষত্রিয়৷ ক্ষাত্র ধর্ম খচ্চর ধর্ম৷ কিছুতেই মন মানতে চায় না৷ ভিতর থেকে প্রবলভাবে মাথা চারা দিয়ে উঠে পথ পাবার জন্য৷ তাকে ব্যাকুল করে তুলল দিল্লী যাবার নেশায়৷ এবার পূর্বের চেয়ে আরও সুন্দর খবর এলো৷ আফগান পাঠানদের যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে ইতোত বিক্ষিপ্ত বাংলার আনাচে কানাচে মুঘল সৈন্য যারা আত্মগোপন করে আছেন তাদের আর ভয় নেই৷ সম্মিলিত মুঘল বাহিনীর সঙ্গে নির্ভয়ে দিল্লী যেতে পারেন৷ এজন্যে এই বাহিনী প্রধান মির্জা আজিম কোকা ফরমান জারী করলেন৷ বায়েজিদ ভয়ানকভাবে মরিয়া হয়ে উঠলেন৷ তিনি ভাবনায় পাগল হয়ে গেলেন৷ সে ভাবনা একদিকে স্ত্রী-পুত্রের অচ্ছেদ্য বন্ধন, অপরদিকে দেশে ফিরে যাবার প্রবল আকর্ষন৷ একসময় বিস্মিল্লা বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি৷ আল্লাহ যদি তাকে সহি সালামতে রাখেন তবে অবশ্যই স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে আবার মিলিত হবেন৷ সুতরাং বিলম্ব করা তার জন্যে ঠিক হবে না৷ তাঁকে ফেরার জন্যে মিলিত হতে হবে সেনা প্রধান মির্জা কোকার সঙ্গে৷ দিল্লীতে ফিরে বাদশাহ্ নামদার মহামতি আকবরের সঙ্গে সাক্ষাত করবেন৷ তাঁর এটাই এখন উত্তম সুযোগ৷ এই সুযোগ এই মুহুর্তে হারালে একজন সেনাপতি হয়েও সারা জীবন সুবেদারের অধীনে সামান্য চাকুরী করতে হবে৷ কিন্তু সেটা তার পক্ষে অসম্ভব৷ তাই তিনি বিদায়ের বন্দোবস্তো করলেন৷ অল্প দিনের মধ্যেই একদিন সোনার টুকরা শিশু পুত্রকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে অশ্রু সিক্ত নয়নে উপস্থিত হলেন আলী বাবা হজরত শাহানশাহ্ বাবা আদম কাশ্মীরীর দরবারে৷ বায়েজিদ এ সংকটজনক মুহুর্তে স্ত্রী এবং পাঠান শিশুকে আশ্রয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করলেন বাবা কাশ্মীরী৷ তবে শর্ত যত শীঘ্র পারেন দিল্লী গিয়ে কার্য শেষে স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে যেতে হবে৷ বায়েজিত এতে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন৷ তবে তিনিও ওয়াদাবদ্ধ হলেন স্ত্রী পুত্র অবশ্যই নিয়ে যাবেন কার্য সিদ্ধি হলে৷ বায়েজিত নিশ্চিন্ত হয়ে স্ত্রী পুত্রকে একান্তে ডেকে তাদেরকে ডেকে অঝোরে কাঁদলেন৷ তিনি পতি প্রাণা স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়ে বললেন তিনি বাদশার দরবারে পেঁৗছেই ভাল একটা চাকুরী নিয়ে পরে এসে তাদের দিল্লী নিয়ে যাবেন৷ তাতে ভুল হবার কথা নয়৷ বাকি মাবুদ ভরসা৷
এদিকে বায়েজিদের স্ত্রী আমিনার বুকফাটা আহাজারি বাবা জান্নাতবাসী হলেন কিছুদিন আগে৷ মাতো অনেকদিন আগেই দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে পরপারে চলে গেলেন৷ ৷ ভরসা ছিল একমাত্র স্বামী৷ সেও তাঁর শিশুপুত্র সাঈদকে রেখে দিল্লীর উদ্দেশ্যে চলে গেলেন৷ বাবা ধর্মান্তরিত হওয়ার অপরাধে তাদের মুখ দর্শন করে না আত্মীয় স্বজনেরা৷ সংসারে আপন বলতে তার আর কেউ নেই৷ আশ্রয়দাতা বাবা শাহানশাহ্ আদম কাশ্মীরী অতিশয় বৃদ্ধ৷
লেখক পরিচিতি ঃ জনাব নূরুল ইসলাম মাষ্টার একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক৷ তিনি অনেকদিন ধরেই লিখেন৷ তাঁর প্রিয় বিষয় ইতিহাস৷ তাছাড়া কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক এগুলোতেও চমত্কার হাত আছে৷ ইতিমধ্যেই তার বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে৷ পত্র পত্রিকাতেও লেখেন তিনি৷ তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে আকাশ, কমল কলি, টুকটাক, রূপসী ললনা, বঙ্গরত্ন শামসুল হক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য৷ এ সমস্ত গ্রস্থরাজি পাঠক সমাজে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে৷ তিনি অবসরজীবন লেখা লেখি করেই কাটান৷ তার লেখার মধ্যে মননশীলতার ছাপ আছে৷ এ লেখা গুলোতে তিনি বিভিন্ন রসের চমত্কার সমন্বয় বর্তমান পরিলক্ষিত হয়৷
নিজ ধর্মের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস থাকলেও তাতে গোড়ামি নেই৷ সুফি ও বাতিল মতবাদ তার কাছে প্রিয়৷ তিনি মনে করেন-
নানা বর্নের গাভী রে ভাই, একই বর্নের দুধ
সারা দুনিয়া ঘুইরা দেখলাম, একই মায়ের পুত৷
বা
সিন্ধু রূপ পুকুড় রে ভাই, ঘাটে ঘাটে বিচার
সব ঘাটেতে একই পানি নেইকো জাত বিচার৷
বা
ডালে ডালে ঘুরে বেড়াই ভাঙ্গল নারে ভুল
হাজার ডালে গাছের শোভা, রস টানে এক মূল৷
এলাকার শিক্ষা বিস্তারে তাঁর বিরাট অবদান আছে৷ ছিলিমপুর এম, এ, করিম উচ্চ বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য ও প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক, আটিয়া শাহানশাহী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, পাকুল্যা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উত্সাহ দাতা ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ছিলিমপুর বাজার হাফেজিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, সুবর্নতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের খন্ডকালীন অবৈতনিক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক৷ নিজ গ্রামে ফোরকানিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, ছিলিমপুর বাজার জামে মস্জিদকে টিনের ঘরের পরিবর্তে পাকা করণ ও এর সামনে পুকুর খনন তাঁর প্রত্যক্ষ মদদে প্রতিষ্ঠিত৷
তাঁর রচিত শামসুল হক বিস্মরনের অপর নাম, ছোটদের ভাসানী, ছোটদের বঙ্গবন্ধু, ছোটদের জিয়া প্রভৃতি শিঘ্রই প্রকাশিত হবে বলে পান্ডুলিপি তৈরি আছে৷